একটি আঁকব?
কথাবার্তা এই পর্যন্তই। মিসির আলি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন। কিন্তু আর কোনাে যােগাযােগ হল না। তিনি বেশ কয়েকবার ডাকলেন, তিনি তিন্নি। কোনাে জবাব নেই।
মিসির আলি নিজের বিছানায় ফিরে এলেন। ঘুম চলে গিয়েছে। শুয়ে থাকার কোনাে মানে হয় না। তিনি আবার ছবি নিয়ে বসলেন। যদি নতুন কিছু বের হয়ে আসে। যে মাটির উপর গাছগুলি দাঁড়িয়ে আছে তার রঙ কী ? আকাশের রঙ কী? গাছপালার ফাকে কোনাে কীটপতঙ্গ আছে কি ? যদি থাকে তাদের রঙ কী ?
আপনি এখনাে জেগে আছেন?
তিনি চমকে উঠলেন । তিনি আবার কথা বলা শুরু করেছে।
হ্যা এখনাে জেগে আছি। তােমার ছবি দেখছি। কেন দেখছেন ? একবার দেখাও যা একশবার দেখাও তা।। উহু তুমি ঠিক বললে না। প্রথমবার অনেক কিছু চোখে পড়ে না। আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন। ঘুম আসছে না। আমি কিন্তু আপনাকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে পারি। পার নাকি ? হা পারি। দেব? না তার দরকার নেই। তােমার সাথে কথা বলতে ভালাে লাগছে। তাহলে কথা বলুন। আমার সঙ্গে তুমি যেভাবে কথা বলছ অন্যদের সঙ্গেও কি সেইভাবে কথা বল ?
কেন বল না ? বলতে ইচ্ছে করে না।
মিসির আলি চেষ্টা করতে লাগলেন আজেবাজে প্রশ্নের ফাঁকে ফাঁকে দু-একটি জরুরি প্রশ্ন করে খবরাখবর বের করে আনার। কিন্তু মেয়েটি খুব সাবধানী। সে অনায়াসে ফাঁদ কেটে বেরিয়ে যাচ্ছে। তবু এর মধ্যে একটি হচ্ছে-তিন্নি শুধু মানুষ নয় পশুদের সঙ্গেও (যেমন বিড়াল) যােগাযােগ করতে পারে। মিসির আলি জিজ্ঞেস করলেন, বিড়াল তােমার কথা বুঝতে পারে ?
হু পারে। তুমি ওর কথা বুঝতে পার ? বিড়াল কোনাে কথা বলে না। তবে সে যা ভাবে তা বুঝতে পারি। অবশ্যি সব। সময় পারি না।
কখন কখন পার ? তা জেনে আপনি কী করবেন? আপনি কি বিড়াল ?
তিন্নি খিলখিল করে হাসতে লাগল। মিসির আলি রােমাঞ্চ বােধ করলেন। মেয়েটি নিজের ঘরে বসে হাসছে অথচ তিনি কী স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছেন।
তিন্নি!
বলুন। এই যে তুমি কথা বলছ আমি শুনছি ; আচ্ছা এ বাড়িতে অন্য যারা আছে তা কি শুনছে? তারা শুনবে কীভাবে, আমি কি তাদের সঙ্গে কথা বলছি ? তাওতাে ঠিক।
আচ্ছা ধরাে কাল ভােরে আমি যদি অনেকদূরে চলে যাই। তিন-চার মাইল দূরে কিংবা তারচেয়েও দূরে, তখনাে কি তুমি আমার কথা শুনতে পারবে ।
তিন্নি বিরক্ত হয়ে বলল, আপনার সঙ্গে আর কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। আমি আর কথা বলব না।
মিসির আলি বললেন, শুভরাত্রি তিন্নি। তার কোনাে জবাব তিনি শুনতে পেলেন । মাথার যন্ত্রণাটা আবার ফিরে এসেছে। শরীরটা হালকা লাগছে। মিসির আলি ডাক্তারের দিয়ে যাওয়া ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে ঘুমুতে গেলেন। ভালাে ঘুম হল না। আজেবাজে স্বপ্ন দেখলেন। বেশ কয়েকবার ঘুম ভেঙেও গেল।
শীতের ভােরবেলায় ময়মনসিংহ শহর মিসির আলির বেশ লাগল । তিনি অন্ধকার থাকতেই জেগে উঠেছেন। একটা উলের চাদর গায়ে দিয়ে শহর দেখতে বের হয়েছেন । আজ আর দারােয়ান তাঁকে বাধা দেয়নি। গেট খুলে দিয়েছে এবং হাসিমুখে বলেছে— এত সকালেই কই যান? সম্ভবত বরকত সাহেব দারােয়ানকে কিছু বলেছেন।
সব মফস্বল শহর দেখতে একরকম তবু এই শহরটি ব্রহ্মপুত্র নদীর জন্যেই বােধ হয় একটু আলাদা। কিংবা কে জানে ভােরবেলার আলাের জন্যেই হয়তাে এ-রকম লাগছে। মিসির আলি হেঁটে নদীর পাড়ে চলে গেলেন। নদী শুকিয়ে এতটুকু হয়েছে। চিনির মতাে সাদা বালির চর পড়েছে । অদ্ভুত লাগছে দেখতে। মর্নিং ওয়াকে বের হয়েছে এ-রকম বেশ কয়েকটি দল পাওয়া গেল। সবই বুড়াের দল। জীবনের শেষপ্রান্তে এসে হঠাৎ শরীরের জন্যে তাদের মমতা জেগে উঠেছে। এইসব অপূর্ব দৃশ্য আরাে কিছুদিন দেখতে হলে শরীরটাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে ।
মিসির আলি নদীর পাড় ধরে দ্রুত হাঁটতে লাগলেন। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে তার মনে কোনাে উদ্দেশ্য আছে। তিনি কিছু একটা করতে চান। কিন্তু তার মনে কোনাে গােপন উদ্দেশ্য ছিল না। ভােরবেলায় নদীর পাড়ের একটি ছােট শহর দেখতে ভালাে লাগছে এই যা। মাইল দু-এক হাঁটার পর খানিকটা ক্লান্তি বােধ করলেন। বয়স হয়ে যাচ্ছে। এখন আর আগের মতাে পরিশ্রম করতে পারেন না।
ঘড়িতে ছটা বাজছে । এখন উল্টোপথে হাঁটা শুরু করা দরকার। বরকত সাহেব নিশ্চয়ই ভােরের নাশতা নিয়ে অপেক্ষা করছেন।
একটা খেয়াঘাট দেখা যাচ্ছে। খেয়াঘাটের পাশে বেঞ্চি পেতে সুন্দর একটা চায়ের দোকান। মিসির আলি বেঞ্চিতে বসে চায়ের কথা বললেন। সিগারেট খাবার ইচ্ছা হচ্ছে। কিন্তু প্যাকেট ফেলে এসেছেন। চা শেষ করবার পর লক্ষ্য করলেন শুধু সিগারেট নয় মানিব্যাগও ফেলে এসেছেন। তার অস্বস্তির সীমা রইল না। তিনি প্রায় ফিসফিস করে বললেন, আগামীকাল ভােরবেলায় চায়ের পয়সা দিয়ে যাব! আমি ভুলে মানিব্যাগ ফেলে এসেছি। আপনি কিছু মনে করবেন না।
চায়ের দোকানি দাঁত বের করে হাসল । যেন খুব মজার একটা কথা শুনছে।
কোনাে অসুবিধা নাই। দরকার হইলে আরেক কাপ খান।
মিসির আলি সত্যি সত্যি আরেক কাপ চা খেলেন। অল্প অল্প রােদ উঠেছে। রােদে পা মেলে জ্বলন্ত উনুনের সামনে একটা হাত মেলে দিয়ে চা খেতে বেশ লাগছে । মিসির আলি হাসিমুখে বললেন, দোকান আপনার কেমন চলে ? লােকজন তাে দেখি না।
দোকান চলে না। বিকিকিনি নাই। মানুষজন নাই, চা কে খাইব কন ? ভালাে জায়গায় গিয়ে দোকান করেন যেখানে লােকজন আছে।
দাড়িওয়ালা লােকটি হাসিমুখে বলল, মনের টানে পইরা আছি। জায়গাটা বড় ভালাে লাগে। মায়া পইরা গেছে। একবার মায়া পড়লে যাওন মুসিবত ।
মিসির আলি চমকে উঠলেন। এই বুড়াের কথায় একটা সূত্র পাওয়া যাচ্ছে। তিনি বুঝতে পারছেন কেন এত কষ্টের পরও নাজিম বা রহিমার মা ও-বাড়িতে পড়ে আছে। সেখানেও মায়া ব্যাপারটাই কাজ করছে। এই মায়া তৈরীর ব্যাপারে তিন্নিরও নিশ্চয়ই একটি ভূমিকা আছে। মায়া জাগিয়ে রাখছে তিন্নি। কেউ তা বুঝতে পারছে না।
মানুষের সমস্ত আবেগ এবং অনুভূতির কেন্দ্র মস্তিষ্ক। মেয়েটি সেই মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণ করতে পারে অতি সহজেই। মিসির আলির মনে হল এই মেয়েটি একই সঙ্গে দুটি কাজ করে আশেপাশের লােকজনদের একটু দূরে সরিয়ে রাখে। আবার টেনে রাখে নিজের দিকে।
মেয়েটি নিজের সব ক্ষমতাও সবাইকে দেখাচ্ছে না। যেমন ধরা যাক দূর থেকে কথােপকথনের ক্ষমতা। এর খবর এ-বাড়ির অন্য কেউ জানে না। কিন্তু কেন জানে না ? কেন এই মেয়েটি এইসব তথ্য গােপন রেখেছে ?
আবার পুরােপুরি গােপনও রাখছে না। তাঁর কাছে প্রকাশ করেছে। কেন করেছে ? আশঙ্কা কেন? এর উত্তর বের করতে হবে। একটির পর একটি তথ্যকে সাজাতে হবে। একটি ছকের মধ্যে ফেলতে হবে। মিসির আলি চিন্তিত বােধ করলেন। নিজের অজান্তেই আরেক কাপ চা চাইলেন।