অনন্ত নক্ষত্র বীথি-পর্ব (১৬)- হুমায়ূন আহমেদ

‘ওরা কথা বলছিল । ওরা মাঝে মাঝে আমার সঙ্গে কথা বলে। যত বারই কথা বলি, তত বারই রেগে যাই।’ 

“ওরা কি আজেবাজে কিছু বলে ? 

অনন্ত নক্ষত্র বীথি

না, আজেবাজে কিছুই বলে না। তবু প্রচণ্ড রাগ লাগে। কেন তাও জানি না।’ ‘রেগে যাওয়ার স্বভাব কিন্তু তােমার ছিল না। তুমি মনে হয় খানিকটা বদলে গেছ। 

‘খানিকটা না, অনেকখানি বদলেছি। ওরা বদলে দিয়েছে।’ “থাক ওদের কথা, যা হবার হবে। অন্য কিছু বল।’ 

অন্য কিছু বলব ? বলার তাে আর কিছু নেই। 

রান্নাঘরে খুটখুট শব্দ হচ্ছে। কফি পার্কোলেক্টরে শব্দ হচ্ছিল, কে যেন সেটা বন্ধ করলকাপ ধােয়ার মতো শব্দ হচ্ছে। চামচ নড়ছে। কেউ একজন কফি বানাচ্ছে রান্নাঘরে। আমি এবং নিকি মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম । তৃতীয় ব্যক্তি কে হতে পারে ? কে কফি বানাতে বসেছে ? নিকি উঠে গেল, রান্নাঘরে ঢুকল না । দরজা পর্যন্ত গিয়ে থমকে দাঁড়াল। আমি দেখলাম সে মূর্তির মতাে জমে গেছে। যেন তার নিশ্বাস পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেছে। মুখে বিন্দু-বিন্দু ঘাম। আমি বললাম, ‘কী হয়েছে নিকি ? 

সে জবাব দিল না। নিঃশব্দে ফিরে এসে কপালের ঘাম মুছল। বসল আমার পাশে। আমি লক্ষ করলাম সে থরথর করে কাঁপছে। 

কী হয়েছে নিকি ? বুঝতে পারছি না।’ 

কী দেখলে ? 

নিকি জবাব দিল না। বড়াে বড়াে করে নিশ্বাস ফেলতে লাগল। তার মুখ রক্তশূন্য। আমি আবার বললাম, রান্নাঘরে কে?’ ‘তুমি যাও। তুমি দেখে এস। আমি কিছু বুঝতে পারছি না। আমি খুব সম্ভব পাগল হয়ে গেছি। আমার মাথা ঠিক নেই। সব এলােমেলাে হয়ে যাচ্ছে।’ আমি উঠে দাড়ালাম এগিয়ে গেলাম দরজা পর্যন্ত । হুঁ, আমি দেখতে পাচ্ছি । নিকির বিস্ময় ও হতাশার কারণ বুঝতে পারছি। রান্নাঘরে আমি নিজেই আছি। দ্বিতীয় আমি ও আরেকজন আমাকে তৈরি করেছে।

অনন্ত নক্ষত্র বীথি-পর্ব (১৬)- হুমায়ূন আহমেদ

নিজের সঙ্গে নিজের দেখা হওয়ার ঘটনাটা কেমন ? খুবই আনন্দের কোনাে ব্যাপার কি ? না, আনন্দের কোনাে ব্যাপার নয়। আমি তীব্র ঘৃণা নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। সেও ভাকাল অামার দিকে। তার মুখে হাসি। কিন্তু বুঝতে পারছি, তার চোখেও তীব্র ঘৃণা । আমি কর্কশ গলায় বললাম, তুমি কে?’ 

সে কফির মগ নামিয়ে ঠাণ্ডা গলায় বলল, ‘তুমি ভালাে করেই জান আমি কে। অর্থহীন কথাবার্তা বলার প্রয়ােজন দেখি না। ওরা তোমার দ্বিতীয় কপিটি তৈরি করেছে। 

নকল কপি ? 

‘আসল-নকলের কোনাে ব্যাপার নয়। ওরা যে-জীন থেকে তােমাকে তৈরি করেছে, সেই একই জীন থেকে আমাকেও তৈরি করেছে। আসল হলে দুটোই 

অসিল, নকল হলে দুটোই নকল।’ 

‘ওরা কপি তৈরি করল কেন?’ 

‘আমাকে এই প্রশ্ন করা কি অর্থহীন নয় ? তােমার মনে যে প্রশ্ন আসছে, আমার মনেও সেই একই প্রশ্ন আসছে। শারীরিক এবং মানসিক—এই দুই দিক দিয়েই তােমার সঙ্গে আমার কোনাে প্রভেদ নেই। এই মুহূর্তে তুমি কী ভাবছ তা আমি জানি, কারণ আমিও একই জিনিস ভাবছি।’ 

কী ভাবছ? ‘আমি ভাবছি নিকির কথা। নিকি কী করবে? কার কাছে যাবে? তোমার কাছে আমার কাছে ? 

আমার গা ঝিমঝিম করতে লাগল। আসলেই আমি তাই ভাবছি। আমরা দুজন পাশাপাশি সঁড়ানােমাত্র নিকি সব গুলিয়ে ফেলবে। কার কাছে সে যাবে? আমার কাছে না তার কাছে ? তার কাছে যাওয়া মানেই তো আমার কাছে যাওয়া । কিন্তু সত্যি কি তাই ? নিৰ্কি আমার সামনে ঐ লােকটিকে চুমু খাবে, এই দৃশ্য 

আমার পক্ষে সহ্য করা কি সম্ভব ? না, সম্ভব নয়। আমি দ্বিতীয়বার বললাম, ওরা এমন করল কেন ? 

অনন্ত নক্ষত্র বীথি-পর্ব (১৬)- হুমায়ূন আহমেদ

‘তুমি যা জান না, আমিও তা জানি না। তবে আমার মনে হয় নিকি আমাদের দু’জনকে পেয়ে কী করে এবং আমরা কী করি, তাই তারা দেখতে চাচ্ছে । তােমারও নিশ্চয়ই সে-রকমই মনে হচ্ছে, তাই না? 

হ্যা, তাই। 

মানব-মানবীর সম্পর্কের ব্যাপারটায় তারা কৌতুহলী হয়েছে। এই জিনিসটা তারা পরীক্ষা করে দেখাতে চায়। তোমারও নিশ্চয়ই সে রকমই মনে হচ্ছে। 

হা, হচ্ছে। 

আমার তাে মনে হয়, ওদের সঙ্গে এখন আমাদের কথা বলা দরকার। ওরা কী চায় জানা দরকার। এই ভয়াবহ সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে হলে ওদের সাহায্য ছাড়া উপায় নেই।’ 

‘যােগাযােগটা করব কীভাবে? আমরা চেষ্টা করলে তাে হবে না, এরা যখন যােগাযােগ করতে চাইবে তখনই হবে।’ 

‘তা ঠিক। আপাতত অপেক্ষা করা ছাড়া দ্বিতীয় কোনাে পথ দেখছি না। অপেক্ষা করা যাক। 

আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম। ক্লান্তিকর দীর্ঘ প্রতীক্ষা। কোনাে লাভ হল । কেউ যােগাযােগ করল না। আমরা তিনজন অপেক্ষা করছি। তিনজন বল কি ঠিক হচ্ছে ? না, ঠিক হচ্ছে না। আমরা আসলে দু’ জন। আমি এবং নিকি। আমি ব্যাপারটা একটু গােলমেলে হয়ে গেছে। এখানে দু’ জুন আমি উপস্থিত। 

নিকি যে কী প্রচও সমস্যায় পড়েছে তা বুঝতে পারছি। কারাে দিকেই সে চোখ তুলে তাকাচ্ছে না। আমি তার দিকে তাকিয়ে ফ্যাকাসে ভাবে হাসলাম, সে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। আমি লক্ষ করলাম অন্য আমিও তার দিকে তাকিয়ে ফ্যাকাসে ভাবে হাসছে। নিকি তার কাছ থেকেও দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। তার ভাব দেখে মনে হল সে এখন কাদবে। যদি সত্যি সত্যি কঁদে, আমি তাকে সান্ত্বনার দুএকটা কথা নিশ্চয়ই বলব । তখন অন্য আমিটি কী করবে? সেও কি সান্ত্বনার কথা বলবে ? বলাই তো উচিত । আমরা দুজন তো আলাদা নই। 

অনন্ত নক্ষত্র বীথি-পর্ব (১৬)- হুমায়ূন আহমেদ

আমি খাটের ওপর বসেছিলাম, উঠে দাঁড়ালাম। ক্লান্তু গলায় বললাম, রান্নাঘরে যাচ্ছি। তােমরা দু জন কথাবার্তা বল। এতে ব্যাপারটা সহজ হবে।’ 

নিকি ভারি গলায় বলল, সহজ হবার কোনাে দরকার নেই। তােমারও অন্য ঘরে যাবার প্রয়ােজন নেই।’ 

নিকি কাঁদতে শুরু করল। ফুপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না । আমি আগে কখনাে নিকিকে কাঁদতে দেখি নি। সে শক্ত ধরনের মেয়ে, সহজে ভেঙে পড়ার মতাে নয়। কিন্তু সে ভেঙে পড়েছে। আমি রান্নাঘরে চলে এলাম। নিকির কান্নার ছবি সহ্য করতে পারছি না। 

সময় কি মাঝে-মাঝে থেমে যায় ? মহাবীর থর নাকি কয়েক মুহূর্তের জন্য সময় থামিয়ে দিয়েছিলেন । ওরা কি তাই করেছে ? সময় কি থেমে আছে ? রান্নাঘরে আমি একা-একা পঁড়িয়ে আছি। মনে হচ্ছে অযুত নিযুত লক্ষ কোটি বছর পার হয়ে যাচ্ছে, আমি দাড়িয়েই আছি। মাঝে মাঝে নিকির কান্নার শব্দ পাচ্ছি । সে কিছুক্ষণ পর পর ফুপিয়ে উঠছে। 

অনন্ত নক্ষত্র বীথি-পর্ব (১৬)- হুমায়ূন আহমেদ

আমার মধ্যে অদ্ভুত একটা চিন্তা এই সময় এল। মনে হল, যারা একই রকম দু জন মানুষ তৈরি করতে পারে, তারা তাে একই রকম দু লক্ষ মানুষ তৈরি করতে পারবে, কিংবা তার চেয়েও বেশি–দু’ কোটি। একটি গ্রহ এক ধরনের মানুষ দিয়ে ভর্তি করে ফেলতে পারবে। অবস্থাটা তখন কী হবে? গ্রহের সবাই এক ধরনের চিন্তা করছে এবং একই ভাবে করছে, একই জিনিস নিয়ে ভাবছে। তাদের সবার ভেতর চমৎকার হৃদয়ের বন্ধন থাকবে, কারণ তারা আলাদা কেউ নয়। একই সঙ্গে একা এবং অনেকে। 

আমি একটা চমক বােধ করলাম । একই সঙ্গে একা এবং অনেকে কথাটা আমি আগে শুনেছি।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *