সুলতান বলল, আপনি যে ভয় পাচ্ছেন না সেটা আপনাকে দেখে বােঝ যাচ্ছে। ভয় পাবেন না জানলে আগেই আপনাকে বলতাম। যাই হােক আপনার উচিত আমাকে ধন্যবাদ দেয়া।
কেন বল তাে?
সুলতান সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, আপনাকে জীবনের শ্রেষ্ঠতম গবেষণার সুযােগটা আমি করে দিচ্ছি। একজন অতি ভয়ঙ্কর মানুষকে আপনি খুব কাছ থেকে দেখার সুযােগ পাচ্ছেন। যে আপনার গবেষণায় আপনাকে সাহায্য করবে। আপনিও আমাকে কিছুটা সাহায্য করবেন।
আমি কী সাহায্য করব?
আমাকে সঙ্গ দেবেন। আপনার সঙ্গে বিজ্ঞান, সাহিত্য, শিল্পকলা নিয়ে আলাপ করব। আকাশের তারা দেখব। তা ছাড়া আমি নিজেও ছোটখাট কিছু পরীক্ষা করছি। মানসিক পরীক্ষা। এই পরীক্ষাতেও আপনি সাহায্য করবেন। মনােজগতের যে পড়াশােনা আপনার আছে আমার তা নেই। পরীক্ষাটা ঠিকমতাে হচ্ছে কি না আপনি দেখে দেবেন।
কী পরীক্ষা ?
সালমা নামের একটা মেয়ের কথা আপনাকে চিঠিতে লিখেছিলাম । তাকে নিয়েই পরীক্ষা। আমি মােটামুটি নিশ্চিত যে, সব মানুষের ভেতরই অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা আছে। মানুষের মনে ভয়ঙ্কর চাপ দিয়ে সেই ক্ষমতা বের করে আনা যায়। আমি সালমার উপর এই চাপটাই দিচ্ছি।
মেয়েটা কোথায় ? মেয়েটা এ বাড়িতেই আছে। রাতে আপনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব। লিলি বলছিল সালমা বলে আলাদা কেউ নেই। লিলিই সালমা।
লিলির সব কথা গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করার কিছু নেই। আমি এখন ঘুমুতে যাব। আপনার কিছু জিজ্ঞেস করার থাকলে জিজ্ঞেস করুন।
আমিই মিসির আলি-পর্ব-(২৪)-হুমায়ূন আহমেদ
হুইল চেয়ারের কি তােমার প্রয়ােজন আছে ?
হুইল চেয়ারের আমার কোনােই প্রয়ােজন নেই। আমি শারীরিকভাবে সুস্থ একজন মানুষ। ইচ্ছা করেই হুইল চেয়ারে সময় কাটাই যাতে বাইরের লােকজন জানে এ বাড়িতে পঙ্গু একজন মানুষ থাকে। পঙ্গু বলেই সে শহর ছেড়ে নির্জন বাস করে। এই কাজটা না করলে কথা উঠত সম্পূর্ণ সুস্থ একজন মানুষ দিনের পর দিন এই নির্জনে স্বেচ্ছাবন্দি হয়ে আছে কেন ? অবশ্যি হুইল চেয়ারের একটা ভালাে ব্যবহারও আছে। টেলিস্কোপ ফিট করে তারা দেখার সময় এটা খুব কাজে লাগে।
তুমি যে আমাকে এখানে আটকে রাখার জন্যে এনেছে তা–কি এ বাড়ির লােকজন জানে ?
জানবে না কেন ? জানে। লিলি জানে, বরকত জানে। আপনার মতাে অনেকেই এ বাড়িতে আসে। কেউ ফিরে যায় না । বুঝতেই পারছেন এ বাড়ি থেকে
কাউকে জীবিত ফেরত পাঠানাে আমার জন্যে সম্ভব না। কোনাে ভয়ঙ্কর মানুষ যদি তার কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে চায় তাহলে অবশ্যই তাকে সাবধানী হতে হবে। সিরিয়াল কিলারদের কথাই ধরুন— সব সিরিয়াল কিলারই চিতাবাঘের চেয়েও সাবধানী। তাকে একের পর এক মানুষ মারতে হবে। সাবধানী না হলে এই কাজটা সে করতে পারবে না। স্যার আমি কি ঠিক বলছি ?
যা ঠিক বলছ। | থ্যাঙ্ক য়ু। আমি সালমা মেয়েটিকে নিয়ে গবেষণাধর্মী যে কাজটা করেছি তা লেখার চেষ্টা করেছি। আমি পাঠিয়ে দেব। পড়ে দেখুন। লেখাটা গবেষণাধর্মী হয় নি। সাইন্টিফিক পেপার কী করে লিখতে হয় জানি না। এই দায়িত্বটা আপনার। আমরা এই জঙ্গলে বসে একের পর এক রিসার্চ পেপার বিদেশী জার্নালে পাঠাব। মূল অথার আপনি আমি কো–অথার।
আমিই মিসির আলি-পর্ব-(২৪)-হুমায়ূন আহমেদ
সুলতান হাসল। সেই হাসি যা চট করে মুখ থেকে মুছে যায় কিন্তু শরীরে থেকে যায়। বেশ কিছুক্ষণ শরীর দুলতে থাকে। এই প্রথম মিসির আলির শরীর গুলিয়ে উঠল। তার কাছে মনে হলাে ঘেন্নাকর কিছু তার সামনে বসে আছে।
সুলতান বলল, স্যার এখন আপনি আমাকে সামান্য ভয় পাচ্ছেন। আপনার চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে। কোম্পানি হিসেবে আমি খারাপ হব না। আমি শিক্ষিত একজন মানুষ। অঙ্কেশাস্ত্রের মতাে একটা জটিল বিষয়ে আমার পিএইচ.ডি. ডিগ্রি আছে। আপনি যদি অংকের ছাত্র হতেন তাহলে আমাকে চেনার সামান্য সম্ভাবনা ছিল আমার পিএইচ.ডি.‘র কাজ খুব ভালাে হয়েছিল। গ্রুপ থিওরির সব বইতেই সুলতান ফাংশান বলে একটা ফাংশানের উল্লেখ আছে। আমার নামে তার নাম। যৌবনে এই দিকে কিছু মেধা ব্যয় করেছিলাম। পরে এইসব অর্থহীন মনে হয়েছে । স্যার আমি কী বলছি আপনি কি শুনছেন ?
হা শুনছি।
এখন আমার কাছে মনে হচ্ছে আসল রহস্য পদার্থবিদ্যা বা অঙ্কে না—আসল রহস্য মানুষের মনে। আকাশ যেমন অন্তহীন মানুষের মনও তাই। পৃথিবীর বেশির ভাগ অঙ্কবিদ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালােবাসতেন। আমিও ভালােবাসি। আকাশের দিকে তাকালে জাগতিক সব কিছুই তুচ্ছ মনে হয়। We are so insignificant. আমাদের জন্ম–মৃত্যু সবই অর্থহীন।
মিসির আলি বললেন, তুমি কি মানুষ খুন করেছ?
সুলতান জবাব দিল না।
মিসির আলি বসে স্তব্ধ হয়ে আছেন। সুলতান হুইল চেয়ার ঘুরিয়ে চলে যাচ্ছে। পেয়ারা গাছের নিচে বরকতকে দেখা যাচ্ছে সে কুকুরকে গােসল দিচ্ছে।
আমিই মিসির আলি-পর্ব-(২৪)-হুমায়ূন আহমেদ
রােদ উঠেছে। আবহাওয়া অত্যন্ত মনােরম। চেরী গাছ থেকে একটা দুটা করে ফুল পড়ছে। ফুলগুলি গাছে যত সুন্দর দেখাচ্ছে হাতে নেয়ার পর তত সুন্দর লাগছে না। কিছু সৌন্দর্য দূর থেকে দেখতে হয়, কাছ থেকে দেখতে হয় ।
আমার নাম সুলতান।
সাধারণত গরিব ঘরের ছেলেমেয়েদের এ জাতীয় নাম থাকে। সুলতান, সম্রাট, বাদশাহ্। বাবা মা ভাবেন বড় হয়ে ছেলে রাজা বাদশাহ্ হবে। আমি কোনাে গরিব ঘরের সন্তান ছিলাম না। বিত্তশালী পরিবারের সন্তান ছিলাম। আমার বাবা মার সন্তানদের নামকরণের মতাে তুচ্ছ বিষয়ে কোনাে আগ্রহ ছিল।
আমরা অনেকগুলি ভাই–বােন ছিলাম। মা প্রতিবছর একটি করে সন্তান প্রসব করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। জ্ঞান হবার পর থেকেই আমি মা’কে বিছানায় শােয়া পেয়েছি। নিজের সন্তানদের দিকে তাকানাের মতাে অবস্থা তার ছিল না। তার মন এবং শরীর দুইই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। শেষের দিকে তিনি মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা শুরু করলেন।