মাস্টারকে প্রায়ই দেখি কুয়ার ওপর বসে থাকে। আচমকা ধাক্কা দিয়ে ব্যাটাকে কুয়ার ভেতর ফেলে দিবি। পারবি না ?
পারার কী আছে? এক ধাক্কায় সব সমস্যার সমাধান। খুবই গহিন কুয়া। নিচে বিষাক্ত গ্যাস। একবার পড়লে আর দেখতে হবে না। কাজটা যে তুই করেছিস সেটাও কেউ বুঝবে না। ভাববে নিজে নিজে পড়ে গেছে। আমার অবশ্যি ধারণা কেউ কোনােদিন জানবেও না যে এইখানে একজন মানুষ পড়ে আছে।
মন্দিরের ভেতরের স্মৃতি এরপর আর আমার কিছু মনে নেই। হয়তাে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম। এই ঘটনার তৃতীয় দিনের দিন আমি মুহম্মদ ইদরিশ মাস্টারকে ধাক্কা দিয়ে কুয়ায় ফেলে দেই। কুয়াটা খুব গভীর তাে বটেই ধাক্কা দেয়ার অনেক পরে ঝপাং শব্দটা কানে আসে। ও আল্লাগাে ও আল্লাগাে শব্দটি দু’বার শােনা যায়। তারপর সব নিস্তব্ধ। আমি খুব স্বাভাবিকভাবে কুয়ার পাড়ে কিছুক্ষণ হাঁটাহাটি করি। তারপর ঘরে চলে আসি।
মাস্টার সাহেব বাড়িতে নেই এটা নিয়ে বাড়ির কাউকেই উদ্বিগ্ন হতে দেখা গেল না— কারণ তখন আমার মায়ের শরীর খুবই খারাপ। শ্বাস কষ্ট হচ্ছে। এখন মারা যান তখন মারা যান অবস্থা। মওলানা ডাকা হয়েছে। মওলানা তওবা করিয়েছেন। খবর পেয়ে বাবা চলে এসেছেন ঢাকা থেকে। মা সেই যাত্রা রক্ষা পেয়ে যান। বাবা উৎফুল্ল মনে ঢাকায় ফিরে যান। যাবার আগে আরেকজন নতুন মাস্টার ঠিক করে যান। মুহম্মদ ইদরিশের বিষয়ে তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে সে ভালাে কোনাে সুযােগ পেয়ে চাকরি ছেড়ে ঢাকায় চলে গেছে। নিমকহারাম টিমকহারাম বলে তাকে অনেক গালাগালিও করেন।
আমিই মিসির আলি-পর্ব-(২৬)-হুমায়ূন আহমেদ
মার শরীর আরেকটু ভালাে হলে আমরা আবার ঢাকা শহরে চলে আসি। মুহম্মদ ইদরিশ কুয়ার ভেতর থেকে যায়। তার বিষয়ে কেউ কিছুই জানে না। আমি নিজেও ব্যাপারটা ভুলে যাই। একবার শুধু রাতে মন্দিরে দেখা নারী মূর্তিকে স্বপ্নে দেখি। স্বপ্নটা এ রকম— আমি মন্দিরের বারান্দায় বসে পেয়ারা খাচ্ছি। নারী মূর্তি এসে আমার সামনে দাঁড়াল। পরিচিত ভঙ্গিতে হাসতে হাসতে বলল, এই বাদর! আমাকে চিনতে পারছিস না? আমি বললাম চিনতে পারছি।
অন্যদিকে তাকিয়ে কথা বলছিস কেন ? না–কি আমার গায়ে কাপড় নেই বলে তাকাতে লজ্জা লাগছে।
আমি বললাম, লজ্জা লাগছে।
চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বল তাহলে লজ্জা লাগবে না। এখন বল দেখি ইদরিশ মাস্টারের উচিত শিক্ষা হয়েছে না?
আমি বললাম, হয়েছে। দেখলি কেউ কিছু বুঝতে পারে নি।
মানুষের শরীর পচে গেলে খুবই দুর্গন্ধ হয়। কুয়াটাতাে অনেক গভীর এই জন্যে পচা গন্ধ নিচে জমে আছে উপরে আসতে পারছে না। বুঝতে পারছিস?
আমি তােকে একটা বিষয়ে সাবধান করতে এসেছি। কোন বিষয়ে ? তুই কুয়ার ধারে একা একা যাবি না। গেলে কি হবে ?
ইদরিশ মাস্টার তােকে ডাকবে । তুই বাচ্চা মানুষতাে। ডাক শুনে ভয় টয় পেতে পারিস।
আচ্ছা কুয়ার পারে যাব না।
আমিই মিসির আলি-পর্ব-(২৬)-হুমায়ূন আহমেদ
কখনাে কোনােদিনও কুয়ার ভেতরে কি আছে উঁকি দিয়ে দেখতে যাবি না। দেখতে গেলেই মহাবিপদ।
আচ্ছা দেখতে যাব না।
ইদরিশ মাস্টারের প্রসঙ্গ এইখানেই শেষ। অনেক বছর পর ইদরিশ মাস্টারের প্রসঙ্গটা আমার আবার মনে আসে। তখন আমি বিলেতে পড়াশােনা করছি। কোন এক উইক এন্ডে হঠাৎ একটা বই হাতে এল— বইটার নাম The crystal door. বইটার লেখক কিংস কলেজের একজন বিখ্যাত সাইকিয়াট্রিস— James Hauler. তিনি এই বইটিতে বললেন মানুষের মনের কিছু দরজা আছে যা সহজে খােলে না। মানুষ যদি কোন কারণে ভয়ংকর কোন চাপের মুখােমুখি হয় তখনি দরজা খুলে যায়। তিনি এই দরজার নাম দিয়েছেন crysta door.
জেমস হাউলার বলছেন— এই স্ফটিক দরজার সন্ধান বেশির ভাগ মানুষ সমগ্র জীবনে কখনাে পায় না। কারণ বেশির ভাগ মানুষকে তীব্র ভয়াবহ মানসিক চাপের মুখােমুখি হতে হয় না। জেমস হাউলার মনে করেন মানুষের কাছে দু‘ধরনের বাস্তব আছে। একটি দৃশ্যমান জগতের বাস্তবতা, আরেকটি
অদৃশ্য জগতের বাস্তবতা। স্বপ্ন হচ্ছে সে রকম একটি অদৃশ্য জগত এবং সেই জগতও দৃশ্যমান জগতের মতই বাস্তব। স্ফটিক দরজা বা cystal door হলাে অদৃশ্য বাস্তবতার জগতে যাবার একমাত্র দরজা।