ফটোগ্রাফার সার্বক্ষণিকভাবে থাকা দরকার, সেলিব্রিটি কেউ আসল, ঝপাঝপ ছবি। তাের বাসায় ক্যামেরা আছে ?
বড় ভাইজানের আছে। দিবে না।
চেষ্টা করতে তাে ক্ষতি নেই। চেষ্টা না করেই যদি বলে ফেলিস দিবে না। তাহলে হবে কীভাবে? সব কাজ বাদ দিয়ে বাসায় যা, তাের ভাইকে ভজিয়ে। ভাজিয়ে ক্যামেরা নিয়ে চলে আয়। নােরা ম্যাডাম যদি সত্যি আসেন তাহলে। অবশ্যই ছবি তুলতে হবে। উনার সঙ্গে তাের পরিচয় কেমন ?
সামান্য পরিচয়।
সামান্য পরিচয়ই খাবলা–খাবলি করে বড় করতে হবে। কখন কী কাজে লাগে কিছুই বলা যায় না। ও ভালাে কথা! তােকে বলতে ভুলে গেছি আমার। মামার বাড়ির ত্রিসীমানায় যাবি না। ঐ এলাকা আমাদের গ্রুপ মেম্বার সবার। জন্যেই আউট অব বাউন্ড। তাের জন্যে বিশেষ করে আউট অব বাউন্ড।
মুহিব অবাক হয়ে বলল, কেন ?
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(২২)-হুমায়ুন আহমেদ
সফিক বিরক্ত হয়ে বলল, সবাই মিলে নির্দোষ একটা মানুষকে সিঁড়ি দিয়ে নেংটো করে দৌড় দেয়াবি আর তার কনসিকোয়েন্স চিন্তা করবি না ?
ঘটনা কী হয়েছে বলেন। থানায় কেইস করেছে ?
কেইস করলে তাে কোনাে ব্যাপার ছিল না। কেইস টেইস কিছু না। আরজু সাহেবের ব্রেইন ঐ ঘটনার পর থেকে শর্ট সার্কিট হয়ে গেছে। কাউকে চিনতে টিনতে পারেন না। ভ্যাবলার মতাে তাকিয়ে থাকেন। আরজু সাহেবের এক মেয়ে আছে। যতদূর জানি যুথী নাম। ঐ মেয়ে তােকে পাগলের মতাে খুঁজছে।
আমাকে খুঁজছে কেন ?
তােকেই তাে খুঁজবে। তুই আরজু সাহেবকে বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে এলি। নিজের নামও বলে এসেছিস। এই সব ক্ষেত্রে সবসময় ফলস্ নাম দিতে হয় । যাই হােক, এত দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই। সামান্য কাপড় খুলতেই যে পাগল হয়ে গেছে তার মধ্যে পাগলামি আগে থেকেই ছিল। দু‘দিন পর আপনা আপনি পাগল হতাে। এখন দোষ পড়েছে আমাদের ঘাড়ে। দাড়িয়ে থেকে সময় নষ্ট করিস না। ক্যামেরা আনার ব্যবস্থা কর ।
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(২২)-হুমায়ুন আহমেদ
বাড়ির ভেতরের দিকের উঠোনে ক এবং খ পা ঝুলিয়ে বসে আছে। দু‘জনের মুখই অসম্ভব গম্ভীর। মুহিবকে ঢুকতে দেখে দুজনই একসঙ্গে মুখ তুলে তাকাল এবং মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে হাসতে লাগল। লক্ষণ মােটেই ভালাে না। এই দু’বােন যখন একসঙ্গে কারাে দিকে তাকিয়ে হাসে তখন বুঝতে হবে তার কোনাে খারাপ খবর আছে। মুহিব বলল, তােদের খবর কী রে ?
দু’জন একসঙ্গে বলল, ভা-–––লাে। বিকেলের মার খেয়েছিস ? দু’জন একসঙ্গে হা–সূচক মাথা নাড়ল। তাদের মুখের হাসি মুছে গেল না।
বাড়ির পরিস্থিতি অস্বাভাবিক এটা মুহিব বুঝতে পারছে। মুহিবের মন বলছে পঞ্চাশ হাজার টাকার ঘটনা কোনাে একটা ক্লাইমেক্সে পৌছেছে। মুহিব বলল, মা কই জানিস ?
ক বলল, চলে গেছে ।
খ মাথা দুলিয়ে হেসেই যাচ্ছে। উঠানের শেষ প্রান্তে নতুন কাজের মেয়েটা আনারস কাটছে। আসরের নামাজের পর বড়চাচা সিজনাল ফুটস খান। আমের সময় আম। আনারসের সময় আনারস। কাজের মেয়েটা আনারস কাটা বন্ধ করে এক দৃষ্টিতে মুহিবের দিকে তাকিয়ে আছে। মুহিবের চোখে চোখ পড়তেই সে অতি দ্রুত চোখ নামিয়ে নিল। আনারস কাটায় অতিরিক্ত মনােযােগী হয়ে গেল। ক খ এর হাসি এবং কাজের মেয়েটির কর্মকাণ্ড পরিষ্কার বুঝিয়ে দিচ্ছে বাড়িতে পঞ্চাশ হাজার টাকার ঘটনা চূড়ান্ত পরিণতির দিকে চলে গেছে।
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(২২)-হুমায়ুন আহমেদ
শুধু মা’র বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার ব্যাপারটা বােঝা যাচ্ছে না। বাড়িতে ইন্টারেস্টিং কোনাে ঘটনা ঘটবে আর তিনি থাকবেন না । তা হয় না। মুহিব কাজের মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল, এই মেয়ে তুমি আমাকে কড়া করে এক কাপ চা খাওয়াতে পারবে ? কাজের মেয়েটা ভোতা মুখ করে বলল, আমার হাত বন্ধ । মুহিব নিজের ঘরে ঢুকে গেল। তার সারা শরীর কুটকুট করছে। শরীর থেকে বাসের কন্ডাকটরদের গায়ের গন্ধের মতাে গন্ধ বের হচ্ছে। সারাদিন ঘােরাঘুরির উপর দিয়ে গিয়েছে। গায়ে ঘামের আস্তর পড়ে গেছে।
সাবান ডলে ডলে ঘামের আস্তর একের পর এক সরাতে হবে। এটি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় যাবার আগে গরম এক কাপ চা খেয়ে নিলে হতাে। সেটা সম্ভব হচ্ছে। না। মুহিব গায়ের ঘামে ভেজা শার্ট খুলতে গিয়েও খুলল না। বাথরুমে সাবান নেই এটা মনে ছিল না। সাবান কিনে আনতে হবে। সাবান কিনে ফেরার সময় খায়রুলের দোকান থেকে ইসপিশাল নতুন পাত্তির চা খেয়ে আসা যায় ।
মুহিব কখন ফিরেছ ?
মুহিবের বড়ভাবি দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলেন। মুহিব বলল, তিন মিনিট এখনাে পার হয় নি।
আজ দুপুরবেলা তােমার খোজে একটা মেয়ে এসেছিল। হাউমাউ করে কান্না।
মেয়েটা কে ? আমরা তাে কেউ চিনি না। নাম বলল যূথী। যূথী নামে কাউকে চেন ? একদিন দেখা হয়েছিল । ঘটনাটা কী? একদিন যার সঙ্গে দেখা সে এ রকম কাঁদবে কেন ? তােমরা জিজ্ঞেস কর নি কেন কাদছে ?
আমি অনেকবারই জিজ্ঞেস করেছি। কিছুই বলে না, শুধু কাঁদে। একটা টেলিফোন নাম্বার দিয়ে গেছে। শুধু বলে গেছে তুমি যখনই আস, যত রাতেই আস এই টেলিফোন নাম্বারে টেলিফোন করার জন্যে। দেব টেলিফোন নাম্বার ?
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(২২)-হুমায়ুন আহমেদ
দাও। তােমাকে ভূতের মতাে লাগছে কেন ? কোথায় ছিলে ? ঘােরাঘুরির মধ্যে ছিলাম। ভাবি এক কাপ চা খাওয়াতে পারবে? কেন পারব না। চা পাঠিয়ে দিচ্ছি। তােমার কাছে ফ্রেশ গায়েমাখা সাবান আছে ? থাকার তাে কথা। আমি চা এবং সাবান পাঠিয়ে দিচ্ছি।
ভাবি থ্যাংক য়ু। আমি আমার জীবনের দীর্ঘতম গােসলটা আজ সারব। The longest bath.
গােসল সেরে বড়চাচার সঙ্গে দেখা করাে। উনি তােমাকে খুঁজছিলেন। কোনাে বিশেষ ঘটনা ? জানি না তাে!
মুহিব বড়চাচার সামনে বসে আছে। তিনি খবরের কাগজ পড়ছিলেন। হাতের ইশারায় মুহিবকে বসে থাকতে বলেছেন। সে বসেই আছে। আজকালকার খবরের কাগজে এত মন দিয়ে পড়ার কিছু থাকে না। তােফিকুর রহমান সাহেবের অনেক বিরক্তিকর অভ্যাসের মধ্যে এটি একটি। কথা বলার জন্যে ডেকে পাঠিয়ে সামনে বসিয়ে রাখবেন, অন্য কোনাে অর্থহীন কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়বেন। সেই কাজ দীর্ঘ হতেই থাকবে। কিছুতেই আর শেষ হবে না । মুহিব ।
জি।
তােমার বিষয়ে একটা অপ্রিয় সিদ্ধান্ত আমরা নিয়েছি। বাধ্য হয়ে নিতে হয়েছে। শেকসপিয়রের কথায় বলি— Thave to be cruel only to be kind.
কী সিদ্ধান্ত ?
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(২২)-হুমায়ুন আহমেদ
তুমি এই বাড়িতে আর বাস করবে না। অন্য কোথাও থাকবে। হােটেলে, কিংবা কোনাে বন্ধুর বাড়িতে কিংবা রেলস্টেশনে।
জি আচ্ছা । জানতে চাচ্ছ না কেন?
বুঝতে পারছি। মনে হচ্ছে চুরি সংক্রান্ত কিছু। বড় ভাইজানের টাকাটা বােধহয় আমার ঘরে পাওয়া গেছে।
| তৌফিকুর রহমান ইজিচেয়ারে সােজা হয়ে বসতে বসতে বিস্মিত গলায়। বললেন, আমি অবাক হচ্ছি, তুমি খুবই স্বাভাবিক আচরণ করছ। তােমার মধ্যে অপরাধবােধ গ্লানিবােধ কিছুই দেখছি না।
মুহিব বলল, একটু আগে গােসল করেছি তাে চাচা! আমাকে ফ্রেশ লাগছে। চেহারায় এই জন্যেই গ্লানিবােধ অপরাধবােধ এইসব জিনিসের ছাপ পড়ছে না। | তােমার সঙ্গে আমার কথা শেষ, তুমি এখন যাও। যদি সম্ভব হয় তুমি তােমার মায়ের সঙ্গে দেখা করবে। সেই বেচারি মনে খুব কষ্ট পেয়েছে। কান্নাকাটি করছিল। তােমার মুখ দেখতে হবে এই ভয়ে সে বাড়ি ছেড়েই চলে গেছে।