ইনসুলিন কী ?এর ব্যবহার ,প্রকারভেদ,সংরক্ষণের পদ্ধতি ও সতর্কতা

ইনসুলিন কীঃ

ইনসুলিন (Insulin) হলো অগ্ন্যাশয়ের প্রধান হরমোন । এটি এক ধরনের পলিপ্যাপটাইড, যা গ্লুকোজকে রক্ত থেকে কোষের মধ্যে প্রবেশ করা নিয়ন্ত্রন করে । ইনসুলিন অগ্ন্যাশয়ের ইনসুলিন নিঃসরণকারী কোষগুলো থেকে নিঃসৃত হয়।শরীরের পরিপাকব্যবস্থা গ্রহণকৃত খাবারে থাকা কার্বোহাইড্রেটকে ভেঙ্গে গ্লুকোজে পরিণত কমে । অগ্ন্যাশয়ে থাকা ইনসুলিন নামক হরমোন গ্লুকোজ শোষণ করতে সাহায্যে করে এবং দেহে কার্বোহাইড্রেট ও ফ্যাটের বিপাক পরিচালনা করে।ইনসুলিনটাইপ-১ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে , শরীর ইনসুলিন তৈরি করতে পারেনা । টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে, শরীর ইনসুলিন তৈরি করতে পারলেও তা কার্যকর ব্যবহার করতে পারে না । শরীরের ইনসুলিন ব্যতীত রক্তে শর্করা পৌঁছে দেয়ার আর কোনও উপায় নেই । 

 

ইনসুলিনের প্রকারভেদঃ

বিভিন্ন ধরনের ইনসুলিন রয়েছে । রোগীর জীবনযাপন ও ইনসুলিন ঘাটতির ওপর ভিত্তি করে চিকিৎসক পাঁচ রকম ইনসুলিনের যেকোনো একটি নেওয়ার পরামর্শ দিতে পারেন । যেমনঃ 

১. র‌্যাপিড অ্যাকটিং ইনসুলিনঃ এটি ১৫ মিনিটের মধ্য কাজ শুরু করে । এক ঘন্টার মধ্যে সর্বোচ্চ হয় এবং চার ঘন্টা পর্যন্ত কার্যকর থাকে 

২. শর্ট অ্যাকটিং ইনসুলিনঃ ৩০ মিনিটের মধ্যে রক্তপ্রবাহে পৌছে এটি । দুই – তিন ঘন্টার সর্বোচ্চ হয় এবং ৬ ঘন্টা পর্যন্ত কার্যকর থাকে । 

৩. ইন্টারমিডিয়েট অ্যাকটিং ইনসুলিনঃ এটি ২-৪ ঘন্টায় রক্তপ্রবাহে মিশে । ৪-১২ ঘন্টায় সর্বোচ্চ হয় এবং ১২-১৮ ঘন্টা পর্যন্ত কার্যকর থাকে । 

৪. লং অ্যাকটিং ইনসুলিনঃ এটি কয়েক ঘন্টার মধ্যেই কাজ করে এবং ২৪ ঘন্টারও বেশি সময় কার্যকর থাকে । 

৫. আল্ট্রা লং অ্যাকটিং ইনসুলিনঃ এটি ৬ ঘন্টার মধ্য রক্তপ্রবাহে পৌঁছে যায় এবং ৩৬ ঘন্টা পর্যন্ত কার্যকর থাকে । 

 

কাদের ইনসুলিন নেওয়ার প্রয়োজনঃ 

ইনসুলিন গ্রহণের নির্দিষ্ট কারণ ও নির্দেশনা রয়েছে । টাইপ-১ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে অগ্ন্যাশয় থেকে ইনসুলিন নিঃসরণ হয় না যার ফলে সবসময় ইনসুলিন নিতে হয় । টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে ইনসুলিন নিঃসরণ কম হয় বা ইনসুলিন ঠিকভাবে কাজ করতে পারে না । এক্ষেত্রে জীবনাচরণ পরিবর্তন ও নানা ধরণের ওষধেই নিয়ন্ত্রণ করা যায় । বিশেষ কিছু রোগীর ক্ষেত্রে ইনসুলিন নেওয়ার প্রয়োজন হয় । তারা হলেন – 

১. গর্ভাবস্থায় ও শিশুকে স্তন্যপান করানোর সময় সবচেয়ে নিরাপদ হচ্ছে ইনসুলিন । গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে এবং আগে থেকে জানা ডায়াবেটিসের রোগী মা হতে চাইলে সব ওষধ বন্ধ করে ইনসুলিন গ্রহন করতে হবে । 

২. ডায়াবেটিসের রোগীদের যেকোনো অস্ত্রোপাচার এর আগে ও পরে শর্করা নিয়ন্ত্রণ করা খুব জরুরি । এই পরিস্থিতিতে সাময়িক বা দীর্ঘমেয়াদী ইনসুলিন লাগতে পারে । 

৩. হার্ট অ্যাটাক,স্টোক,যক্ষ্মা,নিউমোনিয়া,ফোড়া,গ্যাংগ্রিন ইত্যাদি দ্রুত সেরে উঠতে ইনসুলিন সবচেয়ে নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য । 

৪. কিডনি ও যকৃতের জটিলতা থাকলে ইনসুলিন ব্যবহার করতে হয় । জন্ডিস হলে ওষুধ বন্ধ করে ইনসুলিন দিতে হতে পারে ।

৫. টাইপ-১ ডায়াবেটিসে ওষুধ কাজ করে না ইনসুলিন নির্ভর হয়ে বেঁচে থাকতে হয় । 

৬. ওষুধ সর্বোচ্চ মাত্রায় ব্যবহার করার পরও ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত থাকলে একে ওরাল হাইপোগ্লাইসেমিক এজেন্ট ফেইলিত্তর বলে । এ অবস্থায় ওষুধ আর কাজ করে না । তখন ইনসুলিন নেওয়ার প্রয়োজন হয় । 

৭. রক্তে শর্করা আকস্মিকভাবে অনেক বেড়ে গেলে হাসপাতালে ভর্তি করে স্যালাইনের মাধ্যমে ইনসুলিন দিতে হয় ।   

ইনসুলিন নেওয়ার আগে যা জানা দরকারঃ 

১. ইনসুলিন নিলে ওজন বেড়ে যায় । ইনসুলিন নেওয়া শুরু করলে ব্যায়াম বন্ধ করা যাবে না ।

২. ইনসুলিন নিলেও খাবার নিয়ন্ত্রন করা দরকার । খাবারের মধ্যে কম চর্বিযুক্ত খাবার রাখতে হবে । 

৩. বাড়িতে গ্লুকোমিটার রাখুন । প্রতিবার ইনসুলিন নেওয়ার আগে গ্লুকোমিটার মেপে নিন । 

৪. ইনসুলিন দেওয়ার ফলে অনেকসময় সুগার লেভেল কমে যায় । তখন লজেন্স চুষলে ভালো ফল পাওয়া        যায়। তাই বাড়িতে লজেন্স রাখুন । 

ইনসুলিন সংরক্ষণের পদ্ধতিঃ 

ইনসুলিনকে চরম তাপমাত্রায় বা চরম ঠান্ডায় রাখা হলে রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা কমে যায় । যত দীর্ঘসময় ঐ অবস্থায় থাকবে ইনসুলিন তত কার্যকর কম হবে । ইনসুলিন সংরক্ষণের আদর্শ শর্তাবলী গুলো হলোঃ –

১. না খোলা ইনসুলিন গুলো ফ্রিজে রাখা উচিত । 

২. একটি খোলা ভায়াল ২৮ দিনের জন্য ঘরের তাপমাত্রায় বা ফ্রিজে সংরক্ষণ  করা যেতে পারে। 

৩. ইনসুলিনের কার্ট্রিজ যেটি খোলা হয়েছে সেটি ঘরের তাপমাত্রায় রেখেও সংরক্ষণ করা যায় । সরাসরি সূর্যের আলো যাতে না লাগে এমন অবস্থায় কার্টিজ ৪ থেকে ৬ সপ্তাহ পর্যন্ত ঠিক থাকে । 

৪. বাড়িতে মাটির কোন পাত্র থাকলে তার মধ্যে ইনসুলিনের নতুন কার্টিজ সংরক্ষণ করা যেতে পারে । তবে কার্টিজের গলা পর্যন্ত পানি দিয়ে রাখা যাবেনা । কেননা কোন রকম লিকেজ থাকলে পানি ঢুকে যেতে পারে । 

৫. ডিপ ফ্রিজে ইনসুলিন রাখা যাবে না কেননা এটি জর্মে গিয়ে নষ্ট হয়ে যায় । 

৬. ভেজা কাপড়ে মুড়িয়ে ইনসুলিন কার্টিজ সংরক্ষণ করা যায় । 

ইনসুলিন ব্যবহারে সতর্কতাঃ  

১. ইনসুলিন পেন শেয়ার না করাঃ 

এটি শেয়ার করে ব্যবহারের ফলে হেপাটাইটিস বা HIV এর মতো রক্তবাহিত রোগ সংক্রমনের ঝুঁকি বাড়ায় । তাই শেয়ার করে ব্যবহার করাটা অনিরাপদ।

২. ভুল পদ্ধতিতে ইনসুলিন ইনজেকশনঃ 

ইনসুলিন পেশীর বেশি গভীরে প্রবেশ করানো হলে বেশি বেদনাদায়ক হয় । ইনজেকশন নেওয়ার স্থানগুলো হলো, নাভি থেকে চার আঙ্গুল দূরে, ঊরুর বাইরের অংশ, পাছা, নিতম্বের উপরের অংশ, কোমর এবং বাহুর বাইরের অংশ ।

৩. খুব বেশি মাত্রায় ইনসুলিন ইনজেকশনঃ

রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করার জন্য খুব বেশি মাত্রায় ইনসুলিন নেওয়ার ফলে রক্তে বেশি মাত্রায় ইনসুলিন থেকে যেতে পারে । ফলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা খুব কম হলে শরীর তার নিয়মিত ক্রিয়াগুলো চালানোর জন্য যথেষ্ট জ্বালানি পায় না । শরীর এতটা ক্ষুদার্ত হয়ে যায় যে তা কাজ করা বন্ধ করে দিতে থাকে । 

৪.মেয়াদ শেষ হওয়ার তারিখ পরীক্ষা করাঃ 

ইনসুলিন ব্যবহার করার আগে সবর্দা মেয়াদ শেষ হওয়ার তারিখ পরীক্ষা করতে হবে । মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়া ইনসুলিন ব্যবহার করা যাবে না । 

 

ইনসুলিন সম্বন্ধে কিছু কথা জেনে নিন

 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *