অচিনপুর পর্ব (১১)- হুমায়ূন আহমেদ

কিন্তু তিনি নিজের চারদিকে একটি দেয়াল তুলে দিয়েছিলেনএই দেয়াল ভেদ করে তাঁর নৈকট্য লাভের উপায় নেইনিজের সৃষ্ট জগতেই তিনি ডুবে আছেনবাইরের প্রতি একটুও খেয়াল নেইইচ্ছে হল তাে চলে গেলেন পুকুরপাড়ে, একা বেড়াতে গেলেন বাগানেসব দেখেশুনে কেন জানি না আমার একটা ধারণা হয়েছিল, সফুরা খালা। 

অচিনপুর

বড়াে রকমের দুঃখ পাবে জীবনেরকম মনে করবার কোনাে কারণ লি নাকিন্তু আমার মনে হত, একেই হয়তাে intuition বলে

পরবর্তী জীবনে দেখেছি আমার ধারণা অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেছেদুঃখ এসেছে এবং অত্যন্ত সহজভাবে জীবনের প্রাত্যহিক ঘটনার মতাে দুঃখকে তিনিগ্রহণ করেছেনএই মেয়ের গল্প আমি অন্য কোথাও বলব, আজ শুধু হাসানআলির কথাটাই বলি। 

হাসান আলি বাজারে কিসের যেন ঠিকাদারী করতছাব্বিশসাতাশ বৎসর বয়সভীষণ গরিবনানাজানদের কী রকম যেন আত্মীয়থাকত নানাজানদের বাংলাঘরেবাড়ির বহির্মহলে অতিথিঅভ্যাগতের জন্যে নির্মিত ঘরকেই বাংলাঘর বলা হত। 

অচিনপুর পর্ব (১১)- হুমায়ূন আহমেদ

অত্যন্ত নিরীহ ধরনের ছেলেযতক্ষণ ঘরে থাকত, ততক্ষণ বসে বসে হিসাবপত্র করতআমরা সেসময় তার ঘরে হাজির হলে বিনা কারণে আৎকে উঠততার পরই সহজ হওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে চোখমুখ লাল করে এক বিশ্রীকাণ্ড! প্রতি হাটবার দিন দেখতাম, সে অল্প কিছু মিষ্টি কিনে এনেছেমিষ্টি আনা হয়েছে নানাজানের বাড়ির মানুষদের জন্যেই, কিন্তু দেওয়ার সাহস নেইঅনেক রাতে কাউকে ডেকে হয়তাে ফিসফিস করে বলল, একটু মিষ্টি এনেছিলামবাড়ির প্রায় মানুষই তখন ঘুমে। 

সফুরা খালা এক দিন বললেন, রঞ্জু, হাসান আলি বলে একটা লােক নাকি থাকে বাইরের ঘরে

আমি বললাম, হ্যা, আপনি জানলেন কী করে?‘ 

আল্লা, মজার ব্যাপার হয়েছেপরশুদিন দীঘির পাড়ে একা একা গিয়েছি, দেখি কেএকজন লােক চুপচাপ বসে আছেআমি বললাম, কে ওখানে? লােকটা বললআমার নাম হাসান আলি, আমি আপনাদের বাংলাঘরে থাকিআমি তখন ভাবলাম ফিরে যাইলােকটা বললএত রাতে আপনি একা একা আসেন কেন? কত সাপখােপ আছেআমি বললামআপনি তাে আসছেন, আপনার সাপের ভয় নাই? লােকটা তখন কী বলল জান রজু?” 

বলল, আপনি বড়াে ভালাে মেয়েএই বলেই হনহন করে চলে গেলেকী কাণ্ড দেখেছ

এর কিছুদিন পরই শুনলাম হাসান আলি নানাজানের কাছে তাঁর ছােট মেয়েটিকে বিয়ে করবার প্রস্তাব করেছেনানাজান তাে রেগেই আগুনবাড়িতে হাসাহাসির ধুম পড়ে গেলসফুরা খালা শুধু বলেন, আহা, বেচারা গরিব বলে কি ।

অচিনপুর পর্ব (১১)- হুমায়ূন আহমেদ

সবাই রকম করবে! ছিঃ! লাল মামী কথা শুনে বললেন, আমাদের সফুরার ভাতারকে নিয়ে কেউ তামাশা করবে নাখবরদার, সফুরা মনে কষ্ট পায়নানিজান 

লাল মামীর কথা শুনে রেগে যান, চেচিয়ে বলেন, একি কথা বলার ঢং বউ! ব্যাপারটা এখানেই শেষ হল না, নানাজান হাসান আলিকে এখানকার বাস উঠিয়ে চলে যেতে বললেনশরৎকালের এক সকালে নৌকা করে হাসান আলি চলে গেলদুটি ট্রাঙ্কের উপর বিবর্ণ সতরঞ্চিতে ঢাকা একটি বিছানাতার পাশে মুখ নিচু করে বসা হাসান আলি। 

সফুরা খালএর পর থেকেই অস্থির হয়ে পড়লেনমুখে শুধু এক বুলি, বিনা দোষে কষ্ট পেল লােকটানবু মামা অনেক পরে এ ঘটনা শুনে বলেছিলেন, আমি থাকলে দিতাম শালার ঘাড়ে গদাম করে এক ঘুষিসফুরা খালা বিষন্ন কণ্ঠে বলেছেন, ছিঃ নবু ছিঃ। 

অচিনপুরের গল্প লিখতে লিখতে গভীর বিষাদে মন আচ্ছন্ন হয়ে আসছেঅনুভব করছি সুখ এবং দুঃখ আসলে একই জিনিসসময়ের সঙ্গে সঙ্গে সুখ বদলে গিয়ে দুঃখ হয়ে যায়দুঃখ হয় সুখজীবনের প্রবল দুঃখ বেদনার ঘটনাগুলি মনে পড়লে আজ আমার ভালাে লাগেপ্রাচীন সুখের স্মৃতিতে বুক বেদনায় ভারাক্রান্ত য়। 

অচিনপুর পর্ব (১১)- হুমায়ূন আহমেদ

হাসনার কোলে তিন মাস বয়সের যেশিশুটি সংসারে প্রবেশ করেছিল, তার ভূমিকা তাে যুক্তিসঙ্গত কারণেই তৃতীয় পুরুষের ভুমিকা হবেতার উপস্থিতি হবে ছায়ার মতােসরফরাজ খানের এই পরিবারটির সুখদুঃখ তাকে স্পর্শ করবে

কিন্তু আমি তাদের জীবনের সঙ্গে কত ঘনিষ্ঠভাবেই না জড়িয়ে পড়লামবাদশা মামার মলিন চেহারা দেখলে আমার মন কাঁদেসফুরা খালা যখন হেসে হেসে বলেন, রঞ্জু, আমার খুব ইচ্ছে এক দিন অনেক রাত্রে পুকুরে একা একা সাঁতার কেটে গােসল করিপুকুরঘাটে তুমি আমার জন্যে একটুখানি দাঁড়াবে রঞ্জু ? কেউ যেন জানতে না পারেতখন সফুরা খালার জন্যে আমার গাঢ় মমতা বােধ হয়অথচ আমি নিশ্চিত জানি এক দিন লিলির চিঠি আসবেআমি এদের সবাইকে পিছনে ফেলে চলে যাব। 

হালিম শেখের সঙ্গে পরপর দুটি মামলাতে নানাজানের হার হলএত দিন যে জমিতে নানাজানের দখলিস ছিল, হালিম শেখের লােকজন লাল নিশান উড়িয়ে ঢােল আর কাঁসর ঘন্টা বাজাতে বাজাতে সেজমির দখল নিলগ্রামের লােকজনকে গরু জবাই করে খাওয়াল হালিম শেখ। 

জমির পরিমাণ তেমন কিছু নয়অর্থব্যয়ও হয়েছে সামান্যনানাজানের মতাে 

লােকের কাছে সেটাকা কিছুই নয়কিন্তু তিনি ভেঙে পড়লেনগো | মতউঠোনে বসে কোরানপাঠ করতে বসেন নানিজের ঘরে চুপচাপ বসে থাকেনঅত্যন্ত অল্প সময়ের ভেতর স্বাস্থ্য ভেঙে গেলখাওয়া কমে গেল। রাতে ঘুমুতে পারেন নাউঠোনে অনেক রাত পর্যন্ত চেয়ার পেতে বসে থাকেননানিজান মাথায় হাওয়া করেন, পায়ে তেল মালিশ করে দেন। 

অচিনপুর পর্ব (১১)- হুমায়ূন আহমেদ

দিন সাতেক পর নানাজান ঘােষণা করলেন, তিনি বেশি দিন বাঁচবেন নাসম্পত্তির বিলিবন্দোবস্ত করতে চাননবু মামার কাছে চিঠি গেল, তিনি যেন পত্রপাঠ চলে আসেন, পড়াশােনার আর প্রয়ােজন নেইলােক পাঠিয়ে দামী কাফনের কাপড় কেনালেনকবরের জন্য জায়গা ঠিক করা হলকবর পাকা করবার জন্য ইট আনান হল। মৌলানা ডাকিয়ে তওবা করলেনবাড়ির সবাই নিঃশব্দ মৃত্যুর প্রস্তুতি দেখতে লাগলঠিক এই সময় ভাে নানিজান মারা গেলেন। 

মােহরের মা রােজ সকালে দুধ নিয়ে যায় নানিজানের ঘরে! সেদিন কী কারণে যেন দেরি হয়েছেদুপুরের দিকে বাটিভর্তি দুধ নিয়ে গিয়েছেঘরে ঢুকেই বিকট চিৎকারমৃত্যু এসেছে নিঃশব্দেকেউ জানতেও পারে নি, কখন কীভাবে মারা 

গেলেন। 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *