অনন্ত নক্ষত্র বীথি-পর্ব (১৩)- হুমায়ূন আহমেদ

এতদিন মানুষ হিসেবে আপনারা অসংখ্য পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন। এখন ওরা আমাদের নিয়ে পরীক্ষা করছে। আমরা ওদের কাছে মূল্যহীন গিনিপিগ ছাড়া আর কিছু নই।

অনন্ত নক্ষত্র বীথি

মূল্যহীন বলছেন কেন ? উল্টোটাও তাে হতে পারে। হয়তাে আমরা খুবই মূল্যবান। 

মূল্যবান হলে ওরা আমাদের সঙ্গে যােগাযােগ করত। তা কিন্তু করছে না। ওরা ওদের মতো কাজকর্ম করে যাচ্ছে। তাই নয় কি?’ 

তা।’ ইননা। ‘বলুন শুনছি, কিন্তু দয়া করে আমার দিকে তাকাবেন না।’ 

আপনি কি লক্ষ করেছেন যে এরা শুধু সুখের স্মৃতিগুলি নিয়ে খেলা করছে ? আপনার জীবনের অনেক দুঃখময় ব্যাপার নিশ্চয়ই আছে। সে-সব নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। ওরা ইচ্ছা করলে ভয়ংকর সব পরিবেশ তৈরি করতে পারত। পারত না

‘হ্যা, পারত। 

তা কিন্তু ওরা করে নি। 

ইনাে ক্লান্ত গলায় বলল, ‘এখনাে করে নি। ভবিষ্যতে হয়তাে করবে। ইনাের কথা শেষ হার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘর পুরােপুরি অন্ধকার হয়ে গেল । তন্দ্রা বা ঘুমের মতাে কোনাে একটা জগতে আমি চলে গেলাম, যে জগৎ সম্পর্কে আমার সামান্যতম ধারণাও নেই। 

আমার দিন কাটছে। 

কেমন কাটচ্ছে ? 

বলা মুশকিল। ইনাের সঙ্গে আমার আর দেখা হয় নি, আমি সময় কাটাচ্ছি আমার নিজের ঘরে। কখনাে বিছানায় শুয়ে থাকি, কখনাে উঠে বসি, কখনাে হাঁটাহাঁটি করি। কুৎসিত জীবন। মাঝে-মাঝে অসহ্য বােধ হয়, ইচ্ছে করে চেঁচিয়ে বলি, দয়া করে আপনারা আমাকে মুক্তি দিল। আমি মানুষ। এ জাতীয় বন্দি জীবনে আমি অভ্যস্ত নই। ঠিক তখনি ঘরের আলাে কমে আসে, আমি ঘুমিয়ে পড়ি কিংবা চেতনা বিলুপ্ত হয়, কিংবা অন্য কোনাে জগতে চলে যাই । আবার একই ঘরে এক সময় জেগে উঠি, শুরু হয় পুরনাে রুটিন। 

অনন্ত নক্ষত্র বীথি-পর্ব (১৩)- হুমায়ূন আহমেদ

কখনাে কখনো মনে হয় ঘুম এবং জাগরণের এই চক্র চলছে দীর্ঘ সময় ধরে। বছরের পর বছর পার হয়ে যাচ্ছে। আবার পরক্ষণেই মনে হয় না, দীর্ঘ সময় তাে নয়, অল্প কিছুদিন মাত্র পার হল। কতদিন পার হল তা টের পাওয়া খুব কঠিন কিছু নয়। সময়ের সঙ্গে হাত ও পায়ের নখ বড় হয় । চুল লম্বা হয়। চুল কতটুকু বড় হল, বা নখ কতটুকু বড় হল, সেখান থেকে অতি সহজেই সময়ের হিসাব করা যায় । আমি তা করতে পারছি না। কারণ আমার নখ বড়াে হচ্ছে না বা চুলও বাড়ছে না।

এটা মােটামুটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ, যা আমার প্রথম দিকের সন্দেহকে দৃঢ় করে। শুরু থেকেই আমি ভাবছিলাম, আমার শরীর বলে কিছু নেই। চারপাশে যা ঘটছে তার সবটাই কল্পনা। তবে এই তথ্যেও পুরােপুরি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। কারণ আমার ক্ষুধা বা তৃষ্ণার বােধ না থাকলেও শীতবােধ আছে যা থাকার কথা নয় । নাড়ি ধরলে টিক টিক শব্দ পাওয়া যায়, যার মানে শরীরে রক্তপ্রবাহ চলছে। তাইবা কী করে হয় ! ব্যাপারটা সম্পর্কে পুরােপুরি নিশ্চিত হওয়া যায় কীভাবে? এটা নিয়ে প্রায়ই ভাৰি। কোনাে কূলকিনারা পাই না।

একদিন বিদ্যুৎ চমকের মতো মাথায় একটা বুদ্ধি এল। একটা আলপিন বুড়াে আঙুলে ঢুকিয়ে দিলেই তাে হয়। দেখা যাক রক্ত বেরােয় কিনা। দিলাম আলপিন ফুটিয়ে। ব্যথা পেলাম, রক্ত বেরুল। আর তখনি দ্বিতীয় পরিকল্পনাটা মাথায় এল— শরীরে কোনাে একটা গভীর ক্ষত সৃষ্টি করলে কেমন হয় ? টেবিলের উপর একটা কাঁচি আছে। কাগজ-কাটা কাঁচি | অতি সহজেই সেই কাচি ব্যবহার করা যেতে পারে। চোখ বন্ধ করে কঁচির একটা মাথা পায়ের উরুতে বসিয়ে হঁচকা টান দেয়া। কঠিন কোনাে কাজ নয়, তবে অবশ্যই মনের জোর লাগবে। আমি দেখতে চাই ক্ষত সৃষ্টি হবার পরপর এরা কী কর। আমার শরীর বলে যদি সত্যি সত্যি কিছু থেকে থাকে, তবে এদের ভৎক্ষণাৎ এগিয়ে আসতে হবে। ওদের সঙ্গে যােগাযােগেরও একটা সুযােগ হতে পারে। 

অনন্ত নক্ষত্র বীথি-পর্ব (১৩)- হুমায়ূন আহমেদ

আমি টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলাম। কচি পাওয়া গেল না। যদিও অল্প কিছুক্ষণ আগে কাচিটা ছিল। কিন্তু এখন নেই। কোথাও নেই। পুরােপুরি বাতাসে মিলিয়ে গেছে। আমি ছােট্ট একটা নিশ্বাস ফেললাম। এরী আমাকে লক্ষ করছে। তবে এত উল্লসিত হবার কিছু নেই। মানুষ যখন গিনিপিগ নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করে, তখন সে গিনিপিগদের দিকে লক্ষ রাখে। খেয়াল রাখে যাতে এই গিনিপিগরা নিজেদের কোনাে ক্ষতি করতে না পারে। এরাও তাই করছে । এর বেশি কিছু নয়। 

আমি বিছানায় এসে শুয়ে পড়লাম। চোখ বন্ধ করে কোনাে একটা সুখের কল্পনায় নিজেকে ব্যস্ত রাখতে ইচ্ছা করছে, কিন্তু তেমন কোনাে সুখের কল্পনা মাথায় আসছে না। এক ধরনের অস্থিরতা অনুভব করতে শুরু করেছি। এই রকম অবস্থায় ব্যাপারটা ঘটল। ওদের সঙ্গে আমার প্রথম যােগাযােগ হল। আগেও অবচেতন অবস্থায় ওদের সঙ্গে কিছু কথাবার্তা হয়েছে, আজকেরটা সে-রকম নয়। এর মধ্যে কোনাে রকম অস্পষ্টতা নেই। যোগাযােগের মাধ্যম টেলিপ্যাথিক । কোনাে শব্দ শুনতে পাচ্ছি না, কিন্তু ওরা কী বলছে, তা বুঝতে পারছি। আমি কী বলছি, তাও ওরা বুঝতে পারছে। 

কীভাবে কথাবার্তা শুরু হল, তার একটা বর্ণনা দিতে চেষ্টা করি : বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করা মাত্র মাথার বাঁ পাশে মুহর্তের জন্যে তীক্ষ্ণ একটা যন্ত্রণা হল। বমি ভাব হল, তা স্থায়ী হল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই মাথা হালকা বােধ হতে লাগল। দীর্ঘদিন রােগে ভােগার পর বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালে যেরকম লাগে সেরকম। তার পরপরই শুনলাম কিংবা মনে হল কেউ একজন জিজ্ঞেস করছে, তুমি কেমন বােধ করছ ?’ এই প্রশ্ন বিশেষ কোনাে ভাষায় করা হল না । কিন্তু পরিষ্কার বুঝলাম ওরা জানতে চাচ্ছে আমি কেমন বােধ করছি। অবিশ্বাস্য ব্যাপার ! শেষ পর্যন্ত যােগাযােগ হল । আমি বললাম, ভালােই বােধ করছি। 

অনন্ত নক্ষত্র বীথি-পর্ব (১৩)- হুমায়ূন আহমেদ

বেশ কিছুক্ষণ নীরবতা। আবার প্রশ্ন হল ? প্রশ্নের মধ্যে কোথায় যেন কিছুটা প্রশ্রয় এবং কৌতুক মেশানাে। 

‘তােমরা এত সহজে এত অস্থির হও কেন ? 

আমার অবস্থাটা সহজ মনে করছেন কেন? অনিশ্চয়তা একটা ভয়াবহ ব্যাপার। 

‘তােমরা বড় হয়েছ অনিশ্চয়তায়, তােমাদের জীবন কেটেছে অনিশ্চয়তা তারপরেও অনিশ্চয়তাকে ভয় ?

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *