ইস্টিশন পর্ব-০৯ হুমায়ূন আহমেদ

ইস্টিশন পর্ব-০৯

চল চা খাবার ব্যবস্থা করি তারপর আমি আমার ছোট মামার গল্পটা বলব। দারুণ ইন্টারেস্টিং কুসুম শুনতে চাইলে সেও শুনবে। সে ভয় টয় পাবে বলে। মনে হয় না। মেয়েটার মারাত্মক সাহস। মেয়েদের এত সাহসও অবিশ্যি ভালো না। সে যে কীভাবে ব্রিজ থেকে লাফ দিয়ে পানিতে পড়ল এখনো মনে হলে শরীর ঠাণ্ডা হয়ে যায়। এই ঘটনা যদি ঢাকায় গিয়ে বন্ধু বান্ধবকে বলি কেউ বিশ্বাস করবে না। এদেরও দোষ দেয়া যায় না। ঘটনা আমি নিজের চোখে দেখেছি তারপরেও আমার নিজেরই বিশ্বাস হয় না।

কুসুম আপু জেগেই ছিল তবে চা বানানোর জন্য সে বের হল না। রহিমা ফুপু বের হলেন। জাপানি ইঞ্জিনিয়ার খুব সংকুচিত গলায় বলতে লাগলেন, আমি খুবই লজ্জিত আপনাকে কষ্ট দিচ্ছি। নেক্সট টাইম একটা ফ্লাক্স দিয়ে দেব। ঘুমুবার আগে শুধু ফ্লাক্স ভর্তি করে গরম পানি রেখে দেবেন।রহিমা ফুপু লম্বা ঘোমটা দিয়ে থাকলেন। একটা কথারও জবাব দিলেন। আমার ধারণা রহিমা ফুপু জাপানি ইঞ্জিনিয়ারকে একেবারেই পছন্দ করেন।। তিনি অবিশ্যি তার অপছন্দের কথা কখনোই বলবেন না।

আমরা চা খাচ্ছি বারান্দায়। উনার সাথে আমিও খাচ্ছি। চা খেতে আমার ভালো লাগে না, আমার খারাপও লাগে না। শুধু দোকানের চা খেতে ভালো লাগে। জাপানি ইঞ্জিনিয়ার ভূতের গল্প বলছেন এবং একটু পরপরই ভেতরের দিকে তাকাচ্ছেন। তিনি হয়তো ভাবছেন, কুসুম আপু কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে। বেচারার জন্যে আমার মায়াই লাগছে। গল্প করছেন আমার সঙ্গে অথচ তার মন পড়ে আছে অন্য একজনের জন্যে।

আমার নিজের ইচ্ছা করছে ডেকে কুসুম আপুকে নিয়ে আসি। তিনজন না হলে ভূতের গল্প কখনো জমে না। ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের গল্পটা খুব ভয়ের না হলেও খারাপ না।বুঝলে টগর আমার সেই মামাও ভয়ংকর সাহসী। কুসুমের মতোই সাহসী। ভূত যত উপদ্রপ করে তার জেদ তত বাড়ে। ভূত নানান ভাবে তাকে। বিরক্ত করে।

মশারি খাটিয়ে শুতে গিয়েছেন মাঝরাতে দেখা যাবে দড়ি থেকে মশারি খুলে গায়ের উপর ফেলে রাখা হয়েছে। আলনা ভর্তি কাপড় হঠাৎ একদিন দেখা যাবে সব কাপড় ভেজা। কাপড় থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। গোসল করতে লুংগি নিয়ে বাথরুমে ঢুকেছেন। গোসল শেষ করে লুঙ্গি পরতে গিয়ে দেখেন লুঙ্গি নেই। লুঙ্গি দলামচা করে কমোডে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। টগর গল্পটা কেমন লাগছে?

জি ভালো।কুসুম শুনলে মজা পেত।আরেক দিন আপাকে শুনাবেন।ভূতের গল্প বলার মুড সবদিন আসে না। আজকের রাতটা ভূতের গল্প বলার জন্যে ভালো ছিল। দেখ তো জেগে আছে কিনা। জেগে থাকলে পাঁচ মিনিটের জন্য আসতে বল।আমি এখন ডাকতে গেলে রাগ করবে।রাগ করলে আমার উপর রাগ করবে। তুমি তো আর ডাকছ না। আমি ডাকছি। গিয়ে বল খুবই জরুরি কিছু কথা বলব।

আমি নিতান্তই অনিচ্ছার সঙ্গে উঠে দাঁড়ালাম আর তখনি মার ঘর থেকে চাপা চিৎকার ভেসে এল। মনে হচ্ছে কেউ দুহাতে মার গলা চেপে ধরেছে। মা নিঃশ্বাস নেবার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। যে মার গলা চেপে ধরে আছে মা তাকে ছাড়াবার চেষ্টা করছেন।জাপানি ইঞ্জিনিয়ার ধড়মড় করে উঠে দাঁড়ালেন। ভীত গলায় বললেন, কী হয়েছে?

আমি বললাম, কিছু হয় নি।

চিৎকার কে করছে। তোমার মা?

জি।

দেখে আসতো কী ব্যাপার।

দেখা যাবে না।

দেখা যাবে না কেন?

আমি জবাব দিলাম না। জবাব দিতে ইচ্ছা করল না। মা কেন চিৎকার করছেন সেটা দেখা যাবে না, কারণ মার ঘর তালাবদ্ধ। তালার চাবি বাবার কাছে। গত এক সপ্তাহ ধরে মাকে তালাবদ্ধ করে রাখা হচ্ছে। মার শরীর আগের চেয়ে অনেক বেশি খারাপ করেছে। দিনের বেলা তিনি বেশ স্বাভাবিকই। থাকেন। কারো সঙ্গে কোনো কথাবার্তা বলেন না তবে খাওয়া দাওয়া করেন। খাওয়া শেষ করে ছোট বাচ্চাদের মতো কুণ্ডুলী পাকিয়ে ঘুমুতে যান। কিন্তু সন্ধ্যার পর থেকে তিনি অন্য রকম হয় যান।

হই চই চিৎকার চেঁচামেচি কিছুই করেন না, শুধু গায়ে কোনো কাপড় রাখতে পারেন না। তাঁর নাকি তখন শরীর জ্বলে যায়। তাঁর ঘরে বালতি ভর্তি পানি থাকে। তিনি সেই পানি মাথায় ঢালেন এবং ঘরের ভেতরই ছোটাছুটি করেন। এ-রকম চলে সারারাত। ফজরের আজানের পর পরই তিনি স্বাভাবিক হয়ে যান। আবার গায়ে কাপড় পরেন। তাঁকে তখন খুবই লজ্জিত মনে হয়।জাপানি ইঞ্জিনিয়ার উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, টগর খোঁজ নিয়ে আস ব্যাপারটা কী?

খোঁজ নিতে হবে না।এমন ভয়ংকর একজন রোগী ঘরে অথচ তোমরা সবাই কি নির্বিকার।। আমি এর কারণটা বুঝতে পারছি না। পাবনা মেন্টাল হসপিটালের একজন ডাক্তার আছে ডাক্তার আখলাকুর রহমান। আমার ছেলেবেলার বন্ধু। আমরা এক সঙ্গে স্কুলে পড়েছি। কলেজেও একসাথে পড়েছি—ঢাকা কলেজ। ওর বায়োলজি ছিল বলে ও চলে গেল মেডিকেলে। আমার ছিল জিওগ্রাফী। আমি ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলাম। আখলাকের কাছে একটা চিঠি দিয়ে তোমার মাকে পাঠালে সে সব ব্যবস্থা করবে।

ঐখানে চিকিৎসা ভালো হয়। তুমি এক কাজ কর, কুসুমকে ডেকে নিয়ে এসো। তার সঙ্গে ডিসকাস করি।আমি কুসুম আপুকে ডাকতে গেলাম না। মার ঘরের হই চই খুবই বাড়ছে। এখন মনে হচ্ছে জিনিস ছুঁড়ে দরজায় মারা হচ্ছে কিংবা মা দরজায় মাথা ঠুকছেন। পুরো বাড়িই মনে হয় কাঁপছে।রহিমা ফুপু বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন।জাপানি ইঞ্জিনিয়ার বললেন, সমস্যাটা কি একটু বলবেন? আমি যদি কোন সাহায্য করতে পারি।

রহিমা ফুপু শান্ত গলায় বললেন, কোনো সমস্যা নাই। আপনি ঘুমান।জাপানি ইঞ্জিনিয়ার খুবই অবাক হচ্ছেন। সমস্যা নেই বললে তো হবে না। বোঝাই যাচ্ছে বিরাট সমস্যা। ঘর দোয়ার ভেঙ্গে ফেলার মতো অবস্থা।রহিমা ফুপু আমার দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বললেন, টগর তোর বাবাকে ডেকে নিয়ে আয়। তালা খুলতে হবে।জাপানি ইঞ্জিনিয়ারের চিঠি নিয়ে মাকে পাবনা হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা হয়েছে।

সঙ্গে বাবা যেতে পারছেন না, তার ছুটি নেই। আব্দুর রহমান চাচার হাতে ইস্টিশন ফেলে রেখে তিনি যেতে পারেন না। ভাইয়াও যেতে পারছে না। তার নতুন চাকরি, এখনই ছুটি নিলে চাকরি নট হয়ে যাবে। তাছাড়া তাদের অফিসে এক বিদেশিনী এসেছেন। এনজিওর কাজ-কর্ম কেমন হচ্ছে তা তিনি ঘুরে দেখবেন। ভাইয়ার এখন প্রধান দায়িত্ব সেই মহিলাকে সঙ্গে নিয়ে গ্রামে-গঞ্জে ঘুরা। ভাইয়া এই কাজ অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে করছে।

তার মুখে কয়েকদিন ধরেই এই মহিলার কথা ছাড়া অন্য কোন কথা নেই। ভদ্রমহিলার নাম এলেন। সবাই ডাকে মিস এলেন। থুড়থুড়ি বুড়ি হয়ে যাবার পরও বিয়ে করেন নি বলেই মিস এলেন। ভদ্রমহিলাকে আমি দেখেছি। ঠোঁটে গাঢ় করে লিপস্টিস দেয়া। মাথায় লাল রঙের টুপি। হাঁটার সময় হাতে বেতের একটা লাঠি আছে। বুড়ো মানুষেরা যে কারণে লাঠি ব্যবহার করে উনি সেই কারণে করেন না। লাঠিটা তার শোভা।

প্রতিদিনই এই বুড়ির গল্প না বললে ভাইয়ার মনে হয় অস্থির লাগে। আমি সব গল্পই আগ্রহ করে শুনি। বুড়ি মিস এলেনের গল্প শুনতেও আমার ভালো লাগে।বুঝলি টগর। বুড়ির স্বাস্থ্য দেখে বোঝার উপায় আছে যে চার মাইল কাদা মাখা রাস্তা সে জোর কদমে হাঁটতে পারে? আমি একেবারে থান্ডার হয়ে গেছি। হাসে আর ফুস ফুস করে সিগারেট খায়। খুবই লজ্জার কথা—একদিন আবার আমাকে সাধল। আমি মিথ্যা করে বললাম– ডােন্ট স্মােক।তোমাকে মনে হয় খুব পছন্দ করে।

পছন্দ তো করেই। এটা নিয়ে হয়েছে সমস্যা, বাংলাদেশের কারবার। কেউ কারো ভালো দেখতে পারে না। অফিসে যেই টের পেয়ে গেল মিস এলেন আমাকে পছন্দ করেন। ওমি দলাদলি। ছগির বলে অফিসে খানকির পুলা আছে। আমার বদলে মিস এলেনের ডিউটি তাকে করতে দিল।সে কী।কোনো লাভ হয় নি। মিস এলেন পরিষ্কার বলে দিলেন—রন্টু কুটায়? রন্টু। বিদেশীদের জিব্ব্যা ভারী থাকে এরা কঠিন বাংলা শব্দ বলতে পারে না। আমাকে ডাকে রন্টু।বাংলা জানেন?

ভালো বাংলা জানে। মাঝে মাঝে উনার বাংলা শুনে আমি থান্ডার হয়ে যাই। ঐ দিন কি হয়েছে শোন—এক বাড়িতে গিয়েছি। বাড়ির ভেতর থেকে এক লোক বের হয়ে বলল, বুইড়া মাগী কী চায়? মিস এলেন তার কথা শুনে শান্ত গলায় বললেন—মহিলাকে মাগী বলিবে না। মাগী গালাগালি ভালো নহে। ইহা অশোভন গালাগালি।উনি তো দেখি ভালো বাংলা শিখেছেন।বিদেশী তো। এরা ইশারাতেই সব ধরে ফেলে। আমরা ডালে ডালে চললে ওরা চলে পাতায় পাতায়। আমরা পাতায় পাতায় চললে ওরা চলে শিরায় শিরায়।তোমার কাজে উনি খুব খুশি?

ওদের খুশি-অখুশি বোঝা মুশকিল। খুশি হলেও এরা কিছু বলবে না, আবার অখুশি হলেও কিছু বলবে না। তবে আমাকে যে অত্যন্ত স্নেহ করে এটা বোঝা যায়।কীভাবে বুঝলে? তোমাকে কিছু বলেছেন? আমাকে নিয়ে একটা ছড়া বানায়ে ফেলেছে—বুঝলি না।কী ছড়া? সাইকেল নিয়ে বের হই–টুনটুন করে ঘন্টা বাজাই সেটা নিয়ে ছড়া

সাইকেল টিং টিং

রন্টু পাগলা শিং

হা হা লাফটার

রন্টু বিগ স্টার।

মার চলে যাবার দিন ভাইয়া থাকতে পারল না। মিস এলেনকে নিয়ে তার। মুলাদী গ্রামে প্রোগ্রাম। সেই গ্রামে পনেরো জনকে সেনিটারি পায়খানা দেয়া হবে। গর্ত করে রিং স্ল্যাভ বসানো হবে। একজন বয়াতীকে আনা হয়েছে সে তার দলবল নিয়ে স্যানিটারি পায়খানার উপকারিতা নিয়ে গান করবে। পুরো অনুষ্ঠান ভিডিও করা হবে। বিরাট ব্যবস্থা। স্যানিটারি পায়খানার গানের একটা ক্যাসেট ভাইয়া নিয়ে এসেছে। জাপানি ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের ক্যাসেট প্লেয়ারে বাজিয়ে সেই গান আমরা শুনেছি।

ভাইয়া চোখ বড় বড় করে বললবাংলাদেশের গ্রামে গঞ্জে এই গান আমরা ছড়িয়ে দেব। একটা হুলুস্থুলুস পড়ে যাবে। ভাইয়া হুলুস্থুল বলতে পারে না। বলে হুলুস্থুলুস। বুঝলি টগর, লোকের মুখে মুখে গান ফিরবে। আমাদের কর্ম পদ্ধতি মারাত্মক। গানের মাধ্যমে শিক্ষা। ভাইয়া এমন ভাবে কথা বলে যেন গানটা সে নিজেই গেয়েছে। এবং এই গান গ্রামে গঞ্জে ছড়ানোর ব্যবস্থাও সে নিজেই করেছে। ভাইয়া নিজেও গোসল। করার সময় গানটা গায়। তার গলা খারাপ না, শুনতে ভালোই লাগে–

শুনেন শুনেন দশজনাতে শুনেন দিয়া মন

উন্নত পায়খানার কথা করিব বর্ণন।

আহা পায়খানারে। আহা পায়খানা রে।।

দশফুট গর্ত হবে কোনো চিন্তা নাই

তার উপরে স্লাভ বসিবে বলে দিয়া যাই

স্লাভের উপর রিং বসিবে বলি পরিষ্কার

উন্নত পায়খানা হলে চিন্তা নাইকো আর

আহা পায়খানারে। আহা পায়খানারে।।

মাকে পাবনা মেন্টাল হসপিটালে নিতে এসেছেন মায়ের দুই ভাই। দুই। জনই বয়সে মার ছোট। কিন্তু কেমন বুড়োটে দেখাচ্ছে। একজনের চুল দাড়ি পেকে শাদা। তার বোধ হয় হাঁপানি রোগও আছে। আসার পর থেকে হাঁপাচ্ছেন। মার সঙ্গে দুজনই খুব স্বাভাবিক গলায় কথা বলছেন। যেন মার। কোনো অসুখবিসুখ নেই। তিনি সুস্থ মানুষ। আমি এই দুই মামাকে আগে কখনো দেখেছি বলে মনে করতে পারলাম না। কিন্তু তারা আমার সঙ্গেও এমন ভাবে কথা বললেন যেন প্রায়ই আমাদের দেখা সাক্ষাৎ হয়। দুই মামার একজনের নাম হারুন। তার চেহারা সুখি সুখি। তিনি মনে হয় কথা বলতেও পছন্দ করেন।

সবার সঙ্গে আন্তরিক ভঙ্গিতে কথা বলছেন। তিনি পান খেতে খেতে মাকে বললেন–আপনার সুখের সংসার দেখে চক্ষু জুড়ায়ে গেছে বুবু। আপনার বড় ছেলের সঙ্গে এখনো দেখা হয় নাই। ছোটজনকে দেখে চক্ষু জুড়ায়ে গেছে। দুলাভাই এর কাছে শুনলাম বড়জন এনজিওতে চাকরি করে। শুকুর আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ্ পাকের খাস রহমত ছাড়া এটা সম্ভব না।মা মনে হয় মামার কথা কিছুই বুঝলেন না। লম্বা ঘোমটা টেনে ফিস ফিস করে বললেন—আপনাদের খাওয়া দাওয়া হয়েছে?

হারুন মামা উৎসাহের সঙ্গে বললেন, আমাদের খাওয়া দাওয়া নিয়ে মোটেই চিন্তা করবেন না বুবু। আসার পর থাইকা খাওয়া খাদ্যের উপর আছি। আপনার শরীরটা খারাপ হয়েছে শুনে অত্যন্ত চিন্তাযুক্ত। তবে ইনশাল্লা সুচিকিৎসা হবে। সুস্থ হওনের পর বুবু আপনাকে দেশের বাড়িতে কয়েক দিনের জন্যে নিয়া যাব। খুবই গরিবি হালতে আছি আপনার কষ্ট হবে।

বাপের বাড়ির কষ্ট অবশ্য গায়ে লাগে না। দুলাভাই এর সঙ্গে এই বিষয়ে আলাপ হয়েছে। দুলাভাই মত দিয়েছেন। বাকি আল্লাহপাকের ইচ্ছা।মা আবারো ফিস ফিস করে বললেন আপনাদের খাওয়াদাওয়া হয়েছে।মার কথাবার্তার কোনো ঠিক ঠিকানা না থাকলেও তিনি তাঁর দুই ভাইকে দেখার পর থেকেই খুব স্বাভাবিক আচরণ করছেন। চিৎকার হই চই নেই।

ঘোমটা দিয়ে বসে আছেন। বাবা যখন বললেন—বৌ যাও কয়েকটা দিন বেড়ায়ে আস। মা সঙ্গে-সঙ্গে সুবোধ বালিকার মতো ঘাড় নাড়লেন। এবং ফিক করে হেসে ফেললেন।রহিমা ফুপু মার সব কাপড় চোপড় গুছিয়ে দিয়েছেন। মার সুটকেসে বাবা কিছু টাকাও দিয়ে দিয়েছেন। টাকা, চিঠি লেখার পােস্ট কার্ড। বল পয়েন্ট কলম।

বৌ মনে করে চিঠি লিখবে। তোমার লিখতে ইচ্ছা না করলে, হাসপাতালে ডাক্তার আছে, নার্স আছে। তাদেরকে বললেই চিঠি লিখে দিবে। পােস্ট কার্ডে ঠিকানা লেখাও আছে।জি আচ্ছা।খাওয়া দাওয়া ঠিক মতো করবা। অষুধ পত্র খাবার ব্যাপারে অনিয়ম করবা না।জি আচ্ছা।সময় সুযোগ হলেই তোমাকে দেখতে যাব। প্রতি মাসেই কেউ-না-কেউ যাবে। কোনোবার আমি, কোনোবার যাবে রঞ্জু।

জি আচ্ছা।ট্রেন বিকেলে। দুপুরের পর থেকে মাকে খুব খুশি-খুশি লাগতে লাগল। তিনি কারো সঙ্গে কোনো কথা বলছেন না, কিন্তু সবার দিকেই হাসি মুখে তাকাচ্ছেন। তাঁর চোখ দেখে মনে হচ্ছে তিনি সবাইকে চিনতে পারছেন। আমি কাছে গিয়ে বললাম, মা আমাকে চিনেছ? মা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লেন। আমি বললাম, বলতো আমি কে?

মা বললেন, তুই টগর।তোমার মাথার যন্ত্রণা কি কমে গেছে? হ্যাঁ।তুমি কোথায় যাচ্ছ জান? পদ্মনগর।তুমি পদ্মনগর যাচ্ছ না মা, তোমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে। ওরা তোমার চিকিৎসা করবে। তুমি ভালো হয়ে ফিরে আসবে।আচ্ছা।আমি মার গা ঘেঁসে বসে রইলাম। খুব কাছে বসলাম যেন ইচ্ছা করলেই মা আমার গায়ে হাত রাখতে পারেন। মা তা করলেন না। চুপচাপ বসে রইলেন, তবে মাঝে মধ্যেই কৌতূহলী চোখে আমার দিকে তাকাতে লাগলেন। তাঁর ঠোঁটে ফিক ফিক হাসি লেগেই রইল।

দুপুরে খেতে বসে দুই মামার ভেতর কী নিয়ে যেন লেগে গেল। চাপা গলায় একজন আরেকজনের সঙ্গে কথা বলছেন, কটমট করে তাকাচ্ছেন। ভয়ংকর কিছু হচ্ছে তা বোঝা যাচ্ছে, কিন্তু তার ফাঁকে খাওয়াদাওয়া ঠিকই করছেন। এক ভাই আবার আরেক ভাইকে সাধাসাধিও করছেন—মাছ নিবা আরেক পিস?

আমি কৌতূহলী হয়ে একবার জিজ্ঞেস করলাম, মামা কী হয়েছে? হারুন মামা মধুর ভঙ্গিতে হাসতে হাসতে বললেন, কিছু না বাপধন। সংসারী আলাপ। সংসারী আলাপে একটু আধটু হিট হয়। এইটা কিছু না।সংসারী আলাপের রহস্য কিছুক্ষণের মধ্যেই জানা গেল। হারুন মামা খাওয়া শেষ করে পান মুখে দিতে দিতে বাবাকে বললেন, দুলাভাই বুবুর যাতায়াত এবং চিকিৎসার খরচা আপনে বড় ভাই এর হাতে দিয়েছেন। এইটা ঠিক না।

আমরা দুই জনে বুবুরে নিয়া যাইতেছি। খরচা সমান দুই ভাগ কইরা দুইজনের হাতে দেন।বাবা বললেন, একজনের কাছে দিলেই তো হয়।হারুন মামা বললেন, হয় না। সংসার অত সহজ না। বড় ভাই এর কাছ থাইক্যা দুইটা টাকা বাইর করা আমার পক্ষে সম্ভব না। বাকি আপনার বিবেচনা। আমি আমার ব্যবসা বাণিজ্য সব ফালাইয়া রওনা হইছি আর টেকা বগলে নিয়া বইস্যা আছে আরেকজন। এই রকম হইলে তো আমার যাওয়া। সম্ভব না। আমারে বিদায় দেন।এইসব কী বলছ?

আমি পরিষ্কার মানুষ। আমার পরিষ্কার কথা। খরচার টেকা দুই ভাগ হবে। সমান সমান ভাগ। যদি তা হয় আমি আছি। যদি না হয়—থুক্কু।বোনের জীবন মরণ সমস্যা আর তুমি বলে ফেললে–থুক্কু।হারুন মামা আরেকটা পান মুখে দিতে দিতে বললেন, আমি পরিষ্কার মানুষ। পরিষ্কার কথা বললাম। এখন জামানা খারাপ। পরিষ্কার কথা কারোর ভালো লাগে না।

বাবা এই ঝামেলা কীভাবে মেটালেন আমি জানি না। দেখা গেল দুই ভাইই অত্যন্ত আনন্দিত মুখে বোনকে নিয়ে ট্রেনে উঠলেন। হারুন মামা ট্রেনের জানালা থেকে গলা বের করে বললেন। দুলাভাই লিশ্চিন্ত থাকেন। আমরা দুই ভাই থাকতে কোনো অসুবিধা হবে না বাকি আল্লাহপাকের মর্জি।ট্রেনে উঠে মার আনন্দ খুব বাড়ল। তাঁর মুখে পান। একটু পর-পর তিনি জানালা দিয়ে মুখ বের করে পানের পিক ফেলছেন, এবং ছোট বাচ্চাদের মতো হাসছেন।

 

Read more

ইস্টিশন পর্ব-১০ হুমায়ূন আহমেদ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *