সাজঘর (পর্ব-১০): হুমায়ূন আহমেদ

দুটোর মধ্যে একটাহিট করলকারাের হাসি আর থামতেই চাচ্ছে নাএই দলটিকে দেখলে কে বলবে এদের জীবনে কোনাে দুঃখকষ্ট আছে? এদের দেখে মনে হচ্ছে গভীর আনন্দে এদের হৃদয় পরিপূর্ণ

সাজঘররিহার্সেলের ঘরে এরা যখন ঢােকে জীবনের সমস্ত হতাশা বঞ্চনা পেছনে ফেলে ঢােকেনাটক তাদের দ্বিতীয় জীবনএই জীবনটাকেই তারা আঁকড়ে ধরেদ্বিতীয় জীবনই এক এক সময় প্রধান হয়ে দাঁড়ায়। 

তৃতীয় দৃশ্য শুরু হল। এটিও রাতের দৃশ্যলেখক শােবার ঘরেবিছানায় বসেআছেন। পাশেই তাঁর স্ত্রীকুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমুচ্ছেলেখক লিখে যাচ্ছেনহঠাৎ একটা শব্দ হললেখক চমকে তাকালেনঘরের মধ্যে কে যেন দাঁড়িয়েযে দাঁড়িয়ে, তার চেহারা ভালাে নাসে কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে আছেমুখে খোঁচা খোঁচা দাড়িচোখের দৃষ্টি নিষ্প্রভতার নাম ছলিমুদ্দিনছলিমুদ্দিনের ভূমিকায় অভিনয় করছেন প্রণব বাবু। 

লেখক অবাক হয়ে ছলিমুদ্দিনকে দেখছেনচিনতে পারছেন নাএই গভীর রাতে শােবার ঘরে লােকটা কোথেকে এল বুঝতে পারছেন নাতিনি খানিকটা ভীত। 

লেখক : কে কে কে? ছলিমুদ্দিন : আস্তেচেঁচাবেন নাআপনার স্ত্রী জেগে উঠতে পারেনলেখক : কে কে? আপনি কে

সাজঘর হুমায়ূন আহমেদ

ছলিমুদ্দিন : চিনতে পারছেন না? কি অদ্ভুত কথানিজের সৃষ্টি করা চরিত্র নিজেই চিনতে পারছেন নাভালাে করে তাকিয়ে দেখুন, জীবন যুদ্ধে পরাজিত, ক্লান্ত শ্রান্ত একজন মানুষ, আজ সারাদিন যার খাওয়া হয় নিযার প্রেমিকা অন্য এক পুরুষের হাত ধরে...

লেখক : আচ্ছা, আপনি ছলিমুদ্দিন। 

ছলিমুদ্দিন : হ্যা ছলিমুদ্দিনআপনি আমার জন্যে একটা ভালাে নাম পর্যন্ত খুঁজে পান নিনাম দিয়েছেন ছলিমুদ্দিনসুন্দর, শােভন, আনন্দদায়ক কিছুই আপনি আমার জন্যে রাখেন নিএকটি ভালাে নাম কি আমার হতে পারত না

লেখক : না, পারত নাআপনার জন্ম হয়েছে কৃষক পরিবারেআপনার বাবা একজন বর্গাদারসে তার পুত্রদের রকম নামই রাখবে। একজন কৃষক তার পুত্রের নাম নিশ্চয়ই আবরার চৌধুরী রাখবে না। 

ছলিমুদ্দিন : আপনি ইচ্ছা করলে সবই সম্ভবকলম আপনার হাতে। আপনি 

ইচ্ছা করলেই কোর্টে এফিডেভিট করে আমার নাম পাল্টে আবরার চৌধুরী করতে পারেনআপনি ইচ্ছা করলেই বিদেশি কোনাে কোম্পানিতে আমার চমৎকার একটা চাকরি হতে পারেছলিমুদ্দিন নামটা যদি আপনার এতই প্রিয় হয়, বেশ ভাে আপনার ড্রাইভারের ঐ নাম দিয়ে দিন। 

সাজঘর হুমায়ূন আহমেদ

লেখক : তা সম্ভব নয়| ছলিমুদ্দিন ; কেন সম্ভব নয়? একের পর এক আপনার কারণে আমি জীবন যুদ্ধে পরাজিত হচ্ছিকেন আপনি রকম করছেন? লেখক : রকম করছি কারণ, তােমার মাধ্যমে আমি সমাজকে তুলে আনছিতুমি আলাদা কেউ নওতুমি এই সমাজেরই একজন প্রতিনিধিতােমাকে দেখে পাঠক চমকে উঠবেঘা খাবে। 

ছলিমুদ্দিন : আপনি আমাকে তুমি করে বলছেন কেন? নিজের লেখা পড়ে দেখুন, বয়সে আমি আপনার চেয়ে বড়জীবনে তাে আপনি আমাকে কিছুই দেন নি। সামান্য সম্মানটুকু অন্তত দিন। 

লেখক : আমার ভুল হয়েছে। ক্ষমা করবেনএখন থেকে আপনি করে বলব। 

ছলিমুদ্দিন : ধন্যবাদ, আপনাকে যতটা হৃদয়হীন মনে করেছিলাম তত হৃদয়হীন আপনি ননএটাই যখন করলেন তখন আরেকটু করুনআমার প্রেমিকাকে আপনি ফিরিয়ে দিনঅর্থ বিত্ত, কিছুই চাই নাআমি পথেপথে না খেয়ে ঘুরতে রাজি আছিআপনি শুধু আমার প্রেমিকাকে ফেরত দিন। 

লেখক : তা হয় না। 

ছলিমুদ্দিন : অবশ্যই হয়আপনি নিজে তাে আপনার স্ত্রীকে পাশে নিয়ে আরাম করে বসে আছেনআমি কেন বসব না? সমাজ দোষ করতে পারে, রাষ্ট্র দোষ করতে পারেআমি তাে কোনাে দোষ করি নিআমি কেন শাস্তি পাব

সাজঘর হুমায়ূন আহমেদ

লেখক : এই পচা সমাজে নির্দোষ যারা, তারাই শাস্তি পায়। 

ছলিমুদ্দিন : সমাজ করুকআপনি কেন করবেন? আপনি মানবপ্রেমিক জন লেখকআপনি আমার প্রতি করুণা করুনআপনি শেষের কুড়িটা পাতা ছিড়ে ফেলুনআবার নতুন করে লিখুনএর মধ্যে আমি আপনার জন্যে চা বানিয়ে নিয়ে আসছি। 

লেখক : আপনাকে হাত জোড় করে অনুরােধ করছি, আপনি ঘর থেকে যানছলিমুদ্দিন : না, আমি যাব নালেখক : যাবেন না মানে? ছলিমুদ্দিন : মানে হচ্ছে, যাব নাপ্রয়ােজন হলে আপনাকে খুন করবলেখক; খুন করবেন। 

ছলিমুদ্দিন : হাঅস্ত্র নিয়ে এসেছিএই দেখুনএগার ইঞ্চি ছােরাএটা সােজা আপনার পেটে বসিয়ে দেবআমি কেন আত্মহত্যা করব? আমার কি দায় পড়েছে

লেখক : {ভয় পেয়ে) জরী, জরী, একটু ওঠ তােএই জরী। 

নাটক এক পর্যায়ে থেমে গেলবজলু সাহেব ফিরে এসেছেনপুষ্প তার সঙ্গে আছেপুষ্পের চোখ মুখ আনন্দে ঝলমল করছেবজলু সাহেব অতিরিক্ত গম্ভীর। তিনি বিরক্ত গলায় বললেন, এই মজনু, চা দেআসিফ স্টেজ থেকে নেমে এলবজলু 

তাকে নিয়ে বাইরের বারান্দায় চলে গেলেনতিক্ত গলায় বললেন, অপমানের চুড়ান্ত হয়েছিশালার নাটকফাটক ছেড়ে দেব‘ 

আসিফ বলল, মেয়েকে তাে নিয়েই এসেছেন দেখতে পাচ্ছি। 

সাজঘর হুমায়ূন আহমেদ

ভেতরের ঘটনা জানলে এটা বলতে নাআমি নাটকের কথাটা বলতেই বাড়িতে আগুন ধরে গেলসবাই এমন ভাব করতে লাগল, যেন আমি একজন মেয়ের দালালবুড়ােমতাে এক লােক, সম্ভবত মেয়ের চাচাটাচা কিছু হবে, সরু গলায় বলছে, এটা ভদ্রলােকের বাড়িএটা ভদ্রলােকের বাড়িরাগে আমার গা জ্বলে গেলবাটা বলে কী? আমি কি অভদ্রলােক নাকি

রাজি করালেন কী ভাবে

আমাকে কিছু করতে হয় নি, মেয়ে নিজেই উল্টে গেল। সে নাটক করবেইকান্নাকাটি করে বিশ্রী এক কাণ্ড, এমন অবস্থা যে চলেও আসতে পারি নাবসেও থাকতে পারি নাব্যাঙের সাপ গেলার মতাে অবস্থাএরকম সুপার ইমােশনাল মেয়ে নিয়ে কাজ করা যাবে নাশুধু শুধু পরিশ্রম। 

আসিফ বলল, আমি মেয়েটার সঙ্গে খানিকক্ষণ কথা বলিতারপর নম্বর দৃশ্যটা হােকবাড়তি লােক চলে যেতে বলুনমেয়েটা পারবে কী পারবে না আজই বােঝা যাবে। 

তােমার মনে হয় পারবে? হা পারবেভালােই পারবে‘ 

আসিফ পুষ্পকে বলল, এস আমরা কোণার দিকে গিয়ে বসে কিছুক্ষণ গল্পগুজব করিগল্পগুজব করলে টেনশান কমবেঅভিনয় করা সহজ হবে

সাজঘর হুমায়ূন আহমেদ

 আমার মধ্যে কোনাে টেনশান নেই। 

আছেযথেষ্ট আছেটেনশানের সময় মানুষ খুব উঁচু পর্দায় কথা বলে; তুমিও তাই বলছএস আমার সঙ্গে। 

পুষ্প এগিয়ে গেলআসিফ বলল, চা খাবে? পুষ্প বলল, না‘ 

একটু খাওচা খাবার সময় মানুষ একটা কাজের মধ্যে থাকেকাজের মধ্যে থাকলে আপনাআপনি মানুষ খানিকটা ফ্রি হয়ে যায়তখন কথাবার্তা সহজ হয়। 

এত কিছু আপনি জানেন কী ভাবে? ‘রাতদিন তাে এটা নিয়েই ভাবিকাজেই কিছু কিছু জানি। পুষ্প চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল, আপনার কি মনে হয় আমি পারব

অবশ্যই পারবেযারা অভিনয় করে না, তারা মনে করে অভিনয় ব্যাপারটা বুঝি খুবই কঠিনআসলে তা নাঅভিনয় খুবই সহজ। 

আপনি আমাকে সাহস দেয়ার জন্যে এটা বলছেন।’ 

মােটেই নাতােমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছিমনে কর তুমি এক জনের চরিত্রে অভিনয় করছঅভিনয়ের অংশটা হচ্ছে প্রিয়জনের মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর তােমার রিএ্যাকশান। এখন দেখ এই অভিনয়ের কোনাে সেট প্যাটার্ন নেই। পৃথিবীতে অসংখ্য ধরনের মানুষএকেক জন মানুষ মৃত্যুর খবর একেকভাবে নেবেএর যে কোনাে একটা করলেই হলতুমি গড়াগড়ি করে কাঁদলেও ঠিক আছে, আবার স্তব্ধ হয়ে 

গেলেও ঠিক আছে। 

এত সােজা

হ্যা, এই অংশটা সােজাতবে সবচে কঠিন কাজ হচ্ছে,

একবার একটা প্যাটার্ন নিয়ে নিলে গােটা নাটকে তা বজায় রাখতে হবেবুঝতে পারছ

পারছি। 

এই নাটকে তুমি বালিকা বধূর চরিত্রে অভিনয় করছ। ঐ চরিত্রের একটা প্যাটার্ন তােমাকে তৈরি করতে হবেকোনটা তুমি নেবে? সবচে সহজটা নাও, যেটা তুমি জান‘ 

কোনটা আমি জানি

সাজঘর হুমায়ূন আহমেদ

তােমার নিজের চরিত্র ভূমি জানচরিত্রটাই তুমি স্টেজে নিয়ে আসবেমঞ্চে তুমি দেখবে তােমার স্বামীকেএই স্বামী কিন্তু মিথ্যা স্বামী নামঞ্চে সে তােমার সত্যিকার স্বামীএটা যখন তােমার মনে হবে তখনই তুমি পাশ করে গেলে। 

আমার ভয় ভয় লাগছে। 

কোনাে ভয় নেইতুমি সংলাপগুলাে একটু দেখে নিয়ে মঞ্চে যাও, আমি তােমার ভয় কাটিয়ে দিচ্ছি। 

জি আচ্ছা। 

পুষ্প, আরেকটা কথা তােমাকে বলি শােন, এটাও খুব জরুরি

(চলবে)

সাজঘর (পর্ব-৯): হুমায়ূন আহমেদ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *