উপক্রমণিকা (প্রথম পরিচ্ছেদ)
জাতি ও দেশবাচক বঙ্গনামের উৎপত্তি
বঙ্গ জাতি হইতে দেশবাচক বঙ্গ নামের উৎপত্তি। বঙ্গ জাতি তথা বঙ্গ শব্দের প্রাচীনতম উল্লেখ রহিয়াছে ঐতরেয় আরণ্যক সেখানে বলা হইয়াছে যে, তিনটি জাতি নষ্ট হইয়া গিয়াছিল, এবং এই তিন জাতি হইতেছে পক্ষী, অর্থাৎ পক্ষিসদৃশ যাযাবর (মতান্তরে পক্ষীর ন্যায় অব্যক্তভাষী, অথবা পক্ষীর “টোটেম” অর্থাৎ আদিপুরুষরূপে কল্পিত পক্ষিবিশেষের চিহ্নধারী)—বঙ্গ, বগধ এবং চেরপাদ।
প্রজা হ তিস্রঃ অত্যায়মীয়ুরিতি যা বৈ তা ইমাঃ প্রজা স্তিস্রঃ অত্যায়মায়ং স্তানীমানি বয়াংসি বঙ্গা বগধাশ্চেরপাদাঃ। ২-১-২-৫।
ক্রমশ পূর্ব্বদিকে হটিতে হটিতে এই যাযাবর বঙ্গ জাতি এখন যে স্থানকে পূর্ব্ববঙ্গ বলা হয় তথায় বাস করিতে থাকে, তাহা হইতেই পূর্ব্ববঙ্গের প্রাচীন নাম হয় বঙ্গ। বর্ত্তমান কালে এই নাম সমগ্র বাঙ্গালাদেশ বুঝাইতে প্রযুক্ত হয়, কিন্তু কিছুকাল পূর্ব্বেও শুধু পূর্ব্ববঙ্গ বুঝাইতেই বঙ্গ শব্দের চল ছিল। মেয়েলী ছড়ায় বলে—“তুমি যাও বঙ্গে কপাল যায় সঙ্গে।” ১৮৬০ সালের দিকে মধুসূদন লিখিয়াছিলেন—“অলীক কুনাট্যরঙ্গে মজে লোক রাঢ়ে বঙ্গে।”
রাঢ় ও সুহ্ম জাতির নাম হইতে পশ্চিমবঙ্গের নাম হয় রাঢ় ও সুহ্ম দেশ। রাঢ় ও সুহ্ম (প্রাকৃতে “সুব্ত”) দেশের সর্ব্বপ্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় জৈনদিগের আয়ারঙ্গ-সুত্ত বা আচারাঙ্গ-সূত্রে। ইহাতে এই দেশের শয়ন, আসন, ভোজন ও আচরণের নিন্দা করা হইয়াছে। ইহা হইতে আরও জানিতে পারি যে, জৈন শ্রমণদিগের প্রতি রাঢ়-সুহ্মের লোকেরা মোটেই প্রসন্ন ছিল না।
অহ দুচ্চর-লাঢং অচারী বজ্জভূমিং চ সুব্তভূমিং চ।
পন্তং সেজ্জং সেবিংসু আসণগাইং যেব পন্তাইং।।
লাঢেহিং তস্সুবসগ্গা বহবে—জাণবয়া লূসিংসু।
অহ লুক্খদেহিএ ভত্তে কুক্কুরা তত্থু হিংসিংসু নিবইংসু।।
অল্পে জণে নিবারেই লূসণএ সুণএ ডসমাণে।
ছচ্ছুক কারেন্তি আহন্তুং সমণং কুক্কুরা ডসন্তু ত্তি।।
এলিক্খএ জণে ভুজ্জো রহবে বজ্জভূমিং ফরুসাসী।
লটিঠং গহায় নালীয়ং সমণা তত্থ এব বিহরিংসু।।
এবং প তত্থ বিহরন্তা পুট্ঠ-পুব্বা অহেসি সুণএহিং।
সংলুঞ্চমাণা সুণএহিং—দুচ্চরগাণি তত্থ লাঢেহিং।। ৯-৩-২—৬।।
বঙ্গ, রাঢ় ও সুহ্ম জাতি আর্য্যেতর ছিল বলিয়াই মনে হয়; অন্ততপক্ষে ইহারা যে আর্য্য ছিল, এমন কোন প্রমাণ নাই।
বাঙ্গালাদেশে আর্য্যদিগের উপনিবেশ প্রথম স্থাপিত হয় বরেন্দ্র ভূমিতে এবং রাঢ়ের কোন কোন অঞ্চলে, বিশেষ করিয়া ভাগীরথী ও দামোদরের তীরভূমিতে। বরেন্দ্রী বা বরেন্দ্র ভূমির প্রাচীন নাম পুণ্ড্র বা পুণ্ড্রবর্দ্ধন। এই স্থানের অধিবাসী (?) পুণ্ড্রদিগের উল্লেখ ঐতরেয় ব্রাহ্মণে (৭-১৮) পাওয়া যাইতেছে। এখানে অন্ধ্র, পুলিন্দ, শবর প্রভৃতি ব্রাত্য বা অন্ত্যজ দস্যুভূমিষ্ঠ জাতিদিগের মধ্যে পুণ্ড্রগণের নাম করা হইয়াছে।
এখনও পুঁড় বা পুঁড়ো নামে জাতি এই ব্রাত্য পুণ্ড্রদিগের স্মৃতি জাগাইয়া রাখিয়াছে। বোধ হয় এই পুণ্ড্রজাতি আখের চাষে বিশেষ দক্ষ ছিল, এবং ইহাদের নাম হইতেই আখের নাম হইয়াছে পুঁড় এবং এক জাতীয় দেশী আখের নাম পুড়ী। অথবা এমনও হইতে পারে যে “পুণ্ড্র” ইক্ষুর প্রতিশব্দ ছিল, পরে যাহারা আখের চাষ করিত তাহারা পুণ্ড্র নামে পরিচিত হয়। বরেন্দ্র ভূমির নামান্তর গৌড়। ইহা যদি গুড় শব্দজাত হয় তাহা হইলে এখানেও আখ-চাষের ইঙ্গিত পাওয়া যাইতেছে; কিন্তু শব্দটি বোধ হয় গোণ্ড-জাতির নামের প্রাচীন রূপ হইতে আসিয়াছে। পাণিনি তাঁহার ব্যাকরণের একটু সূত্রে এই গৌড় দেশস্থিত গৌড়পুরের উল্লেখ করিয়াছেন বলিয়া অনেকে অনুমান করেন—“অরিষ্টগৌড়পূর্ব্বে চ” (৬-২০-১০০)—অর্থাৎ অরিষ্ট ও গৌড় শব্দকে পূর্ব্বপদ করিয়া পুব শব্দের সমাস হইলে পূর্ব্বপদ অন্ত্যোদাত্ত হইবে। কিন্তু এই গৌড়পুর যে পূর্ব্বভারতে অবস্থিত ছিল না, তাহা ইহার অব্যবহিত পূর্ব্ববর্ত্তী সূত্র হইতে যানা যাইতেছে—“পুরে প্রাচাম্”, অর্থাৎ প্রাচ্যদেশে (অথবা, প্রাচ্যদেশীয় বৈয়াকরণদিগের মতে) পুর শব্দ পরে রাখিয়া সমাস করিলে পূর্ব্বপদ অন্ত্যোদাত্ত হইবে। “অরিষ্টগৌড়পূর্ব্বে চ” সূত্রটি “পুরে প্রাচাম” সূত্রের অপবাদ। সুতরাং এই গৌড়পুর পূর্ব্বদেশে অবস্থিত ছিল না নিশ্চয়ই। আরও একটি কথা, যখন স্বরের ব্যবস্থা রহিয়াছে তখন গৌড়পুর বৈদিক যুগের নগর ধরিতে হইবে, এবং এই স্থানের সহিত উত্তরপশ্চিমাঞ্চলের আয্যেরা বিশেষ পরিচিত ছিলেন তাহাও স্বীকার করিতে হইবে। তাহা হইলে স্থানকে পূর্ব্বভারতে টানিয়া আনা সঙ্গত হয় না।
গৌড় শব্দ সাধারণতঃ বরেন্দ্রভূমিকে বুঝাইলেও অনেক সময় রাঢ় ও সুহ্ম ভূমির সহিত বরেন্দ্রভূমিকে অর্থাৎ পূর্ব্ববঙ্গ বাদ দিয়া সমগ্র বাঙ্গালাদেশকে বুঝাইত।
বাঙ্গালায় আর্য্য উপনিবেশ
বাঙ্গালা দেশ আর্য্যেতর জাতির দ্বারা অধ্যুষিত ছিল বলিয়া এদেশে আগমন ও বসতি করা উত্তর-ভারতের আর্য্যদিগের পক্ষে বহুদিন অবধি নিষিদ্ধ ছিল। এদেশে আসিলে প্রায়শ্চিত্ত না করিয়া কেহ স্বসমাজে গৃহীত হইত না। যাহারা এদেশে রহিয়া যাইত তাহারা ব্রাত্য, নষ্ট বা পতিত বলিয়া গণ্য হইত। বৈদিক যুগে বাঙ্গালা দেশে উপনিবিষ্ট আর্য্যের অস্তিত্ব থাকিলে তাহাদের সংখ্যা নিশ্চয়ই নিতান্ত অল্প ছিল। এদেশে ব্যাপকভাবে উপনিবেশ স্থাপন মৌর্য্যযুগেই আরম্ভ হয়। প্রথমে বরেন্দ্রভূমিতে এবং রাঢ়ের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাহারা উপনিবিষ্ট হয়, তাহাদের বেশী ভাগ ছিল জৈনমতাবলম্বী। জৈনধর্ম্মের মূল কেন্দ্র মগধ বরেন্দ্রভূমি হইতে সুদূর নেহ, সেইজন্য জৈনধর্ম্ম এই অঞ্চলে সর্ব্বপ্রথম প্রসার লাভ করে। দিব্যাবদানে(১) আছে যে, অশোকের সময়ে পুণ্ড্রবর্দ্ধন জৈনধর্ম্মের একটি বিশিষ্ট কেন্দ্র ছিল।
রাঢ়-সুহ্মে অসভ্যজাতির প্রাচুর্য্য থাকায় এবং দেশ দুর্গম হওয়ায় এই অঞ্চলে জৈনধর্ম্ম তত বেশী প্রসার লাভ করিতে পারে নাই। জৈনমতের পর বৌদ্ধমত এবং সর্ব্বদেশে ব্রাহ্মণ্যমত বাঙ্গালাদেশে প্রাধান্য লাভ করে। রাঢ় ও বরেন্দ্র ভূমিতে আর্য্য সংস্কৃতি আসিবার অনেক কাল পরে, সম্ভবত এই দুই স্থান হইতে, বঙ্গে অর্থাৎ পূর্ব্ববঙ্গে ইহা বিস্তার লাভ করে। এই কারণে সংস্কৃতি ও সভ্যতায় পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় যথেষ্ট পশ্চাৎপদ থাকায় পূর্ব্ববঙ্গের অধিবাসী, ‘বঙ্গাল’ বা ‘বাঙ্গাল’, আবহমানকাল সাহিত্যে ও লোকব্যবহারে উপহাসের পাত্র বলিয়া পরিগণিত হইয়া আসিয়াছে।
—————–
১. Cowell ও Neil সম্পাদিত, পৃ. ৪২৭।
১৫৯ গুপ্তাব্দে অর্থাৎ ৪৭৮-৭৯ খ্রীষ্টাব্দে উৎকীর্ণ ও পাহাড়পুরের স্তূপমধ্য হইতে প্রাপ্ত অনুশাসনখানি(২) হইতে জানা যায় যে, খ্রীষ্টীয় পঞ্চম শতকেও বরেন্দ্রভূমিতে জৈনমতাবলম্বী শ্রমণ-শ্রাবকের অসদ্ভাব ছিল না। ব্রাহ্মণ নাথশর্ম্মা ও তাঁহার ভার্য্যা রামী স্বগ্রাম বটগোহালী-স্থিত “কাশিক-পঞ্চ-স্তূপনিকায়িক-নির্গ্রন্থ-শ্রমণাচার্য্য-গুহনন্দি-শিষ্যপ্রশিষ্যাধিষ্ঠিতবিহারে” ভগবান অর্হৎদিগের উদ্দেশে গন্ধ, ধূপ, পুষ্প, দীপ প্রভৃতি পূজোপচার ও তলবাট (অর্থাৎ তৈলবট বা দক্ষিণা) রূপে দান করিবার উদ্দেশ্যে রাজকর্ম্মচারিগণের অনুজ্ঞা প্রার্থনা করায় পুণ্ডবর্দ্ধনস্থিত উচ্চরাজকর্ম্মচারিগণ ও স্থানীয় শাসনপরিষৎ যে অনুজ্ঞা প্রদান করিয়াছিলেন তাহাই এই অনুশাসনটিতে লিপিবদ্ধ হইয়াছে। এই অনুশাসনখানিতে আমরা বাঙ্গালী ভদ্রলোকের নামের প্রাচীনতম উল্লেখ পাইতেছি। ব্রাহ্মণ নাথশর্ম্মা ও তাঁহার রামীর নাম পূর্ব্বে করিয়াছি। তাহা ছাড়া কয়েকজন ‘পুস্তপাল’ অর্থাৎ record-keeper বা নথীপত্র-রক্ষকের নাম পাওয়া যাইতেছে—দিবাকর-নন্দী (‘প্রথম পুস্তপাল’), ধৃতি-বিষ্ণু, বিরোচন, রাম-দাস, হরি-দাস, শশি-নন্দী। এই নামগুলি হইতে অনুমান হয় যে, ইঁহারা কায়স্থ ছিলেন। এই জাতীয় নাম ও পদবী (রামদাস ও হরিদাস ছাড়া) এখনও বাঙ্গালী-সমাজ ভিন্ন অন্যত্র প্রচলিত নাই।
দ্বাদশ শতকেও এই স্থানে একটি বৌদ্ধবিহার অবস্থিত ছিল। তখন ইহা সোমপুর বিহার নামে পরিচিত ছিল। আনুমানিক খ্রীষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর প্রথমার্দ্ধে রচিত নালন্দায় প্রাপ্ত বিপুলশ্রী-মিত্রের অনুশাসনে বাঙ্গাল সৈন্য কর্ত্তৃক এই বিহারের ধ্বংস এবং পরে বিপুলশ্রী-মিত্র কর্ত্তৃক সংস্কারের উল্লেখ আছে। বাঙ্গাল সেনা বিহারে অগ্নি প্রদান করে, তাহাতে গৃহাদির সহিত শ্রবণ করুণাশ্রী-মিত্রও বিনষ্ট হন। করুণাশ্রী-মিত্রের শিষ্য মৈত্রশ্রী-মিত্র, তৎশিষ্য অশোকশ্রী-মিত্র এবং তাহার শিষ্য বিপুলশ্রী-মিত্র।
অনুশাসনটির প্রথম দুই শ্লোক এই—
অস্তু স্বস্ত্যয়নায় বঃ স ভগবান্ শ্রীধর্ম্মচক্রঃ কিয়দ্
যন্নাম শ্রুতবান্ ভবোহস্থিরবপুর্নিব্যাজমুত্তাম্যতি।
তত্র শ্রীঘনশাসনামৃতরসৈঃ সংসিচ্য বৌদ্ধে পদে
তদ্ ধেয়াদপুনর্ভবং ভগবতী তারা জগত্তারিণী।।
শ্রীমৎসোমপুরে বভূব করুণাশ্রীমিত্রনামা যতিঃ
কারুণ্যাদ্গুণসম্পদো হিতসুখাধানাদপি প্রাণিনাম্।
যো বঙ্গাল্বলৈরুপেত্য দহনক্ষেপাজ্জ্বলত্যালয়ে
সংলগ্নশ্চরণারবিন্দযুগলে বুদ্ধস্য যাতো দিবম্।।(৩)
অনুমান হয়, করুণাশ্রী-মিত্র একাদশ শতাব্দীর শেষার্দ্ধে জীবিত ছিলেন। এই “বঙ্গালবল” তাহা হইলে কি হরিবর্ম্মদেবের অথবা ভোজবর্ম্মদেবের?
গুপ্ত সম্রাটদিগের সময় হইতেই ব্রাহ্মণ্যমত এদেশে প্রসার লাভ করিতে থাকে। এবং হয়ত এই সময়ের কিছু পূর্ব্ব হইতে বৌদ্ধ মহাযানমতেরও প্রাদুর্ভাব হয়। জৈন, বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য এই তিন মত সমকালে প্রচলিত থাকিলেও বাঙ্গালা দেশে কখনও ধর্ম্মবিরোধ উপস্থিত হইয়াছিল এমন প্রমাণ পাওয়া যায় নাই। পাহাড়পুর অনুশাসনে দেখিতেছি যে, ব্রাহ্মণ নাথশর্ম্মা জৈনবিহারে অর্হৎদিগের পূজা চিরস্থায়ী করিবার জন্য ভূমিদান করিতেছেন। গুপ্তসম্রাটদিগের রাজত্বকালেও শাসনকর্ত্তৃপক্ষ জৈন ও বৌদ্ধ মঠে ভূমি ও ধন দান করিতেন। পালরাজগণ বৌদ্ধমতাবলম্বী হইলেও ব্রাহ্মণ্যমতের পোষকতা করিতে পরাঙ্মুখ ছিলেন না। বৌদ্ধমতাবলম্বী পালবংশের শেষ সম্রাট মদনপালদেবের মহিষী চিত্রমতিকা মহাভারত-শ্রবণের দক্ষিণাস্বরূপ পাঠক ব্রাহ্মণ বটেশ্বর-স্বামীকে ভূমিদান করিয়াছিলেন।
প্রথম বাঙ্গালী স্বাধীন রাজা হইয়াছিলেন শশাঙ্ক নরেন্দ্রগুপ্ত। ইনি গুপ্তবংশীয় ছিলেন বলিয়া অনেকে মনে করেন। ইঁহার রাজত্ব স্বল্পকালস্থায়ী হইয়াছিল। প্রকৃতপক্ষে বাঙ্গালায় পালরাজারাই প্রথম স্বাধীন রাজবংশ স্থাপিত করেন। ইঁহাদের আমলে বাঙ্গালী নৃপতি সর্ব্বাপেক্ষা বৃহৎ ভূখণ্ডের উপর আধিপত্য করিয়া গিয়াছেন, এবং ইঁহাদের রাজ্যকালে বাঙ্গালা দেশ আর্য্যাবর্ত্তের মধ্যে বিশিষ্ট দেশ হিসাবে প্রথম পরিগণিত হইয়াছিল। পাল নৃপতিরা বৌদ্ধমতাবলম্বী ছিলেন, পরে ব্রাহ্মণ্যমতের পক্ষপাতী হন। পালবংশের পরবর্ত্তী রাজাদিগের মধ্যে শুধু বিক্রমপুরের চন্দ্রবংশীয় রাজারা বৌদ্ধ ছিলেন, কিন্তু এইস্থানে ইঁহাদের অব্যবহিত পরেই যে বর্ম্মরাজারা আসেন তাঁহারা সম্পূর্ণভাবে ব্রাহ্মণ্যমতাবলম্বী ছিলেন।
ব্রাহ্মণ্যমতাশ্রিতেরা পঞ্চোপাসক ছিলেন, ইঁহাদের ইষ্ট দেবতা বিষ্ণু, শিব, চণ্ডী। সেনরাজাদিগের কৌলিক ইষ্টদেবতা ছিলেন শিব। কিন্তু লক্ষ্মণসেনের সকল অনুশাসনই “ওঁ নমো নারায়ণায়” বলিয়া আরম্ভ করা হইয়াছে; তাহার পর অবশ্য শিবের বন্দনা-শ্লোক আছে। লক্ষ্মণসেন-দেবের তৃতীয় রাজ্যাঙ্কে খোদিত একটি চণ্ডীমূর্ত্তি ঢাকায় পাওয়া গিয়াছে।(৪) দেবী চতুর্ভুজা, সিংহোপরি আসীনা। দুই পাশে দুই সখী, সম্মুখে উপবিষ্ট তিন ভক্ত বা অনুচর। দক্ষিণ হস্তদ্বয়ে যথাক্রমে পদ্ম ও জলপাত্র (কমণ্ডলু?) এবং বাম ঊর্দ্ধহস্তে কুঠার এবং নিম্নহস্তে বরাভয়মুদ্রা; দুই হস্তী শুণ্ডে কলস লইয়া দেবীকে অভিশেষ করিতেছে। পাদপীঠে এই লিপি আছে—
শ্রীমল্লক্ষ্মণ । সেন দেবস্য সংত । মালদেইসুত অধিকৃত শ্রীদামোদ্র- । ণ শ্রীচণ্ডীদেবী সমারব্ধা তভ্রাদকণা । শ্রীনারায়ণেন । প্রতিষ্ঠিতেতি ।।
লক্ষ্মণসেন, কেশবসেন ইত্যাদি সেনবংশীয় রাজা ও রাজপুত্রেরা শ্রীকৃষ্ণের বন্দনা ও রাধাকৃষ্ণলীলা বিষয়ক বহু কবিতা রচনা করিয়া গিয়াছেন।(৫)
মল্লিকার্জ্জুন-সূরী নামক একজন জ্যোতির্ব্বিদ ও গণিতজ্ঞ ১১০০ শকাব্দে অর্থাৎ ১১৭৮ খ্রীষ্টাব্দে লল্লাচার্য্য প্রণীত শিষ্যধীমহাতন্ত্রের একটি টীকা রচনা করেন।(৬) টীকার মঙ্গলাচরণে ইনি চণ্ডিকার বন্দনা করিয়াছেন—
শ্রীমৎসুরাসুরাধ্যচরণাম্বুরুহদ্বয়াম্।
চরাচরজগদ্ধাত্রীং চণ্ডিকাং প্রণমাম্যহম্।।
দ্বাদশ শতাব্দীতে দেখি, বাঙ্গালা দেশে বুদ্ধও বিষ্ণুর অবতারপদবীতে উন্নীত হইয়াছেন, জয়দেব দশাবতারবন্দনার মধ্যে বুদ্ধের উল্লেখ করিয়াছেন। কিন্তু ইহা সত্ত্বেও প্রাচীনকালে বাঙ্গালায় বৌদ্ধসমাজ আচারব্যবহারে ব্রাহ্মণ্যসমাজ হইতে অনেকটা স্বতন্ত্র ছিল। এ বিষয়ে পরে আলোচনা করা যাইতেছে।
———————–
২. Epigraphia Indica, XX, no. 5; ব-সা-প-প ৩৯ পৃ. ১৩৯-১৫২।
৩. Epigraphia Indica, XXI, পৃ. ৯৭-১০১।
৪. Inscriptions of Bengal, N. G. Majumdar, পৃঃ ১১৬-১৭।
৫. পালরাজাদিগের সময়ে খোদিত বিস্তর উৎকৃষ্ট বাসুদেব মূর্ত্তি পাওয়া গিয়াছে। পাহাড়পুরে এবং অন্যান্য শ্রীকৃষ্ণলীলাঘটিত প্রস্তরচিত্রাবলী পাওয়া গিয়াছে। নারায়ণপালদেবের মন্ত্রী গুরব ভট্ট গরুড় স্তম্ভ স্থাপন করিয়াছিলেন।
৬. ব-সা-প-প ৪০, পৃ ৮৩-৯৪।
বিদ্যাচর্চ্চা
আর্য্যাবর্ত্তের ধারার অনুসরণে বাঙ্গালা দেশে বিদ্যা ও জ্ঞান চর্চ্চা যথেষ্টই হইত । অনুশাসনগুলি হইতে জানা যায় যে, গুপ্ত, পাল, এবং সেন ও অন্যান্য নৃপতিরা মধ্যদেশবিনির্গত বহু বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণকে ভূমিদান করিয়া বাঙ্গালা দেশে, রাঢে ও গৌড়ে বাস করাইয়াছিলেন। এই বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণেরা এদেশে আসিয়াও কিছুকাল যাবৎ বেদচর্চা ভুলেন নাই। তবে বাঙ্গালা দেশ মধ্যদেশ হইতে সুদূর বলিয়া বেদচর্চ্চা এখানে পরিপুষ্টি লাভ করে নাই। বরং চর্চ্চার অভাবে বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণের সংখ্যা দিন দিন কমিয়া আসিতেছিল।
ব্যাকরণশাস্ত্রের চর্চ্চাতে সেকালের বাঙ্গালী মনীষীরা যথেষ্ট কৃতিত্ব দেখাইয়াছিলেন। উদাহরণ হিসাবে পুরুষোত্তম-দেবের ভাষাবৃত্তি, জিনেদ্রবুদ্ধির ন্যাস ইত্যাদির উল্লেখ করা যাইতে পারে। অভিধান অথবা অভিধানের টিকা রচনায়ও বাঙ্গালীর কৃতিত্ব সামান্য নহে। এ বিষয়ে বন্দ্যঘটীয় সর্ব্বানন্দের নাম সমধিক উল্লেখযোগ্য। সর্ব্বানন্দের বিরচিত অমরকোষের টীকাসর্ব্বস্ব নামক টীকায় প্রায় তিন শতাধিক সংস্কৃত শব্দের বাঙ্গালা প্রতিশব্দ দেওয়া আছে। বাঙ্গালা ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন হিসাবে এই শব্দগুলি যথেষ্ট মূল্যবান।
বৌদ্ধ মহাযান এবং তান্ত্রিক মতের আলোচনা ত হইতই, তাহা ছাড়া সাধারণ অর্থাৎ ব্রাহ্মণ্যমতের দর্শনাদির আলোচনাতেও যে সেযুগের বাঙ্গালী দার্শনিক পণ্ডিতেরা বিশেষ কৃতিত্ব প্রদর্শন করিয়াছিলেন, তাহার প্রমাণ আছে। ভূরিশ্রেষ্টি (বর্ত্তমানে হওয়া জেলায় ভুরশুট) গ্রামনিবাসী পণ্ডিত ভট্ট শ্রীধর ৯১৩ শকাব্দে অর্থাৎ ৯৯১-৯২ খ্রীষ্টাব্দে ন্যায়কন্দলী নামে বৈশেষিক দর্শনের প্রশস্তপাদ-ভাষ্যের একটি অসাধারণ মূল্যবান টীকা রচনা করেন। ইনি স্বীয় পৃষ্ঠপোষক দক্ষিণরাঢ়ের অধিপতি “গুণরত্নাভরণ কায়স্থকুলতিকল” পাণ্ডুদাসের উল্লেখ করিয়া গিয়াছেন। এই পাণ্ডুদাসই বিখ্যাত পাণ্ডুভূমি বিহার প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন।
ন্যায়কন্দলীতে শ্রীধর নিজেই এই পরিচয় দিয়াছেন—
আসীদ্দক্ষিণরাঢ়ায়াং দ্বিজানাং ভূরিকর্ম্মণাম্।
ভূরিসৃষ্টিরিতি গ্রামো ভূরিশ্রেষ্টিজনাশ্রয়ঃ।।
অম্ভোরাশেরিবৈতস্মাদ্ বভূব ক্ষিতিচন্দ্রমাঃ।
জগদানন্দনাদ্ বন্দ্যো বৃহস্পতিরিব দ্বিজঃ।।
তস্মাদ্ বিশুদ্ধগুণরত্নমহাসমুদ্রো বিদ্যালতাসমবলম্বনভূরুহোহভূৎ।
স্বচ্ছেশয়ো বিবিধকীর্ত্তিনদীপ্রবাহপ্রস্পন্দনোত্তমবলো বলদেবনামা।।
তস্যাভূদ্ ভূরিযশসো বিশুদ্ধকুলসম্ভবা।
অব্বোকেত্যচ্চিতগুণা গুণিনো গৃহমেধিনী।।
সচ্ছায়ঃ স্থূলফলদো বহুশাখো দ্বিজাশ্রয়ঃ।
তাভ্যাং শ্রীধর ইত্যুচ্চৈরর্থিকল্পদ্রুমোহভবৎ।।
অসৌ বিদ্যাবিদগ্ধানামসূত শ্রবণোচিতাম্।
যট্পদার্থহিতামেতাং রুচিরাং ন্যাকন্দলীম্।।
ইহা হইতে যানা যায় যে, শ্রীধরের পিতা ছিলেন বলদেব, মাতা অব্বোকী (পাঠান্তরে অচ্ছোকা), এবং শ্রীধর ছিলেন কুলপতিসদৃশ আচার্য্য।