সিগারেট হাতে বসে থাকার মধ্যেও আনন্দ আছে। যারা ধূমপান করে না তারা সুস্বাস্থ্যের অনিন্দ পায়, সিগারেট হাতে বসে থাকার আনন্দটা পায় বরকত চা নিয়ে এসেছে।
দুজনের জন্যেই চা এনেছে। সুন্দর কাপে করে মিসির আলির জন্যে চা আর তার নিজের জন্যে গ্লাস ভর্তি চা। মিসির আলি বললেন, বরকত তুমি কাপটা তােমার বড় সাহেবকে দাও। আর আমি তােমার গ্লাসে করে চা খাব। গ্লাস ভর্তি করে চা খাওয়ায় আলাদা আনন্দ আছে। কাপের চা বাইরে থেকে দেখা যায় না। গ্লাসের চা দেখা যায়।
সুলতান সিগারেটের প্যাকেট বের করতে করতে বলল, আমি মধু খাই না’ এই ধারণার পেছনে আপনার ব্যাখ্যাটা এখন শুনি। আমি ব্যাখ্যাটা শােনার জন্যে অপেক্ষা করছি।
আমার ব্যাখ্যা খুবই সহজ। তুমি আমাকে মধু দেবার সময় নাক মুখ কুঁচকে ফেলেছিলে। রিফ্লেক্স একশান। সেখান থেকেই বুঝলাম তুমি মধু খাও না। খেলেও যে মধুটা আমাকে খেতে দিয়েছ সেটা খাও না।
তাহলে শুধু শুধু সিক্সথ সেন্সের কথা কেন বললেন ?
আমি একটা ছােট্ট পরীক্ষা করলাম। আমি দেখলাম সিক্সথ সেন্সের কথা শুনে তুমি চমকে গেলে খানিকটা রেগেও গেলে। চমকাও কি না এটাই ছিল আমার পরীক্ষা। বরকত দেখি চা ভালাে বানায়।
আমিই মিসির আলি-পর্ব-(২৩)-হুমায়ূন আহমেদ
সুলতান তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে সে অপেক্ষা করছে মিসির আলি কি বলেন তা শােনার জন্যে। মিসির আলি সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বললেন, তুমি যখন বললে সুন্দরবনে নানান ধরনের ফুলের মধু পাওয়া যায় খলিসা ফুলের মধু, কেওড়া ফুলের মধু, গড়ান ফুলের মধু, তখন হঠাৎ করে আমার মনে হলাে
অনেক বিষাক্ত ফুলও তাে প্রকৃতিতে আছে। যেমন ধর ধুতরা ফুল। এমনকি হতে
পারে না যে কিছু মৌমাছি ধুতরা ফুল থেকে মধু নেয়। সেই সব ফুলে ধুতরার ভয়ঙ্কর বিষ মিশবে। সেই বিষ হল a very powerful halucinating drug যা মানুষের চিন্তায় কাজ করে। চেতনাকে পাল্টে দেয়। রিয়েলিটির ভুল ব্যাখ্যা করে। সুন্দরবন হলাে একটা ট্রপিক্যাল ফরেস্ট। পৃথিবীর সবচে বড় ম্যানগ্রোভ বন। সেখানে ধুতরা ফুল থাকারই কথা। তুমি বল থাকবে না ? | হ্যা থাকবে। এবং আছে। সুন্দরবনের ভেতর মাঝে মাঝে হঠাৎ কিছু ফাকা জায়গা পাওয়া যায়। সেখানে প্রচুর ধুতরা ফুল ফোটে।
সেই ফুল থেকে মৌমাছিরা মধু সগ্রহ করে ?
সব মৌমাছি করে না। বিশেষ এক ধরনের মৌমাছি করে। এদের মৌমাছিও বলে না। বলে মৌ পােকা।
মিসির আলি বললেন, যে–কোনােভাবেই হােক বিশেষ ধরনের এই মধু তােমার সংগ্রহে আছে। তার খানিকটা তুমি আমাকে দু’দফায় খাইয়েছ যে কারণে আমি ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন দেখেছি। দুঃস্বপ্নের সঙ্গে বাস্তব মিশে ছিল। প্রথম রাতে সাপ নিয়ে কথা হলাে— আমি স্বপ্নে দেখলাম সাপ। দ্বিতীয় রাতে কুকুর নিয়ে কথা হলাে। লিলি আমাকে বলল, দরজার ছিটকিনি বন্ধ করে ঘুমুতে মাঝে মাঝে কুকুর দোতলায় উঠে আসে। সেই রাতে আমি স্বপ্নে দেখলাম কুকুর। কুকুরটা ঘরে ঢুকে আমার বিছানার চারদিকে ঘুরপাক খাচ্ছিল।
আমিই মিসির আলি-পর্ব-(২৩)-হুমায়ূন আহমেদ
সুলতান বলল, আপনার ডিডাকটিভ লজিক যে ভালাে, আমি জানতাম। এতটা ভালাে বুঝতে পারি নি ।am impressed. | মিসির আলি চায়ের গ্লাস নামিয়ে রাখতে রাখতে বললেন, এখন তুমি কি আমাকে বলবে, কেন আমাকে এখানে এনেছ ? তারা দেখানাের জন্যে নিশ্চয়ই আন নি। চিঠিতে তুমি টোপ ফেলার কথা বলেছ। সেটা কথার কথা ছিল না। আসলেই টোপ ফেলে এনেছ। কেন এনেছ ? খােলাখুলি বলতে অসুবিধা আছে ?
না অসুবিধা নেই। আপনার সঙ্গে অনেক লুকোচুরি খেলা হয়েছে। আর খেলার প্রয়ােজন দেখছি না।
তাহলে তােমার উদ্দেশ্যটা বলে ফেল। তুমি কিছু মনে করাে না— আমার এখানে থাকতে ভালাে লাগছে না। আমি আজ চলে যাব। দুপুরের পর রওনা হতে চাই।
সুলতান বলল, আজ অমাবস্যা। আকাশে মেঘ নেই। আমি নিশ্চিত যে আজ রাতে আকাশ পরিষ্কার থাকবে। আপনাকে আজ রাতে একটা স্পাইরাল গ্যালাক্সি দেখাব। দেখার পর মনে হবে আপনার মানব জীবন ধন্য।
আমার গ্যালাক্সি দেখার শখ এখন নেই। আমি চলে যেতে চাচ্ছি। আকাশ দেখতে ইচ্ছা করছে না।
সুলতান শীতল গলায় বলল, স্যার শুনুন। আপনার ব্যক্তিগত ইচ্ছা অনিচ্ছার কথা ভুলে যান। আমি আপনাকে এখান থেকে বের হতে দেব না।
মিসির আলি অবাক হয়ে বললেন, বের হতে দেবে না ?
আমিই মিসির আলি-পর্ব-(২৩)-হুমায়ূন আহমেদ
সুলতান বলল, না। এবং তার জন্যে কোনাে সমস্যাও হবে না। কেউ জানবেও না আপনি কোথায় আছেন। আপনার পরিচিতজনরা জানে আপনার স্বভাব হচ্ছে মাঝে মধ্যে বাইরে কোথাও চলে যাওয়া। সবাই ভাববে এবারাে তাই হয়েছে। আপনার এক ছাত্র আপনার জন্য টেকনাফে অপেক্ষা করছে। সে যখন দেখবে আপনি এসে পৌঁছান নি তখন সে খানিকটা খোঁজ খবর করবে। সবাই জানবে টেকনাফ যাবার পথে আপনি হারিয়ে গেছেন। কিছুদিন পর মানুষ আপনাকে ভুলে যাবে। মানুষ বিস্মৃতিপরায়ণ জীব।
আমাকে এখানে আটকে রেখে তােমার লাভ কি ?
লাভ আছে। সাইকোলজি বিশেষ করে প্যারাসাইকলজির উপর আপনার দখল অসাধারণ। আপনি আমার উপর গবেষণা করবেন। আমার মাথার ভেতর উঁকি দিয়ে দেখবেন সেখানে কী আছে। কেন আমি এ রকম ?
তুমি কী রকম?
আপনার অনুমান শক্তি তাে ভালাে আপনি অনুমান করুন। আপনাকে সামান্য সাহায্য করছি। আমার তুলনায় অশ্বিনী কুমার রায় একজন মহাপুরুষ। হা হা হা।
মিসির আলি তাকিয়ে আছেন। সুলতানও তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। সে এখন আর হাসছে না। কিন্তু হাসিটা শরীরের ভেতর আছে। কারণ তার শরীর কাঁপছে। মনের ছায়া চোখে না–কি পড়ে। চোখ হচ্ছে মনের জানালা। মিসির আলির মনে হলাে না— সুলতানের চোখে মনের কোনাে ছায়া পড়েছে। শান্ত স্থির চোখ। যে চোখ বুদ্ধিতে ঝকমক করছে।
সুলতান বলল, স্যার আপনার কি ভয় লাগছে ? মিসির আলি বললেন, না। সুলতান বলল, ভয় লাগছে না কেন? বুঝতে পারছি না কেন?