অনন্ত নক্ষত্র বীথি-পর্ব (১৫)- হুমায়ূন আহমেদ

করছি না। কারণ সে নিকি নয়, রােবট শ্রেণীর কেউ। ‘খুব ভুল বললে। ‘আমি ভুল বলি নি।’ 

‘বিশ্রাম নাও, তুমি ক্লান্ত । বিশ্রামের পর যখন জেগে উঠবে, তােমার বান্ধবী থাকবে তােমার পাশে। 

অনন্ত নক্ষত্র বীথি

আমি ঘুমিয়ে পড়লাম । 

‘তােমার কফিতে ক্রিম দেব ? 

আমি চমকে ফিরে তাকালাম। নিকি দাড়িয়ে আছে। সেই পরিচিত নিকি। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। রান্নাঘরে কাজকর্ম করার সময় যে এপ্রন সে গায়ে দেয়, সেই নীল রঙের এপ্রন গায়ে দিয়েছে। হাতে কফির মগ। আমি বললাম, “দাও, খানিকটা ক্রিম দাও।’ 

নিকি রান্নাঘরে ফিরে যাচ্ছে। পা কেমন যেন ক্লান্ত ভঙ্গিতে ফেলছে। বিজবিজ শব্দ হচ্ছে কফি-মেকারে। টাটকা কফির সুঘ্রাণ ঘরময় ভেসে বেড়াচ্ছে। চমৎকার দৃশ্য। অভিভূত করে দেবার মতাে। আমি অবশ্যি অভিভূত হলাম না। এই নিকির প্রতি আমি পুরনাে আকর্ষণ বােধ করছি না। সেই তীব্র তীক্ষ্ণ আনন্দ আমার মধ্যে নেই । নিকিকে মনে হচ্ছে পুতুলের মতাে, যদিও জানি সে পুতুল নয়। 

আধ চামচ চিনি দিয়েছি। ভালো করেছ।’ 

নিকি আমার পাশে এসে বসল । নিজের মনেই বলল, “এটা বােধ হয় স্বপ্ন, তাই না ? তােমার সঙ্গে তাে আমার দেখা হবার কোনাে কারণ নেই। 

আমি উত্তর না দিয়ে কফির কাপে চুমুক দিতে লাগলাম। সমস্ত ব্যাপারটা নিকিকে গুছিয়ে বলতে হবে। বলার পরেও সে বুঝতে পারবে কিনা কে জানে। 

‘নিকি তুমি কফি খাচ্ছ না? ‘ইচ্ছা করছে না। স্বপ্নের মধ্যে আমার কিছু খেতে ইচ্ছা করে না, ভালােও লাগে । তােমার পাশে বসে থাকতে ভালাে লাগছে।’ নিকি খুব স্বাভাবিকভাবে তার বাঁ হাত আমার কোলে রাখল। মাথা ঝাকিয়ে হাসল। আবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই খানিকটা বিষন্নও হয়ে পড়ল। আমি বললাম, তুমি যা দেখছ, তার কিছুই কিন্তু স্বপ্ন নয়। এবং এটা যে স্বপ্ন নয়, তা আমি চট করে প্রমাণ করতে পারি।’ 

প্রমাণ কর।‘ 

তার জন্যে তােমাকে এক চুমুক কফি খেতে হবে। নাও আমার মগ থেকে খাও। 

নিকি কফির মগে ছােট্ট একটা চুমুক দিল। আমি বললাম, ‘কফিটা কেমন লাগছে ? 

ভালাে। ‘মিষ্টি ছিল না ? ‘কিছুটা।’ 

স্বপ্নদৃশ্যে আমরা অনেক ধরনের খাবারদাবার খাই। তার কোনােটারই কিন্তু কোনাে স্বাদ নেই।’ 

কে বলল তােমাকে ? ‘আমি জানি। 

তুমি মাস্টারদের মতাে কথা বলছ। এভাবে কথা তুমি বল না। এখন বলছ, কাজেই এটা স্বপ্ন। স্বপ্ন না হলে তোমার দেখা পাব কী করে? 

‘নিকি, এটা স্বপ্ন নয়। 

“আচ্ছা ঠিক আছে, যাও এটা স্বপ্ন না। কিছু সময়ের জন্যে তােমাকে পাওয়া গেছে, আর তুমি শুরু করেছ তর্ক ? ‘এটা যে স্বপ্ন না, এও তার একটা বড় প্রমাণ। স্বপ্নে কথা বলাবলির ব্যাপারটা কম থাকে। 

‘আচ্ছা, ঠিক আছে বাবা, চুপ কর।‘ 

আমি চুপ করলাম। নিকি হালকা গলায় বলল, কফি শেষ হয়েছে ? 

“তাহলে কফির মগ রান্নাঘরে রেখে এসে আমাকে একটু আদর কর। 

আমি হেসে ফেললাম । অবাক হয়ে লক্ষ করলাম পুরনাে আবেগ, পুরনাে ভালােবাসা ফিরে আসতে শুরু করেছে। নিকিকে এখন আর পুতুল বলে মনে হচ্ছে । কী সুন্দরই না তাকে লাগছে ! পৃথিবীর জীবনে তাকে কি এত সুন্দর লাগত। 

নিশ্চয়ই লাগত হয়তাে। তখন এত ভালাে করে লক্ষ করি নি। কিংবা কে জানে এরা 

হয়তাে তাকে আরাে সুন্দর করে বানিয়েছে। 

নিকিকে সমস্ত ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললাম। সে বুঝতে পারল কিনা জানি না, তবে চুপ করে বসে রইল। প্রতিবাদ করল না। প্রতিবাদ করলে ভালাে হত, আমি আমার যুক্তিগুলি আরাে গুছিয়ে তাকে বলতে পারতাম। 

‘নিৰ্কি।’ “বল। ‘আমার কথা বিশ্বাস করতে পারছ ? 

‘জানি না। বিশ্বাস করি বা না-করি তাতে কিছু যায় আসে না। তুমি পাশে আছ, এই যথেষ্ট।’ 

তুমি মনে হচ্ছে বেশ সুখী। 

সুখী । কেন সুখী হব না বল ? একজন মানুষের সুখী হতে খুব বেশি কিছু কি লাগে? 

না, তা অবশ্যি লাগে না। 

নিকি ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল, তােমার মাস্টারি ধরনের কথা শুনে কান ঝা ঝা করছে। অন্য কিছু বল।’ 

কী ধরনের কথা বুলব? ভালােবাসার কথা বল। তুমি যে আমাকে ভালোবাস এই কথাটা বল‘এটা তাে তুমি জানই । নতুন করে বলার প্রয়ােজন কি?’ ‘প্রয়ােজন আছে। ‘আমি তােমাকে ভালােবাসি।’ 

আবার বল।’ “আমি তােমাকে ভালােবাসি। “থামবে না, বলতেই থাক। 

নিকির চোখে জল টলমল করছে। আমি মৃদুস্বরে বারবার বলছি, “আমি তােমাকে ভালােবাসি, আর সে চোখ মুছছে। আমার নিজের চোখ ভিজে উঠতে শুরু করেছে। অশ্রু খুবই সংক্রামক ব্যাপারনিকি বলল, আর কখনাে তুমি আমাকে ছেড়ে যাবে না।’ 

আমি কিছু বললাম না, একটা হাত রাখলাম তা হাতে। স্পর্শ দিয়েও অনেক কিছুই বলা যায়। আমি নিকিকে কাছে টানলাম—ঠিক তখন ওদের সঙ্গে যােগাযােগ হল। ওরা স্পষ্ট স্বরে বলল, “তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাই।’ 

‘আমি চাই না।’ 

“আমরা অত্যন্ত কৌতূহল বােধ করছি। দয়া করে আমাদের প্রশ্নের জবাব দাও।” 

আমি কোনাে কৌতূহল বােধ করছি না। আমাকে আমার বান্ধবীর সঙ্গে থাকতে দিন।’ 

তােমার বান্ধবী দীর্ঘকাল তােমার পাশে থাকবে, আমরা থাকব না। আমরা পরিব্রাজক। আমরা বেশি সময় একজায়গায় থাকতে পারি না। আমাদের যাত্রা শুরু করতে হবে। 

কখন যাত্রা শুরু হবে ? ‘খুগ শিগগিরই। ‘আমাদের কী হবে? ‘তােমাদের জন্যে কোনাে একটা ব্যবস্থা নিশ্চয়ই হবে।’ ‘সে ব্যবস্থাটা কী, জানতে চাই।‘ 

সময় হলেই জানবে, এখনাে সময় হয় নি। এখন দয়া করে আমার প্রশ্নের জবাব দাও।‘ 

আমার প্রশ্নের জবাব না দিলে আমি আপনাদের কোনাে প্রশ্নের জবাব দেব না।’ 

তুমি এত রেগে যাচ্ছ কেন? ‘আমি রেগে যাচ্ছি না। আমি শুধু বলছি, আমার প্রশ্নের জবাব না দিলে আমি আপনাদের কোনাে প্রশ্নের জবাব দেব না। 

“ঠিক আছে জবাব দিও না।’ 

কথাবার্তা থেমে গেল। মাথায় ভোতী ধরনের যন্ত্রণা নিয়ে আমি তাকালাম নিকির দিকে। নিকি বলল, কী হয়েছে ?

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *