সমস্ত দিন কেটে গেল। সফুরা খালা কাঁদতে লাগলেন! কী বিশ্রী অবস্থা! বাদশা মা নৌকা করে চলে গিয়েছেন শ্রীপুর। লাল মামীর মাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসবেন একেবারে।
কানাবিবি বারবার বলে, বউয়ের কোনাে খারাপ বাতাস লেগেছে, না হলে এমন হয়! মুকুন্দ ওঝাকে খবর দেও না এক বার।
লাল মামীর মা খবর পেয়েই এসে পড়লেন। লা মামী বলল না, আমি কিছুতেই খাব না। এ বাড়িতে কিছু খাব না আমি। নানাজান বললেন, ‘আচ্ছা, মেয়েকে না হয় নিয়েই যান। ক’ দিন থেকে সুস্থ হয়ে আসুক।‘
ধরাধরি করে লাল মামীকে নৌকায় তােলা হল। নৌকার পাটাতন বাদশা মামা তাঁর সুটকেস নিয়ে আগে থেকেই বসে আছেন। লাল মামী বাদশা মামাকে দেখেই জ্বলে উঠলেন, ‘ও গেলে আমি যাব না। আল্লাহর কসম, আমি যাব না।‘ | বাদশা মামী চুপচাপ নেমে পড়ে দাঁড়িয়ে বােকার মতাে সবার দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগলেন। যেন কিছুই হয় নি। তাঁর কাণ্ড দেখে আমার চোখে পানি এসে গেল।
বু মামার বিয়ের জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন সবাই। মেয়ে তাে আগেই ঠিক করা ছিল, এবার কথাবার্তা এগুতে লাগল। নানাজান অনেক রকম মিষ্টি, হলুদ রংয়ের শাড়ি ও কানের দুল নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে মেয়ে দেখতে গেলেন। সঙ্গে গেলেন। হেডমাষ্টার সাহেব, আজিজ খাঁ সাহেব। আমিও গেলাম তাঁদের সঙ্গে। কী মিষ্টি মেয়ে, শ্যামলা রং, বড়াে বড়াে চোখ। একনজর দেখলেই মন ভরে ওঠে। দেখে আমার বড়াে ভালাে লাগল। পৌষ মাসের মাঝামাঝি দিন ফেলে নানাজান উঠে এলেন।
অচিনপুর পর্ব (১৫)- হুমায়ূন আহমেদ
বাড়িতে একটি চাপা আনন্দের স্রোত বইতে লাগল। সবচেয়ে খুশি সফুরা খালা। হাসি–হাসি মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সবার সঙ্গে বিয়ে নিয়ে গল্প। নবু মামার কিন্তু ভাবান্তর নেই। কী হচ্ছে না–হচ্ছে, তা নিয়ে মাথাব্যথাও নেই। মাছ ধরতে যান। কোথাও যাত্রাটাত্রার খবর পেলে যাত্রা শুনতে যান।
গ্রামের মাঠে ফুটবল নেমে গেছে। সারা বিকাল কাটান ফুটবল খেলে। সেন্টার ফরােয়ার্ডে তিনি দাঁড়ালে প্রতিপক্ষ তটস্থ হয়ে থাকে। শীল্ডের অনেক খেলা শুরু হয়ে গেছে। গ্রামের টীম খুব শক্ত। ফাইনালে উঠে যাবে সন্দেহ নেই। নবু মামা প্রাণপণে খেলেন। মরণপণ খেলা। বল নিয়ে দৌড়ে যাবার সময় তাঁর মাথার লম্বা চুল বাতাসে থরথরিয়ে কাঁপে। মাঠের বাইরে বসে বসে মুগ্ধ নয়নে আমি তাই দেখি। রাতের বেলা গরম পানি করে আনি, নবু মামা গরম পানিতে পা ডুবিয়ে অন্যমনস্কভাবে নানা গল্প করেন। লাল মামী প্রসঙ্গে কোনাে আলাপ হয় না।
তিনি সেই যে গিয়েছেন আর ফেরার নাম নেই। বাদশা মামা প্রতি হাটবারে নৌকা নিয়ে চলে যান। আবার সেই দিনই ফিরে আসেন। লাল মামীর ঘরেই বাকি সময়টা কাটে তীর। আমি বুঝতে পারি কোথায়ও সুর কেটে গিয়েছে। ভালাে লাগে না। কবে লিলির চিঠি আসবে, কবে আমি চলে যেতে পারব, তাই ভাবি। তখন আমি অনেক রকম স্বপ্ন দেখতে শিখেছি। পরগাছা হয়ে বেঁচে থাকতে ঘেন্না বােধ হচ্ছে, অথচ বেরিয়েও আসতে পারছি না। বড়াে নানিজান অনেক সম্পত্তি নাকি আমাকে আর লিলিকে দিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু তাতে আমার অবস্থার কোনাে পরিবর্তন হয় নি।
অচিনপুর পর্ব (১৫)- হুমায়ূন আহমেদ
তাছাড়া সে–সময়ে আমি প্রেমেও পড়েছিলাম। অচিনপুরের এই কাহিনীতে যে প্রেমের উল্লেখ না করলেও চলে, কারণ তার কোনাে ভূমিকা নেই এখানে। তবে প্রচণ্ড পরিবর্তন হচ্ছিল আমার মধ্যে––এইটুকু বলা আবশ্যক।
নবু মামার স্কুল ফাইনালের রেজাল্ট হল তখন। খুবই ভালাে রেজাল্ট। ডিষ্ট্রিক্ট স্কলারশিপ বলে কী–একটা স্কলারশিপ পেলেন। কলেজে ভর্তি হবার জন্যে টাকা পয়সা নিয়ে নবু মামা রওনা হলেন। নানাজানের ইচ্ছে ছিল, নবু মামা যেন আনন্দমােহন কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু নবু মামার ইচ্ছে প্রেসিডেন্সি কলেজ।
নবু মামার বিয়ের তারিখ ঠিকই থাকল। নবু মামা নিজেও এক দিন মেয়ে দেখে এলেন। সফুরা খালা যখন বললেন, ‘মেয়ে পছন্দ হয়েছে? নবু মামা ঘাড় নেড়ে সায় দিয়েছে।
বারােই ভাদ্র তারিখে নবু মামা চলে গেলেন। আর তেরই ভাদ্র বাদশা মামা শ্রীপুর থেকে আধপাগল হয়ে ফিরে এলেন। আমি ভাসা ভাসা ভাবে শুনলাম, লাল মামী শ্বশুরবাড়ি ফিরে যাবার নাম করে নবু মামার সঙ্গে চলে গিয়েছেন।
কেউ যেন জানতে না পারে, সেই জন্যে বাদশা মামাকে ঘরে বন্ধ করে রাখা। হল। তাঁর মাথার ঠিক নেই, কখন কাকে কী বলে বসেন। ছােট নানিজানের ফিটের ব্যারাম হয়ে গেল। সফুরা খালাকে দেখে কোনাে পরিবর্তন নজরে পড়ে না, শুধু তাঁর চোখে কালি পড়েছে। মুখ শুকিয়ে তাঁকে দেখায় বাচ্চা ছেলেদের মতাে।
অচিনপুর পর্ব (১৫)- হুমায়ূন আহমেদ
নানাজান সেই বৎসরেই হজ করতে গেলেন। যাওয়ার আগে সব সম্পত্তির বিলি–বন্দোবস্ত হল। বাদশা মামাকে সব লিখে–পড়ে দিয়ে গেলেন।
একটি প্রকাণ্ড প্রাচীন বটগাছ যেন চোখের সামনে শুকিয়ে উঠেছে। সবুজ পাতা ঝরে যাচ্ছে, কাণ্ড হয়েছে অশক্ত। আমি তাই দেখছি তাকিয়ে তাকিয়ে। শৈশবের যে অবুঝ ভালােবাসায় নানাজানের বাড়িটিকে আমি ঘিরে রেখেছিলাম, সেই ভালােবাসা করুণ নয়নে চেয়ে আছে আমার দিকে। কিন্তু আমি তাে এখানের কেউ নই। এক দিন চুপচাপ চলে যাব। কেউ জানতেও পারবে না, রঞ্জু নামের আবেগপ্রবণ ছেলেটি হঠাৎ কোথায় চলে গেল।
এত বড়াে বাড়ি, অথচ এই ক‘ জন মাত্র মানুষ আমরা। রাতের বেলা গা ছমছম করে। মােহরের মা মাঝেমধ্যে চমকে ওঠে, ‘ওটা কি গাে, ও মা, ভূত নাকি? গাছের পাতায় বাতাস লেগে সরসর শব্দ হয়।। | এ বাড়ির সব কিছুই বদলে গেছে। লাল ফেজটুপি–পরা নানাজান সূর্য ওঠার আগেই উঠোনের চেয়ারে এসে আর বসেন না। ‘ফাবিয়ায়ে আলা রাব্বিকুমা তুকাজ্জিবান’ ঘুমঘুম চোখে অর্ধজাগ্রত কানে কত বার শুনেছি এই সুর। এখন সকালটা বড়াে চুপচাপ।
অচিনপুর পর্ব (১৫)- হুমায়ূন আহমেদ
ভােরের আলােয় মনের সব গ্লানি কেটে যায়। আমি চাই এ বাড়ির সবার মনের গ্লানি কেটে যাক। নবু মামা ফিরে এসে আগের মতাে জোছনা দেখে উল্লাসে চিৎকার করুক : কী জোছনা, খেতে ইচ্ছে করে! সফুরা খালা ঠিক আগের মতাে লাঠি হাতে ‘পাখি উড়ে গেল’ বলে এ সংসারের যাবতীয় দুঃখ–কষ্ট উড়িয়ে দিক। বাদশা মামা তার সাজ–পােশাক পরে হিরণ্য রাজার পার্ট করুক। কিন্তু তা আর হবে না, তা হবার নয়। আমি সংসারের মন্থর স্রোতে গা এলিয়ে দিলাম। কারাে সঙ্গেই আজ আমার যােগ নেই। দিন কেটে যেতে লাগল।