রাকিব হাসিমুখে তাকাল আশফাকের দিকে এবং নরম গলায় বলল, তুমি ওর সঙ্গে যাও। এবং শুনে রাখা এখন বাজে নটা কুড়ি, তুমি নটা পঁয়ত্ৰিশ মিনিটে প্রচুর কথা বলবে। সবার বাড়ি দেখিয়ে দেবে। ধরিয়ে দেবে। আমি এই নিয়ে তোমার সঙ্গে দশ হাজার টাকা বাজি রাখতে পারি।যে লোকটি আশফাকের ডান হাত নিজের মুঠোয় ধরে রেখেছে তার মুখ গোলাকার। এ রকম গোল মানুষের মুখ হয়? যেন কম্পাস দিয়ে মুখটি আঁকা। তার হাতটিও মেয়েদের হাতের মত তুলতুলে নরম। লোকটি পেনসিলের মত সাইজের একটি কাঠি। আশফাকের দুআঙুলের ফাকে রাখল। আশফাকের মনে হচ্ছে এটা একটা স্বপ্নদৃশ্য। বাস্তবে এ রকম কিছু ঘটছে না।
গোলাকার মুখের এ লোকটি তার হাত নিয়ে খেলা করছে। আশফাক নিজেই বুঝতে পারল না যে সে পশুর মত আঁ আঁ করে চিৎকার করে উঠেছে। কেউ কী টেনে তার হাতটি ছিঁড়ে ফেলেছে? কী করছে এরা? কী করছে? তীব্র তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা। দ্বিতীয়বারের মত চিৎকার করেই সে জ্ঞান হারাল।মেজর রাকিব তাকিয়ে আছে তার দিকে। কি সুন্দর চেহারা এই লোকটির! নাদিমের সঙ্গে মিল আছে। নাকটা লম্বা।আশফাক, তোমার জ্ঞান ফিরেছে মনে হচ্ছে। ভালই হয়েছে। গাড়ি এসে গেছে। চল, যাওয়া যাক। নাকি যাবার আগে আরেক কাপ কফি খাবে?
আশফাক তাকিয়ে আছে। লোকটি নাদিমের মত লম্বা নয়। একটু খাট। বড়জোর পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি।আশফাক, তুমি ওদের ঠিকানা জান নিশ্চয়ই। জানি না? কয়েকজনের জানি। সবার জানি না।ওতেই হবে। ব্যাপারটা হচ্ছে মাকড়সার জালের মত। একটা সুতার সন্ধান পাওয়া গেলে জালটা খুঁজে পাওয়া যায়। আশফাক।বলুন! চল, রওনা হওয়া যাক।আমি আপনাকে কিছুই বলব না।কিছুই বলবে না? না।মাত্র দু’টি আঙুল তোমার ভাঙা হয়েছে। তোমার হাতে আরো আটটি আঙুল আছে।আমি কিছুই বলব না।তোমার মাথা গরম হয়ে গেছে।
অনেক সময় ব্যথার পরিমাণ বেশি হলে মাথা গরম হয়ে যায়। তুমি মাথা ঠাণ্ডা কর। কফি খাও, সিগারেট খাও। তারপর আমরা কথা বলব। নাকি সলিড় কিছু খাবে? গোশত পরোটা? আশফাক কিছু বলল না। সে তাকিয়ে আছে তার বা হাতের দিকে। মুহূর্তের মধ্যে কেমন ফুলে উঠেছে। একি সত্যি তার হাত? আশফাক গোশত, পরটা খুব আগ্রহ করে খেল। তার এতটা ক্ষিধে পেয়েছিল সে নিজেও বুঝতে পারেনি। ঝাল দিয়ে রান্না করা গোশত। চমৎকার লাগছে। পশ্চিমারা এতটা ঝাল খায় তার জানা ছিল না।
আশফাক! জি।আরো লাগবে? জি না।কফি চলবে? একটা পান খাব।পান খাওয়া যাবে না। দোকানপাট বন্ধ। এখন কার্ফু চলছে। সিগারেট আছে তো? না থাকলে বল।জি আছে।চল, তাহলে রওনা দেওয়া যাক।কোথায়? তুমি তোমার বন্ধুদের দেখিয়ে দেবে। বাড়ি চিনিয়ে দেবে।আশফাক অনেক কষ্টে এক হাতে দেয়াশলাই জ্বলিয়ে সিগারেট ধরাল। অনেকখানি সময় নিয়ে ধোয়া ছাড়ল। বেশ লাগছে সিগারেট।মেজর সাহেব।বল।আমি কিছুই বলব না।কিছুই বলবে না? জি না। আপনি তো আমাকে মেরেই ফেলবেন। মারেন। কষ্ট দেবেন না। কষ্ট দেয়া ঠিক না।মরতে ভয় পাও না? জি পাই। কিন্তু কি করব বলেন। উপায় কি?
উপায় আছে। ধরিয়ে দাও ওদের। আমি তোমাকে ছেড়ে দেবার ব্যবস্থা করব। আমি ব্যক্তিগতভাবে এই গ্যারান্টি তোমাকে দিচ্ছি।মেজর সাহেব, এটা সম্ভব না।সম্ভব না? জি না। আমি তো মানুষের বাচ্চা। কুকুর বিড়ালের বাচ্চা তো না।তুমি মানুষের বাচ্চা? জি, আমাকে কষ্ট দেবেন না মেজর সাহেব। মেরে ফেলতে বলেন। কষ্ট সহ্য করতে পারি না।মেজর রাকিব। দীর্ঘ সময় তাকিয়ে রইল। এই ছেলেটির যাবতীয় যন্ত্রণার অবসান করবার জন্যে তার ইচ্ছা করছে। কিন্তু তা সম্ভব নয়। খবর বের করতেই হবে। এটা একটা মাকড়সার জাল। একটা সুতা পাওয়া গেছে। জালটিও পাওয়া যাবে। যেতেই হবে। মানুষ আসলে একটি দুর্বল প্ৰাণী। মেজর রাকিব আশফাকের আরো দু’টি আঙুল ভেঙে ফেলার হুঁকুম দিয়ে নিজের ঘরে এসে বসল।
বাইরে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছে।রাত এগারোটায় টেলিফোন। নাসিমা ভয়ে ভয়ে টেলিফোন ধরলেন।কে? ফুফু, আমি। কী ব্যাপার রাত্রি? গলা এরকম শুনাচ্ছে কেন? কী হয়েছে? কিছু হয়নি। ফুফু, তোমার কাছে যে একজন ভদ্রমহিলা এসেছিলেন। মেডিকেল কলেজের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর মিসেস রাবেয়া করিম, উনার টেলিফোন নম্বর দাও।কেন? খুব দরকার ফুফু। তুমি দাও।কী হয়েছে বলা? বলছি। নম্বরটা দাও আগে। তোমার পায়ে পড়ি ফুফু।নাসিমা অবাক হয়ে শুনলেন রাত্ৰি ফুপিয়ে কাঁদছে। তিনি নম্বর এনে দিলেন।সেই নম্বরে বারবার টেলিফোন করেও কাউকে পাওয়া গেল না। রিং হচ্ছে, কেউ ধরছে না।
মতিন সাহেব ঠিক একই ভঙ্গিতে কাঁধ চেপে ধরে আছেন। তার ধারণা রক্ত বন্ধ হয়েছে। তিনি মনে মনে সারাক্ষণ সুরা এখলাস পড়ছেন।আলম এখন আর পানি খেতে চাচ্ছে না। খানিকটা আচ্ছন্নের মত হয়ে পড়েছে। সুরমা এক কাঁপা গরম দুধ খাওয়াতে চেষ্টা করলেন। এটা সে খেতে পারল বলে মনে হল।তার জ্ঞান আছে। ডাকলে সাড়া দেয়। চোখ মেলে তাকায়। সেই চোখ টকটকে লাল।মতিন সাহেব বললেন, মাথায় জলপট্টি দেয়া দরকার। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। সুরমা ভেজা তোয়ালে নিয়ে এস।ভেজা তোয়ালে দিয়ে কপাল স্পর্শ করতেই আলম কেঁপে উঠল। সুরমা মৃদু স্বরে বললেন, বাবা, এখন রাত দুটো বাজে। ভোর হতে বেশি বাকি নেই। ভোর হলেই যে ভাবেই হোক তোমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করব। তুমি শক্ত থাক।
আশফাক তাকিয়ে আছে। শূন্য দৃষ্টিতে। মেজর রাকিবের মুখ এমন গোলাকার লাগছে কেন? তার মুখ তো এমন ছিল না। গোল মুখ ছিল ঐ লোকটির যে আঙুল ভাঙে। ভাঙার সময় কেমন টুক করে শব্দ হয়।আশফাক।জি।চিনতে পারছ আমাকে? জি। আপনি মেজর রাকিব।তুমি কী এখন বলবে? জি না। মেজর সাহেব, আপনি আমাকে মেরে ফেলেন, কষ্ট দেবেন না।মেজর রাকিব তাকিয়ে রইল। এই ছেলেটি কোনো কথা বলবে না। এ বিষয়ে সে এখন নিঃসন্দেহ। তার প্রচণ্ড রাগ হওয়া উচিত। কিন্তু কেন জানি হতে পারছে না।
সে ঠাণ্ডা গলায় বলল, তুমি কী কিছু খেতে চাও? কফি কিংবা সিগারেট? খেতে চাইলে খেতে পার। চাও কিছু? জি না। ধন্যবাদ মেজর সাহেব। বহুত শুকরিয়া।আশফাক। জি।তুমি কী বিবাহিত? জি স্যার।ছেলে মেয়ে আছে? জি না।নতুন বিয়ে? জি।স্ত্রীকে ভালবাস? আশফাক জবাব দিল না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। মেজর রাকিব সহজ ভঙ্গিতে বলল, জবাব দাও। ভালবাস? জি স্যার।তাহলে তো ওর জন্যেই বেঁচে থাকা উচিত। উচিত নয় কী?
জি, উচিত।তাহলে বোকামি করছি কেন? তোমার কী ধারণা কয়েকটি ছেলে ধরা পড়লে যুদ্ধ বন্ধ হযে যাবে? তা তো না। নতুন নতুন ছেলে আসবে। এবং কে জানে এক সময় যুদ্ধে তোমরা জিতেও যেতে পার। পার না? জি স্যার, পারি।নিজের জীবনের চেয়ে মূল্যবান আর কিছুই নেই। এটা একটা সহজ সত্য। তুমি নেই তার মানে তোমার কাছে পৃথিবীর কোনো অস্তিত্ব নেই–দেশ তো অনেক দুরের কথা। আমি কী ঠিক বলছি? জি স্যার, ঠিক।বেশ এখন তুমি কথা বল। চল আমার সঙ্গে। শুধুমাত্র একজনকে ধরিয়ে দাও। আমি কথা দিচ্ছি, ভোরবেলায় তোমাকে ছেড়ে দেবার ব্যবস্থা করব।
আশফাক অনেকক্ষণ মেজর রাকিবের দিকে তাকিয়ে রইল। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। তাকাল তার ফুলে উঠা হাতের দিকে। আহ কী অসম্ভব যন্ত্রণা। যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে ইচ্ছা! করে। খুবই ইচ্ছা করে।চল, আশফাক। চল। দেরি হয়ে যাচ্ছে।স্যার, আমি কিছু বলব না।বলবে না? জি না।দু’জন দীর্ঘ সময় দুজনের দিকে তাকিয়ে রইল। মেজর রাকিব বেল টিপে কাকে যেন ডাকল। শীতল গলায় আশফাককে মেরে ফেলবার নির্দেশ দিল। আশফাক বিড়বিড় করে বলল, স্যার যাই। স্নামালিকুম।আলম কোন সাড়া শব্দ করছে না। তার পা আগুনের মত গরম। কিছুক্ষণ আগেও ছটফট করছিল। এখন সে ছটফটানি নেই। একবার শুধু বলল, পানি খাব। পানি দিন।
মতিন সাহেব চামচে করে পানি দিলেন। সে পানি খেল না। মুখ ফিরিয়ে নিল।পানি চেয়েছিলে তুমি। একটু হা কর।না।ব্যথা কী খুব বেশি? না বেশি না।মতিন সাহেব চিন্তিত বোধ করলেন। হঠাৎ করে ব্যথা কমে যাবে কেন? এর মানে কী? আলম! আলম! জি।ভোর হতে খুব দেরি নাই। তোমার আত্মীয়-স্বজন কাকে খবর দেব বল তো।আলম জবাব দিল না। মতিন সাহেব এই প্রশ্নটি দ্বিতীয়বার করলেন। আলম বলল, কাউকে বলতে হবে না।কেন বলতে হবে না। নিশ্চয়ই বলতে হবে।কেন বিরক্ত করছেন? মতিন সাহেব চুপ করে গেলেন।আলম বিড়বিড় করে বলল, আমার মাথার নিচে আরেকটা বালিশ দিন।
তার কাছে মনে হচ্ছে তার মাথা ক্রমেই নিচে নেমে যাচ্ছে। টেনে কেউ তাকে নিয়ে যাচ্ছে অতলান্তিক জলে। কিছুতেই ভাসিয়ে রাখা যাচ্ছে না। ঘরবাড়ি অচেনা হয়ে যাচ্ছে। সে কী মারা যাচ্ছে! মরবার আগে সমস্ত অতীত স্মৃতি নাকি ঝলসে ওঠে। কই সে রকম তো কিছু হচ্ছে না। চোখের সামনে কিছুই ভাসছে না। কোন স্মৃতি নেই। চেষ্টা করেও কোনো কিছু মনে করা যাচ্ছ না। যতবার সে কিছু মনে করবার চেষ্টা করছে ততবারই সাদেকের মুখ ভেসে উঠছে। নূরুর মুখের ছবি আসছে না। অথচ গাড়ি থেকে বের হবার সময় সে এই দুজনের দিকেই তাকিয়ে ছিল। তার চেয়েও আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে নূরুকে সে অনেক বেশি পছন্দ করে। অনেক বেশি। কী ঠাণ্ডা একটা ছেলে। বয়স কত হবে? কুড়ি একুশ? তার চেয়েও কম হতে পারে। কোনোদিন জিজ্ঞেস করা হয়নি। জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল। মতিন সাহেব।কী বাবা?
আমাদের সঙ্গে দু’টি ছেলে ছিল। ওরা মারা গেছে।বাবা, তুমি চুপ করে থাক। কথা বলবে না। কোনো কথা বলবে না।পানি খাব।বিন্তি এক চামচ পানি দিল মুখে। রাত্রি এসে দাঁড়িয়েছে। দরজার পাশে। সেখানে থেকেই সে বলল, আপনার কী এখন একটু ভাল লাগছে? রাত সাড়ে তিনটা, সকাল হতে বেশি বাকি নেই।আলমের মাথা আবার কেমন ভারী হয়ে যাচ্ছে। সে কী আবার তলিয়ে যেতে শুরু করেছে? কিন্তু সে তলিয়ে যেতে চায় না। জেগে থাকতে হবে। মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে।
পাশা ভাইও এ রকম গুলি খেয়েছিল। গুলি লেগেছিল পেটে। ভয়াবহ অবস্থা। কিন্তু পাশা ভাই ছিলেন ইস্পাতের মত। মৃত্যুর আগ মুহূর্তেও বললেন–আমাকে মেরে ফেলা এত সহজ না। সামান্য একটা সিসার গুলি আমাকে মেরে ফেলবে। পাগল হয়েছিস তোরা? বিনা যুদ্ধে নাহি দেব সুচাগ্র মেদিনী। কথায় কথায় কবিতা বলতেন। ছড়া বলতেন। দেশের সেরা সন্তানদের আমরা হারাচ্ছি। এরা দেশের শ্রেষ্ঠতম ফসল। এই দেশ বীর প্রসবিনী।রাত্রির পাশে তার মা এসে দাঁড়িয়েছেন। কী করুণ লাগছে ভদ্রমহিলার মুখ। আলম একবার ভাবল বলবে, আপনাদের অনেক ঝামেলায় ফেললাম। কিন্তু বলা গেল না। বললে নাটকীয় শোনাবে। বাড়তি নাটকের এখন কোনো দরকার নেই। আলম বলল, ক’টা বাজে?
তিনটা পঁয়ত্ৰিশ।মাত্র পাঁচ মিনিট গিয়াছে? সময় কী থেমে গেছে? কে একজন ছিল না যে সময়কে থামিয়ে দিয়েছিল? কী নাম যেন? মহাবীর থর? না অন্য কেউ? সব এলোমোলো হয়ে যাচ্ছে। আবার সাদেকের মুখটা ভাসছে। মৃত মানুষদের কথা এখন আমি ভাবতেই চাই না। কিছুতেই না। আমি ভাবতে চাই জীবিত মানুষদের কথা। মার কথা ভাবতে চাই। বোনের কথা ভাবতে চাই। এবং এই মেয়েটির কথাও ভাবতে চাই। রাত্রি! কী অদ্ভুত না।আলম পাশ ফিরতে চেষ্টা করল। সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়ল তীব্র তীক্ষা ব্যথা। আবার সে ডুবে যেতে শুরু করেছে। সে বিড়বিড় করে বলল, মতিন সাহেব মাথাটা একটু উঁচু করে দিন।রাত্রি একা একা বারান্দায় বসে আছে। সে তাকিয়ে আছে নারকেল গাছের দিকে। সেখানে বেশ কিছু জোনাকি ঝিকমিক করছে। শহরেও জোনাকি আছে তার জানা ছিল না।ভাল লাগছে। ওদরে দিকে তাকিয়ে থাকতে।
পাশের বাড়িতে দোতলা ফ্ল্যাটে একটি ছোট বাচ্চা কাঁদছে। তার মা তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না।আকাশ পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। একটি দু’টি করে তারা ফুটতে শুরু করেছে। রাত্ৰি লক্ষ্য করল আকাশের তারার সঙ্গে জোনাকিদের চমৎকার মিল আছে।বাচ্চাটা কান্না থামিয়েছে। হয়ত দুধ বানিয়ে দিয়েছে তার মা। নিশ্চিত হয়ে ঘুমুচ্ছে। আহ শিশুরা কত সুখী।সুরমা বারান্দায় এসে তাকালেন মেয়ের দিকে। তাঁর বুক ধক কবে একটা একটা ধাক্কা লাগল। রাত্রি! কী মা? এক একা বসে আছিস কেন? রাত্ৰি জবাব দিল না। তাকিয়ে রইল জোনাকিব দিকে। সুরমা ক্লান্ত স্বরে বললেন, ভোব হতে দেরি নেই।রাত্রি ঠিক আগের মতই বসে রইল। সুরমা বললেন, তুই চিন্তা করিস না। আমার মনে হয় ও সুস্থ হয়ে উঠবে। তোর মনে হয় না?
আমার কিছু মনে-টনে হয় না।বলতে গিয়ে রাত্রির গলা ধরে গেল। ইচ্ছা করল চেঁচিয়ে কেঁদে উঠতে।সুরমা বসলেন মেয়ের পাশে। একটি হাত রাখলেন তার পিঠে। অস্বাভাবিক কোমল স্বরে বললেন, দেশ স্বাধীন হয়ে যাবার পর আমি আলমের মার কাছে গিয়ে বলব চরম দুঃসময়ে আমরা আপনার ছেলের কাছে ছিলাম। তার ওপর আমাদের দাবি আছে। এই ছেলেটিকে আপনি আমায় দিয়ে দিন।দুজনে অনেকক্ষণ কোনো কথা বলল না–রাত্রির চোখ দিয়ে ক্রমাগত জল পড়তে লাগল। সুরমা মেয়েকে কাছে টানলেন। চুমু খেলেন তার ভেজা গালে।রাত্রি ফিসফিস করে বলল, জোনাকিগুলিকে আর দেখা যাচ্ছে না কেন মা? জোনাকি দেখা যাচ্ছে না। কারণ ভোর হচ্ছে। আকাশ ফর্সা হতে শুরু করছে। গাছে গাছে পাখপাখালি ডানা ঝাপ্টাচ্ছে। জোনাকিদের এখন আর প্রয়োজন নেই।