ইস্টিশন পর্ব-১০ হুমায়ূন আহমেদ

ইস্টিশন পর্ব-১০

মাকে বিদায় দিতে আমরা সবাই ইস্টিশনে এসেছি। বাবা দাঁড়িয়ে আছেন কুঁজো হয়ে। দুপুরের পর থেকে তাঁর পেটে ব্যথা শুরু হয়েছে। আজকের ব্যথাটা মনে হয় তীব্র। কারণ তাঁর মুখ কালো হয়ে গেছে। তিনি একটু পর পর হাতঘড়িতে সময় দেখছেন। ব্যথা উঠলেই তিনি ঘড়ি দেখেন। বাবার পাশে রহমান চাচা দাঁড়িয়ে আছেন। রহমান চাচা বাবার কানে-কানে কি যেন বলছেন। বাবা ক্লান্ত ভঙ্গিতে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ছেন।

রহিমা ফুপু একটু দূরে একা দাঁড়িয়ে আছেন। সব সময় তার মাথায় ঘোমটা থাকে। আজ তার মাথায় ঘোমটা নেই। আমি দাঁড়িয়ে আছি কুসুম আপুর পাশে। কুসুম আপুর চোখ দিয়ে ক্রমাগত পানি পড়ছে। কুসুম আপু এত কাঁদছে কেন আমি বুঝতে পারছি না। মার সঙ্গে তার কখনোই কোনো খাতির ছিল না। মা যখন সুস্থ থাকেন তখনও কুসুম আপুর সঙ্গে কথা বলতেন না। বরং তাকে দেখলে মার ভুরু সামান্য কুঁচকে যেত। চোখের দৃষ্টি কঠিন হয়ে যেত।

ভাইয়ার ইস্টিশনে আসার কথা না। বুড়ি মিস এলেনের সঙ্গে তার প্রোগ্রাম। কিন্তু ভাইয়া ঝড়ের বেগে সাইকেল চালিয়ে উপস্থিত হল। মনে হয় সে অনেক দূর থেকে এসেছে আর শার্ট ঘামে ভেজা। চোখ লাল। বড় বড় নিঃশ্বাস নিচ্ছে।ভাইয়াকে দেখে বাবা অসম্ভব খুশি হলেন। মনে হল হঠাৎ তাঁর পেটের ব্যথাটা কমে গেছে। তিনি ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে বললেন, বাবা যাও। মাকে কসমবুসি করে আস। ট্রেন এখন ছেড়ে যাবে। এম্নিতেই দুই মিনিট বেশি রেখেছি।

ভাইয়া নড়ল না। সাইকেল ধরে হাঁপাতে লাগল। বাবা রহমান চাচার হাত থেকে সবুজ ফ্ল্যাগ নিয়ে উড়িয়ে দিলেন। ট্রেন চলতে শুরু করল। মার দৃষ্টি এতক্ষণ এলোমেলো ছিল, ট্রেন চলতে শুরু করা মাত্র তিনি কেমন যেন অস্থির হয়ে গেলেন। অবাক হয়ে সবার দিকে তাকাতে লাগলেন। মনে হল কী ঘটছে তিনি বুঝতে পারছেন না।

আমরা সবাই ট্রেনের সঙ্গে সঙ্গে আসছি শুধু বাবা সবুজ ফ্ল্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ফ্ল্যাগ নাড়াচ্ছেন। ভাইয়া হঠাৎ বলল, টগর সাইকেলটা ধরত।আমি সাইকেল ধরলাম। ভাইয়া ছুটে গিয়ে চলন্ত ট্রেনে লাফ দিয়ে উঠে পড়ল। যে জানালা দিয়ে মুখ বের করে মা আমাদের দেখছিলেন সেই জানালা দিয়ে সেও মুখ বের করল। মা হাত নাড়াচ্ছে, মার সঙ্গে সঙ্গে ভাইয়াও হাত নাড়াচ্ছে।

বাবা প্লাটফর্মে বসে পড়েছেন। পেটের ব্যাথাটা আজ মনে হয় খুবই বেড়েছে। রহমান চাচা বাবার হাত ধরে আছেন। বাবা খুব কাঁদছেন। আমি কাছে যেতেই বাবা আমাকে ইশারা করলেন পাশে বসতে। আমি বসলাম। বাবা। ফিসফিস করে বললেন, রঞ্জু যে কাজটা করেছে তার জন্যে আল্লাহপাক তার উপর খুবই সন্তুষ্ট হয়েছেন বলে আমার বিশ্বাস। আল্লাহপাকের সন্তোষ লাভ করা ভাগ্যের ব্যাপার। আমার বড় পুত্র বড়ই ভাগ্যবান।

বাবা খুবই কাঁদছেন। আমি বললাম, তোমার পেটে ব্যথা কি খুব বেশি? বাবা চোখ মুছতে মুছতে বললেন, হ্যাঁ, ব্যাথাটা বাড়তেছে। মনে হচ্ছে পেটে। কয়লার চুলা বসায়ে কেউ রান্না করতেছে।।রাতে বাবার ব্যথা খুবই বাড়ল। তিনি ছটফট করতে লাগলেন। রহমান। চাচা ডাক্তারকে খবর দিয়ে আনলেন। ডাক্তার সাহেব চোখ মুখ কুঁচকে বললেন, সদর হাসপাতালে নেয়া উচিৎ। এ্যাপেনডিক্স বাস্ট করলে এমন হয়, আবার ধরেন আলসারও হতে পারে। পাকস্থলী ফুটা হয়ে গেছে।কুসুম আপু বলল, আপনার হাতে কোনো চিকিৎসা নাই?

ডাক্তার সাহেব বললেন, ঘুম চিকিৎসা আছে। ঘুম পাড়ায়ে দিতে পারি। ঘুম ভাঙলে আবার ব্যথা শুরু হবে।দিন আপাতত ঘুম পাড়িয়ে দিন।ডাক্তার সাহেব চারটা ঘুমের ট্যাবলেট খাইয়ে দিয়ে গলা অস্বাভাবিক নিচু করে বললেন, আমার আসল সন্দেহ ক্যানসার। পুরাতন ব্যাধির কথা বললেন। তো–পুরাতন ব্যাধি একটাই ক্যানসার। হ্যাজ নো আনসার। হয়ে গেলে উপায় নাই। ডাক্তার কবিরাজ গুলে খাইয়ে দিলেও কোনো লাভ নাই। ডাক্তার কবিরাজ হজম হয়ে যাবে ক্যানসারের কিছু হবে না।

আজ সারাদিন জাপানি ইঞ্জিনিয়ারের কোনো খোঁজ ছিল না। তাঁর কাছে আবারো ইন্সপেকশন টিম এসেছে। ক্রেন চালক জামশেদ দলবল নিয়ে ইন্সপেকশন টিমের সঙ্গে এসেছে। শুধু তাই না এবার দলের সাথে সত্যিকার বিদেশী ইঞ্জিনিয়ারও একজন এসেছেন। মগরা ব্রিজের রিপেয়ারের কাজ চীন সরকারের সাহায্যে হচ্ছে বলেই একজন চীনাম্যান এসেছেন। চীনাম্যানের নাম—আনতাং বা এই রকম কিছু। ব্রিজের রিপেয়ার কাজ যতদিনই চলবে ততদিনই তিনি এখানে থাকবেন।

জাপানি ইঞ্জিনিয়ার চীনাম্যানকে নিয়ে রাতে আমাদের বাসায় খেতে এলেন। বাবার অবস্থা দেখে দুজনই হতভম্ব। বাবা এই অসুস্থ অবস্থায়ও বিনয়ে গলে গিয়ে বারবার বলতে লাগলেন—ভেরি হ্যাপী। মাই হ্যাপীনেস নোজ নো। বাউন্ড। প্লীজ হ্যাভ রাইস৷ উই আর পুওর বেঙ্গলি। অনলী রাইস এন্ড কারি। নাথিং এলস।চীনাম্যান বোধ হয় ইংরেজি জানে না। বাবার প্রতিটি কথায় হাসিমুখে হ্যাঁ। সূচক মাথা ঝাঁকাল। তারপর চা-টা কিছুই না খেয়ে চলে গেল।

বাবার পেট ব্যথা বাড়তেই থাকল। ডাক্তারের দেয়া ঘুমের অষুধে কিছু হল। জাপানি ইঞ্জিনিয়ার আবারো ডাক্তার সাহেবকে ডেকে আনতে পাঠালেন। তিনি ফিরলেন ডাক্তার না নিয়েই। ডাক্তার সাহেব উত্তর পাংশায় কলে গিয়েছেন। রাতে ফিরবেন না। রহমান চাচা ডাক্তার নিয়ে না ফিরলেও ভালো খবর নিয়ে ফিরলেন। মেট্রিকের রেজাল্ট হয়েছে। কুসুম আপু পাশ করেছে।কুসুম আপু বলল, পাশ তো অনেক রকম। আমি কী রকম পাশ করলাম?

রহমান চাচা বললেন, সেটা মা আমি জানি না। পাশ করছ এইটা জানি। পাশ করছ এর জন্যেই আল্লার দরবারে শোকর গুজার কর। তোমার ভাই রঞ্জু ফেল হয়েছিল। সে ছেলে হইয়াও কিন্তু পাশ দিতে পারে নাই। তার বুদ্ধিও কোনো অংশে কম না। বরং অত্যধিক বেশি। ছোট থেকে তারে আমি দেখেছি এই অঞ্চলে এমন কোনো ছেলে ছিল না যে তার সাথে মারবেল খেলায় পারে।

দুইটা মার্বেল একটার গায়ে একটা লাইগ্যা আছে এর মধ্যেও তুমি যদি বল পশ্চিমেরটারে মার। হে পশ্চিমেরটারে মারব।কুসুম আপু বিরক্ত হয়ে বলল, আমি যে পাশ করেছি এইটাই আপনাকে। কে বলল? কেউ বলে নাই। আমি গাঁজাখোর মানুষ। আগবাড়াইয়া কে আমারে খবর দিব?তাহলে জানলেন কীভাবে? বাজারে আলোচনা।কী অদ্ভুত কথা। আমি পাশ করেছি না ফেল করেছি এটা নিয়ে বাজারে আলোচনা হবে কেন?

সেইটা তো আম্মাজি আমি জানি না। আলোচনা হইতেছে শুনছি। বিশ্বাস করা-না-করা আপনের বিবেচনা। আমি গাঁজাখোর। গাঁজাখোর যে কথাই কয় মনে হয় মিথ্যা। এইটা হইল গাঁজাখোরের কপাল। মদখোরের কপাল আবার। ভালো। মদখোর যাই কয় সবেই ভাবে সত্য কথা বলতেছে।রহমান চাচা সত্যি কথাই বলেছিল। কুসুম আপু পাশ করেছে এবং তার পাশ নিয়ে বাজারে আলোচনা হচ্ছে। কুসুম আপু খুব সাধারণ পাশ করে নি।

ঢাকা বোর্ডে ছেলে মেয়ে সবার মধ্যে ফোর্থ হয়েছে। লেটার পেয়েছে ছয়টা। বিন্ধুবাসিনী স্কুলের হেডমাস্টার সাহেব তার স্কুলের সব শিক্ষকদের নিয়ে রাত নটার সময় চলে এলেন। তিনি আরো আগেই আসতেন স্যাকরার দোকানে গোল্ডমেডাল বানাতে গিয়ে দেরি হয়ে গেল। গোল্ড মেডালটা হেডমাস্টার সাহেব নিজ খরচায় দিচ্ছেন। তার মায়ের নামে মেডালের নাম মোসাম্মত মনোয়ারা খাতুন স্বর্ণপদক। এই স্বর্ণপদক।

এই স্বর্ণপদক শুধুমাত্র বিন্দুবাসিনী স্কুলের মেয়েদের জন্যে প্রযোজ্য। এই স্কুলের কোনো মেয়ে যদি বোর্ডে দশজনের মধ্যে থাকতে পারে তবেই সে এই পদক পাবে।বাবার পেটে ব্যথা সেরে গেল। তিনি গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসলেন। জাপানি ইঞ্জিনিয়ার যে ব্যস্ততা দেখালেন তাও দেখার মতো। এত বড় সুসংবাদ নিয়ে লোকজন আসছে তাদের শুধু মুখে দেয়া যায় না। তিনি আমাকে নিয়ে মিষ্টি আনতে গেলেন।

শুধু মিষ্টি না, চা পাতা, চিনি এবং চায়ের দুধও কেনা হল। এবং জাপানি ইঞ্জিনিয়ার নিজেই চা বানাতে রান্না ঘরে ঢুকে গেলেন। রহিমা ফুপু একবার শুধু বলেছিলেন—ছিঃ ছিঃ আপনি কেন? জাপানি ইঞ্জিনিয়ার গম্ভীর মুখে বললেন, আপনি শুধু দেখুন। চা আম ভালোই বানাতে পারি। একা। একা দীর্ঘদিন চা বানিয়ে এমন এক্সপার্ট হয়েছি। হা হা হা। জাপানে আমি একবার কম্পিটিশনে চা বানিয়ে ফার্স্ট প্রাইজ পেয়েছিলাম।

শ্রীলংকার এক ছেলে, আমি, পাকিস্তানের একজন, ইন্ডিয়ার মাদ্রাজের একজন, আরেকজন জাপানি মেয়ে এই পাচজনের মধ্যে কম্পিটিশন। যার চা সবচে ভালো হবে সে পাবে এক হাজার ইয়েন। জাজ ছিলেন ব্রিটিশ এক ভদ্রলোক। এক হাজার ইয়েন আমিই পেয়েছিলাম।অন্য সময় জাপানি ইঞ্জিনিয়ার মিনিটে মিনিটে কুসুম আপুর খোঁজ করেন। আজ তা করছেন না। মহানন্দে চা বানাচ্ছেন। আমি তার হেল্পার। আজ আমার সঙ্গেই গল্প করছেন। আগ্রহ নিয়েই গল্প করছেন। গল্পের বিষয়বস্তু অবশ্য কুসুম আপু।

বুঝলে টগর, তোমার বোন যখন ব্রিজের উপর থেকে ঝাঁপ দিল তখনি আমি বুঝেছি এই মেয়ে সাধারণ মেয়ে না। এ মেয়ে হল মাকিউকি টাইপ। মাকিউকি কি তাতো জান না। মাকিউকি হল যারা প্রতিভা জনিত কারণে একসেন্ট্রিক। মাকিউকি একটা জাপানি শব্দ। ভালো কথা একসেন্ট্রিক শব্দের মানে জান? একসেন্ট্রিক ইংরেজি শব্দ—এর মানে বায়ুগ্রস্ত।

ঠিক পাগল না, আবার ঠিক সুস্থও না। ছোটদের সঙ্গে গল্প করার এই হল সমস্যা। প্রতিটি স্টেপ ব্যাখ্যা করে করে এগুতে হয়। গল্পের মূল ফ্লো যায় নষ্ট হয়ে। আমি কি ঠিক করেছি জান? আমি ঠিক করেছি কুসুমকে ম্যাথমেটিক্স পড়াব। ম্যাথ বিষয়ে সবার মধ্যে অকারণ ভীতি কাজ করে। ভালো ছেলেমেয়েরা আবার অন্যদের কাছে শুনে কম্পিউটার সায়েন্স এস্ট্রোফিজিক্স এইসব পড়তে চায়। সায়েন্সের মূল বিষয় হল ম্যাথ।

জি।যদিও ম্যাথ কিন্তু বিজ্ঞান না। এই ভুলটা সবাই করে। ম্যাথ বললেই মনে করে সায়েন্স। ম্যাথ হল বিজ্ঞানকে বোঝার একটা টুল। টুল মানে জান? জি না। টুল মানে যন্ত্রপাতি। ও। কুসুমের সঙ্গে কথা বলতে হবে, দেখি সে রাজি হয় কিনা। অবশ্য আমি যা বলব তাতেই সে রাজি হবে।না, রাজি হবে না। উল্টো হবে। কুসুম আপু যা বলবে তাতেই আপনি রাজি হবেন।কেন?

কারণ কুসুম আপুর শরীরে একটা বিশেষ চিহ্ন আছে। এই চিহ্ন যার শরীরে থাকে সব পুরুষ তার কথা শুনে।তোমাকে কে বলেছে? কুসুম আপু।চিহ্নটা কী? চিহ্নটা কী আপনাকে বলা যাবে না।জাপানি ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের বোধ হয় সারারাত গল্প করার পরিকল্পনা ছিল। তিনি তা করতে পারলেন না। সাইট থেকে তাকে নেবার জন্যে লোক। এসেছে। চীনাম্যানের সঙ্গে ক্রেইনের ড্রাইভার জমশেদের কী নাকি গন্ডগোল হয়েছে। সিরিয়াস ঝামেলা হচ্ছে। তিনি না গেলেই না।

এত বড় একটা পাশ করার পরেও কুসুম আপু খুব স্বাভাবিক। যেন তার কিছুই হয় নি। রহিমা ফুপু বললেন, কিরে মেডেলটা খুলে রাখলি কেন। গলায় দে।কুসুম আপু বলল, আমি কি বিড়াল যে গলায় ঘন্টা বেঁধে ঘুরব।এটা সোনার মেডেল এটা ঘন্টা নাকি?

কুসুম আপু আমাকে ঘুম থেকে তুলল। ফিস ফিস করে বলল, আজ একটা আনন্দের ঘটনা ঘটেছে সেই উপলক্ষে তোকে আমি আমার চিহ্নটা দেখাব। কি দেখতে চাস? ভ্যাবদার মতো বসে থাকবি না। দেখতে চাইলে মাথা নাড়।আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম।

কুসুম আপু সঙ্গে সঙ্গে বলল, আজ না আরেক দিন।মাকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে ভাইয়া ফিরে এসেছে। ভর্তির ব্যাপারে কোনো সমস্যা হয় নি। জাপানি ইঞ্জিনিয়ারের বন্ধু সব করিয়ে দিয়েছেন। এবং ভাইয়াকে ডেকে বলেছেন, তুমি কোনো দুশ্চিন্তা করবে না। তোমার মায়ের ভালো চিকিৎসা হবে। তার অবস্থার উন্নতি অবনতি যাই হয় আমরা চিঠি দিয়ে জানাব।

হাসপাতালের খাওয়া দাওয়ার সমস্যা আছে। করার কিছু নাই। হেড আয়াকে কিছু টাকা পয়সা দিয়ে যাও, বাইরে থেকে এটা সেটা কিনে খাওয়াবে। এদেরকে হাতে রাখা ভালো। রোগীর আসল দেখাশোনা এরাই করে।ভাইয়া হেড আয়ার হাতে পাঁচশ টাকা এবং হেড নার্সের হাতে পাঁচশ টাকা দিয়ে এসেছে। বাবা বললেন, এত টাকা তুই পেয়েছিস কোথায়?

অফিসের টাকা। অফিসের বারোশ টাকা আমার কাছে ছিল।আমার কাছ থেকে টাকাটা নিয়ে দিয়ে আয়।ভাইয়া বলল, আচ্ছা।।অফিসে টাকা ফেরত দেওয়ার ব্যাপারে তার কোনো আগ্রহ দেখা গেল না। অফিসে যাবার ব্যাপারে তার আর উৎসাহ নেই। অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমায়। ঘুম থেকে উঠে রেস্টুরেন্টে যায় চা খেতে। চা খেয়ে চলে আসে ইস্টিশনে। ইস্টিশনে এসে রেল লাইনে পা রেখে ঝিম ধরে বসে থাকে।

দূর থেকে দেখলে মনে হয় টেলিগ্রাফের তারে কাক বসে আছে। কাকরা যেমন মাথা ঝাঁকায়, ভাইয়াও মাথা ঝাঁকায়।রহমান চাচার ধারণা রেল লাইনে বসে থাকা খুবই অলক্ষণ। কেউ ঘন-ঘন রেল লাইনে বসলে রেল লাইন তাকে চিনে ফেলে। নিশি রাতে ডাকাডাকি শুরু করে। রেল লাইনের ডাক, নিশি ডাকের মতোই মারাত্মক। রেল লাইন। মানুষটাকে ডেকে ঘর থেকে বের করবে। তারপর ভুলিয়ে ভালিয়ে কোনো এক নিশুতি রাতে তাকে কাছে টানবে।

বেচারা ঘোরের মধ্যে লাইন ধরে হাঁটতে থাকবে, বুঝতেও পারবে না পেছন থেকে ঝড়ের গতিতে আসছে চিটাগাং মেইল, কিংবা বাহাদুরাবাদ এক্সপ্রেস। সে ট্রেনের শব্দ ঠিকই শুনবে, কিন্তু ভাববে বাতাসের শব্দ। ট্রেনের ড্রাইভার যখন বাঁশি বাজাবে সেই শব্দও তার কানে যাবে। কিন্তু সে ভাববে বনের ভেতর থেকে শীস-পাখি শীস দিচ্ছে।

শীসপাখিরা ট্রেন লাইনের আশেপাশে বনজঙ্গলে থাকে। তারা অবিকল রেল ইঞ্জিনের বাঁশির মতো শীস দেয়।ভাইয়ার যে চাকরি নেই, চাকরি নেই বলেই ঝিম ধরে রেল লাইনে বসে থাকে এটা প্রথম ধরতে পারলেন বাবা। আমি স্কুল ছুটির পর ইস্টিশনে বাবা কী করছেন দেখতে গিয়েছি—বাবা বললেন, জানালা দিয়ে দেখতো রঞ্জু গাধাটা রেল লাইনের উপর বসে আছে কিনা।

আমি বললাম, হ্যাঁ।

কী করছে?

ঘাস চিবাচ্ছে।

ওর ঘটনা কি জানিস কিছু?

না।

বাবা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, গাধাটার হয় কোনো খানে প্রেম-মহব্বত হয়েছে, কিংবা চাকরি চলে গেছে। দুটার একটা। দু ক্ষেত্রেই একটা লক্ষণ। চল খোঁজ নিয়ে আসি।ভাইয়া দূর থেকে আমাদের দেখে ঘাস চিবানোয় আরো মন দিল। নড়াচড়াও শুরু করল। হুট করে উঠে উল্টোদিকে হাঁটা দিতে পারে। বাবা তার আগেই বললেন, রঞ্জু তোর কি চাকরি চলে গেছে?

ভাইয়া বলল, হুঁ।চাকরিটা গেল কেন? চুরি করেছিস? বেদেশী এক বুড়ির লেজ ধরে কিছুদিন ঘুরলি তার ব্যাগ সাফাই করেছিস? ভাইয়া জবাব দিল না। আহত চোখে তাকিয়ে রইল। বাবা ভাইয়ার আহত দৃষ্টি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বললেন- কোন ধরনের চুরি করেছিস সেটা বল, ছোট চুরি, মাঝারি চুরি না পুকুর চুরি? চুরি করি নাই।

এখন করিস নাই। বড় হয়ে করবি। তোর চেহারার ভেতরই একটা চোর চোর ভাব চলে এসেছে। যাই হোক পুত্র হিসাবে তোকে একটা উপদেশ দেই। চুরি করলে বড় চুরি করবি। ছোট চুরি যেমন পকেটমার করে ধরা পড়লে শক্ত মার খাওয়া লাগে। মাঝারি চুরি করলে মার খেতে হয় না, জেল খাটতে হয়।। বড় চুরি করলে সমাজে সম্মান আছে। কাজেই বড় চুরি করাটা ভালো।

বলতে বলতে বাবা বসে পড়লেন। এটা একটা অলক্ষণ। বাবার বসে পড়ার দুটা অর্থ এক, তিনি ক্রমাগত কথা বলা শুরু করবেন। একই কথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলতেই থাকবেন, বলতেই থাকবেন। দুই, বাবার পেটে ব্যথাটা শুরু হয়েছে। এখন পেটে ব্যথা শুরু হলে কিছুক্ষণ বসা থেকেই তিনি শুয়ে পড়বেন। তখন তাকে ধরাধরি করে ঘরে নিয়ে যেতে হবে।তারপর রঞ্জু বল কি ঠিক করলি। ছোট চুরি করবি, না বড় চুরি?

ভাইয়া বিড়বিড় করে বলল, আমি দোকান দিব।দোকান দিবি? বাহ্ ভালো তো। বিজনেস ম্যান৷ দোকানটা কিসের? চায়ের দোকান। ভাতের দোকান।দোকান দিতে টাকা লাগে। টাকাটা তোকে কে দিবে? টাকার যোগাড় হয়েছে।তুই দেখি বিরাট লায়েক হয়ে গেছিস। সব নিজে নিজে যোগাড় করতে পারিস। যোগাড়টা করলি কীভাবে সেটা শুনি। যদি বলতে অসুবিধা না থাকে।কুসুম দিয়েছে।কুসুম?

হুঁ। পনেরো হাজার টাকা দিয়েছে।বাবা চুপ করে গেলেন। কোটের পকেট থেকে সিগারেট বের করে মুখে দিতে গিয়েও দিলেন না। ঢোক গিললেন। কুসুম আপুর টাকা আছে। তার বাবা প্রায়ই তাকে টাকা পাঠান। কুসুম আপু একটা টাকাও খরচ করে না। ভাইয়া বলল, তোমার কি ব্যথাটা শুরু হচ্ছে?

বাবা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লেন। ব্যথাটা শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গে বাবা মূর্তির মতো শক্ত হয়ে যান। মনে হয় নিঃশ্বাসও ফেলেন না। ভাইয়া বলল, চল বাসায় নিয়ে যাই। বাবা বললেন, অসম্ভব। এখন নড়াচড়া করাই যাবে না। পানি খাব।ভাইয়া ছুটে গেল পানি আনতে। বাবা এবং আমি দুজনই রেল লাইন ধরে তাকিয়ে আছি।

দেখতে পাচ্ছি রেল লাইনের স্লীপারে পা রেখে-রেখে জাপানি। ইঞ্জিনিয়ার আসছেন। এবং দূর থেকে তার চেহারা দেখা যাচ্ছে না। তাকে চেনা যাচ্ছে তার মাথার ছাতা দেখে। চীনাম্যান তাকে একটা হলুদ ছাতা উপহার দিয়েছেন। এই ছাতা ছাড়া তিনি কোথাও যান না।চীনাম্যানের সঙ্গে জাপানি ইঞ্জিনিয়ারের সম্পর্ক ভয়ংকর খারাপ যাচ্ছে।

প্রতিদিনই কথা কাটাকাটি হচ্ছে। জাপানি ইঞ্জিনিয়ার কুসুম আপুকে মন খারাপ করে বলেছেন। বুঝলে কুসুম, আমি যাই করি ব্যাটা বলে এটা কী করেছ? এক নম্বর স্প্যানে তিনশ বস্তা বালি ফেললাম। দুই দিন লাগল বালি ফেলতে। সব কটা বস্তা যখন ফেলা হল তখন ব্যাটা বলে কি জান? ব্যাটা বলে, বস্তাগুলি যে ভাবে ফেলছ তাতে নদীর মাঝখানে চর জাগবে। দুই নম্বর স্প্যানে পানির চাপ পড়বে।

সব বস্তা তোল। সব বস্তা যদি তুলতেই হয় তুই শুরুতে কেন বলিস না? এখন নদীর তল থেকে আমি বস্তা তুলব কীভাবে? ড়ুবুরী লাগাব? কুসুম আপু বলল, কোনো কিছু করার আগে উনাকে জিজ্ঞেস করে নিলেই হয়।।জিজ্ঞেস করলে বলে, সব কিছু আমাকে জিজ্ঞেস কর কেন? বুদ্ধি খাটিয়ে নিজে কর। তারপর চীনা ভাষায় গালি দেয়।

কী গালি?

বলে–কুঁকুঁতু, কুঁকুঁতু।

গালিটার মানে কী?

মানে জানি না। চাইনিজ ভাষা জানে এমন কাউকে পেলে জেনে নেব। মানে নিশ্চয়ই খুব খারাপ। যে দেশের সভ্যতা যত প্রাচীন সে দেশের গালাগালিও ততই খারাপ। চাইনীজ সভ্যতা অতি প্রাচীন মিং ডায়ানাস্টিই ছিল পাঁচ হাজার বছর। ওদের গালাগালি তো খারাপ হবেই।চাইনীজটার গণ্ডগোলটা কি শুধু আপনার সঙ্গে? আরে না। সবার সাথে। সবচে বেশি বাজাবাজি হয় জমশেদের সাথে। জমশেদের গায়ে সে একবার থুতু পর্যন্ত ফেলেছে।সে কী।

বললাম না। অতি অসভ্য। জমশেদ প্রায়ই আমাকে বলে, দেন অর্ডার দেন। হারামির পুতরে মগরা ব্রিজ থেকে নিচে ফেলে দেই। কায়দা করে স্প্যানের উপর ফেলব। ঠাস করে মাথা ফেটে ব্রেইন বের হয়ে যাবে। তারপরে পুলিশের কাছে বলব ব্রিজ ঠিক করতে গিয়ে পা পিছলে পড়ছে।কী ভয়ংকর কথা? এটা হল রাগের কথা। সত্যি-সত্যি তো কেউ ফেলছে না।

 

Read more

ইস্টিশন শেষ – পর্ব হুমায়ূন আহমেদ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *