বহুব্রীহি পর্ব (৫)- হুমায়ূন আহমেদ

ডাক্তার সাহেব মাঝ সিড়ি থেকে বলের মত গড়িয়ে নীচে নামতে লাগলেনশব্দ শুনে সােবাহান সাহেব এবং মিনু বেরিয়ে এলেন, ফরিদ বেরিয়ে এল, বাসার কাজের ছেলে কাদের ছুটে এলবহুব্রীহি

সােবাহান সাহেব বললেন, কে? মিলি বলল, ডাক্তার সাহেবতােমার প্রেসার মাপতে এসেছেনপ্রেসার মাপতে এসে মাটিতে শুয়ে থাকার কারণ কি? পা পিছলে পড়ে গেছেন বাবাপা পিছলে পড়েছে টেনে তুলবি না? হা করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?” 

মিলিকে টেনে তুলতে হল না, মনসুর নিজেই উঠলসার্টের ধূলা ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, একদম ব্যথা পাইনিসত্যি বলছি। 

তার চারপাশের লােকজন মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগলসােবাহান সাহেব কি একটা বলতে গিয়েও বললেন নামনসুর বলল, এক গ্লাস ঠান্ডা পানি খাব! সোবাহান সাহেব বললেন

অবশ্যই খাবেমিলি একে নিয়ে ফ্যানের নীচে বসাকাদের এগিয়ে এসে বলল, আমারে ধইরা ধইরা হাঁটেন ডাক্তার সাবচিন্তার কিছুনাই, উপরে আল্লা নীচে মাড়ি| নীচে মাটি এমন কোন লক্ষণ মনসুর পাচ্ছে নাতার কাছে মনে হচ্ছে সে চোরাবালির উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেপা ডেবে ডেবে যাচ্ছেঘরটাও মনে হচ্ছে একটু একটু দুলছেকে যেন বলল, বাবা তুমি এখানে বস। 

বহুব্রীহি পর্ব (৫)- হুমায়ূন আহমেদ

কে বলল কথাটা? মহিলা না? ইনি বােধ হয় মিলির মাতাকে কি সালাম দেয়া হয়েছে? স্নামালিকুম বলা দরকার না? দেরী হয়ে গেছে বােধ হয়দেরী হলেও বলা দরকার। 

নিন পানি নিন। 

মনসুর পানি নিলনিয়েই ক্ষীণ স্বরে বলল, স্নামালিকুমবলেই বুঝল ভুল হয়ে গেছেকথা এমন জিনিস একবার বলা হয়ে গেলে ফিরিয়ে নেয়া যায় নামনসুর লক্ষ্য করল তার চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা লােকজন মুখ চাওয়া চাওয়ি করছেসে নিশ্চয়ই খুব উল্টা পাল্টা কিছু বলেছেটেনশনের সময় তার মাথা এলােমেলাে হয়ে যায়মনসুর অবস্থা স্বাভাবিক করবার জন্যে শব্দ করে হাসলঅবস্থা স্বাভাবিক হল না মনে হল আরাে খারাপ হয়ে গেল। 

ফরিদ বলল, ছােকরার মনে হয় ব্রেইণ ডিফেক্ট হয়ে গেছেকেমন করে হাসছে দেখুন না দুলাভাইঅবিকল পাগলের হাসিসােবাহান সাহেব বললেন, একজন ডাক্তারকে খবর দেয়া দরকার। 

ফরিদ বলল, ডাক্তার কিছু করতে পারবে বলেতাে মনে হচ্ছে নাআমার ধারণা ব্রেইণ হেমারেজহােয়াট পিটি, রকম ইয়াং এজ। 

আনিস অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করছে ভয়ংকর একটা রাগের ভঙ্গি করতে। যা দেখে তার আট বছরের ছেলে টগর আঁৎকে উঠবে এবং মুখ কাচুমাচু করে বলবে, আর করব না বাবাটগর ফা করেছে তাকে ক্ষমা করার কোন প্রশ্নই উঠে নাসে ফায়ার ব্রিগেড খেলা খেলছিলআগুন ছাড়া এরকম খেলা হয় না, কাজেই অনেক কষ্টে সে বিছানার চাদরে আগুণ ধরালতাকে সাহায্য করেছিল তার ছােট বােন নিশা যার বয়স পাঁচ হলেও এই জাতীয় কাজ খুব ভাল পারে

বহুব্রীহি পর্ব (৫)- হুমায়ূন আহমেদ

খেলার দুটি অংশ, প্রথম অংশে বিছানার চাদর এবং জানালার পর্দায় আগুন লেগে যাবে, নিশা তার খেলনা টেলিফোন কানে নিয়ে বলবে, হলাে, আমাদের বাসায় আগুন লেগে গেছেতখন শুরু হবে খেলার দ্বিতীয় অংশটগর সাজবে ফায়ার ম্যানবাথরুম থেকে নল দিয়ে সে পানি এনে চারদিকে হিটিয়ে স্যাল নেভাবেবেশ মজার খেলা। 

খেলার প্রথম অংশ ভালমত শুরু হবার আগেই ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেলতিন তলার ভাড়াটে ছুটে এলেনএকতলা থেকে বাড়িওয়ালা এলেন এবং ঘন ঘন বলতে লাগলেন, কি 

সর্বনাশ! কি সর্বনাশ

আনিস গিয়েছিল বাড়ির খোঁজেবাড়িওয়ালা নােটিশ দিয়েছেগত মাসেই বাড়ি ছাড়ার কথাএখনাে কিছু পাওয়া যায়নি বলে বাড়ি ছাড়া যাচ্ছে নাবাড়িওয়ালার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে এবার তিনি আর মুখের কথা বলে সময় নষ্ট করবেন নাপাড়ার ছেলেপুলে দিয়ে তুলে দেবেনগত সপ্তাহে খুব ভদ্র ভাষায় জাতীয় ইংগীত দেয়া হয়েছে। 

সারাদিন বাড়ি খুঁজে ক্লান্ত বিরক্ত হয়ে বাসায় ফিরে টগর এবং নিশার নতুন কীর্তি শােনার পর মেজাজ ঠিক থাকার কথা নয়আনিসের মেজাজ যথেষ্টই খারাপ, কিন্তু তা সে ঠিক প্রকাশ করতে পারছে নাটগরের গালে একটা চড় বসিয়ে দেয়া খুবই প্রয়ােজন, হাত উঠছে নাবাচ্চা দুটির মা এক বছর আগে মারা গেছেমা নেই দুটি শিশুর উপর রাগ করা কিংবা তাদের শাসন করা বেশ কঠিন ব্যাপারআনিসের বেলায় তা আরাে কঠিন কারণ রাগ তার স্বভাবে নেইসে এক দৃষ্টিতে টগরের দিকে তাকিয়ে আছেটগর খানিকটা অস্বস্তি বােধ করছে তবে খুব ঘাবড়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে না। 

বহুব্রীহি পর্ব (৫)- হুমায়ূন আহমেদ

টগরজি বাবাটগর যা করে নিশার ঠিক সেই জিনিসটিই করা চাই, কাজেই সেও বলল, জ্বি বাবা। 

আনিস বলল, নিশা মা, তুমি এখন কোন কথা বলবে নাটগরের সঙ্গে আমার খুব জরুরী কথা আছেওকে আমি যা বলব তা খুব মন দিয়ে শুনবে। 

টগরজি বাবাঘরে আগুন লাগিয়েছিলে?নাতােবিছানার চাদরে লাগিয়েছিলামআর নিশাকে বলেছিলাম জানালার পর্দায় লাগাতেকি জন্যে? আমরা ফায়ার সার্ভিস ফায়ার সার্ভিস খেলছিলাম! খেলতে আগুন লাগে? অন্য খেলায় লাগে নাফায়ার সার্ভিস খেলায় লাগেআগুন না লাগলে নেভাব কি করে? আমি খুব রাগ করেছি টগরএত রাগ করেছি যে আমার গা কাপছে রাগেকই বাবা, গা তে কাঁপছে না। 

তােমরা দুজন খুবই অবাধ্য হয়েছআমার কোন কথা তোমরা শােন নারােজ অন্তত অদ্ভুত সব খেলা খেলদুদিন আগে দোতলার ছাদ থেকে লাফ দিয়ে নীচে পড়লে। 

দোতলার ছাদ থেকে তাে লাফ দেই নিগ্যারাজের উপর থেকে লাফ দিয়েছিনীচে বালি ছিলএকটুও ব্যথা পাইনিবালি না থাকলে লাফ দিল্লাম না। 

তােমাদের কখনাে আমি কোন শাস্তি দেই না বলে এই অবস্থা হয়েছেআজ তােমাদের শাস্তি দেব‘ 

তুমি নিজেই ঠিক কর কি শাস্তিআমি কিছু বলব না। 

এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকব বাবা? বেশ দাঁড়াও। 

টগর এবং নিশা দুজনই উঠে এক পায়ে দাঁড়িয়ে গেলদেখা গেল শাস্তি গ্রহণে দুজনেরই সমান আগ্রহএই শাস্তিতে তারা বেশ মজা পাচ্ছে বলেও মনে হলমিটিমিটি হাসছে 

টগর! জ্বি বাবা

একটা কথা তােমাদের সব সময় মনে রাখতে হবেকথাটা হচ্ছে– 

আনিস তার দীর্ঘ বাক্য শেষ করতে পারল না, বাড়িওয়ালার ভাগ্নে এসে বলল, আপনাকে মামা ডাকেআনিস দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালবাড়িওয়ালার সঙ্গে বকবক করতে তার মােটেই ইচ্ছা করছে নাউপায় নেই, ইচ্ছা না করলেও বকবক করতে হবে। 

বহুব্রীহি পর্ব (৫)- হুমায়ূন আহমেদ

আনিসের বাড়িওয়ালার নাম মীজা সুলায়মানভাড়াটেদের সঙ্গে তার সম্পর্ক ভালশুধু ভাল না, বেশ ভালসুলায়মান সাহেবের ব্যবহার অতি মধুরহাসি হাসি মূখ না করে তিনি কোন কথা বলেন নাভাড়াটেদের যখন ডেকে পাঠান তখন বসার ঘরের টেবিলে নানান ধরনের খাবার দাবার তৈরী থাকে| আনিস বাড়িওয়ালার বসার ঘরে ঢুকে দেখল টেবিলে ঠান্ডা পেপসির গ্লাস, প্লেটে ফুট কেকসুলায়মান সাহেবের বয়স ষাটের কাছাকাছি হলেও তিনি তার সব ভাড়াটেদের ডাকেনবড় ভাইকেউ এই নিয়ে কিছু বললে তিনি বলেন, এটা হচ্ছে আমার দস্তুরআমার পিতাজীর কাছ থেকে শিখেছিপিতাজী সবাইকেই বড় ভাই ডাকতেন। 

সুলায়মান সাহেব তার দস্তুর মত আনিসকে দেখে হাসি হাসি মুখ করে বললেন, বড় ভাই সাহেব আছেন কেমন

জ্বি ভাল‘ 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *