মেয়েটির উপর চক্রাকারে পাখি উড়ছে।”
সারাটা দিন তিন্নি ছাদে কাটাল।
একবার এ-মাথায় যাচ্ছে, আরেকবার ও-মাথায়। মাঝে মাঝে বিড়বিড় করে নিজের মনে কথা বলছে এবং হাসছে। শীতের দিনের রােদ দুপুরের দিকে খুব বেড়ে যায়। সারা গা চিড়বিড় করে। কিন্তু মেয়েটি নির্বিকার। হাঁটছে তাে হাঁটছেই। রহিমা দুপুরে ছাদে এসে ভয়ে ভয়ে বলেছিল—ভাত দিছি খেতে আসেন। তিনি কোনাে কথা বলেনি। রহিমা খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেছে। তিনি বুঝতে পারছে সিড়ি দিয়ে নামার সময় রহিমা মনে মনে বলছে–পিশাচ পিশাচ । মানুষ না পিশাচ। তিন্নির খানিকটা রাগ লাগছিল। কিন্তু সে সামলে নিল। সব সময় রাগ করতে ভালাে লাগে না। তার নিজেরও কষ্ট হয়। চোখ জ্বালা করে।
রহিমার মা চলে যাবার পরপরই বরকত সাহেব এলেন। তিনি কোনাে কথা বললেন না। চিলেকোঠার কাছে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে রইলেন। তিন্নির মন খারাপ হয়ে গেল। বাবা আগে তাকে ভয় পেতেন না। এখন পান। খুবই ভয় পান। অথচ সে বাবাকে একদিনও ব্যথা দেয় নি। কোনােদিন দেবেও না।
তিন্নি।। কি বাবা? ভাত খেতে আস। আমার খিদে নেই বাবা। যেদিন খুব রােদ ওঠে সেদিন আমার খিদে হয় না।
বরকত সাহেব ছােট্ট একটি নিশ্বাস ফেললেন। সেই নিশ্বাসের শব্দ শুনে তিন্নির আরাে মন খারাপ হয়ে গেল।
তিন্নি। কি বাবা?
যে ভদ্রলােক এসেছেন তার সঙ্গে কি তােমার কথা হয়েছে? হ্যা হয়েছে। তাকে তােমার কেমন লেগেছে? ভালাে।
তাহলে তাঁকে ব্যথা দিলে কেন? আমি কিছুক্ষণ আগে একতলায় গিয়েছিলাম। দ্রলােক মরার মতাে পড়ে আছেন।
তিন্নি জবাব দিল না। বরকত সাহেব বললেন, তুমি জাননা উনি কীজন্যে এসেছেন?
জানি। উনি আমাকে বলেছেন।
তুমি লক্ষী মেয়ের মতাে তােমার যত কথা আছে সব উনাকে বলবে। কিছুই লুকোবে না।
আচ্ছা।
তােমার স্বপ্নের কথাও বলবে। উনি বিশ্বাস করবেন না । হাসবেন।
হাসবেন না। উনি একজন অত্যন্ত বুদ্ধিমান মানুষ। তােমার সব কথা উনি বুঝবেন। আমি যা বুঝতে পারিনি উনি তা পারবেন ।
তিন্নি বলল, উনি কি গাছের মতাে জ্ঞানী?
বরকত সাহেব মৃদুস্বরে বললেন, তােমার গাছের ব্যাপারটা আমি জানি না তিনি। কাজেই বলতে পারছি না গাছের মতাে জ্ঞানী কি না। আমার ধারণা গাছের জীবন থাকলেও তা খুব নিম্নপর্যায়ের। জ্ঞানবুদ্ধির ব্যাপার সেখানে নেই।
বাবা! বল মা। আমার স্বপ্নের ব্যাপারটা কি আজই উনাকে বলব?
আজ না বললেও হবে। কাল বােলাে। আজ দ্রলােক ঘুমুচ্ছেন। আমার মনে হয় সারাদিনই ঘুমুবেন! তুমি ব্যথা দেবার পর উনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
তিন্নি লজ্জিত হল । কিছু বলল না। বরকত সাহেব বললেন, তুমি কি ছাদেই থাকবে?
হা। তুমি যাও, ভাত খাও।
বরকত সাহেব নেমে গেলেন । তিন্নি ছাদের এ-মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত আবার হাঁটতে শুরু করল। সে নেমে এল সন্ধ্যাবেলায়। তার গা ঝিমঝিম করছে। হাত-পা কাঁপছে। আজ সে আবার স্বপ্ন দেখবে। এসব লক্ষণ তার এখন চেনা হয়ে গেছে। তার ভয়-ভয় করতে লাগল। স্বপ্ন এত বাজে ব্যাপার, এত কষ্টের!
ঘুমুবার আগে তিন্নি একবাটি দুধ খেল। রহিমা কমলা এনেছিল খােসা ছড়িয়ে। তার দুটি কোয়া মুখে দিল। রহিমা বলল, আমি এই ঘরে ঘুমাইব আপা? তিনি কড়া গলায় বলল, “না”। রহিমা প্রতি রাতেই এই কথা বলে। প্রতি রাতেই তিন্নি একই উত্তর দেয়। একা-থাকা তার অভ্যেস হয়ে গেছে। অথচ কেউ সেটা বুঝতে চায় না। বাবাও মাঝে মাঝে এসে বলেন, তুমি কি আমার সঙ্গে ঘুমুবে মা?
একবার খুব ঝড় বৃষ্টি হচ্ছিল। ঘন ঘন বাজ চমকাচ্ছিল। বাবা এসে জোর করে তাকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। সে কতবার বলেছে– আমি কাউকেই ভয় করি না । বাবা শুনেন নি। বাবা-মা’রা কোনাে কথা শুনতে চায় না। মার কথা সে অবশ্যি বলতে পারে না, কারণ মা’র কথা তার কিছুই মনে নেই। শুধু মনে আছে মাথা-ভর্তি চুলের একটি গােলগাল মুখ তার মুখের ওপর ঝুঁকে আছে। তিনি ভাবতে লাগল। মা বেঁচে থাকলে এখন কী করত? তাকে নিয়ে খুব সমস্যায় পড়ে যেত। হয়তাে রােজ রাতে তার সঙ্গে ঘুমুত। কান্নাকাটি করত। আচ্ছা সে এ-রকম হল কেন? সে অন্যসব মেয়েদের মতাে হল না কেন?
রহিমা এখনাে দাঁড়িয়ে আছে। সরাসরি তিন্নির দিকে তাকাচ্ছে না। কিন্তু মনে মনে চাচ্ছে তাড়াতাড়ি এ-ঘর থেকে চলে যেতে। তিনি ভেবে পেল না যে চলে যেতে চাচ্ছে
সে চলে না-গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কেন?
রহিমা। জ্বি আপা।