মাতাল হাওয়া শেষ – পর্ব হুমায়ূন আহমেদ

মাতাল হাওয়া

আমি এবং আনিস সাবেত মহসিন হলের ছাদে পা ঝুলিয়ে বসে আছি। ছাদে রেলিং নেই। দমকা বাতাস দিলে নিচে পড়ে যাব। এই নিয়ে আমাদের তেমন মাথাব্যথা আছে বলে মনে হচ্ছে না। নিজেদের খুব এলোমেলো লাগছে। এলোমেলো যে লাগছে তার প্রমাণ আমাদের কথাবার্তা। কথাবার্তার নমুনা

আনিস : হুমায়ুন, লাফ দিতে পারবে?

আমি : পারব।

আনিস : তুমি পারবে না, আমি পারব।

আমি : লাফ দিয়ে দেখান যে আপনি পারবেন।

আনিস : দু’জন একসঙ্গে লাফ দিলে কেমন হয়?

আমি : ভালো হয়।

আনিস : তোমাকে লাফ দিতে হবে না। তুমি ওয়ান টু থ্রি বলো।

আনিস সাবেত উঠে দাঁড়ালেন। তাকে দাঁড়াতে দেখেও আমার কোনো ভাবান্তর হলো না। আমি ওয়ান টু থ্রি না বলা পর্যন্ত তিনি লাফ দেবেন না, এটা নিশ্চিত। তিনি আবার বসলেন। আমি বললাম, চলুন ঘরে যাই। আনিস সাবেত বললেন, তুমি যাও। আমি সারা রাত ছাদে বসে থাকব।

আমি নিজের ঘরে চলে এলাম। আনিস ভাই ছাদে বসে রইলেন।আনিস সাবেত ছিলেন অত্যন্ত রাজনীতি সচেতন মানুষ। মিটিং মিছিল কোনো কিছুই বাদ নেই। লন্ডনপ্রবাসী পশ্চিম পাকিস্তানের ছাত্রনেতা তারিক আলি যখন ঢাকায় আসেন, তখন আনিস সাবেত ফুলের মালা নিয়ে এয়ারপোর্টে যান তাকে অভ্যর্থনা জানাতে।

রাজনীতির মাতাল হাওয়া দেখে আনিস সাবেত ভেঙে পড়েছিলেন। কোনো কিছুই তখন কাজ করছে না।গোলটেবিল বৈঠকের ফলাফল শূন্য।সম্মিলিত বিরোধী দলের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করেছে আওয়ামী লীগ। কী কারণ তা স্পষ্ট না।ছাত্র সংগঠনগুলির ভেতর নানা ঝামেলা, অবিশ্বাস, নেতৃত্বের লড়াই।

মাওলানা ভাসানী হঠাৎ লাহোরে যাবার জন্যে বিমানে উঠলেন। কেন এই সময় তাঁর লাহোর যাত্রা কেউ জানে না। তিনি বললেন, পশ্চিম পাকিস্তান সফরে যাচ্ছেন।শোনা যাচ্ছে শিগগিরই আরেক যুদ্ধ হবে ভারতের বিরুদ্ধে। ভারত শায়েস্তা হলেই পূর্বপাকিস্তান ঠান্ডা হবে। এবার যুদ্ধ করতে সমস্যা নেই। পাকিস্তানের বন্ধুরাষ্ট্র মহান চীন। পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের প্রকাশ্য এবং গোপন দু’ধরনের সামরিক চুক্তি নাকি আছে। এই আঁতাতের প্রধান কারিগর নাকি মাওলানা ভাসানী।

দেশ চরম অনিশ্চয়তায়। অনিশ্চয়তার ছাপ ভয়ঙ্করভাবে পড়েছে আনিস সাবেতের ওপর। তার কাজকর্ম অপ্রকৃতস্থ মানুষের মতো।রাত তিনটার দিকে আমি আবার ছাদে গেলাম। আনিস সাবেত বললেন, অদ্ভুত কাণ্ড। আমি জেগে থেকেই একটা স্বপ্ন দেখে ফেলেছি।আমি বললাম, কী স্বপ্ন দেখেছেন?

পাশে এসে বসো। বলব। স্বপ্ন বলা শেষ করে হয় আমি ছাদ থেকে লাফ দেব নয়তো তোমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলব।আনিস ভাই, ঘরে চলুন। আপনাকে চা বানিয়ে খাওয়াব। হিটারের তার কেটে গেছে, আপনাকে শুধু তার ঠিক করে দিতে হবে।আনিস ভাই চিন্তিত গলায় বললেন, হিটারের তার কেটে গেছে আমাকে বলবে না? আশ্চর্য! তিনি উঠে দাঁড়ালেন। ব্যস্ত ভঙ্গিতে হাঁটা ধরলেন। যেন হিটারের তার কেটে যাওয়া ভয়ঙ্কর কোনো ঘটনা। এখনই ঠিক করতে হবে।

তার ঠিক হলো। আমরা চা খেলাম। আনিস ভাই তার স্বপ্ন বললেন। তিনি স্বপ্নে দেখেছেন, পূর্বপাকিস্তান স্বাধীন হয়েছে। সবাই মহাসুখে আছে। শুধু তিনি নেই।তাঁর স্বপ্ন সত্যি হয়েছে। সবাই মহাসুখে না থাকলেও দেশ স্বাধীন হয়েছে।স্বাধীন দেশে বাস করার আনন্দ আনিস ভাই পাননি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই তিনি Ph.D করার জন্যে কানাডা গিয়েছিলেন। সেখানেই ক্যান্সারে মারা যান।

থাক এই প্রসঙ্গ। নাদিয়ার অদ্ভুত চিঠির কথাটা বলি। রেজিষ্ট্রি করা একটা চিঠি নাদিয়ার কাছ থেকে পেয়েছি। চিঠি না বলে সংবাদ বলা উচিত। সংবাদের শিরোনাম—

বিবাহ বিলাস

ফেব্রুয়ারি মাসের পঁচিশ তারিখ আমার বিয়ে।

পাত্র : হাসান রাজা চৌধুরী।

পাত্রের রূপ বিচার : কন্দর্প কান্তি (কন্দর্প কান্তির মানে জানো? না জানলে ডিকশনারি দেখো।) পাত্রের গুণ বিচার ; একটি খুন করেছেন। একটি যখন করেছেন, আরও করার সম্ভাবনা আছে।পাত্রের অর্থ বিচার : তার বিষয়আশয় কুবেরের মতো। (কুবের কে জানো না? অর্থের দেবতা।)

পাত্ৰ-বিষয়ে ঠাট্টা করছি না। যা লিখেছি সবই সত্যি। জেনেশুনে এমন কাজ কেন করছি জানো? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্যে করছি তিনি জেনেশুনে বিষ পান করতে বলেছেন। তার মতো মহাপুরুষের কথা অগ্রাহ্য করি কীভাবে? যাই হোক, তুমি বিয়েতে আসবে। সব বন্ধুবান্ধব নিয়ে আসবে। আমাদের অতিবাড়ির পুরোটা তোমার এবং তোমার বন্ধুদের জন্যে ছেড়ে দেব।

বজরা নিয়ে তোমরা ব্রহ্মপুত্রে নৌবিহার করবে। পাখি শিকার করতে চাইলে তোমাদের নিয়ে যাব ভাটিপাড়ায় আমার শ্বশুরবাড়িতে। ওই বাড়িটার নাম—কইতরবাড়ি। কইতর কী জানো তো? কইতর হচ্ছে কবুতর।রাগ করো না, তোমাকে একটা কথা বলি। তুমি হাত দেখতে জানো না। আমার প্রসঙ্গে যা যা বলেছ তার কোনোটাই সত্য হয়নি।

কাজেই হাত দেখা হাত দেখা খেলা আর খেলবে না। এখন থেকে মন দেখা খেলা খেলবে। মনে করো কেউ তোমাকে বলল, আপনি হাত দেখতে পারেন? তুমি বলবে, হাত দেখতে পারি না তবে মন দেখতে পারি।ভালো কথা, আমি দাদিজান হাজেরা বিবিকে নিয়ে ৭৮ পৃষ্ঠা লিখেছি। দাদি অতি নোংরা যেসব কথা বলেন তাও লিখেছি। পড়ে দেখতে চাও? না, পড়তে দেব না। নোংরা

অংশগুলি না থাকলে পড়তে দিতাম।

ইতি

নাদিয়া, দিয়া, তোজল্লী।

হঠাৎ করে কুয়াশা পড়েছে। এমন কুয়াশা যে এক হাত দূরের মানুষ দেখা যায় না। নাদিয়া কুয়াশা গায়ে মাখার জন্যে দোতলা থেকে নামল। কুয়াশা হচ্ছে মেঘের এক রূপ। কুয়াশা গায়ে মাখা এবং মেঘ গায়ে মাখা একইরকম।

সিঁড়ির গোড়ায় প্রণব দাঁড়িয়ে ছিলেন। নাদিয়াকে দেখে বললেন, একজন দ্রলোক তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।নাদিয়া বলল, কে? তাকে অতিথঘরে বসিয়েছি। নিজে গিয়ে দেখো কে? পরিচিত কেউ? প্রণব হাসতে হাসতে বললেন, পরিচিত কেউ না। আমরা তাকে চিনি না।হাসান রাজা চৌধুরী?

হুঁ।আশ্চর্য! কুয়াশার অতিথি! হাসান রাজা নাদিয়াকে ঘরে ঢুকতে দেখে উঠে দাঁড়াল। নাদিয়া বলল, কেমন আছেন? ভালো আছি। আপনার জন্যে একটা টেলিস্কোপ এনেছি। তারা দেখতে পারবেন।ও আচ্ছা।হাসান কাঠের বাক্স এগিয়ে দিল। নাদিয়া টেলিস্কোপ বের করেছে। আগ্রহ নিয়ে দেখছে। নাদিয়া বলল, এমন দিনে টেলিস্কোপ এনেছেন যে আকাশ থাকবে কুয়াশায় ঢাকা।কুয়াশা কেটে যাবে।

কীভাবে জানেন কুয়াশা কেটে যাবে? ঘন কুয়াশা বেশিক্ষণ থাকে না। হালকা বাতাসেই সরে যায়। পাতলা কুয়াশা সরে না।জানতাম না। নতুন জিনিস শিখলাম।হাসান বলল, আমি এখন উঠব।টেলিস্কোপ দেওয়ার জন্যে এসেছিলেন? হ্যাঁ।নাদিয়া অবাক হয়ে বলল, টেলিস্কোপ দেওয়ার জন্যে তো আপনার আসার প্রয়োজন ছিল না। ২৫ তারিখের পর আমি যাচ্ছি আপনার কইতরবাড়িতে। আচ্ছা কবুতরগুলি কি এখনো আছে?

আছে।আমি যে ঘরে থাকব সেখান থেকে হাওর দেখা যাবে? হাসান রাজা ক্ষীণস্বরে বলল, যাবে।আপনাদের কি কোনো বজরা আছে? না। বড় নৌকা আছে।আমি বিশাল একটা বজরা বানাব। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেরকম বজরায় করে পদ্মায় ঘুরতেন সেরকম বজরা। আমার কাছে রবীন্দ্রনাথের বজরার ছবি আছে। ছবি দেখে কারিগররা বজরা বানাতে পারবে না?

পারবে।বজরায় লাইব্রেরি থাকবে। গান শোনার ব্যবস্থা থাকবে। রাতে ঘুমাবার আয়োজনও থাকবে।হাসান চুপ করে আছে। কিছু বলছে না। নাদিয়া বলল, চলুন পুকুরঘাটে যাই। কুয়াশার ভেতর চা খাই। যাবেন?

হুঁ।আপনি ঘাটে গিয়ে বসুন। আমি চায়ের কথা বলে আসি। রবীন্দ্রনাথের বজরার ছবিটাও নিয়ে আসি। আপনাকে দিয়ে দেব। আপনি এখনই বানাতে দিবেন।আচ্ছা।দিঘির ঘাটে আমরা দুজন একসঙ্গে চায়ের কাপে চুমুক দেব। এবং তখন থেকে আমি আপনাকে তুমি করে বলব। আপনিও আমাকে তুমি করে বলবেন। আমার মা বাবাকে আপনি করে বলেন, আমার বিশ্রী লাগে।নাদিয়া উঠে দাঁড়াল। হাসান রাজা বলল, শেষবারের মতো আপনাকে আপনি করে একটা কথা বলি।

নাদিয়া বলল, বলুন। আমার জীবনের পরম সৌভাগ্য যে আপনার মতো একজনের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে। মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত আমি আপনার কথা মনে করব।নাদিয়া বলল, চায়ের জন্যে অপেক্ষা করব না। আমি এখন থেকেই তুমি বলব। এই তুমি এমন নাটকীয় ডায়ালগ কেন দিচ্ছ? মনে হচ্ছে স্টেজে অভিনয় করছ। যাও ঘাটে গিয়ে বসো। আমি আসছি।

নাদিয়া চা নিয়ে ঘাটে এসে কাউকে দেখতে গেল না। অতিথঘরে কেউ নেই, বাগানে কেউ নেই।ডিসট্রিক্ট জজ আবুল কাশেম সপ্তাহে চার দিন হাঁটেন। বাড়ির বাইরে যান না। কম্পাউন্ডের ভেতরই হাঁটেন। অনেক বড় কম্পাউন্ড। পুরো কম্পাউন্ড চক্কর দিতে পনেরো মিনিট লাগে।

আজ তাঁর হাঁটার দিন। বাড়ি থেকে বের হয়েই দেখলেন, অত্যন্ত সুদর্শন এক যুবক দাঁড়িয়ে আছে। দারোয়ান আটকে দিয়েছে, ঢুকতে দিচ্ছে না। তিনি যুবককে অগ্রাহ্য করলেন। পুরো কম্পাউন্ড চক্কর দিলেন। যুবক চলে গেল না। তিন দফা চক্করের পরে তাঁর হাঁটার সমাপ্তি হলো। তিন চক্করের পরেও যুবককে পঁড়িয়ে থাকতে দেখে তিনি এগিয়ে গেলেন।

যুবক বলল, স্যার আমি আপনার কাছে কিছু চাইতে আসি নাই। তিন মিনিট কথা বলতে এসেছি।কী বিষয়ে কথা বলবে? একটা মামলা বিষয়ে।মামলা বিষয়ে আমি কারও সঙ্গে কথা বলি না।স্যার, আপনি একজন ভুল মানুষকে ফাঁসি দিয়েছেন। তার নাম ফরিদ। সে খুন করে নাই। আমি খুন করেছি। আমার নাম হাসান রাজা চৌধুরী। আমার বাবার নাম রহমত রাজা চৌধুরী। আমাকে বাঁচানোর জন্যে একজন নির্দোষ মানুষকে ফাঁসিতে ঝুলানো হচ্ছে।

আবুল কাশেম বললেন, এসো ভেতরে। আমি প্রশ্ন করব উত্তর দিবে। নিজ থেকে কিছু বলবে না।জি আচ্ছা।হাসান রাজা চৌধুরী আবুল কাশেমের মুখোমুখি বসেছে। তার সামনে চায়ের কাপ। হাসান চায়ে চুমুক দিচ্ছে না।খুন তুমি করেছ? জি।ঠান্ডা মাথায়? জি। কারণ কী? যাকে খুন করেছি ছোটবেলায় আমি তাঁর বাড়িতে থেকে মোহনগঞ্জ স্কুলে পড়তাম। উনি আমার মামা। আপন মামা না। দূরসম্পর্কের মামা। উনি আমাকে ব্যবহার করতেন।শারীরিক ব্যবহার?

জি।আমি কষ্টকে বলতে পারতাম না। নিজের মনে কাঁদতাম। এতবড় লজ্জার কথা কীভাবে বলি! আমার যখন বয়স দশ, তখন ঠিক করি একদিন উনাকে খুন করব।তোমাকে ব্যবহারের ঘটনা তুমি আর কাউকে বলেছ?

একজনকে শুধু বলেছি। যাকে খুন করেছি তার মেয়েকে মেয়ের নাম রেশমা।চা খাও।চা খাব না স্যার।আবুল কাশেম বললেন, তুমি আর কিছু বলবে? আমি চাই নির্দোষ মানুষটা ছাড়া পাক। আমার শাস্তি হোক।ফাঁসিতে ঝুলবে? জি ঝুলব।আবুল কাশেম দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়লন। হাসন রাজা বলল, স্যার আমি এখন কী করব? থানায় যাব?

হ্যাঁ। তুমি যাও। বাকি ব্যবস্থা আমি করব। আচ্ছা তোমার হাতটা বাড়াও তো তোমার সঙ্গে হাত মিলাই। এই প্রথম আমি জেনে শুনে একজন খুনির সঙ্গে হাত মিলাচ্ছি। তবে তোমার বিচার আমি করব না। অন্য কোনো বিচারক করবেন। আমি রিটায়ারমেন্ট চলে যাচ্ছি।

হামান রাজা চৌধুরী হাজতে আছে। তার মামলা নতুন করে শুরু হয়েছে।২৫ ফেব্রুয়ারি মোনায়েম খান বিয়েতে উপস্থিত হওয়ার তারিখ দিয়েছিলেন। ওই তারিখে তিনি কাউকে কিছু না জানিয়ে দেশ ছেড়ে পশ্চিম পাকিস্থানে পালিয়ে গলেন।

কালরাত্রি ২৫ মার্চ কালরাত্রি—এই তথ্য আমরা জানি। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ হত্যা-উৎসবে মেতেছিল পাকিস্তানের সেনাবাহিনী।ঊনসত্তরের ২৫ মার্চও কিন্তু কালরাত্রি। ওই রাতে প্রেসিডেন্ট আয়ুব খান সামরিক আইন জারি করে দেশের ক্ষমতা তুলে দেন জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে।

পরিশিষ্ট

কিছুক্ষণ আগে হাজেরা বিবি মারা গেছেন।মৃত্যুর সময় নাদিয়া একাই উপস্থিত ছিল। দাদির পাশে বসে লিখছিল। হাজেরা বিবি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললেন, কী লেখ? নাদিয়া বলল, তোমার কথা লিখি।লেখা ‘বন’ কর। আমার দিকে মুখ ফিরা।নাদিয়া খাতা রেখে দাদির দিকে ঘুরে তাকাল। অবাক হয়ে বলল, আজ তোমাকে অন্যরকম লাগছে।কী রকম?

চেহারা উজ্জ্বল লাগছে। চোখ ঝকঝক করছে। মনে হচ্ছে তোমার বয়স কমে গেছে।হাজেরা বললেন, শইল্যের ভিতর মরণের বাতি জ্বলছে। মরণের বাতি জ্বললে চেহারায় জেল্লা লাগে।মরণের আবার বাতি আছে নাকি? আছে।আল্লাপাক এই বাতি জ্বালায় দেন। আজরাইল আইসা নিভায়।

নাদিয়া বলল, তুমি খুব ভালো আছ, সুস্থ আছ। তোমার মরতে এখনো অনেক দেরি।হাজেরা বিবি শব্দ করে আনন্দময় হাসি হাসলেন।নাদিয়া বলল, বাহ! তুমি তো কিশোরী মেয়েদের মতো হাসছ। হাজেরা নাদিয়ার হাত ধরে কোমল গলায় বললেন, আমি তোর বাপের কাছে অপরাধ। তুই আমার হইয়া তার কাছে ক্ষমা চাইবি। মা ছেলের কাছে ক্ষমা চাইতে পারে না। জায়েজ নাই।কী অপরাধ করেছ?

ছোটবেলা থাইকা নানানভাবে তারে কষ্ট দিয়েছি। খাটের সাথে সারা দিন বাইন্ধ্যা রাখছি। খাওয়া দেই নাই। পুসকুনিতে একবার তারে নিয়া গোসলে নামছি, হঠাৎ তার মাথা পানিতে চাইপ্যা ধইরা বলছি- মর তুই মর।কেন দাদি?

তোর দাদাজান তার ছেলেরে খুব পছন্দ করত। ছেলে ছিল তার চোখের মণি। ছেলেরে কষ্ট দিলে সে কষ্ট পাইত। এইজন্যে কষ্ট দিতাম। তোর দাদাজান ছিল অতি বহু মানুষ। কত দাসী যে তার কারণে পেট বাধাইছে। ছিঃ ছিঃ ছিঃ।দাদাজানকে শাস্তি দেওয়ার জন্যে তুমি তার ছেলেকে কষ্ট দিয়েছ। কাজটা ভুল করেছ।

অবশ্যই। হাবীব বড় হইছে তারপরেও তারে কষ্ট দিয়েছি। আমি জানি ‘হাবু ডাকলে রাগ করে। ইচ্ছা কইরা ডাকি—হাবু হাবু হাবুরে।কেন দাদি? এখন তো আর দাদাজান বেঁচে নেই। এখন কেন কষ্ট দেওয়া? আমি চেয়েছি সে রাগ করুক। আমারে দুইটা মন্দ কথা বলুক। ছোটবেলায় তার দিকে যে অন্যায় করেছি তার কিছুটা কাটা যাক। কিন্তু আমি এমন ছেলে পেটে ধরেছি যে আমার উপর রাগ করে না।

তারে রাগানির চেষ্টায় আমার ত্রুটি ছিল না। একসময় তার চরিত্র নিয়া কথা শুরু করলাম। অতি নোংরা কথা। সফুরার পেটে তার সন্তান–এইসব হাবিজাবি। তাও আমার পুলা রাগে না।নাদিয়া বলল, তোমার কাছে শুনে শুনে মা নিজেও কাজের মেয়েদের নানান কথা বলেন। বাবার সামনে যেন কেউ না যায়—এইসব। বাবার ত্রুটি আছে। নোংরা ত্রুটি নাই।

হাজেরা বিবি বললেন, অবশ্যই নাই। এইটা আমার পুলা। ছগিরন মাগি, বছিরুন মাগির পুলা না।নোংরা কথা বন্ধ করো দাদি।হাজেরা বিবি বললেন, মইরাই তো যাইতেছি। পচা কথা আর বলতে পারব না। দুই একটা বলি। তোর পছন্দ না হইলে কানে হাত দিবি।আচ্ছা বলো যা বলতে চাও। তবে তুমি কঠিন চিজ। সহজে মারা যাওয়ার জিনিস না।তারপরেও ধুম কইরা মইরা যাইতে পারি। তুই তখন অবশ্যই আমার হইয়া তার কাছে পায়ে ধইরা ক্ষমা চাইবি।

বললাম তো ক্ষমা চাব। মৃত্যুর কথাটা আপাতত বন্ধ থাকুক। দু’একটা আনন্দের কথা বলো।এখন তোর বাপরে ডাক দিয়া আন। আইজ তারে আমি হাবু ডাকব না। আইজ তারে ডাকব হাবীব। সুন্দর কইরা বলব, হাবীব। বাবা কেমন আছ? আমার সামনে বসো। কী বলতেছি মন দিয়া শোনো। সব মানুষের মাতৃঋণ থাকে। তোমার নাই।

নাদিয়া বলল, এখন বাবাকে ডাকতে পারব না দাদি। আমি লেখা শেষ করব।হাজেরা বললেন, আচ্ছা খাক। লাগবে না।বলেই মাথা এলিয়ে পড়ে গেলেন। নাদিয়া তাকিয়ে ছিল, সে সত্যি সত্যি দাদির চোখে গোলাপি আলো দেখতে পেল।হাবীব চেম্বারে মক্কেলদের সঙ্গে ছিলেন। নাদিয়া শান্ত ভঙ্গিতে ঘরে ঢুকল। বাবার কাধে হাত রেখে বলল, বাবা! আমি বাগানে কদমগাছের নিচে সারা রাত বসে থাকব। কেউ যেন সেখানে না যায়, কেউ যেন না যায়।হাবীব অবাক হয়ে বললেন, তোর কী হয়েছে রে মা?

নাদিয়া বলল, আমার কিছু হয়নি। আমি ভালো আছি। খুব ভালো আছি। দাদিজান মারা গেছেন।নাদিয়া কদমগাছের নিচের বেদিতে বসে আছে কাছেই বকুলগাছে ফুল ফুটেছে। ফুলের গন্ধে চারপাশ আমোদিত। ঝাক বেধে জোনাকি বের হয়েছে। নাদিয়া তার দাদির কথা ভাবছে না। সে তার ছোটমামার কথা ভাবছে। আবার সে তার মামার নাম ভুলে গেছে। কিছুতেই নাম মনে করতে পারছে না। মৃত মানুষ কত সহজেই না হারিয়ে যায়।

জীবিত মানুষও মাঝে মাঝে হারিয়ে যায়। হাসান রাজা চৌধুরী এখনো জীবিত। হাজতে আছে। কিন্তু সে হারিয়ে গেছে। যা হাসান রাজা তাকে একটা চিঠি লিখেছে। নাদিয়া তার উগ্র লিখে রেখেছে। পাঠানো হয়নি। নাদিয়া ভেবে রেখেছে বাবাকে সঙ্গে নিয়ে জেলহাজতে হাসান রাজার সঙ্গে দেখা করতে যাবে। তাকে চিঠিটা হাতে হাতে দেবে।

নাদিয়া লিখেছে— আমি তোমার সাহসে মুগ্ধ হয়েছি। তোমার মতো একজন সাহসী ভালো মানুষের সঙ্গে আমি বাস করতে পারব নী এই দুঃখ আমি আজীবন পুষে রাখব। তুমি লিখেছ আমার জন্যে বুজরা বানানোর কথা তুমি তোমার বাবাকে বলেছ। বজরা তৈরি হোক আমি একাই সেই বজরায় রাত কাটাব। তোমার দেওয়া টেলিস্কোপ দিয়ে আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র খুঁজে বের করব। নক্ষত্রের নাম Sirius, বাংলায় লুব্ধক।

ভাদু নাদিয়াকে দেখেছে। মেয়েটি একা। আশেপাশে কেউ নেই। সহসাই যে কেউ আসবে সে সম্ভাবনা নেই। ভাদু জেনেছে, বুড়িটা মারা গেছে। সবাই বুড়িটাকে নিয়ে ব্যস্ত। ভাদু এগোচ্ছে। তার মধ্যে কোনো ব্যস্ততা নেই। হাতে অফুরন্তু সময়।পশ্চিম পাকিস্তান থেকে জেনারেল ইয়াহিয়া খান রওনা হয়েছেন বাংলাদেশের দিকে। তার সামনে ব্লাক ডুগের বোতল। তিনি আয়েশ করে হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দিচ্ছেন। তার মধ্যে কোনো ব্যস্ততা নেই। তার হাতেও অফুরন্ত সময়।

ভাদু কাছাকাছি চলে এসেছে। সে এখন এগুচ্ছে হামাগুড়ি দিয়ে। তাকে দেখাচ্ছে জন্তুর মতো। তার মুখ থেকে জন্তুর মতো গোঁ গোঁ শব্দ হচ্ছে। সে চেষ্টা করেও শব্দ আটকাতে পারছে না।নাদিয়া চমকে তাকাল। ভাদুকে দেখে অবাক হয়ে বলল, এই তোমার কী হয়েছে? এরকম করছ কেন?

ভাদু নাদিয়ার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।দিঘির পানিতে নাদিয়া পড়ে আছে। তার চোখ খোলা। যেন সে অবাক হয়ে পৃথিবী দেখছে।নাদিয়া দিঘির যেখানে পড়ে আছে সেখানেই সে একবার নিজের ছায়া দেখে প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিল।

————-

ময়মনসিংহ সেন্ট্রাল জেলে মে মাসের আট তারিখ হাসান রাজা চৌধুরীর ফাঁসি হয়।

                      (সমাপ্ত)

 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *