আজ আমি কোথাও যাব না পর্ব – ৫ হুমায়ূন আহমেদ

আজ আমি কোথাও যাব না পর্ব – ৫

ঘরে কি টেলিভিশন চলছে? টেলিভিশনের শব্দই তো আসছে। কার্টুন চ্যানেল। ঝা ঝুমঝুম ঋ মিউজিক। পৃথুর হাসি শোনা যাচ্ছে। এই ছেলেটার হাসি খুব অদ্ভুত। খিলখিল করে হাসতে হাসতে হঠাৎ থেমে একেবারে চুপচাপ। একশ কিলোমিটারের গাড়ি হঠাৎ ব্রেক কষে থেমে গেল।শামসুদ্দিনের মনে হলো তিনি স্বপ্ন দেখছেন। ঘরে টিভি থাকার কথা না। রফিক টিভি বিক্রি করে দিয়েছে। টিভি থাকলেও রাহেলা পৃথুকে সকালবেলা টিভি দেখতে দেবে না। রাহেলার নিয়ম কানুন খুব কড়া।

তিনি পাশ ফিরলেন। আসলেই স্বপ্ন দেখছেন কি-না এটা জানার জন্যে পাশি ফেরা। স্বপ্নে মানুষ অনেক কিছুই করতে পারে, পাশ ফিরতে পারে না। সহজেই তিনি পাশ ফিরলেন। তিনি জেগে আছেন এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেল। তার কি শরীর খারাপ করেছে? মাথায় ভেঁতা যন্ত্রণা। চোখ মেলতে পারছেন না। কেউ যেন সুপার গ্লু দিয়ে চোখের পাতা আটকে দিয়েছে। মুখের ভেতরটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে অথচ পানির তৃষ্ণা নেই। অসুস্থ মানুষের শরীর পানির জন্যে খাঁ খাঁ করে অথচ তার তৃষ্ণা হয় না।ভাইজান, শরীরের অবস্থা এখন কী?

শামসুদ্দিন চোখ মেললেন। ধ্বক করে কিছু হলুদ আলো চিড়বিড়িয়ে চোখের ভেতর দিয়ে মগজে ঢুকে গেল। রফিক বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সে খাটে বসতে বসতে বলল–কাল রাতে আপনাকে দেখে ভয়ই পেয়েছিলাম। চোখ টকটকে লাল। জরে গা পুড়ে যাচ্ছে। ক্রমাগত ঘঁচি দিয়ে যাচ্ছেন। হাঁচির চোটে নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে। আপনার অবস্থা দেখে রাহেলা শুরু করল কান্না। এখন আছেন কেমন? ভালো।রফিক কপালে হাত দিয়ে বলল, জ্বর এখন সামান্যই আছে। নাশতা খাবেন? ক্ষিধা পেয়েছে? না।

একগ্লাস লেবুর শরবত বানিয়ে নিয়ে আসি। জ্বরের রেমিশন হলে শরীরে হাই ডোজের ভিটামিন সি পড়লে শরীর ঝন করে ঠিক হয়ে যায়।শরবত খাব না।তাহলে মসলা চা খান। আদা-লং আর এলাচ দিয়ে খাঁটি নেপালি মসলা চা। রাহেলা ঘরে নেই। চা আমাকেই বানাতে হবে।রাহেলা কোথায়? রফিক বিরক্ত মুখ করে বলল, জানি না কোথায়। রাতে মাইল্ড একটা ঝগড়া হয়েছে। সকালে ঘুম ভেঙে দেখি সে নাই। কাজের মেয়েটাও নাই। দুজন নাকি এক সঙ্গে বের হয়েছে।কোথায় গেছে কাউকে বলে যায় নি?

পৃথুকে বলে গেছে। আমি পৃথুকে জিজ্ঞেস করলাম, কী বলে গেছে? সে বলল, তার মনে নাই। গাধা টাইপ ছেলে হলে যা হয়। যাই হোক ভাইজান আপনি দুশ্চিন্তা করবেন না। সে তার কোনো বান্ধবীর বাসায় ঘাপটি মেরে পড়ে আছে। যাবে আর কোথায়? যাবার কি জায়গা আছে নাকি।শামসুদ্দিন বিছানায় উঠে বসতে বসতে বললেন, শরীরের এই অবস্থায় রাগারাগি করে ঘর থেকে বের হওয়া ঠিক না।রফিক সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, ঠিক না তো অবশ্যই। তাকে কে বোঝাবে? কাল রাতে সে ডিসিসান নিয়েছে কাজের মেয়ে ছাড়িয়ে দেবে। ভালো একটা কাজের মেয়ে পাওয়া আর সোনার খনি পাওয়া সেম জিনিস। ক্রিকেট খেলায় কিছু কিছু ব্যাটসম্যান যেমন সেট হয়ে যায়, কাজের মেয়েও সেট হয়ে যায়। সামান্য দোষত্রুটি থাকলেও সেট হওয়া কাজের মেয়ে বিদায় করতে নেই।

শামসুদ্দিন কিছু বললেন না।রফিক বলল, ভাইজান সিগারেটের ধোঁয়ার গন্ধ কি খারাপ লাগছে? যদি খারাপ না লাগে তাহলে বুঝবেন অসুখ সেরে গেছে। অসুখটা সেরেছে কি-নাএটা জানার জন্যেই আপনার মুখের কাছে ধোয়া ছাড়ছি।গন্ধটা তেমন খারাপ লাগছে না।তাহলে উঠে হাতমুখ ধোন। আমি হোটেল থেকে ডালপুরি নিয়ে আসি। কিংবা পৃথুর সঙ্গে টিভি দেখতে পারেন।টিভি কিনেছ না-কি?

টিভি কিনব কী জন্যে? নষ্ট টিভি সারাতে দিয়েছিলাম। সারিয়ে দিয়ে গেছে।রাহেলা বলেছিল টিভি বিক্রি করে দিয়েছ।রফিক বিস্মিত হয়ে বলল, টিভি বিক্রি করে দেব কী জন্যে? ভাইজান শুনুন, আপনার বোনের বেশিরভাগ কথাই বিশ্বাস করবেন না। বিশ্বাস করলে ধরা খাবেন। সে এমনভাবে মিথ্যা কথা বলে যে শুনলে মনে হবে সুতোর বাবা। অবশ্যই এটা একটা অসুখ। এই অসুখের চিকিৎসা আছে কি-না জানি না। জ্বর হলে ডাক্তারকে গিয়ে বলতে পারি- জ্বর হয়েছে। ট্যাবলেট দেন। এখন ডাক্তারকে গিয়ে কী বলব, আমার স্ত্রী শুধু মিথ্যা কথা বলে, ট্যাবলেট দেন?

শামসুদ্দিন হেসে ফেললেন। রফিকের কথা শুনে এত ভালো লাগছে। রাহেলা তার স্বামী সম্পর্কে যা বলেছে সবই যে বানিয়ে বলেছে তা বোঝা যাচ্ছে। এটা আনন্দ এবং স্বস্তির বিষয়। তার মনে হলো শরীরে যতটুকু অবসাদ আছে সবটাই কেটে গেছে।ভাইজান, কাল বৃষ্টিতে ভিজে এত রাতে কোথেকে ফিরেছেন? রাতে আপনার যে অবস্থা ছিল কিছু জিজ্ঞেস করি নি।জয়নালের বাসায় গিয়েছিলাম।জয়নালটা কে? সেও আমার সঙ্গে ভিসা পেয়েছে। দুজন এক সঙ্গে আমেরিকা যাব। অত্যন্ত ভালো ছেলে। আমাকে তার বাসায় রেখে আধঘন্টার জন্যে কোথায় যেন গিয়েছিল। তারপর আর ফিরে না। অপেক্ষা করতে করতে দেরি হয়ে গেল। বাসায় আর কেউ নেই, আমি একা।শেষে ফিরেছে তো?

না। তার টেবিলের উপর তালাচাবি ছিল। ঘরে তালা দিয়ে আমি চাবি নিয়ে চলে এসেছি। চিঠি লিখে এসেছি আমার কাছ থেকে যেন চাবি নিয়ে যায়।রফিক বিরক্ত গলায় বলল, ভাইজান আপনি ঐ ছেলের কাছ থেকে দশ হাত দূরে থাকবেন। বোঝাই যাচ্ছে ধান্দাবাজ ছেলে। আপনার সঙ্গে ব খাতির জমাবে। এক সময় টাকা ধার করবে। এই টাইপ ছেলে আমি লি।ছেলেটা সে-রকম না। কোনো বিপদে নিশ্চয়ই পড়েছে।কোনো বিপদে পড়ে নি। কোনো একটা চাল চেলেছে। চাল না চললে খালি বাসায় আপনাকে বসিয়ে রেখে আধঘণ্টার কথা বলে বাইরে যায়?

অপু সোজা-সরল মানুষ। যে যা বলে তাই বিশ্বাস করেন। ধান্দাবাজ লোক আপনার মতো মানুষ খোঁজে। তারপর সুযোগ বুঝে ঘাড়ে চেপে বসে। একেবারে সিন্দাবাদের ভুত। ঘাড় থেকে নামানোই যাবে না।রফিক হোটেলে নাস্তা কিনতে গেল। শামসুদ্দিন পৃথুর পাশে এসে বসলেন। তার মাথা ঝিমঝিম করছে। মাথা সোজা করে বেশিক্ষণ বসে থাকা যাবে বলে মনে হয় না। কষ্ট করে হলেও কিছুক্ষণ পৃথুর সঙ্গে থাকা। মামাকে পাশে বসতে দেখে পৃথু আনন্দে অভিভূত গলায় বলল, মামা দেখ, বাবা টিভি এনেছে। রাতে এনেছে।শামসুদ্দিন বললেন, খুব খুশি?

পৃথু মামার গায়ে এলিয়ে পড়ে বলল, হুঁ। তুমি খুশি মামা? হুঁ। আমিও খুশি।দুজনের মধ্যে কে বেশি খুশি মামা? তুমি না আমি? মনে হচ্ছে আমি বেশি খুশি।পৃথু চোখ মুছতে মুছতে বলল, হয় নি। আমি খুশি। শামসুদ্দিন অবাক হয়ে বললেন, তুই কি খুশিতেই কাঁদছিস না-কি? পৃথু বলল, জানি না।শামসুদ্দিন বাঁ হাতে পৃথুকে জড়িয়ে ধরলেন। পৃথু গাঢ় গলায় বলল, বাবা বলেছে মা না আসা পর্যন্ত আমি টিভি দেখতে পারব। আজ আমাকে স্কুলেও যেতে হবে না।তাহলে তো তোর আজ ঈদ!

হুঁ।তোর মা যদি সারাদিন না ফেরে তাহলে কী করবি? সারাদিন টিভি দেখবি? হুঁ।আমেরিকা থেকে তোর জন্যে কী আনব? বন্দুক।শুধু বন্দুক, আর কিছু না? না।বড় হয়ে তুই কী হবি রে পৃথু? কিছু হবে না মামা।ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার সায়েন্টি কিছুই হবি না? না।আমার মতো ঝিম ধরে ঘরে বসে থাকবি? হু।আচ্ছা পৃথু শোন, তোর বাবা আর মা এই দুজনের মধ্যে তুই কাকে বেশি ভালোবাসিস? তোমাকে।আমাকে ভালোবাসিস কেন? জানি না। তুমি আমেরিকা চলে গেলে আমার কী রকম দুঃখ হবে জানো মামা? কী রকম দুঃখ হবে? টিভি না থাকলে যে-রকম দুঃখ হয় সে-রকম।শামসুদ্দিন বিস্মিত হয়ে বললেন, তুই তো দেখি ভালোই কথা বলা শিখে গেছিস। ফুটুর ফুটুৱ করে বড় হচ্ছিস তো এই জন্য বোঝা যায় না।পৃথু বলল, মামা তুমি আমেরিকায় কেন যাচ্ছি? বেড়াতে?

শামসুদ্দিন থমকে গেলেন। তিনি আমেরিকায় বেড়াতে যাচ্ছেন না। একজনের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন। সেই কথাটা কি পৃথুকে বলা যায়? হয়তো বলা যায়। শিশুদের সঙ্গে সিরিয়াস বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যায়। ভূতপ্রেতের গল্প তারা যে আগ্রহ নিয়ে শোনে, সিরিয়াস বিষয়ে আলোচনাও তারা সে-রকম আগ্রহ নিয়েই শোনে। সিরিয়াস বিষয় সম্পর্কে মতামতও দেয়। সেই মতামত অগ্রাহ্য করার মতো না।একজনের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি।

ও আচ্ছা!শামসুদ্দিন বললেন, একজন মানুষ অনেক বছর আগে আমার মনে খুব কষ্ট দিয়েছিল। কেন সে কষ্ট দিয়েছিল এটা তাকে জিজ্ঞেস করব।এখনো মনে কষ্ট আছে? আছে।ও আচ্ছা! পৃথু টিভি দেখা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তার পছন্দের কার্টুন শো শুরু হয়েছে। ফ্লিনস্টোন পরিবার এসে গেছে। শামসুদ্দিনও আগ্রহ নিয়েই কার্টুন দেখছেন। পৃথুর সঙ্গে পৃথুর পছন্দের অনুষ্ঠানগুলো তিনি সব সময় দেখেন। পৃথু তখন একই সঙ্গে কার্টুন দেখে এবং তার মামাকে দেখে হাসির জায়গাগুলোতে তার মামা যদি না আসে তখন সে আমার পেটে খোঁচা দেয়। শামসুদ্দিন হাসতে শুরু করলে সে গলা মিলিয়ে হাসে।

টিভিতে ফ্লিনস্টোন পরিবার পানিতে পড়ে গেছে। পরিবারের কর্তা সাঁতার কীভাবে দিতে হয় ভুলে গেছেন। তাকে তাৎক্ষণিকভাবে সাঁতার শেখানো হচ্ছে। খুবই হাস্যকর পরিস্থিতি। শামসুদ্দিন হাসছেন না। পৃথুর খোঁচা খেয়ে হাসতে শুরু করলেন। পৃথুও হাসছে। হাসতে হাসতে পৃথুর চোখে পানি এসে গেল। সে চোখের পানি মুছে বলল, যে তোমার মনে কষ্ট দিয়েছিল তার নাম কী? শামসুদ্দিন হকচকিয়ে গেলেন। পৃথু কার্টুন ঠিকই দেখছে কিন্তু মাথায় মামার কষ্ট পাওয়ার ব্যাপারটা আছে। তিনি ইতস্তত করে বললেন, তার নাম বীথি।

পৃথু বলল, ও আচ্ছা! কার্টুনে আরো মজার দৃশ্য শুরু হয়েছে। ফ্লিনস্টোন অতি বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে সাঁতার শিখে ফেলেছে। সমস্যা একটাই–সাঁতারের টেকনিকে গণ্ডগোল হচ্ছে। সে সাঁতরে সামনে যেতে চায় কিন্তু চলে যায় পেছনে। এ দিকে পেছন থেকে ভয়ঙ্কর হাঙ্গর মাছ দেখা যাচ্ছে। ফ্লিনস্টোন সাঁতারে হাঙর থেকে যতই দূরে যেতে চায় ততই কাছে চলে আসে। পৃথু তার মামার পেটে শক্ত খোঁচা দিল–শামসুদ্দিন হাসতে শুরু করলেন।

ডালপুরি নাশতা শামসুদ্দিন খেতে পারলেন না। তেল পোড়ার গন্ধে তার বমি আসতে লাগল। মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। শরীরে ক্লান্তিময় আলস্য। তিনি চাদর গায়ে দিয়ে বিছানায় শুয়ে থাকলেন। তিনি বুঝতে পারছেন–জ্বর আসতে শুরু করেছে। সৈন্য-সামন্ত নিয়ে প্রবল বেগেই আসছে। কিছুক্ষণের মধ্যে মাথা তোলার শক্তিও থাকবে না। জয়নালের খোঁজে তার একবার যাওয়া উচিত। ছেলেটা কি এখনো ফিরে নি? তার কি সমস্যা হয়েছে? কোনো একটা বিপদে যে সে পড়েছে তা বলাই বাহুল্য। বিপদটা কোন ধরনের? একসিডেন্ট করে হাত পা ভেঙে হাসপাতালে পড়ে নাই তো?

দুপুরে পৃথু এসে তার পাশে কিছুক্ষণ বসে রইল। কপালে হাত দিয়ে বলল, মামা তোমার জ্বর কি খুব বেশি নাকি? শামসুদ্দিন বললেন, হুঁ।মাথাব্যথা করছে? হুঁ।শুয়ে শুয়ে টিভি দেখবে মামা? শুয়ে শুয়ে টিভি দেখলে মাথাব্যথা কমে যায়।না, টিভি দেখব না। তুই যা, টিভি দেখতে থাক। আমার পাশে বসে থাকতে হবে না।পৃথু ক্ষীণ গলায় বলল, মামা, দুপুরে আমরা ভাত খাব না? আমি খাব না। তুই খাবি।ভাত কে রাঁধবে? বাবা চলে গেছে।দুপুরে ভাত খাবার আগে তোর বাবা ফিরে এসে ভাত রাঁধবে কিংবা হোটেল থেকে ভাত আনবে।মা আর কোনোদিন বাসায় আসবে না? আসবে না কেন, অবশই আসবে। রাগ কমলেই আসবে। তবে রাগটা দেরিতে পড়াই ভালো। তুই বেশিক্ষণ টিভি দেখতে পাবি।হুঁ। মামা, আমি কি তোমার চুল টেনে দেব?

কোনো দরকার নেই। তুই যা, টিভি দেখতে থাক।পানি খাবে? পানি এনে দিই। পানি আনতে হবে না।পৃথু চলে গেছে। শামসুদ্দিন চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন। জ্বরের ঘোরে তার হাত-পা কাঁপছে। টিভির শব্দ খুব কানে লাগছে। পৃথুকে বললেই সে শব্দ বন্ধ করে শুধু ছবি দেখবে। কোনো আপত্তি করবে না, মন খারাপও করবে না। কিন্তু তাকে বলতে ইচ্ছা করছে না। আহ, বাচ্চা মানুষ আগ্রহ করে দেখছে, দেখুক। শীতে শরীর কাঁপছে। একটা কম্বল গায়ে দিয়ে দিতে পারলে ভালো হতো। ওয়ারড্রোবে কম্বল আছে। তিনি যে নেমে কম্বল আনবেন সেই শক্তিও নেই। মৃত্যু এসে উপস্থিত হয় নি তো? শামসুদ্দিন গভীর ঘোরে তলিয়ে গেলেন।

তার ঘুম ভাঙল পানির শব্দে। কেউ পানির কল ছেড়ে দিয়েছে। প্রবল বেগে পানির কল থেকে পানি বের হচ্ছে। পানি পড়ছে তার মাথাতেই। পানি ঢালছে রাহেলা। সে ঝুঁকে এসে বলল, ভাইজান, এখন কি একটু ভালো লাগছে? তিনি বললেন, হুঁ।রাহেলা বলল, তোমার জ্বর কত উঠেছিল জানো? একশ পাঁচ। গায়ের উপর ধান ছেড়ে দিলে ফুটে খই হয়ে যেত।তুই কখন এসেছিস? ঘড়ি দেখি নাই। দুটা হবে। এসে দেখি স্যুট পরা কোনো এক বাবু সাহেব তোমার মাথায় পানি ঢালছে।কে, জয়নাল? নাম জিজ্ঞেস করি নাই। তাকে পাঠিয়েছি ডাক্তার আনতে। ভাইজান, সত্যি করে বলো তো এখন কি একটু ভালো লাগছে? রাহেলার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে শামসুদ্দিন বললেন, যে পানি ঢালছিল তার মাথায় কি টাক?

এত কিছু লক্ষ করি নি ভাইজান। আমি বাঁচি না নিজের যন্ত্রণায়। আমি বসে বসে দেখব কার মাথায় টাক কার মাথায় চুল? সে তো ডাক্তার নিয়ে আসবেই তখন দেখে তার মাথা ভর্তি চুল না টাক।রফিক কোথায়? আমি জানি না কোথায়। একটার সময় এসে ছেলের হাতে এক প্যাকেট বিরিয়ানি ধরিয়ে দিয়ে চলে গেছে।মাথায় আর পানি দিস না। ঠাণ্ডা লাগছে।লাগুক ঠাণ্ডা, ডাক্তার না আসা পর্যন্ত আমি পানি দিতেই থাকব। ভাইজান, তুমি সুস্থ হয়ে উঠ। তোমার সঙ্গে আমার জরুরি কথা আছে। আমি বাসায় ফিরতাম না, শুধু তোমাকে জরুরি কথা বলার জন্যেই ফিরেছি। এসে দেখি তোমার এখন যায় তখন যায় অবস্থা। ডাক্তার এসে তোমাকে দেখে যাক, তারপর তোমাকে জরুরি কথাগুলো বলে চলে যাব।কোথায় চলে যাবি? তোর কি থাকার জায়গা আছে?

জায়গা না থাকলেও চলে যাব। প্রয়োজনে খারাপ পাড়ায় গিয়ে বাড়িওয়ালীকে বলব, এখন আমাকে দিয়ে আপনার চলবে না তবে পেটের বাচ্চা খালাস হয়ে গেলে আমি ভালো রোজগারপাতি করব। আমার চেহারা সুন্দর, গায়ের রঙ ফর্সা। খদ্দের আমার ঘরে হুমড়ি খেয়ে পড়বে। ভাইজান শোন, আসিয়া যে ফিরে এসেছে তুমি জানো? আসিয়াটা কে? আসিয়া কে তুমি ভুলে গেছ? আমাদের কাজের বুয়া। পৃথুর বাবার সহনায়িকা।ও আচ্ছা! আমি তাকে বেতন, বেতনের সাথে দুশ টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে দিয়ে গিয়েছিলাম। পৃথুর বাবা আজ সকালে তাকে তার বাসায় খবর দিয়ে নিয়ে এসেছে। সে যে আসিয়ার বস্তির বাসার ঠিকানাও জানে তা জানতাম না।ও আচ্ছা! কথায় কথায় ও আচ্ছা বলবে না। কোনো কিছুই আচ্ছা না। ভাইজান, একটু একা একা থাক, আমি পৃথুকে একটা চড় দিয়ে আসি।কেন?

টিভি বন্ধ করে দিয়ে এসেছিলাম, আবার চালু করেছে। বাপ যেমন বদ, ছেলেও সেই পথ ধরবে আমি চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। ঠোঁটের উপর গোফ দেখা যাওয়া মাত্র বাবার মতো কাজের মেয়েদের নিয়ে ফস্টিনস্টি শুরু করবে।পৃথুর কান্নার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। বেচারা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। শামসুদ্দিনের মন খারাপ লাগছে। তিনি চোখ বন্ধ করে পড়ে আছেন। এখন শরীরটা আগের মতো খারাপ লাগছে না। জুর মনে হয় কমতে শুরু করেছে। রাহেলার সাড়া শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। একবার শুধু শোনা গেছে সে আসিয়াকে বেবীটেক্সি ডেকে আনতে বলছে। আবারো কি ঘর ছেড়ে চলে গেল?

জয়নাল ডাক্তার আনতে পারে নি। ডাক্তার এখন আর হাউজ কলে উৎসাহী না। তবে সে খালি হাতে আসে নি। এক হোমিওপ্যাথ ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে ওষুধ নিয়ে এসেছে। সাগু দানার মতো ওষুধ। তিনবেলা তিন দানা খেলেই নাকি শরীর ঠিক হয়ে যাবে।শামসুদ্দিন একদানা ওষুধ খেলেন। জয়নাল বলল, ওষুধটা ব্লাড়ে মিশতে দুঘণ্টা লাগবে। দুঘণ্টা পরে দেখবেন আপনি গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসেছেন।শামসুদ্দিন বললেন, ঐ রাতে কী হয়েছিল? তুমি ফিরছই না, আমি খুব দুশ্চিন্তা করেছি।আপনি দুশ্চিন্তা করেছেন বুঝতে পেরেছি।

চাচাজি আমার উপায় ছিল না। ফেঁসে গিয়েছিলাম। আধ ঘন্টার জন্যে গিয়ে ছয় ঘণ্টার জন্যে আটকা। ইতিদের বাড়িতে তো আমি আগেও গিয়েছি। ওদের ড্রয়িংরুমে গিয়ে ফকির মিসকিনের মতো বসে থাকা। বাসি টক চানাচুর দিয়ে চা খাওয়া। ইতির বাবার সঙ্গেও কয়েকবার দেখা হয়েছে। তিনি এমনভাবে চোখ মুখ কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়েছেন যেন আমার সারা গায়ে কাদা লেগে আছে। তাদের সোফাতে কাদা লেগে যাচ্ছে। সালাম দিলেও উনি সালাম নিতেন না। ই বলে শব্দ করতেন।ঐ রাতে কথা বলেছেন?

ইস্কাবনের টেক্কা আমার হাতে। কথা বলবে না মানে? রাজনীতি নিয়ে কথা, দেশের অর্থনৈতিক দুরবস্থা নিয়ে কথা। আমেরিকায় গিয়ে আমি কী করব তা নিয়ে কথা। আমিও মনের সুখে মিথ্যা কথা বলেছি।মিথ্যা কী বলেছ?

বলেছি–আমেরিকায় দুটা ইউনিভার্সিটিতে অ্যাডমিশন হয়ে আছে। আগে MS করব। আমেরিকায় সেটল করার কোনো ইচ্ছা আমার নাই- সেটল করব নিউজিল্যান্ডে। দেশটা ছোট। মাত্র চল্লিশ লাখ লোকের বস। বাস করার জন্যে অপূর্ব।জয়নাল মনের আনন্দে হরবর করে কথা বলে যাচ্ছে। শামসুদ্দিনের শুনতে ভালো লাগছে। তার মাথার ভেঁতা যন্ত্রণাটাও মনে হয় কমে যাচ্ছে।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *