হুমায়ুন আহমদ এর শ্যামল ছায়া (পর্ব-৩)

সে বােধ হয় বহু দিন চা খায় নি। খাওয়া শেষে ভোঁস ভোঁস করে কেঁদে ফেলল। তাদের কাছে আমাদের একটিমাত্র জিজ্ঞাসা ছিলশিয়ালজানী খালে কোনাে নৌকা বাঁধা দেখেছে কিনা। আমাদের একটি দল সেখানে থাকার কথা। কিন্তু হরি পাল বা হরি পালের মাঝি, কেউই সেকথা বলতে পারল না।

শ্যামল ছায়াহাসান আলি নৌকা ছেড়ে দিল। কাচ কচি শব্দে দাঁড় পড়ছে। হরি পালদের নৌকাকে পেছনে ফেলে এগচ্ছি, হঠাৎ শুনলাম ইনিয়েবিনিয়ে সেনৌকা থেকে কে একটি মেয়ে কাঁদছে। হয়তাে তার স্বামী নিখোঁজ হয়েছে, হয়তাে তার ছেলেটিকে বেঁধে নিয়ে গেছে রাজাকাররা। নিস্তব্ধ দিগন্ত, বিস্তৃত জলরাশি, আকাশে পরিষ্কার চাঁদএ সবের সঙ্গে এই করুণ কান্না কিছুতেই মেলান যায় না। শুধু শুধু মন খারাপ হয়ে যায়| এগারটা বেজে গেছে। দুটোর আগে রামদিয়া পৌছান অসম্ভব বলেই মনে হচ্ছে। অবশ্যি তা নিয়ে কাউকে খুব চিন্তিতও মনে হচ্ছে না।

আনিস দেখি আরেকটা সিগারেট ধরিয়েছে। মজিদ লম্বা হয়ে শুয়ে পড়েছে। হাসান আলি নির্বিকার ভঙ্গিতে দাঁড় টানছে। আমি বললাম, হাসান আলি, দুটোর মধ্যে পৌছতে পারব তো?  হাসান আলি জবাব দিল না। বিশ্রী স্বভাব তার। কিছু জিজ্ঞেস করলে ভান করবে যেন শুনতে পায় নি। যখন মনে করবে জবাব দেওয়া প্রয়ােজন, তখনি জবাব দেবে, তার আগে নয়। আমি আবার বললাম, ‘কী মনে হয় হাসান আলি, দুটোর মধ্যে রামদিয়া পৌছব?” 

 কোনাে সাড়াশব্দ নেই। এই জাতীয় লোেক নিয়ে চলাফেরা করা মুশকিল। আমি তাে সহ্যও করতে পরি না। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় দিই রাইফেলের বাঁট দিয়ে মাথায় এক বাড়িহারামজাদা ছােটলােক। কিন্তু রাগ সামলাতে হয়। কারণ লােকটা দারুণ কাজের। এ অঞ্চলটা তার নখদর্পণে। নিকষ অন্ধকারে মাঝে মাঝে আমাদের এত সহজে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে গিয়েছে যে, মনে হয়েছে ব্যাটা বিড়ালের মতো অন্ধকারেও দেখতে পায়। খাটতে পারে যন্ত্রের মতাে।

শ্যামল ছায়া (পর্ব-৩)

সারা রাত নৌকা চালিয়ে কিছুমাত্র ক্লান্ত না হয়ে বিশত্রিশ মাইল হেটে মেরে দিতে পারে। আৰু ভাই হাসান আলির কথা উঠলেই বলতেন, ‘দি জায়েট।’ 

 কিন্তু এই এক দোষ, মুখ খুলবে না। কিছু জিজ্ঞেস করলে শূন্যদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে আবার নিজের কাজ করে যাবে। প্রথম প্রথম মনে হ’ত হয়তাে কানে কম শােনে। ও আল্লা, শেষে দেখি এক মাইল দূরের ঝিঝি পােকার ডাকটিও বুঝি তার কান এড়ায় না।

 কুড়ালখালির কাছে এক বার-আমাদের সমস্ত দলটি নৌকায় ব’সে। আবু ভাই সে-সময় বেঁচে। তিনি এক ন্যাংটো বাবার গল্প করছেন, আমরা সবাই হাে-হাে করে হাসছি। এমন সময় হাসান আলি বলল, লঞ্চ আসছে উঠেন সবাই পাড়ে উঠেন।’ 

আমরা কান পেতে আছি। কোথায় কীবাতাসের হুস হুস শব্দ ছাড়া কোনাে শব্দ নেই। আনিস বলল, ‘যত সব বােগাস। তারপর কী কী হল? আৰু ভাই বললেন, ‘গল্প পরে হবে, এখন উঠে পড় দেখি। হাসান আলি যখন শব্দ শুনেছে, তখন আর ভুল নেই।’ | সেবার সত্যি সত্যি দু’টি স্পীডবােট বাজারে এসে ভিড়েছিল। হাসান আলির কথা না শুনলে গােটা দলটা মারা পড়তাম। 

শ্যামল ছায়া (পর্ব-৩)

 আর অবশ্যি সে রকম মৃত্যুভয় নেইতবু কে আর বেঘােরে মরতে চায়? আমাদের মধ্যে মজিদের ভয়টাই বােধহয় সবচেয়ে বেশি। কোনাে অপারেশনে যাওয়ার আগে কুরআন্ শরীফ চুমু খাওয়া, নফল নামাজ পড়া, ডান পা আগে ফেলা–এক শ’ পদের ফুকরা। গলায় ছােটখাটো ঢােলের আকারের এক তাবিজ।কোন পীর সাহেবের দেওয়া, যা সঙ্গে থাকলে অপঘাতে মরবার বিন্দুমাত্র আশঙ্কাও নেই। ভাবলেই অসি পায়। 

রকম ছেলে দলে নেওয়া ঠিক নয়। এতে অন্যদের মনের বল কমে যায়। তবে হ্যাঁ, আমি এক শ’ বার স্বীকার করি, অপারেশন যখন শুরু হয় তখন মজিদের মাথা থাকে সবচেয়ে ঠাণ্ডা। এক তিল বেতাল নেই। আর এইম’ পেয়েছে কি, তিনটি ওলীর মধ্যে তার দুটি গুলী যে টার্গেটে লাগবে এ নিয়ে আমি হাজার টাকা বাজি রাখতে পারি। আমাদের ট্রেনিং দেওয়াতেন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সুবেদার সুরুজ মিয়া।

 

Read more

হুমায়ুন আহমদ এর শ্যামল ছায়া (পর্ব-৪)

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *