আমরা সবাই তাঁর ঘরের সামনে ভিড় করে দাঁড়ালাম। পরিপাটি বিছানা পাতা। বালিশের চাদর পর্যন্ত একটুও কোঁচকায় নি। বড় নানিজান সেই পরিপাটি বিছানায় শক্ত হয়ে পড়ে আছেন।
ইদুর কিংবা অন্য কোনাে কিছু তাঁর ঠোট আর একটি চোখ খেয়ে গিয়েছে। বিকট হাঁ করা সেই মূর্তি দেখে সফুরা খালা ও মাগাে ও মাগাে বলে কাঁদতে লাগলেন। লাল মামী সফুরা খালার হাত ধরে তাঁকে নিচে নামিয়ে নিয়ে গেলেন।
নানাজানের জন্যে কেনা কাফনের কাপড়ে তাঁর কাফন হল। নানাজানের জন্যে ঠিক করে রাখা জায়গায় কবর হল তাঁর। যে–ইট নানাজান নিজের জন্যে
আনিয়েছিলেন, সেই ইট দিয়ে কবর বাধিয়ে দেওয়া হল।
সপ্তাহখানেকের মধ্যে আমরা সবাই বড়াে নানিজানের কথা ভুলে গেলাম। আগের মতাে ঝগড়া, রং–তামাশা চলতে লাগল। বড়াে নানিজানের ঘর থেকে তাঁর সমস্ত জিনিস সরিয়ে ফেলে সংসারের প্রয়ােজনীয় পেঁয়াজ–রসুন রাখা হল গাদা করে।
দিন কেটে যেতে লাগল। একঘেয়ে বৈচিত্র্যহীন জীবন। সেই একা একা হাঁটতে হাঁটতে সােনাখালি চলে যাওয়া। পুকুরঘাটে রাতের বেলা চুপচাপ বসে থাকা। এর বাইরে যেন আমার জানা কোনাে জগৎ নেই। সমস্ত বাসনা–কামনা এইটুকুতেই কেন্দ্রীভূত। এর মধ্যে এক দিন নানাজান আমাকে তাঁর ঘরে ডেকে নিয়ে গেছেন। বলেছেন, ‘তােমার বড়াে নানিজান তাঁর নিজের সম্পত্তি তােমাকে আর লিলিকে দিয়ে গিয়েছেন দানপত্র করে।
অচিনপুর পর্ব (১২)- হুমায়ূন আহমেদ
বড়াে নানিজান তার বাবার কাছ থেকে প্রচুর সম্পত্তি পেয়েছিলেন জানতাম। তার পরিমাণ যে কত তা কেউই জানত না। নানাজান বললেন, অনেক জায়গা জমি, লিলির আসা দরকার। কিন্তু তার ঠিকানাই তাে জানা নেই।
রাজশাহী থেকে খবর এল, স্কুল ফাইনাল দিয়েই নবু মামা কাউকে কিছু না বলে কোলকাতা চলে গেছেন। নানাজানের মুখ গম্ভীর হল। নানিজানের কেন জানি ধারণা, নবু মামা আর কখনাে ফিরবে না। তিনি গানের মতাে সুরে যখন কাঁদতে থাকেন, তখন বলেন, এক মেয়ে পাগল, এক ছেলে বিবাগী, এক বউ বাঁজা।
শুনলে হাসি পায়, আবার দুঃখ লাগে। বাদশা মামা মাঝেমধ্যে গিয়ে নানিজানকে ধমক দেন, ‘কি মা, আপনি সব সময় বাজা বউ বাঁজা বউ করেন?
নালিজান ক্ষেপে গিয়ে বলেন, ‘ও বাঁজা বউরে আমি আর কী বলে ডাকব? ‘আহা, এলাচি মনে কষ্ট পায়। নানিজান কপালে করাঘাত করেন আর বলেন, ‘হা রে বউ, তুই কি যাদুটাই করলি!
বাদশা মামা চিন্তিত, বিরক্ত আর ক্লান্তমুখে চলে আসেন।
নবু মামা হঠাৎ করে কোলকাতা চলে যাওয়ায় খুশি মনে হয় শুধু সফুরা খালাকে। আমাকে ডেকে বলেন, “আমি ছেলে হলে নবুর মতাে কাউকে না বলে আমিও চলে যেতাম।
অচিনপুর পর্ব (১২)- হুমায়ূন আহমেদ
আট–দশ দিন পর নবু মামা কোলকাতা থেকে টাকা চেয়ে পাঠাল। নানাজান লােক মারফত টাকা পাঠালেন। নির্দেশ রইল, ঘাড় ধরে যেন তাকে নিয়ে আসা হয়। বাড়িতে সিদ্ধান্ত নেয়া হল নবু মামাকে বিয়ে দেওয়া হবে। নানাজান মেয়ে দেখতে লাগলেন। নানিজান মহা খুশি। লাল মামীকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলছেন, নতুন বউয়ের এক বৎসরের ভেতর ছেলে হবে, আমি স্বপ্ন দেখেছি।
টাকা নিয়ে লােক যাওয়ার কয়েক দিন পরই নবু মামা এসে পড়লেন। সরাসরি এসে বাড়িতে তিনি উঠলেন না, লােক মারফত খবর পাঠালেন কাউকে কিছু না বলে আমি যেন আজিজ খাঁর বাড়িতে চলে আসি।
আজিজ খাঁর বাইরের ঘরের চেয়ারে নবু মামা গম্ভীর হয়ে বসে ছিলেন। মাথায় বেড়েছেন কিছু। গায়ের রং ফর্সা হয়েছে। আমাকে দেখে রহস্যময় হাসি হাসলেন, ‘বাড়িতে কেউ জানে না তাে আমি এসেছি যে?
“না।” ‘গুড।‘
‘কী ব্যাপার নবু মামা?
একটা প্ল্যান করেছি রঞ্জু। লাল ভাবীকে একেবারে চমকে দেব। গ্রামােফোন কিনেছি একটা। ঐ দেখ টেবিলে।।
আমি হাঁ করে টেবিলে রেখে দেওয়া বিচিত্র যন্ত্রটি তাকিয়ে দেখি। নবু মামা হাসিমুখে বলেন, ‘পাঁচটা রেকর্ডও আছে। এক শ’ পনের টাকা দাম।
অচিনপুর পর্ব (১২)- হুমায়ূন আহমেদ
নবু মামার প্ল্যান শুনে আমার উৎসাহের সীমা থাকে না। রাতের বেলা সবাই ঘুমিয়ে পড়লে নবু মামা গ্রামােফোন নিয়ে চুপি চুপি যাবেন। যে–ঘরটায় আমি আর নবু মামা থাকি সেই ঘরটায় চুপি চুপি এসে গ্রামােফোন বাজার ব্যবস্থা করা হবে। গান শুনে হকচকিয়ে বেরিয়ে আসবেন লাল মামী। অবাক হয়ে বলবেন, ‘রজু, কী। হয়েছে রে, গান হয় কোথায়?
তখন হাে হাে করে হাসতে হাসতে বেরিয়ে আসবেন নবু মামা। উৎসাহে নবু মামা টগবগ করছেন। আমি বললাম, ‘নবু মামা, এখন একটা গান শুনি!
নবু মামা হাঁ–হাঁ করে ওঠেন, ‘না–না, এখন না। পরে শুনবি। ফার্স্টে কোনটা বাজাব বল তাে?
‘কি করে বলব, কোনটা?
সেদিন সন্ধ্যার আগেভাগেই ঝুমঝুম করে বৃষ্টি নামল। সে কী বৃষ্টি। ঘরদোর, ভাসিয়ে নিয়ে যায়। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হু–হু করে ঝড়াে হাওয়া বইতে লাগল। নবু মামা বিরক্ত মুখে বসে রইলেন। রাতের খাওয়াদাওয়া আজিজ খাঁর ওখানেই হল। রাত যখন অনেক হয়েছে, লােকজন শুয়ে পড়েছে সবখানে, তখন আমরা উঠলাম। বৃষ্টি থামে নি, গুড়ি গুড়ি পড়ছেই। মাথায় ছাতা ধরে আধভেজা হয়ে বাড়িতে উঠলাম। কাদায় পানিতে মাখামাখি। বাড়িতে জেগে নেই কেউ। শুধু নানাজানের ঘরে আলাে দেখা যাচ্ছে। দু‘ জনে নিঃশব্দে দোতলায় উঠে এলাম। দরজা খােলা হল অত্যন্ত সাবধানে। একটু কাঁচ শব্দ হলেই দু জনে চমকে উঠছি।