স্যার আইজাক নিউটন এর জীবনী

স্যার আইজাক নিউটন

স্যার আইজাক নিউটন [১৬৪২-১৭২৭]

১৬৪২ সালের বড়দিন আইজাক নিউটন জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর জন্মের কয়েক মাস আগেই পিতার মৃত্যু হয় । জন্মের সময়ে আইজাক ছিলেন দুর্বল শীর্ণকায় আর ক্ষুদ্র আকৃতির, ধাই তাঁর জীবনের আশা সম্পূর্ণ ত্যাগ করেছিল । হয়ত বিশ্বের প্রয়োজনেই বিশ্ববিধাতা তাঁর প্রাণরক্ষা করেছিলেন । বিধবা মায়ের সাথেই নিউটনের জীবনের প্রথম তিন বছর কেটে যায় । এই সময় তাঁর মা বারনাবাস নামে এক ভদ্রলোকের প্রেমে পড়ে তাকে বিবাহ করেন । নব বিবাহিত দম্পতির জীবনে শিশু নেহাতেই অবাঞ্ছিত বিবেচনা করে মা শিশু নিউটনকে তাঁর দাদির কাছে রেখে দেন ।

১২ বছর বয়সে নিউটনকে গ্রামের স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হল । জন্ম থেকেই রুগ্ন ছিলেন নিউটন । তবু তাঁর দুষ্টুমি কিছু কম ছিল না । কিন্তু শিক্ষকরা তাঁর অসাধারণ মেধার জন্য সকলেই ভালবাসতেন । স্কুলের অধ্যক্ষের শালা প্রায়ই স্কুলে পৌঁছতে দেরি করত । একদিন নিউটন বললেন, স্যার আমি আপনার জন্য একটা ঘড়ি তৈরি করে দিচ্ছি, তাহলে ঘড়ি দেখে ঠিক সময়েই স্কুলে আসতে পারবেন । নিউটন ঘড়ি তৈরি করলেন । ঘড়ির উপরে থাকত একটা পানির পাত্র । প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণ পানি সেই পাত্রে ঢেলে দেওয়া হত । তাঁর থেকে ফোঁটা পানি ঘড়ির কাটার উপর পড়ত এবং ঘড়ির কাটা আপন গতিতেই এগিয়ে চলত । 

Isaac Newton Biography

ভাগ্যের পরিহাস নিউটনের সৎ বাবা মারা গেলেন । মার একার পক্ষে ক্ষেত জমিজমা দেখাশুনা করা সম্ভব হল না । স্কুল ছাড়িয়ে চৌদ্দ বছরের নিউটনকে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে এলেন । 

ভাগ্যক্রমে চাচা উইলিয়াম ভাইপোর জ্ঞানতৃষ্ণায় মুগ্ধ হয়ে নিজের কাছে নিয়ে এলেন । চাচা কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন । তিনি ভাইপোকে আবার স্কুলে ভর্তি করে দিলেন । এক বছর পর নিউটন ট্রিনিটি কলেজে ভর্তি হলেন । শুরু হল এক নতুন জীবন । 

ছাত্র হিসাবে নিউটন ছিলেন যেমন অধ্যাবসায়ী, পরিশ্রমী তেমনি অসাধারণ মেধাসম্পন্ন । তাঁর সবচেয়ে বেশি দখল ছিল অঙ্কে । যে কোন জটিল অঙ্কের সমাধান সহজেই করে ফেলতেন । তবুও অঙ্কের প্রতি তাঁর কোন আকর্ষণ ছিল না । প্রকৃতির দুজ্ঞেয় রহস্য তাঁকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করত । নিউটন বিশ্বাস করতেন একমাত্র বিজ্ঞানের মাধ্যমেই প্রকৃতির এই গোপন রহস্যকে উদঘাটন করা সম্ভব । অবশেষে ১৬৬৫ সালে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করলেন । 

Isaac Newton Biography

নিউটন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্রিনিটি কলেজের গণিতের অধ্যাপক হিসাবে নির্বাচিত হলেন । সেই সাথে আলোর বর্ণচ্ছাটা নিয়ে গবেষণার কাজ আরম্ভ করলেন । ইংল্যাণ্ডের রয়াল সোসাইটিও নিউটনের বৈজ্ঞানিক গবেষণার কাজে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে সোসাইটির সদস্য নির্বাচিত করলেন । তখন তাঁর বয়স মাত্র ২৯ । ইংলান্ডের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীদের পাশে তাঁর স্থান হল । সোসাইটির প্রথম সভায় তাঁর আলোকতত্ত্ব নিয়ে প্রবন্ধ পাঠ করলেন । তাঁর বিষয়বস্তুর সঙ্গে একমত হতে না পারলেও সোসাইটির সমস্ত বিজ্ঞানীই উচ্চকণ্ঠে তাঁর বৈজ্ঞানিক নিবন্ধের প্রশংসা করলেন । তিনি যেন এক আত্মমগ্ন সাধক । প্রায়ই দেখা যেত তিনি কলেজে আসছেন, তাঁর জামার বোতাম খোলা, পায়ে মোজা গুটিয়ে আছে, এলোমেলো চুল । তন্ময় চলেছেন কোন নতুন বৈজ্ঞানিক ভাবনায় বিভোর । 

Isaac Newton Biography

কল্পনা প্রবণ এই মনের জন্যই বাস্তব জগৎ সম্বন্ধে তাঁর ধারণা ছিল অস্পষ্ট । একদিন একজন লোক তাঁর বাড়িতে এসে একটা প্রিজম (তিনকোণা কাঁচ) দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করল এর কত দাম হতে পারে?  প্রিজমের বৈজ্ঞানিক গুরুত্ব বিবেচনা করে নিউটন বললেন, এর মূল্য নির্ণয় করা আমার সাধ্যের বাইরে । লোকটি নিউটনের কথা শুনে অস্বাভাবিক বেশী দামে প্রিজমটি বিক্রি করতে চাইল । কোন দরদাম না করেই সেই দামে প্রিজমটি কিনে নিলেন নিউটন । নিউটনের বাড়িওয়ালা সব কথা শুনে বললেন, তুমি নেহাতই বোকা । এটা সাধারণ একটা কাঁচ, এই কাঁচের যা ওজন হবে সেই দামেই এটা কেনা উচিত ছিল । নিউটন কোন কথা না বলে শুধু হাসলেন । পরবর্তীকালে এই প্রিজম থেকেই উদ্ভাবন করেন বর্ণতত্ত্ব (Theory of colour) । কলেজের ছুটির অবকাশে মায়ের কাছে গিয়েছেন নিউটন । দিনের বেশির ভাগ সময়ই বাগানের মধ্যে বসে থাকেন ।

Isaac Newton Biography

প্রাণ ভরে উপভোগ করেন প্রকৃতির রূপ রস গন্ধ । একদিন হঠাৎ সামনে খসে পড়ল একটা আপেল । মুহূর্তে তাঁর মনের কোণে উঁকি মারে এক জিজ্ঞাসা– কেন আপেলটি আকাশে না উঠে মাটিতে এসে পড়ল? এই জিজ্ঞাসাই মানুষের চিন্তার জগতে এক যুগান্তর নিয়ে এল । জন্ম নিল মাধ্যকর্ষণ তত্ত্বের । যদিও এই চিন্তার সূত্রপাত হয়েছিল বহু পূর্বেই । তাঁর পূর্ণ পরিণতি ঘটল ১৬২৭ সালে । নিউটন প্রকাশ করলেন তাঁর কাল জয়ী গ্রন্থ (Mathematical principles of Natural philosophy)

Isaac Newton Biography

মানুষ মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কথা সামান্য কিছু জানলেও এই বিশ্বব্রহ্মণ্ড জুড়ে রয়েছে যে তার অস্তিত্ব সে কথা কেউ জানত না । মাধ্যকর্ষণ গ্রহ নক্ষত্র পৃথিবীকে একসূত্রে বেধে রেখেছেন । একদিন রাতে এক বন্ধুর বাড়িতে তাঁর নিমন্ত্রণ হয়েছে । কাজ করতে করতে রাত হয়ে গিয়েছে । হঠাৎ তাঁর মনে পড়ল বন্ধুর বাড়িতে যেতে হবে । তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বার হলেন নিউটন । যখন বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে পৌঁছলেন তখন গভীর রাত । চারদিক অন্ধকার । নিউটন বুঝতে পরলেন নিমন্ত্রণ পর্ব আগেই শেষ হয়ে গিয়েছে । বাড়ি ফিরে এসে আবার কাজে বসলেন । রাতে খাওয়ার কথা মনেই হল না তাঁর ।  

Isaac Newton Biography

নিউটন তাকে একটি বই-এ তালিকা দিয়ে বললেন, আপনি আগে এই বইগুলো পড়ুন তাহলে আমার তত্ত্ব বোঝার কাজ সহজ হবে । ভদ্রলোক তালিকাটি দেখে বললেন, নিউটনের তত্ত্ব বোঝা আমার সাধ্যের বাইরে । কারণ প্রাথমিক তালিকার এই কটি বই পড়া শেষ করতেই আমার অর্ধেক জীবন কেটে যাবে ।

 Philosophiac naturalis principia Mathematica  প্রকাশিত হয় ১৬৪৭ সালে । লাটিন ভাষায় লেখা এই বইটি   তিনটি খণ্ডে বিভক্ত । 

প্রথম খণ্ডে নিউটন গতিসূত্র সম্বন্ধে আলোচনা করেছেন । তিনটি গতিসূত্র হল, (১) প্রত্যেকটি বস্তু চিরকাল সরল রেখা অবলম্বন করে সমবেগে চলতে থাকে । (২) বস্তুর উপর প্রযুক্ত বল বস্তুর ভরবেগরে পরিবর্তনের হারের সমানুপাতিক এবং বল যেদিকে ক্রিয়া করে, ভরবেগের পরিবর্তনও সেদিক ঘটে । (৩) প্রত্যেকটি ক্রিয়ার সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে ।

Isaac Newton Biography

তাঁর প্রতি সমালোচনা করা হল, তিনি তাঁর তত্ত্বে বিশ্বপ্রকৃতিকে যেভাবে বিবেচনা করেছেন তা থেকে মনে হয় এ সমস্তই যেন এক বিশঙ্খল মনের প্রাণহীন সৃষ্টির কাহিনী । 

নিউটন তাঁর জাবাবে বললেন, প্রকৃতপক্ষে এই বিশ্বপ্রকৃতি এমন সুশৃঙ্খল সুসামঞ্জস্যভাবে সৃষ্টি হয়েছে মনে হয় এর পশ্চাতে কোন ঐশ্বরিক স্রষ্টা রয়েছেন ।

নিউটনের এই বিচিত্র মানসিকতার জন্য কোন মানুষই তাঁকে সহজভাবে উপলব্ধি করতে পারেনি । হয়ত নিজেই নিজের বিরাটতত্ত্বকে সঠিকভাবে চিনতে পারেননি । অসাধারণ আবিষ্কারের পরও তিনি ছিলেন অসুখী মানুষ ।

Isaac Newton Biography

Principia প্রকাশের পরই নিউটন সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে নামলেন । যখন দ্বিতীয় জেনম বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা কেড়ে নিতে চাইলেন, তিনি তাঁর সক্রিয় বিরোধী হয়ে উঠলেন । রাজপরিবারের উৎখাতের পর ১৬৯৬ সালে নতুন সংবিধান তৈরির জন্য যে কনভেনশন গড়ে উঠল, নিউটন তাঁর সদস্য হলেন । 

রাজনীতিবিদ হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন নিউটন । ১৬৯০ সালে কনভেনশনের পরিসমাপ্তি ঘটল, নিউটনের রাজনৈতিক জীবনেরও পরিসমাপ্তি ঘটল । 

১৭০৩ সালে নিউটনের জীবনে এলো এক অভূতপূর্ব সম্মান । তিনি রয়াল সোসাইটির সভাপতি হলেন । আমৃত্যু তিনি সেই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন ।

Isaac Newton Biography

১৭০৫ সালে রানী এ্যানি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে এলেন । রানীর পক্ষ থেকে নিউটনকে নাইটহুড উপাধিত ভূষিত করা হল । এই সময় ডিফারেন্সিয়াল ক্যালকুলাস (Differential Calculus)– এর প্রথম আবিষ্কর্তা হিসাবে জার্মান দার্শনিক লিবনিজ  (Leibniz/Leibnitz) এর সাথে বির্তকে জড়িয়ে পড়লেন । ইংলান্ডের রয়াল অ্যাকাডেমি জানতে পারে লিবনিজ  Differential Calculus–  এর আবিষ্কর্তা হিসাবে দাবি জানাচ্ছেন । রয়াল একাডেমির সদস্যরা ক্রোধে ফেটে পড়ল । তাদের সভাপতির কৃতিত্ত্বকে এক বিদেশী চুরি করে নিজের নামে প্রচার করতে চাইচ্ছে । কারণ তারা বিশ্বাস করতেন নিউটনই প্রথম Calculus– এর সম্ভাবনা, তাঁর অস্তিত্ব সম্বন্ধে লিবনিজের কাছে বলেছিলেন । লিবনিজ একে উন্নত করছে, সঠিক বিস্তুতি দিয়েছে কিন্তু আবিষ্কার করেনি । তাবে নিরপেক্ষ ঐতিহাসিকদের মতে নিউটন ডিফারেন্সিয়াল ক্যালকুলাসের উদ্ভাবক হলেও লিবলিজের পদ্ধতি ছিল অনেক সহজ এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ । 

Isaac Newton Biography

 ১৭২৭ সাল, নিউটন গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন । চিকিৎসাতে কোন সুফল পাওয়া গেল না । অবশেষে ২০শে মার্চ মহাবিজ্ঞানী নিউটন তাঁর প্রিয় অনন্ত বিশ্বপ্রকৃতির বুকে চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেলেন । সাত দিন পর তাকে ওয়েস্ট মিনিস্টার এ্যারিতে সমাধিস্থ করা হল ।

সমস্ত দেশ অবনত মস্তকে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানায় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ এই জ্ঞানতাপসকে । ‍যদিও নিজেকে তিনি কখনো পণ্ডিত বা জ্ঞানী ভাবেননি । মৃত্যুর অল্প কিছুদিন আগে তিনি লিখেছিলেন, “পৃথিবীর মানুষ আমাকে কি ভাবে জানি না কিন্তু নিজের সম্বন্ধে আমি মনে করি আমি একটা ছোট ছেলের মত সাগরের তীরে খেলা করছি আর খুঁজে ফিরেছি সাধারণের চেয়ে সামান্য আলাদা নুড়ি বা ঝিনুকের খোলা । সামনে আমার পড়ে রয়েছে অনাবিষ্কৃতি বিশাল জ্ঞানের সাগর ।”

 

আব্রাহাম লিঙ্কন এর জীবনী

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *