আজ আমি কোথাও যাব না শেষ – পর্ব হুমায়ূন আহমেদ

আজ আমি কোথাও যাব না শেষ – পর্ব

রফিক কী করবে বুঝতে পারছে না। শামসুদ্দিন সাহেব হাসপাতালে পড়ে আছেন। রফিকের উচিত তার পাশে থাকা। চিকিৎসার কী হচ্ছে না হচ্ছে তার খোঁজ নেয়া। অথচ সে পৃথুর সঙ্গে টিভি সেটের সামনে। জয়নাল নামের নিতান্তই অপরিচিত একজন মানুষ দৌড়াদৌড়ি ছোটাছুটি করছে। জয়নাল সম্পর্কে আগে যা ভাবা হয়েছিল তা ঠিক না। মানুষটা অবশ্যই ভালো।রাহেলা টেলিফোন করল রাত বারটায়। বাড়িওয়ালার ছেলে খুবই বিরক্তমুখে খবর দিতে এলো। এত বিরক্ত হবার মতো কিছু ঘটে নি। ইমার্জেন্সি সিচুয়েশন তৈরি হতেই পারে।

ভয়ঙ্কর কোনো বিপদে রাত বারটার সময় ভাড়াটের টেলিফোন আসতেই পারে।রফিক মাথা ঠাণ্ডা রেখে টেলিফোন ধরল। সে ঠিক করে রাখল রাহেলার সঙ্গে খুব শান্ত গলায় কথা বলবে। কোনোরকম রাগারাগি করবে না। ভুলিয়ে ভালিয়ে তাকে বাসায় নিয়ে আসতে হবে।টেলিফোন ধরতেই রাহেলা বলল, হ্যালো শোন, আমি নেত্রকোনা যাচ্ছি। কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে টেলিফোন করছি।নেত্রকোনা যাচ্ছি মানে কী? নেত্রকোনার কোথায় যাচ্ছ? বাবার বাড়িতে যাচ্ছি। না-কি বাবার বাড়িতেও যেতে পারব না? বাবার বাড়িতে যেতে হলেও তোমার কাছ থেকে ভিসা নিতে হবে?

রাহেলা আমার কথা একটা কথা শোন… রফিকের কথার মাঝখানে রাহেলা চেঁচিয়ে বলল, তোমার কোনো কথা শুনব নী। এখন থেকে আমি কথা বলব, তুমি শুনবে। তোমার সঙ্গে আমার সমস্ত সম্পর্কের এখানেই ইতি। তুমি যদি আমাকে আনতে যাও তাহলে গুণ্ডা দিয়ে তোমাকে জুতা পেটা করব। চরিত্রহীন বদ কোথাকার! রাহেলী শোন, বাসায়… আবার কথা বলে! খবরদার কথা বলবি না। খবরদার।রাহেলা খট করে টেলিফোন লাইন কেটে দিল।রাহেলার খুব মজা লাগছে। পৃথুর বাবা এখন চিন্তায় চিন্তায় অস্থির হোক। ছোটাছুটি করতে থাকুক। রাহেলা নিশ্চিত পৃথুর বাবা কমলাপুর রেলস্টেশনে চলে যাবে। স্টেশনের এ-মাথা ও-মাথা তাকে খুঁজবে। তার মাথায় সপ্ত আকাশ ভেঙে পড়বে।

পক আকাশ ভেঙে। শিক্ষা হোক। রাহেলার সবাইকে শিক্ষা দিতে ইচ্ছা করছে। কঠিন শিক্ষা। যে-ই তার কাছে আসবে সে-ই শিক্ষা পাবে। সে-ই বুঝবে কত ধানে কত চাল।সমস্যা হচ্ছে পৃথুর বাবা মানুষটা ভালো। শুধু ভালো না, বেশ ভালো। তারপরেও রাহেলা তাকে শিক্ষা দেবে। সে সুখে নেই, অন্যরা কেন সুখে থাকবে? তার গায়ে আগুন জ্বলছে, অন্যদের গায়ে কেন জ্বলবে না? অন্যদের গায়ে কেন ঠাণ্ডা বৃষ্টির ফোটা পড়বে? রাহেলা খুব ঘামছে। সে বড় বড় করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। তার মন এখন খুবই ভালো, কিন্তু শরীর ভালো লাগছে না। রাহেলা এসে উঠেছে তার কলেজ জীবনের বান্ধবী শায়লার বাসায়। রাহেলা কলেজ পাশ করতে পারে নি, তার আগেই বিয়ে হয়ে গেল। শায়লা ঠিকই কলেজ পাশ করেছে–মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়ে ডাক্তার হয়েছে। কোনো এক ক্লিনিকে ডাক্তারি করে।

মাসে কুড়ি হাজার টাকা পায়। অথচ এই মেয়ে কলেজে হাবাগোবা ছিল। তাকে সবাই ডাকত হাবলি বেগম। হাবা থেকে বলি। সেই হাবলি মাসে কুড়ি হাজার টাকা পায়। স্বামী চাকরি করে। একটা মাত্র বাচ্চা। বাড়ি ভর্তি জিনিসপত্র। এর মধ্যে একটা হলো মাইক্রোওয়েভ ওভেন। বোতাম টিপলেই ঠাণ্ডা খাবার গরম হয়ে যায়। হাবলিটা কত সুখে আছে, আর তার কী অবস্থা! রাহেলা সোফায় বসে হাঁপাচ্ছে। শায়লী বলল, তোর কি শরীর খারাপ লাগছে? রাহেলা না-সূচক মাথা নাড়ল।শায়লা বলল, কার সঙ্গে কথা বলছিলি? পৃথুর বাবার সঙ্গে।কঠিন রাগারাগি চলছে?

রাহেলা বলল, হ্যাঁ।শায়লা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে রাগরাগি ইওয়া ভালো। যত বেশি রাগারাগি হবে তাদের ভেতরের বন্ধন তত শক্ত হবে।এটা কি তোর ডাক্তারি কথা? ডাক্তারি কথা না, এটা আমার মনের কথা। আমি যখনই কোনো স্বামী-স্ত্রীকে ঝগড়া করতে দেখি আমার হিংসা হয়। ভালোবাসা আছে বলেই ঝগড়া হচ্ছে। আমার অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমাদের কখনোই কোনো রাগারাগি হয় না। সে সারাদিন তার মতো অফিস করে। আমি ক্লিনিকে থাকি। রাতে এক সঙ্গে ডিনার খাই। টুকটাক গল্প করি। কিছুক্ষণ টিভি দেখে দুজনে দুটা ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে ঘুমুতে যাই। আবার সকালবেলা দুজন দুদিকে চলে যাই। তোদের ঝগড়া কী নিয়ে হয়?

সবকিছু নিয়েই হয়।শায়লা মুগ্ধ গলায় বলল, কী রোমান্টিক! তুই রাগ করে বাসা থেকে চলে এসেছিস মিথ্যা করে বললি তুই আছিস কমলাপুর রেলস্টেশনে। সেই বেচারা তোকে স্টেশনে খুঁজে বেড়াচ্ছে। ভাবতেই ভালো লাগছে। তুই চা-কফি কিছু খাবি? রাহেলা বলল, না। আমি বাসায় যাব।শায়লা অবাক হয়ে বলল, এখন বাসায় যাবি মানে কী? রাত একটা বাজে।বাজুক রাত একটা। আমার এখানে থাকতে ভালো লাগছে না। আমার শরীর খারাপ লাগছে। বুক ধড়ফড় করছে।এত রাতে বাসায় যাবি কীভাবে? তুই তো গাড়ি চালাতে পারিস। তুই আমাকে গাড়ি করে নামিয়ে দিবি। আর তা যদি না পারিস- দারোয়ান পাঠিয়ে রিকশা বা বেবিটেক্সি কিছু একটা এনে দে। আমি একা চলে যাব।একী চলে যাবি?

হুঁ।শায়লা বলল, তোর তো মাথা খারাপ। কোনো ভালো সাইকিয়াট্রিস্টকে দিয়ে তোর চিকিৎসা করানো উচিত।রাহেলা বলল, চিকিৎসা করবি। এই মুহূর্তে তো আর চিকিৎসা করানো যাচ্ছে না। এখন আমি বাসায় যাব।রাহেলা সোফা থেকে উঠে দাড়াল। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে সে একাই দরজা খুলে বের হয়ে যাবে। শায়লা বিরক্ত গলায় বলল, দাড়া গাড়ি বের করছি। তোকে আমার দোহাই লাগে, আবার যদি তোদের মধ্যে রাগারাগি হয় আমাদের বাসায় আসবি না।রাত দুটা বাজে।হাসপাতালের বারান্দার রেলিং-এ হেলান দিয়ে জয়নাল দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে সিগারেট। হাসপাতালে সিগারেট খাওয়া নিষেধ। রাত বারটার পর সব নিষেধই খানিকটা দুর্বল হয়ে যায় এই ভরসায় জয়নাল সিগারেট ধরিয়েছে।

সাধারণত খালি পেটে সিগারেটে টান দিলে গা গুলায়। আজ গা গুলাচ্ছে না। বরং ভালো লাগছে। ঠাণ্ডা বাতাস ছেড়েছে। বাতাসে শরীর জুড়িয়ে যাচ্ছে। একটা পাটি থাকলে মেঝেতে পার্টি পেতে ঘুমিয়ে পড়ত।জয়নালের মন অস্বাভাবিক ভালো। শামসুদ্দিন সাহেব এখন চোখ মেলে তাকাচ্ছেন। কথাবার্তা বলছেন। তাঁর প্রেসার নেমে প্রায় স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। ডাক্তার বলছেন, ভয়ের কিছু নেই। রোগীর যা দরকার তা হলো–রেস্ট। হাসপাতালেও রোগী রাখার দরকার নেই। সকালবেলা বাড়িতে নিয়ে গেলেই হবে। জয়নাল ঠিক করেছে রাতটা হাসপাতালের বারান্দায় পার করে দিয়ে ভোরবেলা রোগী রিলিজ করে বাসায় ফিরবে। সার্বক্ষণিকভাবে সে নিজেই রোগী দেখবে।

ইতি তো আছেই। যতই দিন যাচ্ছে ইতি মেয়েটাকে তুরি ততই পছন্দ হচ্ছে। এক সময় তার ধারণা ছিল ইতি চ্যাং ব্যাঙ টাইপ মেয়ে। এখন সে ধারণা পাল্টে গেছে। চ্যাং ব্যাঙ টাইপ মেয়ে অপরিচিত একজন অসুস্থ মানুষ নিয়ে এত ঝামেলা করে না। ইতি করেছে। এখন সে গিয়েছে চায়ের খোঁজে। রাত দুটার সময় চা পাওয়ার কথা না। তবে ইতি যেমন স্মার্ট মেয়ে ব্যবস্থা করবেই।করিডোরের মাথায় ইতিকে দেখা গেল। তার হাতে লাল রঙের ছোট্ট ফ্লাস্ক? আরেক হাতে কাগজের ঠোঙ্গা। নিশ্চয়ই খাবারদাবার আছে। জয়নালের মন সামান্য খারাপ হয়ে গেল। নাশতা খেয়ে চা খাবার পর একটা সিগারেট ধরাতে ইচ্ছা করবে। জয়নালের সঙ্গে সিগারেট নেই। শেষ সিগারেটটা সে একটু আগে শেষ করেছে।

ইতি প্যাকেট ভর্তি গরম সিঙাড়া এনেছে, কল এনেছে। এক রোগীর কাছ থেকে ফ্লাস্ক ধার করে ফ্লাস্ক ভর্তি চা এনেছে। ছোট্ট কাগজের পকেটে দুটা মিষ্টি পান। তারচেয়েও বিস্ময়কর ঘটনা হলো–ইতি এক প্যাকেট বেনসন সিগারেট এবং একটা দেয়াশলাইও এনেছে। জয়নাল সিঙাড়ায় কামড় দিতে দিতে স্বাভাবিক গলায় বলল, সিগারেট কী মনে করে এনেছ? ইতি বলল, টেনশনে পড়ে তুমি যে হারে সিগারেট টানছু আমার ধারণা তোমার সিগারেট শেষ। চায়ের সঙ্গে তুমি আরাম করে সিগারেট খাও। যদি সিগারেট না থাকে এই ভেবে কিনেছি।জয়নাল ফ্লাস্ক থেকে চা ঢালতে ঢালতে বলল, আগামী দশ বছরে তুমি যে সব অপরাধ করবে তার প্রতিটি আমি অ্যাডভান্স ক্ষমা করে দিলাম।

ইতি হাসতে হাসতে বলল–তুমি মহান, তুমি একুশে ফেব্রুয়ারি।জয়নাল বলল, চাচাজির লেটেস্ট খবর কিছু জানো? ইতি বলল, জানি। উনি ভালো আছেন। আরাম করে ঘুমোচ্ছেন। উনার বোন এসেছেন। তিনি ভাইয়ের হাত ধরে বসে আছেন। বসার ভঙ্গিটা একবার আড়াল থেকে দেখে আসি। দেখলে ভালো লাগবে।ভালো লাগবে কেন? ইতি মুগ্ধ গলায় বলল, ভাইয়ের হাত ধরে উনি এমন কঠিন ভঙ্গিতে বসে আছেন যে দেখলেই মনে হবে–তার ভাইকে তার হাত থেকে নিয়ে যাবার ক্ষমতা কারো নেই। আজরাইলেরও নেই। আজরাইলকেও দরজার বাইরে থমকে দাড়াতে হবে।জয়নাল আগ্রহের সঙ্গে বলল, চল তো দেখে আসি।

কিছুক্ষণ আগেই শামসুদ্দিন সাহেবের ঘুম ভেঙেছে। তিনি অবাক হয়ে রাহেলার দিকে তাকাচ্ছেন। একটু আগে ইতি যে চেয়ারটায় বসে ছিল এখন সেখানে অন্য একজন বসে আছে। যে বসে আছে সে দেখতে রাহেলার মতো, কিন্তু রাহেলা না। শামসুদ্দিন বললেন, কে? মেয়েটা তার কাছে ঝুঁকে এসে বলল, ভাইজান আমি রাহেলা।তোর রাগ কমেছে? রাহেলা বলল, হ্যাঁ কমেছে।রফিক কোথায়? ও পৃথুকে নিয়ে বাইরে বারান্দায় বসে আছে। ডাকব? ডাকতে হবে না। তোরা খামাখা কষ্ট করিস না তো। বাসায় গিয়ে আরাম করে ঘুমো। আমি ভালো আছি। সকালে আমাকে রিলিজ করে দেবে।রাহেলা বলল, ভাইজান, তুমি মোটেও ভালো নেই।

এই যে আমি তোমার বিছানার পাশের চেয়ারে বসেছি–তুমি পুরোপুরি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত আমি চেয়ার থেকে উঠব না।শামসুদ্দিন হেসে ফেললেন। রাহেলা বলল, ভাইজান, হেসো না। আমি কোনো হাসির কথা বলি নি।শামসুদ্দিন বললেন, আচ্ছা যা, হাসব না।রাহেলা চাপা গলায় বলল, তুমি আরাম করে ঘুমাও ভাইজান। তুমি আরাম করে ঘুমাও। আমি তোমার পাশ থেকে এক সেকেন্ডের জন্যেও নড়ব না।শামসুদ্দিন ঘুমিয়ে পড়লেন।হাসপাতালের বারান্দায় একটা বেঞ্চে পৃথু শুয়ে আছে। পৃথুর মাথা তার বাবার কোলে। যদিও বাবা হাত দিয়ে তাকে ধরে আছেন তারপরেও পৃথুর মনে হচ্ছে সে গড়িয়ে পড়ে যাবে। পৃথুর ঘুম আসছে না। তার প্রচণ্ড ক্ষিধে পেয়েছে।

বাবা বলেছিল হোটেল থেকে খাবার আনবে, শেষ পর্যন্ত আনে নি। বাসায় একটার পর একটা সমস্যা। বাবা ভুলে গেছে। এখন তাকে খাবারের কথা বলতে তার লজ্জা লাগছে।বাবা! কী রে ব্যাটা? মা সবচে বেশি কাকে পছন্দ করে বাবা? তোমাকে, আমাকে, না বড় মামাকে? তোর বড় মামাকে।তারপর? তারপর তোকে।আমি সেকেন্ড, তাই না বাবা? হ্যাঁ।আমার ফাস্ট হতে ইচ্ছা করে বাবা।ইচ্ছা করলেই ফাস্ট হওয়া যায় না। ফাস্ট হওয়া খুবই কঠিনরে ব্যাটা। আর কথা বলিস না, ঘুমো।পৃথু ঘুমুতে চেষ্টা করছে। রফিক তার গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।

পৃথু খুব মজার একটা স্বপ্ন দেখছে। বড়মামা হাঁচি কম্পিটিশনে নাম দিয়েছেন। তিনি সাদা রঙের জার্সি পরে বিশাল একটা মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে খুঁচি দিচ্ছেন। একজন সবুজ রঙের পোশাক পরা মহিলা রেফারি, হাতে স্টপওয়াচ নিয়ে হাঁচির সংখ্যা গুনছে–ওয়ান, টু, থ্রি, ফোর, ফাইভ। মাঠের চারদিকে শত শত মানুষ। তারা খুব হৈ চৈ করছে। হাত তালি দিচ্ছে। বড়মামা হাঁচি দিয়েই যাচ্ছেন। ছোট্ট একটা সমস্যা হয়েছে। হাঁচির কারণে বড়মামার নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে। তার সাদা রঙের জার্সি লাল হয়ে যাচ্ছে। রেফারি বাঁশি বাজাচ্ছে আর বলছে, হবে না, হবে না, ডিসকোয়ালিফাই…। রেফারির কথায় খুব হৈ চৈ শুরু হলো। তাদের হৈ চৈ-এ পৃথুর ঘুম ভেঙে গেল। পৃথু দেখল সে হাসপাতালের বারান্দায় কাঠের বেঞ্চিতে শুয়ে আছে। তার মাথার পাশে সবুজ পোশাক পরা অপরিচিত একটা মেয়ে। আশেপাশে বাবা বা মা কেউ নেই।সবুজ পোশাক পরা মেয়েটি বলল, তোমার নাম পৃথু?

পৃথু হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। মেয়েটি বলল, তোমার বড়মামার শরীর হঠাৎ করে খুব খারাপ করেছে। তোমার বাবা মা দুজনই তাকে নিয়ে ব্যস্ত। তুমি ভয় পেও না। আমি তোমার সঙ্গে আছি।পৃথু বলল, আমি ভয় পাচ্ছি না।সবুজ শাড়ি পরা মেয়েটি বলল, তুমি ভয় পাচ্ছি না জেনে আমার খুব ভালো লাগছে। সাহসী ছেলে আমার খুব পছন্দ।পৃথু বলল, তোমার নাম কী? সবুজ শাড়ি পরা মেয়েটি বলল, আমার নাম ইতি।পৃথু বলল, ইতি, আমার খুব ক্ষিধে পেয়েছে।বলতে গিয়ে লজ্জায় তার গলা ভেঙে গেল। চোখে সামান্য পানিও এসে গেল। ইতি পৃথুর হাত ধরে বলল, আমার সঙ্গে চল তো দেখি ক্যান্টিন খুলেছে কি-না।শামসুদ্দিনের নাক দিয়ে গলগল করে রক্ত পড়ছে। অল্প বয়স্ক ইন্টার্নি ডাক্তার অবাক হয়ে দৃশ্যটা দেখছে। তার ডাক্তারি জীবন অল্পদিনের। এ ধরনের রোগী সে আগে দেখে নি। শামসুদ্দিনের শরীর থর থর করে কাঁপছে।

জয়নাল দু হাতে তার কাধ ধরে আছে। দেয়ালে হেলান দিয়ে রাহেলা দাঁড়িয়ে আছে। রাহেলাও শামসুদ্দিনের মতো কাঁপছে। রাহেলার হাত ধরে রফিক দাঁড়িয়ে আছে। রফিক নিশ্চিত কিছুক্ষণের মধ্যেই রাহেলা মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। তখন তাকে ধরতে হবে।শামসুদ্দিনের জ্ঞান আছে। তিনি রফিকের দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট গলায় বললেন, রফিক, জয়নাল ছেলেটা আমেরিকা যাবার টিকিটের টাকা জোগাড় করতে পারছে না। আমার ড্রয়ারে তার টাকা আমি আলাদা করে রেখেছি। তুমি টাকাটা তাকে দিয়ে দিও।রফিক কিছু বলার আগেই জয়নাল বলল, চাচাজি আমি টাকা জোগাড় করেছি। আমার টিকিটের টাকা নিয়ে আপনি দুশ্চিন্তা করবেন না।শামসুদ্দিন বললেন, আমেরিকা থেকে তুমি আমার বোনের জন্যে খুব ভালো সেন্ট কিনে পাঠাবে। সে দামি সেন্ট খুব পছন্দ করে।মেডিকেল কলেজের প্রফেসর চলে এসেছেন। তার সঙ্গে দুজন ডাক্তার। শামসুদ্দিন সাহেবকে ওটিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

ওটির সামনে সবাই ভিড় করে আছে। শুধু জয়নাল সেখানে নেই। সে বেবিটেক্সি নিয়ে তার বাসায় চলে গেছে। বাসা থেকে সে পাসপোর্টটা নেবে। সেখান থেকে যাবে বাদামতলী। বাদামতলী থেকে একটা নৌকা ভাড়া করে সে যাবে বুড়িগঙ্গার মাঝখানে। মাঝ বুড়িগঙ্গায় সে আল্লাহকে বলবে–আল্লাহপাক, আমি আমার জীবনের সবচে প্রিয় জিনিসের বিনিময়ে চাচাজির জীবন ভিক্ষা চাইছি। আমার সারা জীবনের শখ আমেরিকা যাওয়া। আমি আমেরিকা যাব না। আল্লাহপাক, আমি পাসপোর্টটা বুড়িগঙ্গায় ফেলে দিচ্ছি।সকাল দশটার সময় সত্যি সত্যি মাঝ বুড়িগঙ্গায় জয়নাল তার পাসপোর্ট ফেলে দিল। শামসুদ্দিন সাহেব মারা গেলেন সকাল এগারোটায়। মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তার জ্ঞান ছিল। তিনি চারদিকে তাকিয়ে জয়নালকে খুঁজলেন। বিড়বিড় করে বললেন, পাগলাটা গেল কোথায়?

পরিশিষ্ট 

সতেরো বছর পরের কথা। এক মেঘলা দুপুরে জয়নাল নিউইয়র্কে জন,এফ. কেনেড়ি এয়ারপোর্টে নামল। তার সঙ্গে তার স্ত্রী, দুই পুত্র-কন্যা।জীবন তার মঙ্গলময় হাত দিয়ে জয়নালকে স্পর্শ করেছে। সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় সে অনেকদূর উঠে এসেছে।জয়নালের বড় মেয়ে শর্মি খুবই অবাক হয়ে বলল, মা দেখ তো কাণ্ড! বাবা কাঁদছে। শর্মির মা ইতি বলল, বাবার দিকে এইভাবে তাকিয়ে থেকো না। সে কাঁদছে কাঁদুক।এরকম করে কাঁদছে কেন মা? ইতি বলল, আমেরিকা আসা নিয়ে তোমার বাবার অনেক দুঃখময় স্মৃতি আছে। এই জন্যে কাঁদছে।জয়নালের ছোট ছেলে টগর বলল, আমেরিকা বেড়ানো শেষ হলে আমরা ইউরোপ যাব। বাবা বলেছিল নিয়ে যাবে।

সত্যি কি নিয়ে যাবে?ইতি বলল, তোমার বাবা যদি বলে থাকে নিয়ে যাবে তাহলে অবশ্যই নিয়ে যাবে।শর্মি বলল, বাবা কেমন হাউমাউ করে কাঁদছে। সবাই তাকাচ্ছে বাবার দিকে। আমার খুব লজ্জা লাগছে। মা, আমি কি বাবার কাছে যাব? ইতি বলল, না। তোমার বাবাকে একা কাঁদতে দাও। এসো আমরা দেখি আমাদের নিতে গাড়ি এসেছে কি-না।নিউইয়র্কে জয়নালের একটি ব্রাঞ্চ অফিস আছে। বড় সাহেব প্রথমবারের মতো আমেরিকা আসবেন এই খবর তারা পেয়েছে। তারা লিমোজিন নিয়ে এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করছে।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *