বাবার কাছে শুনেছি আমার ঠাকুরদাদার ঠাকুরদা নাকি সন্ন্যাসী হয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন, আর তিনি নাকি অনেকদিন হরিদ্বারে ছিলেন। হয়তাে এই সব খাতার মধ্যে তাঁর নাম, ঠিকানা আর হাতের লেখা পাওয়া যাবে । বনবিহারীবাবু বললেন, ‘পাণ্ডাটাল্ডার কোনও দরকার নেই। এতে সুবিধের চেয়ে উৎপাতটাই বেশি। চলুন, আমার জানা শীতল দাসের ধরমশালায় নিয়ে যাই আপনাদের। একসঙ্গে থাকা যাবে, খাওয়াও মন্দ না। একদিনের তাে মামলা । তারপর তাে মােটরে করে হৃষীকেশলছমনঝুলা।’
কুলির মাথায় জিনিস চাপিয়ে প্রায় রাতের মতাে অন্ধকারে আমরা পাঁচজন তিনটে টাঙ্গায় উঠে পড়লাম। —একটায় ফেলুদা আর আমি, একটায় বনবিহারীবাবু, আর একটায় বাবা আর শ্রীবাস্তব। | যেতে যেতে ফেলুদা বলল, ‘তীর্থস্থান মানেই নােংরা শহর। তবে একবার গঙ্গার ধারটায় গিয়ে বসতে পারলে দেখবি ভালই লাগবে।’
খট খট ঘড় ঘড় করতে করতে আমাদের টাঙ্গা অলিগলির মধ্যে দিয়ে চলেছে। দোকান-টোকান এখনও একটাও খােলেনি। রাস্তার দুপাশে লােক কম্বল মুড়ি দিয়ে খাটিয়ায় শুয়ে ঘুমােচ্ছে। কেরােসিনের বাতি দু–একটা টি টিম্ করে জ্বলছে এখানে সেখানে। কিছু বুড়াে লােক দেখলাম হাতে ঘটি নিয়ে রাস্তা হেঁটে চলেছে। ফেলুদা বলল ওরা গঙ্গাস্নান
ফেলুদা সমগ্র ১ম খণ্ড (পর্ব-৩০)
যাত্রী। সূর্য যখন উঠবে তখন কোমরজলে দাঁড়িয়ে সূর্যের দিকে চেয়ে স্তব করবে । বাকি শহর এখনও ঘুমন্ত বললেই চলে।
আমাদের সামনের গাড়িটায় বনবিহারীবাবু ছিলেন। একটা সাদা একতলা থামওয়ালা বাড়ির সামনে সেটা থামল । আমাদের আর বাবাদের গাড়িও তার পিছনে থামল। বুঝলাম এটাই শীতলদাসের ধর্মশালা । বাড়ির সামনের ফটকের ভিতর দেখতে পেলাম একটা বেশ বড় খােলা জায়গা, আর তার তিন পাশে বারান্দা আর ঘরের সারি ।
ধর্শিালার চাকর এসে মালগুলাে তুলে নিয়ে গেল । আমরা তার ফটকের পিছন গেট দিয়ে ঢুকছি, এমন সময় আরেকটা টাঙ্গা এসে ফটকের সামনে দাঁড়াল। তারপর দেখি, বেরিলি পর্যন্ত যে সন্ন্যাসী আমাদের সঙ্গে গিয়েছিলেন, তিনি সেই টাঙ্গা থেকে নামলেন। লােকটাকে দেখে আমি ফেলুদার কোটের আস্তিন ধরে একটা টান দিয়ে বললাম, এই সেই ট্রেনের সন্ন্যাসী, ফেলুদা !
ফেলুদা একবার আড় চোখে লােকটার দিকে দেখে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলল, এই বাবাজির মধ্যেও তুই রহস্যজনক কিছু পেলি নাকি ?
কিন্তু বার বার ‘চোপ! চ’ ভেতরে চ’!’
দুটো পাশাপাশি ঘরে আমাদের থাকার বন্দোবস্তু হল। একটাতে চারটে খাটিয়া পাতা রয়েছে, তার মধ্যে একটাতে একজন লােক ঘুমােচ্ছে, আর বাকি তিনটে আমি, বাবা আর ফেলুদার জন্য ঠিক হল। পাশের ঘরে শ্রীবাস্তব আর বনবিহারীবাবুর ব্যবস্থা হল। বনবিহারীবাবুর ঘরেই দেখলাম সেই বাবাজিও আশ্রয় নিলেন।
ফেলুদা সমগ্র ১ম খণ্ড (পর্ব-৩০)
মুখটুখ ধুয়ে চা বিস্কুট খেতে খেতে সূর্য উঠে গেল, আর ধর্মশালাতেও লােকজন উঠে গিয়ে বেশ একটা গােলমাল শুরু হয়ে গেল। এখন বুঝতে পারলাম কতরকম লোেক সেখানে এসে রয়েছে। ছেলে বুড়াে মেয়ে পুরুষ বাঙালি হিন্দুস্থানি মাড়ােয়াড়ি গুজরাটি মারাঠি মিলে হইচই হট্টগােল ব্যাপার!
বাবা বললেন, তােরা কি বেরােবি নাকি?’ ফেলুদা বলল, ‘সেরকম তাে ভাবছিলাম। একবার ঘাটের দিকটা ঘুরে এলে…’ ‘ত হলে সেই ফাঁকে আমি বনবিহারীবাবুর সঙ্গে গিয়ে কাল সকালের জন্য দুটো ট্যাক্সির ব্যবস্থা দেখি। আর একটা কাজ করাে তাে ফেলবাজারের দিকটা গিয়ে একবার দেখাে
তো যদি এভারােডি টর্চ পাওয়া যায়। এ তাে আর লখনৌ শহর না-ও জিনিস একটা হাতে রাখা ভাল।’
আমরা দুজনে বেরিয়ে পড়লাম। ফেলুদা বলল এত ছােট শহরে টাঙ্গা না নিয়ে হাঁটাই ভাল ।
হাঁটতে হাঁটতে বুঝলুম হরিদ্বার শহরে সত্যিই বেশ ঠাণ্ডা। আর গঙ্গার পাশে বলেই বােধহয় সমস্ত শহরটা একটা আবছা কুয়াশায় ঢেকে রয়েছে। ফেলুদাকে জিজ্ঞেস করতে ও বলল, “যত না কুয়াশা তার চেয়ে বেশি উনুনের ধোঁয়া ।
ধর্মশালার সামনের রাস্তা দিয়ে কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে একজন লােককে জিজ্ঞেস করতেই সে ঘাটের পথ দেখিয়ে দিয়ে বলল, “ইসে আধা মিল যনেসেই ঘাট মিল যায়গা।’ | ঘাটে পৌছনাের কিছু আগে থেকেই একটা গণ্ডগােল শুনতে পাচ্ছিলাম, শেষে বুঝতে পারলাম যে সেটা আসলে এত লােক একসঙ্গে স্নান করার গণ্ডগােল । তার উপর ঘাটের পথের দুদিকে ভিখিরি আর ফেরিওয়ালার সারি, তারাও কম চেঁচামেচি করছে না।
ফেলুদা সমগ্র ১ম খণ্ড (পর্ব-৩০)
আমরা ভিড় ঠেলে ঘাটের সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলাম। এরকম দৃশ্য আমি আর কখনও দেখিনি। জলের মধ্যে যেন একটা মেলা বসেছে। ঘাটের উপরেই একটা মন্দির, তার থেকে আরতির ঘণ্টার আওয়াজ আসছে। এক জায়গায় গলায় কণ্ঠী পরা, কপালে তিলক কাটা একজন বৈষ্ণব গান গাইছে। তাকে ঘিরে একদল বুড়ােবুড়ি বসে আছে। মানুষের আশেপাশে ছাগল কুকুর গােরুবাছুরও কিছু কম নেই।
ফেলুদা ঘাটের ধাপে একটা খালি জায়গা বেছে নিয়ে বসে পড়ে বলল, ‘প্রাচীন ভারতবর্ষ যদি দেখতে চাস তাে এই ঘাটের ধাপে কিছুক্ষণ বসে থাক। লখনৌ থেকে এই জায়গার ব্যাপারটা এত অন্যরকম যে, আমার মন থেকে আংটির ঘটনাটা প্রায় মুছেই যাচ্ছিল।
ফেলুদারও কি তাই-~~-না কি ও মনে মনে রহস্য সমাধানের কাজ চালিয়েই চলেছে ? ওকে সে কথাটা আর জিজ্ঞেস করতে সাহস হল না। ওর দিকে ফিরে দেখি, ও বেশ একটা খুশি খুশি ভাব নিয়ে পকেট থেকে দেশলাই আর সিগারেট বার করেছে। বাবাদের সামনে তাে খেতে পারে না, তাই এই সুযােগে খেয়ে নেবে।
সিগারেটটা মুখে পুরে দেশলাইয়ের বাক্সটা খুলতেই দেখলাম তার মধ্যে কী যেন একটা জিনিস ঝলমল করে উঠল।
আমি চমকে উঠে বললাম, ওটা কী, ফেলুদা ? ফেলুদা ততক্ষণে দেশলাই বার করে বাক্স বন্ধ করে দিয়েছে। সে অবাক হবার ভাব করে বলল, কোনটা ?
‘ওই যে চক্ চক করে উঠল—দেশলাইয়ের বাক্সে ?
ফেলুদা সমগ্র ১ম খণ্ড (পর্ব-৩০)
ফেলুদা কায়দা করে দুহাতের আড়ালে গঙ্গার হওয়ার মধ্যেও সিগারেটটা ধরিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বলল, দেশলাইতে ফসফরাস থাকে জানিস তাে ? সেইটেই রােদে চকচক করে উঠেছে আর কী।’
আমি আর কিছু জিজ্ঞেস করতে পারলাম না, কিন্তু দেশলাইয়ের উপর রােদ পড়ে এতটা ঝলমল করে উঠতে পারে, এ জিনিসটা আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।
হরি-কা-চরণ ঘাট থেকে গঙ্গার দৃশ্য দেখে, দক্ষেশ্বরের মন্দির দেখে বাজারের মনিহারি দোকান থেকে যখন আমরা তিন-সেলের একটা টর্চ কিনছি, তখন প্রায় সাড়ে দশটা বাজে। যতই ঘুরি না কেন, আর যা-ই দেখি না কেন, ফেলুদার দেশলাইয়ের বাক্সর মধ্যে ওই চক-চকানির কথাটা আমি কিছুতেই ভুলতে পারছিলাম না। বারবার খালি মনে হচ্ছিল যে ওটা আসলে ওই আওরঙ্গজেরে আংটির হিরের চকচিকানি। ফেলুদা যদি বলত ওটা একটা সিকি বা আধুলি–তা হলেও হয়তাে বিশ্বাস করতে পারতাম, কিন্তু ফসফরাসের ব্যাপারটা যে একেবারে গুল, সেটা আমার বুঝতে বাকি ছিল না।
Read More