এপিটাফ শেষ:পর্ব হুমায়ূন আহমেদ

এপিটাফ শেষ:পর্ব

আদরের মা-মণি! তোমাকে আমি খুব খুব সুখী করব এরকম একটা ইচ্ছা ছিল। তুমি চেয়েছিলে আমি ডাক্তার হব। আমি ভেবেছিলাম খুব বড় একজন ডাক্তার হব। এমন ডাক্তার যে হাসিমুখে রোগীর ঘরে এসে দাঁড়ালেই রোগ অর্ধেক সেরে যায়।আমি তা পারলাম না মা। রোগে নিজে কষ্ট করলাম, তোমাকে কষ্ট দিলাম। অসুখের চিকিৎসার জন্যে টাকা জোগাড় করতে গিয়ে তুমি কত না অপমানের ভেতর দিয়ে গেলে। তোমাকে আমি এই কষ্ট, এই অপমানে ফেলেছি– তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও, মা।নানিজান আমাকে বলেছেন- মৃত্যুর ঠিক আগে আগে মানুষ আল্লাহপাকের কাছে অন্যের জন্যে যে প্রার্থনা করে আল্লাহপাক তা শুনেন।

শুধু তার নিজের জন্যে যে প্রার্থনা করে তা শুনেন না।আমি ঠিক করে রেখেছি, মৃত্যুর ঠিক আগে আগে আমি আল্লাহকে বলব হে আল্লাহ, তুমি আমার মার মন থেকে আমার সমস্ত স্মৃতি সরিয়ে নিয়ে যেও। কোনোদিন যেন আমার কথা ভেবে মা কষ্ট না পায়। আল্লাহ নিশ্চয়ই আমার সেই প্রার্থনা শুনবেন।মা শোন, ফুলির মা বুয়া আমার জন্যে কী যে কষ্ট করেছে। তা শুধু সে জানে। তুমি অবশ্যই তার শেষদিন পর্যন্ত তাকে দেখবে। তার খুব শখ, বিয়ে করে সে ঘরসংসার করে, তার আবার ছেলেপুলে হয়। কতবার যে সে আমাকে তার গোপন শখের কথা বলেছে। মাগো, তুমি দেখো তো এটা পারা যায় কি-না। আর তার বিয়েতে তুমি তাকে লাল রঙের একজোড়া স্যান্ডেল কিনে দেবে। লাল রঙের স্যান্ডেলেরও তার খুব শখ।

আসি মা?

তোমার অতি আদরের

নাতাশা

পুনশ্চ : মা, তুমি কি একবার কষ্ট করে আমাদের স্কুলে যাবে? আমাদের বাংলা আপাকে (মিস রোকেয়া) বলবে গুরু নানকের কথাটা আমি পরীক্ষা করে দেখেছি। খুব সত্যি। আর আমাদের অঙ্ক আপাকে (মিস শাহেদা) বলবে স্কুলের সব মেয়েরা তাকে যমের মতো ভয় করলেও তিনি সবার খুব প্রিয়। সবাই যে তাঁকে ভয় পায় তা তিনি জানেন। কিন্তু তিনি যে সবার খুব প্রিয় তা জানেন না। তার জানা দরকার। এবং এদের দুজনকেই তুমি আমার সালাম দেবে।

ফুলির মা শেষপর্যন্ত পাঁচশ টাকার একটা চকচকে নোট জোগাড় করেছে। তার কাছে মোট চারশ আশি টাকা ছিল। মাত্র বিশটা টাকার জন্যে পাঁচশ টাকা হচ্ছিল না। শেষ মুহূর্তে সুযোগ হলো। সে বাথরুম পরিষ্কার করতে গিয়ে দেখে, বাথরুমের বেসিনের উপর কুড়ি টাকার একটা নোট আধা ভেজা অবস্থায় পড়ে আছে। তৎক্ষণাৎ সে নোটটা নিয়ে বের হয়ে এলো।তার একটু ভয় ভয় করছিল— দিলশাদ টের পায় কি-না। মনে হয় টের পাবে। আজ নাতাশা চলে যাচ্ছে, তার মন পুরোপুরি সেদিকে। বিশ টাকার নোট কোথায় ফেলে রেখেছে এটা নিয়ে মাথা ঘামাবার কথা না।

ফুলির মা ভাঙতি টাকা সব নিয়ে মোড়ের দোকানে গেল। ভাঙতি টাকার বদলে চকচকে একটা পাঁচশ টাকার নোট নিয়ে এলো। তার খুব ইচ্ছা সে নাতাশা আপার চিকিৎসার জন্যে কিছু দেয়। তার মতো মানুষের কাছ থেকে তো এরা টাকা নেবে না। কাজেই টাকাটা দিতে হবে গোপনে। পাঁচশ টাকার নোটটা সে আপার ব্যাগে একফাঁকে ঢুকিয়ে দেবে। ব্যাগ খুলতে গেলে টাকা বের হয়ে আসবে। টাকার গায়ে নাম লেখা থাকে না। কাজেই তখন টাকাটা পাওয়া গেলে কেউ বুঝতে পারবে কে টাকাটা দিয়েছে।পাঁচশ টাকার নোট আঁচলে বেঁধে সন্ধ্যা পর্যন্ত ফুলির মা দারুণ দুঃশ্চিন্তায় কাটাল– আপার ব্যাগে সে টাকাটা রাখার সুযোগ পাচ্ছে না। সবসময় ঘরে লোকজন।

সন্ধ্যাবেলা হঠাৎ সুযোগ হয়ে গেল। দিলশাদ বলল, ফুলির মা, নাতাশার ব্যাগে ধুলা জমে আছে। ধুলা ঝেড়ে দাও।ফুলির মা ধুলা ঝাড়তে ঝাড়তে একফাঁকে ব্যাগের পকেটে নোটটা ঠেসে দিয়ে দিল। এখন আর চিন্তা নেই। নিশ্চিন্ত মনে সে ঘরের অন্যসব কাজ করতে পারে।আপারা রাত বারোটার সময় রওনা হবে। ঘরের মেলা কাজ পড়ে আছে। তারা রাতে খেয়ে যাবে। পাকশাক করতে হবে। ফুলির মা খুশিমনে রান্নাঘরে ঢুকল। কোরান শরীফটা ঢুকিয়ে দিতে পারলে খুব ভালো হতো। বিদেশে মাথাব্যথা কমানোর জন্যে দরকার হতে পারে। ফুলির মা কোরান শরীফ ঢুকানোর সুযোগ পায় নি। ব্যাগে জায়গাও নেই।

এয়ারপোর্ট যাবার জন্যে দুটা গাড়ি এসেছে। এয়ারপোর্ট দিলশাদরা যাচ্ছে, তার বাবা-মা যাচ্ছেন। দিলশাদের দুই বোনও যাচ্ছে। দিলশাদের মেজো দুলাভাই যাচ্ছে। বড়জন যাচ্ছে না, সে ঢাকায় নেই।দিলশাদ ফুলির মাকে বলল, ফুলির মা, কাপড়টা বদলে তুমিও এয়ারপোর্টে চল।ফুলির মা বলল, ধোয়া পাকলা সব বাকি। আমি গেলে কাজকাম কে করব! এসে করবে যা করার।জি-না আম্মা, আফনেরা যান। ঘর আউলা রাইখ্যা আমি যামু না। আমার উড়োজাহাজ দেখনের শখ নাই।

সবাই গাড়িতে গিয়ে উঠেছে। নাতাশা রান্নাঘরে গেল ফুলির মা’র কাছ থেকে বিদায় নিতে। দিলশাদ মেয়ের হাত ধরে ছিল। নাতাশা বলল, মা, আজ আমার শরীরটা খুব ভালো লাগছে। আমি একা একা রান্নাঘরে গিয়ে ফুলির মা বুয়ার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসি।দিলশাদ বলল, আচ্ছা যাও।নাতাশা রান্নাঘরে ঢুকে বলল, বুয়া, আমি যাচ্ছি। ফুলির মা নাতাশার দিকে না তাকিয়ে বলল, আইচ্ছা আফা যান। আল্লাহর হাতে সোপার্ট।

ফুলির মা চোখ তুলে তাকাল না। কারণ চোখ তুলে তাকালেই সে কেঁদে ফেলবে। যাত্রার সময় চোখের পানি খুব অলক্ষণ। তার কারণে আপার অলক্ষণ সে হতে দেবে না। দরকার হলে চোখ গেলে ফেলবে কিন্তু কাদবে না।নাতাশা বলল, চলে যাচ্ছি তো, আমাকে একটু আদর করে দাও।আমার হাত ময়লা তো আফা। আমি পারুম না। দিরং কইরেন না, রওনা দেন।নাতাশাদের গাড়ি রওনা হবার পর ফুলির মা রান্নাঘরের দরজা বন্ধ করল। তারপর মেঝেতে গড়াগড়ি করে কাঁদতে লাগল। চিৎকার করে বলতে লাগল, ও আমার আফারে! ও আমার আফারে! দুটা গাড়ির একটিতে নাতাশা, তার বাবা এবং নাতাশার নানাভাই।

অন্য গাড়িতে মনোয়ারা আর দিলশাদ। দিলশাদের দুইবোন তাদের গাড়িতে করে আলাদা এয়ারপোর্টে যাবে। এদের সঙ্গে যাচ্ছে না। মনোয়ারা গাড়িতে সারাক্ষণ তার মেয়ে দিলশাদের হাত ধরে রাখলেন।দিলশাদ এয়ারপোর্টে পৌঁছে গাড়ি থেকে নেমে বলল, মা, আমার এয়ারপোর্টের ভেতর যেতে মন চাচ্ছে না। আমি বাইরে থাকি।মনোয়ারা বললেন, বেশ তত থাক।তুমি আমার সঙ্গে থাকো মা।আচ্ছা আমি থাকব। আয় আমরা একটা নির্জন জায়গা দেখে বসি।আজ একটা মজার ব্যাপার হয়েছে মা। এয়ারপোের্ট রওনা হবার আগে বারান্দায় গিয়ে দেখি আমার সবকটা অর্কিডে ফুল ফুটেছে। নীল নীল ফুল বারান্দা আলো হয়ে আছে।

বলিস কী! একবার গিয়ে দেখে আসব।এটা নিশ্চয়ই খুব ভালো লক্ষণ। তাই না মা? অবশ্যই ভালো লক্ষণ।মা, তুমি কি নাতাশার বাবাকে চুপি চুপি একটা কথা বলে আসবে? কী কথা? তুমি তাকে বলবে আমি এয়ারপোর্টে ঢুকব না। সে যেন নাতাশাকে আমার কাছে না আনে।আদা বলে আসছি।নতুন সাদা ড্রেসটায় নাতাশাকে কী স্মার্ট লাগছে দেখছ মা? হ্যাঁ, দারুণ সুন্দর লাগছে।কেমন গট গট করে হাঁটছে দেখছ মা? হ্যাঁ দেখছি। আজ মনে হয় ওর শরীরটা ভালো।মা, তুমি আমার হয়ে ওর নাকে একটা চুমু দিয়ে এসো।আচ্ছা মা। দেব।

নাতাশা তার বাবার হাত ধরে ইমিগ্রেশন এরিয়ার ভেতর ঢুকতে যাচ্ছে। তার খুব লজ্জা লজ্জা লাগছে। এত মানুষ এসেছে তাকে বিদায় দিতে। তাদের স্কুল থেকে চারজন আপা এসেছেন। আজ সে যাচ্ছে এই খবরটা তারা কীভাবে পেলেন কে জানে। তাদের ফ্ল্যাট বাড়ি থেকেও প্রায় সবাই এসেছে। ঐ তো তার মা’র অফিসের বস রহমান সাহেব। তিনি তার স্ত্রীকে নিয়ে এসেছেন। এত বড় একজন অফিসার গভীর রাতে এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে আছেন।

এমন অনেকে এসেছে যাদের নাতাশা চেনে না। তাঁর বাবার এক ফুফু এসেছেন– অতি বৃদ্ধা। দুজনের কাঁধে ভর দিয়ে এসেছেন। নাতাশা সবাইকে এয়ারপোর্টে দেখতে পাচ্ছে শুধু তার মাকে দেখতে পাচ্ছে না। সে একসময় বলল, মা কোথায় বাবা! সাজ্জাদ বলল, তোমার মা এয়ারপোর্টের বাইরে। তার খুব মাথা ধরেছে। সে ভিড় সহ্য করতে পারছে না। ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। চল আমরা ভেতরে ঢুকে পড়ি।

চল।দেখ কত মানুষ তোমাকে সি-অফ করতে এসেছে। ওদের দিকে তাকিয়ে একটু হাত নাড়।নাতাশা হাত নাড়ল। হাত নাড়তে গিয়ে দেখল, ডাক্তার সাহেবও এসেছেন। পিজির নিওরোসার্জন প্রফেসর ওসমান। পায়জামা-পাঞ্জাবিতে ভদ্রলোককে কী সুন্দর লাগছে! উনি হাসিমুখে হাত নাড়ছেন। নাতাশা বলল, বাবা দেখ– পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা ঐ ভদ্রলোক আমার ডাক্তার। উনার নাম– ওসমান। উনার চোখ খুব সুন্দর। চশমা দিয়ে চোখ ঢাকা, এইজন্যে তুমি দেখতে পাচ্ছ না।সাজ্জাদ বলল, তাই বুঝি?

সাজ্জাদের গলার স্বর খুব ভারী শুনাল। পুরুষমানুষ কাঁদে গোপনে। তখন তাদের চোখ দিয়ে পানি বের হয় না। শুধু তাদের গলা ভারী হয়ে যায়। কথা জড়িয়ে যায়।বাবা! কী গো মা? শেষবারের মতো মা’কে একটু দেখতে ইচ্ছে করছে।সাজ্জাদ বলল, শেষবারের মতো দেখা আবার কী? তুমি ভালো হয়ে ফিরে আসবে। মাকে দেখতে দেখতে তোমার চোখ পচে যাবে।নাতাশা শান্ত গলায় বলল, ও আচ্ছা।

এয়ারপোর্ট থেকে অনেকটা দূরে দিলশাদ তার মাকে নিয়ে ঘাসের উপর বসে আছে। মনোয়ারা পান খাচ্ছেন। জর্দার গন্ধে জায়গাটা ম ম করছে।দিলশাদ বলল, তোমার হাতে কি ঘড়ি আছে মা–-কটা বাজে? মনোয়ারা বললেন, ঘড়ি নেই মা। রাত তিনটার মতো বোধহয় বাজে।এক্ষুনি তাহলে নাতাশাদের প্লেন ছাড়বে। তাই না মা? হুঁ।মা, তোমার কি মনে হয় জীবিত অবস্থায় আমার মেয়ে ফেরত আসবে? অবশ্যই আসবে মা।সেদিন প্রচুর ফুল নিয়ে এয়ারপোর্টে আসতে হবে।অবশ্যই ফুল নিয়ে আসতে হবে। ঢাকা শহরে ফুলের দোকানের সব ফুল আমরা কিনে ফেলব।আমার খুব কষ্ট হচ্ছে মা। বুকটা ফেটে যাচ্ছে কী করব বলো তো।মা, একটু কাঁদতে চেষ্টা কর। কাঁদলে বুক হালকা হবে।অনেকক্ষণ থেকেই কাঁদতে চেষ্টা করছি, পারছি না।

বিকট গর্জন করে ডিসি-১০ আকাশে উঠে গেল। দিলশাদ উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে পড়েছে। বিমানটি দেখার চেষ্টা করছে। ঐ তো দেখা যাচ্ছে। ঐ যে। সে উৎফুল্ল গলায় বলল- মা দেখ, দেখ।আকাশভর্তি ঘন কালো মেঘ। বিজলি চমকাচ্ছে। ক্ষমতাধর মানুষের সৃষ্ট বিশাল যন্ত্রযান মেঘ কেটে উপরে উঠে যাচ্ছে। কত অবলীলাতেই না সে উড়ছে।দিলশাদের চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়ছে। সে শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে মার দিকে হাত বাড়িয়ে শান্ত গলায় বলল, তুমি কুট কুট করে কী সুন্দর পান খাচ্ছ। তোমার মুখ থেকে একটু পান দাও তো মা।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *