রাত্রি হাসছে। আলম ধাঁধায় পড়ে গেল। এই বয়েসী মেয়েদের সঙ্গে তার কথা বলার অভ্যেস নেই। খুবই অস্বস্তি লাগছে। সে বুঝতে পারছে তার গাল এবং কান লাল হতে শুরু করেছে। ইচ্ছে করছে এ জায়গা থেকে কোনোমতে ছুটে পালিয়ে যেতে এবং একই সঙ্গে মনে হচ্ছে এই মেয়েটি এক্ষুণি যেন চলে না যায়। যেন সে থাকে আরো কিছুক্ষণ। আলমের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমল।রাত্রি বলল, যাই। আপনি শুয়ে পড়ুন।আলম অনেক রাত পর্যন্ত চুপচাপ বসে রইল। অদ্ভুত এক ধরনের কষ্ট হতে লাগল তার। এই কষ্টের জন্ম কোথায় তার জানা নেই।রাত বাড়ছে। চারদিক চুপচাপ। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। আবারো হয়ত ঝড়-বৃষ্টি হবে। হোক, খুব হোক। সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে যাক।
আলম বাতি নিভিয়ে দিল। আজ রাতেও ঘুম আসবে না। জেগে কাটাতে হবে। ঢাকায় আসার পর থেকে এমন হচ্ছে। কেন হচ্ছে? আগে তো কখনো হয়নি। সে কি ভয় পাচ্ছে? ভালবাসা, ভয়, ঘৃণা, এসব জিনিসের জন্ম কোথায়? তার পানির পিপাসা হল। কিন্তু বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছা করছে না।শরীফ সাহেব অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। নিজের চোখকে তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না। আলম বলল, কথা বলছি না কেন মামা? কেমন আছ? ভাল আছি। তুই কোথেকে। বেঁচে আছিস এখনো? আছি। বাসা অন্ধকার কেন? মামি কোথায়?
দেশের বাড়িতে। তুই এখন কোনো প্রশ্ন কববি না। কিছুক্ষণ সময় দে নিজেকে সামলাই।শরীফ সাহেব সোফায় বসে সত্যি সত্যি বড় নিঃশ্বাস নিতে লাগলেন। আলম বলল, বাসার খবর বল। সবাই আছে কেমন? তুই বাসায় যাসনি? না।সরাসরি আমার এখানে এসেছিস? তাও না। ঢাকাতেই আছি কয়েকদিন ধরে।তোর কথা কিছুই বুঝতে পারছি না।ঢাকায় আমি একটা কাজ নিয়ে এসেছি মামা।আই সি।এখন বল বাসার খবর।বাসার খবর তোকে কেন বলব? তোর কী কোন আগ্রহ আছে, না কোন দায়িত্বজ্ঞান আছে? বোন আর মাকে ফেলে চলে গেলি দেশ উদ্ধারে। ওদের কথা ভাবলি না? তোমরা আছে, তোমরা ভাববে।প্রথম রেসপনসিবিলিটি হচ্ছে নিজের পরিবারের জন্যে। এই সাধারণ কথাটা তোরা কবে বুঝবি?
আলম হোসে ফেলল। শরীফ সাহেব রেগে গেলেন। মানুষটি ছোটখাটো। ফাইন্যান্সের জয়েন্ট সেক্রেটারি। যতটা না বয়েস তার বেয়েও বুড়ো দেখাচ্ছে। মাথার সমস্ত চুল পেকে গেছে। মুখের চামড়ায় ভাজ পড়েছে। আলম বলল মামা, বাসার খবর তো এখনো দিলে না। ওরা কেমন আছে? ভালই।মা’র শরীর কেমন? শরীর ঠিকই আছে। শরীর একটা আশ্চর্য জিনিস, এটা ঠিকই থাকে।তোমার তো তাও ঠিক নেই মামা, বুড়ো হয়ে গেছ।তা হয়েছি। একা থাকি। রাতে ঘুম-টুম হয় না।আমাদের বাড়িতে গিয়ে থাকলেই পাের।পাগল হয়েছিস। ঐ বাড়ির ওপর নজর রাখছে না। তুই যুদ্ধে গেছিস সবাই জানে। তোর মাকে থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে।আর কোনো ঝামেলা করেনি?
করত। তোর বাবার জন্যে বেঁচে গেলি! ভাগ্যিস সে মরবার আগে ‘তমঘায়ে খিদমত’টা পেয়েছিল।শরীফ সাহেব শার্ট গায়ে দিলেন। জুতো পরলেন।যাচ্ছে কোথায় মামা? অফিসে। আর কোথায় যাব? তুই কি ভেবেছিলি – যুদ্ধে যাচ্ছি? অফিস-টফিস করছি ঠিকমতই? করব না? তোর মত কয়েকজন চেংড়া ছোড়া দু’একটা গুলি-টুলি করবে। আর এতেই দেশ স্বাধীন হয়ে যাবে? দিল্লি হনুজ দূরঅস্ত। তাছাড়া পলিটিক্যাল সলুশন হয়ে যাচ্ছে। খুব হাই লেভেলে কথাবার্তা হচ্ছে। আমেরিকা চাপ দিচ্ছে। আমেরিকার চাপ কি জিনিস তোরা বুঝবি না। স্যাকরার ঠিকঠাক কামারের এক ঘা।
আলম হাসতে লাগল। এই মামার সঙ্গে তার খুবই ভাব। একজন সৎ এবং সত্যিকার অর্থে ভাল মানুষ। তাঁর একটি মাত্র দোষ–উল্টো তর্ক করা। আলমের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু এই তিনিই আবার পাকিস্তানি ভাব আছে এমন কারোর সঙ্গে কথা বলবার সময় এমন যুক্তি দেবেন যাতে মনে হবে সপ্তাহ খানেকের মধ্যে দেশ স্বাধীন হচ্ছে।আলম।জি।তোর মার সঙ্গে দেখা করবি না? না।ভাল। লায়েক ছেলে তুই! যা ভাল মনে করিস তাই করবি। আমার এখানে থাকতে চাস? না।তোর কি ধারণা আমার এখানে উঠলেই তোকে আমি মিলিটারির হাতে ধরিয়ে দেব?
তোমাদের কোনো ঝামেলায় ফেলতে চাই না।এসেছিস কী জন্যে আমার কাছে? দেখতে এলাম।যা দেখার ভাল করে দেখে নে। দশ মিনিট সময়। দশ মিনিটের মধ্যেই বেরুব।আলম উঠে দাঁড়াল। শরীফ সাহেব বললেন, তুই কোথায় আছিস ঠিকানাটা রেখে যা।ঠিকানা দেয়া যাবে না মামা। মাকে বুলবে। আমি ভাল আছি এবং ভবিষ্যতেও থাকব।আমি বললে বিশ্বাস করবে না। তুই মরে গেছিস এটা বললে সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বাস করবে, বেঁচে আছিস বললে করবে না। তুই একটা কাজ কর, একটা কাগজে লেখ–আমি ভাল আছি। তারপর নাম সই করে দে। আজকের তারিখ দিবি।আলম লিখল–ভাল আছি মা। তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে লিখল, শিগগির তোমাকে দেখতে আসব।
দ্বিতীয় লাইনটি লিখে তার একটু খারাপ লাগতে লাগল। শিগগিরই তোমাকে দেখতে আসব। এই লাইনটিতে কোথায় যেন একটু বিষাদের ভাব আছে। দেখতে আসা হবে না। এই কথাটি যেন এর মধ্যে লুকানো।শরীফ সাহেব গন্ত্রীর গলায় বললেন, একটা লাইন লিখতে গিয়ে বুড়ো হয়ে যাচ্ছিস দেখি। তাড়াতাড়ি কর।আলম কাগজটা মামার হাতে ধরিয়ে নিউ পল্টনে চলে এল। বসবার ঘরে সাদেক তার জন্যে অপেক্ষা করছে।সাদেককে কেমন অচেনা লাগছে।ফর্সা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন একজন মানুষ। সে গোঁফ ফেলে দিয়েছে। লম্বা চুল ছিল। সেগুলি কেটেছে। জুতো জোড়াও চক চক করছে। আলম বলল, খোলস পাল্টে ফেলেছিস মনে হচ্ছে। চেনা যাচ্ছে না।
ঢাকা শহরে ঢুকলাম এতদিন পর। সেজোগুজে ঢুকব না? তুই ছিলি কোথায়? দেড় ঘণ্টা ধরে এক জায়গায় বসে আছি।আজ আসবি বুঝব কী করে? আমি তো ভাবলাম প্রোগ্রাম ক্যানসেল। সব বাতিল।ক্যানসোল হওয়ার মতই।কী বললি? রহমানের খোঁজ নেই। নো ট্রেস।নো ট্রেস মানে? নো ট্রেস মানে নো ট্রেস। সে আমার সঙ্গেই ঢাকায় ঢুকেছে। তারপর যেখানে যাবাব কথা সেখাদ্যযন্ধু, কোথায় আছে তাও কেউ জানে না। একগাদা এক্সপ্লোসিভ তার সাথে।বলিস কী? আমার আক্কেল গুডুম হয়ে গিয়েছিল। ডুব মারলাম। তিনদিন ডুব দিয়ে থাকার পর গেলাম ঝিকাতলা। কনটাক্ট পয়েন্টে। সেখানেও ভোঁ ভোঁ। কেউ নেই।এখন ব্যাপারটা কোন পর্যায়ে আছে?
বলছি। তার আগে বাথরুমে যাওয়া দরকার। কিডনি ফেটে যাওয়ার মতো অবস্থা। হেভি প্রেসার।আলম ইতস্তত করে বলল, এখানে বাথরুমের একটু অসুবিধা আছে। বাইরে চলে যা, রাস্তার পাশে কোথাও বসে পড়। সাদেক বেরিয়ে গেল। এ বাড়িতে এসে সে খানিকটা ধাঁধায় পড়ে গেছে। দেড় ঘণ্টা একা একাই বসে ছিল। এর মধ্যে ঘোমটা দেয়া এক মহিলা এসে বললেন, আলম বাইরে গেছে। এসে পড়বে। তুমি বস। এ রকম শীতল কণ্ঠ সাদেক এর আগে শোনেনি। যেন একজন মরা মানুষ কথা বলছে।প্রায় আধঘণ্টা পর বাইশ-তেইশ বছর বয়েসী চকলেট রঙ শাড়ি পরা একটি মেয়ে এসে ঢুকল এবং সরু চোখে তাকিয়ে রইল। এ রকম রূপবতী মেয়েদের সাধারণত সিনেমা পত্রিকার কভারে দেখা যায়। বাড়িতে তাদের দেখতে পাওয়ার কথা নয়। সাদেক ঘাবড়ে গিয়ে বলল, কিছু বলবেন আমাকে? মেয়েটি তার মার মত শীতল গলায় বলল, আপনি কী দুপুরে এখানে খাবেন?
কি অদ্ভুত কথা। অচেনা, অজানা একটা মানুষকে কেউ এভাবে বলে নাকি? সাদেক অবশ্যি নিজেকে চট করে সামলে নিয়ে বলল, জি খাব। দুপুরে কী রান্না হচ্ছে? মেয়েটি এই কথার জবাব দেয়নি। ভেতরে চলে গেছে। তারপর খাটাং খটাং শব্দ। সেলাই মেশিন চলতে শুরু করেছে। মেয়েটি চায়ের কাপ নিয়ে এসেছে কিছুক্ষণ পর। কাপ নামিয়ে বলেছে। চিনি লাগবে কিনা বলুন।না লাগবে না।চুমুক দিয়ে বলুন। চুমুক না দিয়েই কিভাবে বললেন? সাদেক চুমুক দিয়েছে। তার বাথরুমে যাওয়া দরকার ছিল। কিন্তু এ রকম রূপবতী একটি মেয়েকে নিশ্চয়ই বলা যায় না। আমি একটু ইয়েতে যাব। সাদেক বসে বসে তেতাল্লিশ পৃষ্ঠা পর্যন্ত প্রথম কদম ফুল পড়ে ফেলল। বইটা থাকায় রক্ষা। নয়ত সময় কাটানো মুশকিল হত। ফেরার সময় বইটা সঙ্গে করে নিতে হবে। কোনো কাজ আধাআধি করে রাখা ঠিক না। মরে গেলে একটা আফসোস থাকবে।
সাদেক অল্প কথায় কিছু বলতে পারে না। কিংবা বলার চেষ্টাও করে না। রহমানের খোঁজ পাওয়া গেছে। সে ভালই আছে–এই খবরটা বেবি করতে অ্যালমের এক ঘণ্টা লাগল। তাও পুরোপুরি বের করা গেল না। কেন রহমান যেখানে উঠার কথা ছিল সেখানে উঠেনি। সেটা জানা গেল না।জিনিসপত্র সব এসেছে? এসেছে কিছু কিছু।কিছু কিছু মানে কী? কিছু কিছু মানে হচ্ছে কিছু কিছু।আলম বিরক্ত হয়ে বলল, যা বলার পরিষ্কার করে বল। অর্ধেক কথা পেটে রেখে দিচ্ছিস কেন? কী কী জিনিসপত্র এসেছে? যা যা দরকার সবই এসেছে। শুধু এলএমজি আসেনি।আসেনি কেন? আমাকে বলছিস কেন? আর এ রকম ধমক দিয়ে কথা বলছিস কেন? জিনিসপত্র আনার দায়িত্ব আমার ছিল না। এক্সপ্লোসিভ আনার কথা ছিল, নিয়ে এসেছি।কোথায় সেগুলি?
জায়গামতই আছে।প্রোগ্রামটা কী? সাদেক সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, সেটা তুই ঠিক করা। তুই হচ্ছিস লিডার। তুই যা বলবি, তাই।সবার সঙ্গে কথা বলা দরকার।কারো সঙ্গে কথা বলার দরকার নেই। ফাইন্যাল প্রোগ্রামটা শুধু ওদের জানাব। সেই ভাবে কাজ হবে। প্রথম দানেই ছক্কা ফেলতে হবে।ছক্কা ফেলতে হবে মানে? সাদেক বিরক্ত হয়ে বলল, তুই কী বাংলাও ভুলে গেছিস? ছক্কা পাঞ্জাও তোর কাছে এক্সপ্লেইন করতে হবে? প্রথম দানে ছক্কা মানে প্রথম অপারেশন হবে ক্লাস ওয়ান। ওয়ান হানড্রেড পারসেন্ট সাকসেস। বুঝতে পারছিস? আলম চুপ করে রইল। সাদক সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বলল, তুই কেমন অন্য রকম হয়ে গেছিস! কী রকম?
কেমন যেন সুখী সুখী চেহারা হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে তুই এ বাড়ির জমাই। সাদেক গলা ফাটিয়া হাসতে লাগল। অস্বস্তিকর অবস্থা। আলম বিরক্তমুখে বলল, এত হাসছিস কেন? হাসির কী হয়েছে? তুই কেমন পুতুপুতু হয়ে গেছিল তাই দেখে হাসি আসছে। মোনালিসার প্রেমে পড়ে গেছিল চুপ কর।ভাবভঙ্গি তো সে রকমই। মজনু মজনু ভাব। অবশ্যি যে জিনিস দেখলাম প্রেমে পড়াই উচিত।সাদেককে আটকানো মুশকিল। যা মনে আসবে বলবে। আলম চিন্তায় পড়ে গেল। সে গম্ভীর গলায় বলল, আজেবাজে কথা বন্ধ করা। কাজের কথা বল। মোটামুটি একটা প্ল্যান দাঁড় করানো যাক। আমরা বেরুব কখন?
কার্ফুর আগে আগে বের হওয়াই ভাল। রাস্তাঘাটে লোক চলাচল সে সময়টায় বেশি থাকে। গাড়ি-টাড়ি চলে। সময়টা ধর সাড়ে তিন থেকে চার।কথাবার্তার এই পর্যায়ে বিন্তি এসে বলল, আপনেরো খাইতে ডাকে। আহেন।খাবার টেবিল বারান্দায়। খাবার দেয়া হয়েছে দু’জনকেই। এ বাড়ির কেউ বসেনি। সুরমা দাঁড়িয়ে রইলেন। ঠাণ্ডা, গলায় বললেন, নিজেরা নিয়ে খাও। সাদেক সঙ্গে সঙ্গে বলল, কোনো অসুবিধা নেই খালাম্মা। আপনার থাকতে হবে না। খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে আমার কোনো লজ্জা নেই।লজা না থাকাই ভাল।আমার কোনো কিছুতেই লজ্জা নেই। আলমের সঙ্গে আমার বনে না। এই জন্যেই। কয়েকটা শুকনো মরিচ ভেজে আনতে বলুন তো খালাম্মা। ঝাল কম হয়েছে।সুরমা নিজেই গেলেন। সাদেক মাথা ঘুরিয়ে চারদিকে দেখতে লাগল। মৃদু স্বরে বলল, বেশি পরিষ্কার। ভাগ্যিস এ বাড়িতে আমি উঠিনি। আমার এখানে উঠার কথা ছিল। বাড়ির মালিক কী করেন?
জানি না। কী করেন? বলিস কী, ভদ্রলোক কি করেন জানিস না? না।মেয়েটার নাম কী? না তাও জানিস না? ওর নাম রাত্রি।রাত্রি? বাহ, চমৎকার তো! জোছনা রাত্রি নিশ্চয়ই। হা হা হা।আস্তে হাস।সুরমা কাচের প্লেটে ভাজা শুকনা মরিচ নিয়ে ঢুকতেই সাদেক বলল, রাত্রি খাবে না? হোস্টদের তরফ থেকে কারোর বসা উচিত। সুরমা শান্ত স্বরে বললেন, তোমরা খাও, ওরা পরে খাবে।পরে খাবে কেন? ডাকুন, গল্প করতে করতে খাই।সুরমা অনেকক্ষণ সাদেকের দিকে তাকিয়ে থেকে সত্যি সত্যি রাত্রিকে ডাকলেন। এবং আশ্চর্য! রাত্রি একটি কথা না বলে খেতে বসল। সাদেক হাত-টাত নেড়ে একটা হাসির গল্প শুরু করল। ছেলেবেলায় দৈ মনে করে এক খাবলা চুন খেয়ে তার কী দশা হয়েছিল।
দশ দিন মুখ বন্ধ করতে পারেনি। হা করে থাকতে হত। সেই থেকে তার নাম হয়ে গেল ভেটকি মাছ। ভেটকি মাছ মুখ বন্ধ করে না, হা করে থাকে। গল্প শুনে কেউ হাসল না। সাদেক একাই বারান্দা কাঁপিয়ে হাসতে লাগল।ফার্স্ট ক্লাস রান্না হয়েছে খালাম্মা। খাওয়ার পর আমি পান খাব। পান আছে ঘরে? না থাকলে বিন্তিকে পাঠিয়ে দিন, নিয়ে আসবে।সুরমা বিন্তিকে পান আনতে পাঠালেন। সাদেক রাত্রির দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল, আপনি এত গম্ভীর হয়ে আছেন কেন? রাত্রি কিছু বলল না।আপনি ইউনিভার্সিটিতে পড়েন নিশ্চয়ই। চেহারা দেখেই মনে হচ্ছে। ইউনিভার্সিটিতে পড়া মেয়েগুলি গম্ভীর হয় খুব।আমি ইউনিভার্সিটিতেই পড়ি।কোন সাবজেক্ট? কেমিস্ট্রি।
সর্বনাশ! মেয়েরা এত কঠিন কঠিন সাবজেক্ট কেন পড়ে বুঝতে পারি না। মেয়েরা পড়বে বাংলা।রাত্রি উঠে পড়ল। আলম একটা মজার ব্যাপার লক্ষ্য করল। রাত্ৰি মেয়েটি বিরক্ত হয়নি। সাদেকের কথাবার্তার ধরনে যে-কেউ বিরক্ত হত। হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই মেয়েটি হয়নি। হাত ধুয়ে এসে সে আবার চেয়ারে বসল এবং চামচে করে ভাত তুলে দিল সাদেকের প্লেটে। তুলে দেয়ার ভঙ্গিটা সহজ ও স্বাভাবিক।সাদেক দুপুর তিনটা পর্যন্ত থাকল। মৃদু গলায় প্ল্যান নিয়ে কথা বলল। প্রথম দিনের অপারেশনের জায়গাগুলি ঠিক করল। রেকি করবার কি ব্যবস্থা করা যায় সে নিয়ে কথা বলল। অপারেশন চালাতে হবে অচেনা গাড়ি দিয়ে। সেই গাড়ির জোগাড় কিভাবে করা যায়। সেই নিয়েও কথা হল। আগামীকাল ভোরে আবার বসতে হবে। এ বাড়িতে নয়। পাক মটরস-এর কাছের একটি বাড়িতে। সেখানে রহমানও থাকবে। প্রোগ্রাম ফাইন্যাল করা হবে সেখানেই।
সাদেক যাবার আগে সুরমাকে পা ছুঁয়ে সালাম করল। সুরমা হকচাকিয়ে গেলেন।দোয়া করবেন খালাম্মা।হ্যাঁ নিশ্চয়ই দোয়া করব।রাত্রিকে ডাকুন। ওর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যাই।রাত্রি এল। খুব সহজ এবং স্বাভাবিক ভঙ্গিতে সাদেক বলল, রাত্ৰি চলি। আবার দেখা হবে। যেন এ বাড়ির সঙ্গে তার দীর্ঘদিনের চেনাজানা। রোজই আসছে, যাচ্ছে। রাত্ৰি হেসে ফেলে বলল, হ্যাঁ নিশ্চয়ই দেখা হবে। ভাল থাকবেন।সাদেক ঘর থেকে বেরুবামাত্র রাত্রি বলল, আপনার বন্ধুর সঙ্গে আপনার কোন মিল নেই। দু’জন সম্পূর্ণ দুরকম। ও কী আপনার খুব ভাল বন্ধু?
হ্যাঁ ভাল বন্ধু। ও কিন্তু একটি অসম্ভব ভাল ছেলে।তা জানি।কিভাবে জানেন? কিছু কিছু জিনিস টের পাওয়া যায়। আপনার হয়ত ধারণা হয়েছে। আমি উনার ওপর বিরক্ত হয়েছি। এটা ঠিক না। আমি বিরক্ত হইনি।অনেক দিন পর আলম দুপুর বেলা ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুম ভাঙল সন্ধ্যা মিলাবার পর। বিন্তি চায়ের পেয়ালা হাতে তাকে ডাকছে। বাইরে প্রবল বর্ষণ। ঘোর বর্ষা যাকে বল। মতিন সাহেব বসে আছেন সোফায়। তাকে কেমন যেন চিন্তিত মনে হচ্ছে। আলম উঠে বসতেই তিনি বললেন, শরীর খারাপ করেছে নাকি? জি না।হাত-মুখ ধুয়ে আস। একটা খারাপ খবর আছে।কী সেটা? আমেরিকানরা সেভেনথ ফ্লিট নিয়ে বঙ্গোপসাগরের দিকে রওনা হয়েছে।আলম এই খবরে তেমন কোনো উৎসাহ দেখাল না। তার কাজকর্মের সঙ্গে আমেরিকান সেভেনথ ফ্লিটের কোন সম্পর্ক নেই। মতিন সাহেব নিচু গলায় বললেন, এর চেয়েও একটা খারাপ সংবাদ আছে।
বলুন শুনি।ঢাকা শহরে চাইনজি সোলজার দেখা গেছে।আপনি নিজে দেখেছেন? না, আমি নিজে দেখিনি। কিন্তু দেখেছেন অনেকেই। নাক চেঁপা বাঁটু সোলজার। দেখলেই চেনা যায়।আলম বাসিমুখে চায়ে চুমুক দিতে লাগল। গুজবে ভর্তি হয়ে গেছে। ঢাকা শহর। মানুষের মরাল ভেঙে পড়ছে। ঢাকা শহরের গেরিলাদের প্রথম কাজই হবে এই মরাল ঠিক করা। নতুন ধরনের গুজবের জন্ম দেয়া। যা শুনে একেকজনেব বুকেব ছাতি ফুলে উঠবে। এবা রাতে আশা নিযে ঘুমুতে যাবে। মতিন সাহেবের মত প্রাণহীন মুখ করে সোফায় বসে থাকবে না। আলম।বলুন।শুনলাম তোমার এক বন্ধু নাকি এসেছিল? জি।কাজ তাহলে শুরু হচ্ছে? হচ্ছে।
অবস্থা কাহিল হয়ে যাবে ওদের, কী বল? তা হবে।এক লাখ নতুন কবর হবে, কী বল? হওয়ার তো কথা।যশোহরের এক পীর সাহেব কী বলেছেন শুনবে কী? বলুন।খুবই কামেল আদমি। সুফী মানুষ।মতিন সাহেব অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে যশোবের পীর সাহেবের কথা বলতে লাগলেন। আলম কোনো কথা না বলে গল্প শুনে গেল। ডুবন্ত মানুষরাই খড়কুটো আঁকড়ে ধরে। ঢাকার মানুষ কী ডুবন্ত মানুষ? তারা কেন এ রকম করবে? আলম একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস চাপতে চেষ্টা করল।রাত্রির ঘর অন্ধকার। সে বাতি নিভিয়ে চুপচাপ শুয়েছিল। অপালা এসে বলল, ফুফু টেলিফোন করেছে। তোমাকে ডাকে। রাত্রি একবার ভাবল টেলিফোন ধরবে না। বলে পাঠাবে শবীর ভাল না, জ্বরজ্বর লাগছে। কিন্তু তাতে লাভ হবে না। ফুফু বলবেন রিসিভার এ ঘরে নিয়ে আসতে। তার চেয়ে টেলিফোন ধরাই ভাল।কেমন আছিস রাত্রি?
ভাল।তোদের ইউনিভার্সিটি নাকি খুলেছে? ক্লাস-টাস হচ্ছে? হ্যাঁ হচ্ছে।তুই যাচ্ছিস না? না। পরীক্ষা নাকি ঠিকমত হবে শুনলাম? হলে হবে।তোর গলাটা এত ভারী ভারী লাগছে কেন? জ্বর নাকি? না, জ্বর না।কাল গাড়ি পাঠাব। চলে আসবি আমার এখানে।আচ্ছা।আরেকটা কথা শোন, ঐ ভদ্রমহিলা আসবেন তোকে দেখতে। দেখলেই যে বিয়ে হবে এমন তো কোনো কথা না। তোর মত মেয়েকে কি কেউ জোর করে বিয়ে দিতে পারে? তোর অনিচ্ছায় কিছু হবে না। বুঝতে পারছিস? পারছি।
কাজেই ভদ্রমহিলা এলে স্বাভাবিকভাবে কথাবার্তা বলবি।ঠিক আছে বলব।রাত্রি আরেকটা কথা শোন–আমাদের ড্রাইভার বলল সে দেখেছে কে একজন লোক তোদের বসার ঘরের ক্যাম্প খাটে শুয়ে আছে। কে সে?আব্বার এক বন্ধুর ছেলে।এখানে সে কী করছে? কি একটা কাজে ঢাকায় এসেছে। থাকার জায়গা নেই। বুধবারে চলে যাবে।নাসিমা বিরক্ত স্বরে বললেন– থাকার জায়গা নেই মানে? হোটেল আছে কী জন্যে? বাড়িতে সেয়ানা মেয়ে। এর মধ্যে ছেলে-ছোকরা এনে ঢুকানোর মানেটা কী? দেখি তোর বাবাকে টেলিফোনটা দে তো।
Read more