কিন্তু তিনি নিজের চারদিকে একটি দেয়াল তুলে দিয়েছিলেন। এই দেয়াল ভেদ করে তাঁর নৈকট্য লাভের উপায় নেই। নিজের সৃষ্ট জগতেই তিনি ডুবে আছেন। বাইরের প্রতি একটুও খেয়াল নেই। ইচ্ছে হল তাে চলে গেলেন পুকুরপাড়ে, একা বেড়াতে গেলেন বাগানে। এ–সব দেখেশুনে কেন জানি না আমার একটা ধারণা হয়েছিল, সফুরা খালা।
বড়াে রকমের দুঃখ পাবে জীবনে। এ–রকম মনে করবার কোনাে কারণ লি না। কিন্তু আমার মনে হত, একেই হয়তাে intuition বলে।
পরবর্তী জীবনে দেখেছি আমার ধারণা অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেছে। দুঃখ এসেছে এবং অত্যন্ত সহজভাবে জীবনের প্রাত্যহিক ঘটনার মতাে দুঃখকে তিনি। গ্রহণ করেছেন। এই মেয়ের গল্প আমি অন্য কোথাও বলব, আজ শুধু হাসান। আলির কথাটাই বলি।
হাসান আলি বাজারে কিসের যেন ঠিকাদারী করত। ছাব্বিশ–সাতাশ বৎসর বয়স। ভীষণ গরিব। নানাজানদের কী রকম যেন আত্মীয়। থাকত নানাজানদের বাংলাঘরে। বাড়ির বহির্মহলে অতিথিঅভ্যাগতের জন্যে নির্মিত ঘরকেই বাংলাঘর বলা হত।
অচিনপুর পর্ব (১১)- হুমায়ূন আহমেদ
অত্যন্ত নিরীহ ধরনের ছেলে। যতক্ষণ ঘরে থাকত, ততক্ষণ বসে বসে হিসাবপত্র করত। আমরা সে–সময় তার ঘরে হাজির হলে বিনা কারণে আৎকে উঠত। তার পরই সহজ হওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে চোখ–মুখ লাল করে এক বিশ্রী। কাণ্ড! প্রতি হাটবার দিন দেখতাম, সে অল্প কিছু মিষ্টি কিনে এনেছে। মিষ্টি আনা হয়েছে নানাজানের বাড়ির মানুষদের জন্যেই, কিন্তু দেওয়ার সাহস নেই। অনেক রাতে কাউকে ডেকে হয়তাে ফিসফিস করে বলল, ‘একটু মিষ্টি এনেছিলাম। বাড়ির প্রায় মানুষই তখন ঘুমে।
সফুরা খালা এক দিন বললেন, ‘ও রঞ্জু, হাসান আলি বলে একটা লােক নাকি থাকে বাইরের ঘরে?
আমি বললাম, হ্যা, আপনি জানলেন কী করে?‘
ও আল্লা, মজার ব্যাপার হয়েছে। পরশুদিন দীঘির পাড়ে একা একা গিয়েছি, দেখি কে–একজন লােক চুপচাপ বসে আছে। আমি বললাম, ‘কে ওখানে? লােকটা বলল––আমার নাম হাসান আলি, আমি আপনাদের বাংলাঘরে থাকি। আমি তখন ভাবলাম ফিরে যাই। লােকটা বলল––এত রাতে আপনি একা একা আসেন কেন? কত সাপ–খােপ আছে। আমি বললাম––আপনি তাে আসছেন, আপনার সাপের ভয় নাই? লােকটা তখন কী বলল জান রজু?”
‘বলল, আপনি বড়াে ভালাে মেয়ে। এই বলেই হনহন করে চলে গেলে। কী কাণ্ড দেখেছ?
এর কিছুদিন পরই শুনলাম হাসান আলি নানাজানের কাছে তাঁর ছােট মেয়েটিকে বিয়ে করবার প্রস্তাব করেছে। নানাজান তাে রেগেই আগুন। বাড়িতে হাসাহাসির ধুম পড়ে গেল। সফুরা খালা শুধু বলেন, “আহা, বেচারা গরিব বলে কি ।
অচিনপুর পর্ব (১১)- হুমায়ূন আহমেদ
সবাই এ–রকম করবে! ছিঃ! লাল মামী ও কথা শুনে বললেন, ‘আমাদের সফুরার ভাতারকে নিয়ে কেউ তামাশা করবে না। খবরদার, সফুরা মনে কষ্ট পায়।‘ নানিজান
লাল মামীর কথা শুনে রেগে যান, চেচিয়ে বলেন, ‘একি কথা বলার ঢং বউ! ব্যাপারটা এখানেই শেষ হল না, নানাজান হাসান আলিকে এখানকার বাস উঠিয়ে চলে যেতে বললেন। শরৎকালের এক সকালে নৌকা করে হাসান আলি চলে গেল। দু’টি ট্রাঙ্কের উপর বিবর্ণ সতরঞ্চিতে ঢাকা একটি বিছানা––তার পাশে মুখ নিচু করে বসা হাসান আলি।
সফুরা খাল। এর পর থেকেই অস্থির হয়ে পড়লেন। মুখে শুধু এক বুলি, ‘বিনা দোষে কষ্ট পেল লােকটা। নবু মামা অনেক পরে এ ঘটনা শুনে বলেছিলেন, ‘আমি থাকলে দিতাম শালার ঘাড়ে গদাম করে এক ঘুষি। সফুরা খালা বিষন্ন কণ্ঠে বলেছেন, ‘ছিঃ নবু ছিঃ।
অচিনপুরের গল্প লিখতে লিখতে গভীর বিষাদে মন আচ্ছন্ন হয়ে আসছে। অনুভব করছি সুখ এবং দুঃখ আসলে একই জিনিস। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সুখ বদলে গিয়ে দুঃখ হয়ে যায়। দুঃখ হয় সুখ। জীবনের প্রবল দুঃখ ও বেদনার ঘটনাগুলি মনে পড়লে আজ আমার ভালাে লাগে। প্রাচীন সুখের স্মৃতিতে বুক বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়।
অচিনপুর পর্ব (১১)- হুমায়ূন আহমেদ
হাসনার কোলে তিন মাস বয়সের যে–শিশুটি এ সংসারে প্রবেশ করেছিল, তার ভূমিকা তাে যুক্তিসঙ্গত কারণেই তৃতীয় পুরুষের ভুমিকা হবে। তার উপস্থিতি হবে ছায়ার মতাে। সরফরাজ খানের এই পরিবারটির সুখ–দুঃখ তাকে স্পর্শ করবে।
কিন্তু আমি তাদের জীবনের সঙ্গে কত ঘনিষ্ঠভাবেই না জড়িয়ে পড়লাম। বাদশা মামার মলিন চেহারা দেখলে আমার মন কাঁদে। সফুরা খালা যখন হেসে হেসে বলেন, রঞ্জু, আমার খুব ইচ্ছে এক দিন অনেক রাত্রে পুকুরে একা একা সাঁতার কেটে গােসল করি। পুকুরঘাটে তুমি আমার জন্যে একটুখানি দাঁড়াবে রঞ্জু ? কেউ যেন জানতে না পারে। তখন সফুরা খালার জন্যে আমার গাঢ় মমতা বােধ হয়। অথচ আমি নিশ্চিত জানি এক দিন লিলির চিঠি আসবে। আমি এদের সবাইকে পিছনে ফেলে চলে যাব।
হালিম শেখের সঙ্গে পরপর দু‘টি মামলাতে নানাজানের হার হল। এত দিন যে জমিতে নানাজানের দখলিস ছিল, হালিম শেখের লােকজন লাল নিশান উড়িয়ে ঢােল আর কাঁসর ঘন্টা বাজাতে বাজাতে সে–জমির দখল নিল। গ্রামের লােকজনকে গরু জবাই করে খাওয়াল হালিম শেখ।
জমির পরিমাণ তেমন কিছু নয়। অর্থব্যয়ও হয়েছে সামান্য। নানাজানের মতাে
লােকের কাছে সে–টাকা কিছুই নয়। কিন্তু তিনি ভেঙে পড়লেন। গো | মত। উঠোনে বসে কোরান–পাঠ করতে বসেন না। নিজের ঘরে চুপচাপ বসে থাকেন। অত্যন্ত অল্প সময়ের ভেতর স্বাস্থ্য ভেঙে গেল। খাওয়া কমে গেল। রাতে ঘুমুতে পারেন না। উঠোনে অনেক রাত পর্যন্ত চেয়ার পেতে বসে থাকেন। নানিজান মাথায় হাওয়া করেন, পায়ে তেল মালিশ করে দেন।
অচিনপুর পর্ব (১১)- হুমায়ূন আহমেদ
দিন সাতেক পর নানাজান ঘােষণা করলেন, তিনি বেশি দিন বাঁচবেন না। সম্পত্তির বিলি–বন্দোবস্ত করতে চান। নবু মামার কাছে চিঠি গেল, তিনি যেন পত্রপাঠ চলে আসেন, পড়াশােনার আর প্রয়ােজন নেই। লােক পাঠিয়ে দামী কাফনের কাপড় কেনালেন। কবরের জন্য জায়গা ঠিক করা হল। কবর পাকা করবার জন্য ইট আনান হল। মৌলানা ডাকিয়ে তওবা করলেন। বাড়ির সবাই নিঃশব্দ মৃত্যুর প্রস্তুতি দেখতে লাগল। ঠিক এই সময় ভাে নানিজান মারা গেলেন।
মােহরের মা রােজ সকালে দুধ নিয়ে যায় নানিজানের ঘরে! সেদিন কী কারণে যেন দেরি হয়েছে। দুপুরের দিকে বাটিভর্তি দুধ নিয়ে গিয়েছে। ঘরে ঢুকেই বিকট চিৎকার। মৃত্যু এসেছে নিঃশব্দে। কেউ জানতেও পারে নি, কখন কীভাবে মারা
গেলেন।