হরনাথবাবুর ফার্ম আছে জঙ্গলের কাছে। এগ্রিকালচারাল ফার্ম। তারপর রাত্রিকালে আমারে কিডন্যাপ করল—কী য্যান কয়? হঃ! ডিস্কো।
‘ডিস্কো ! বলেন কী!
‘আমারে বাঁধছে, তহন জিগাইলাম, হু আর ইউ? বান্ধো ক্যান? কয় কী, ডিস্কোর হুকুমে তােমারে বাঁধছি। এবারে মা ভবানীর মন্দিরে তােমারে বলি দিমু।
কর্নেল বললেন, এক মিনিট! কফি খেয়েছেন তাে?
‘তাহলে নিশ্চয় আপনার নার্ভ চাঙ্গা হয়েছে। এবার গােড়া থেকে বলুন, শােনা যাক।
এবার গােয়েন্দা ভদ্রলােক তাঁর অনবদ্য মিশ্রভাষায় যে বিবরণ দিলেন, তা মােটামুটি এই : রাঙাটুলি পৌঁছুতে সেদিন হালদারমশাইয়ের রাত দশটা বেজে যায়। ট্রেন লেট করেছিল। অত রাতে খােজখবর নিয়ে উনি জানতে পারেন, মাইল তিনেক দূরে জঙ্গলের কাছে নদীর ধারে হরনাথ সিংহের কৃষিখামার আছে। হরনাথবাবু রাতে সেখানেই থাকেন। অনেক চেষ্টা করে হালদারমশাই একটা এক্কাগাড়ি যােগাড় করেন। ফার্মে গিয়ে হরনাথবাবুকে চন্দ্রিকা রায়ের শােচনীয় মৃত্যুর খবর দেন।
হরনাথবাবু প্রথমে কেঁদে ফেলেন। বলেন, হতভাগিনী নিজেই নিজের মৃত্যুকে ডেকে এনেছে। পাপের প্রায়শ্চিত্ত ছাড়া কী বলব? তবে হালদারমশাইয়ের মতে, হরনাথবাবু শক্ত মনের মানুষ। হালদারমশাইয়ের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করেন। খাওয়ার পর ফার্মের একটা ঘরে শােওয়ার ব্যবস্থাও করেন। তারপর জিজ্ঞেস করেন, চন্দ্রিকা হালদারমশাইকে কোনও জিনিস রাখতে দিয়েছিল কি না। দেয়নি শুনে গম্ভীর হয়ে চলে যান।
কর্নেল সমগ্র প্রথম খন্ড এর অংশ -২৮
অচেনা জায়গায় হালদারমশাইয়ের ঘুম আসতে চায় না। ফার্মে বিদ্যুৎ আছে। ফ্যানও আছে। জানালার বাইরে আবছা আলােয় একটা ফুলবাগান দেখা যাচ্ছিল। তার একধারে উঁচু কয়েকটা গাছ। হঠাৎ হালদারমশাই দেখতে পান, গাছের ফাঁকে টর্চের আলাে ফেলে কে চলাফেরা করছে।
গােয়েন্দাগিরি যাঁর পেশা, তাঁর কাছে এটা সন্দেহজনক মনে হওয়া স্বাভাবিক। উনি চুপিচুপি দরজা খুলে বেরিয়ে যান। ফুলবাগানের ভেতর দিয়ে গুড়ি মেরে এগিয়ে হালদারমশাই দেখেন, ঘন গাছপালার ভেতর দিয়ে টর্চের আলাে ফেলতে ফেলতে কে এগিয়ে যাচ্ছে। গােয়েন্দা গুড়ি মেরে তাকে অনুসরণ করেন। একটু পরে লােকটা গাছের ডগার দিকে টর্চের আলাে ফেলে। তখন অবাক হয়ে যান হালদারমশাই। লােকটা স্বয়ং হরনাথ সিংহ।
এত রাতে হরনাথবাবু একটা ঝাঁকড়া গাছের ডগায় আলাে ফেলে কী দেখছেন, এটা রীতিমতাে রহস্য। একটু পরে উনি এদিকে টর্চের আলাে ফেলতে ফেলতে এগিয়ে এলে হালদারমশাই চুপিসাড়ে চলে এসে ঘরে ঢােকেন এবং দরজা আটকে শুয়ে পড়েন।
রহস্যটা জানার জন্য হালদারমশাই পরদিন রাঙাটুলিতে থেকে যাওয়াই ঠিক করেন। সকালে চা খেয়ে হরনাথবাবুর সঙ্গে ফার্মের চাষবাস দেখতে বেরােন। কিন্তু তাঁর মন পড়ে আছে সেই গাছগুলােতে। ফার্মের উত্তর প্রান্তে ওটা একটুকরাে
জঙ্গল বলা চলে। জঙ্গলটা কেন কাটা হয়নি জিজ্ঞেস করলে হরনাথবাবু বলেন, অর্কিডের চাষ করার জন্য গাছগুলাে রেখেছেন।
কর্নেল সমগ্র প্রথম খন্ড এর অংশ -২৮
হরনাথবাবু তাঁকে অর্কিড দেখাতে নিয়ে যান। প্রত্যেকটি গাছে প্রচুর অর্কিড রঙবেরঙের পাতায় ঝলমল করছে। হালদারমশাই কর্নেলের কথা তােলেন। কারণ কর্নেলের অর্কিডের হবি আছে। হরনাথবাবু বলেন, কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের সঙ্গে তাঁর পরিচয় আছে। অমরেন্দ্র সিংহরায়ের বাড়ি এসেছিলেন।
সেখানেই আলাপ হয়। (কর্নেলের মন্তব্য : হুঃ’) পরে কর্নেল সায়েব তাঁর ফার্মে এসে অর্কিড দেখে গেছেন। যাইহােক, হালদারমশাই কথায় কথায় বলেন, জায়গাটা তাঁর ভাল লেগেছে। একটা দিন কাটিয়ে যেতে চান। হরনাথবাবু কোন মুখে না বলেন তাঁকে? | (ইতিমধ্যে চন্দ্রিকার জীবনকাহিনী হালদারমশাই জেনে নেন। আমরা যতটা জানি, তার বেশি কোনও তথ্য নেই।)
হালদারমশাই সেই বিশেষ গাছটা দিনের বেলায় চিনতে পারেননি, যেটার ডগায় হরনাথবাবু আলাে ফেলে কী খুঁজছিলেন। বিকেলে হরনাথবাবু হালদারমশাইকে রাঙাটুলির বিখ্যাত ভবানীমন্দির দেখাতে নিয়ে যান। ফার্মের পশ্চিমে নদী। নদীর ওপারে জঙ্গলের ভেতর প্রাচীন ঐতিহাসিক একটা মন্দির। চারপাশে অজস্র ধ্বংসাবশেষ। মন্দিরও ভেঙে পড়েছে। শুধু সামনের উঁচু চত্বরটি পাথরের বলে অটুট আছে। তার নিচে হাড়িকাঠ পোঁতা। বৈশাখী পূর্ণিমায় পুজোর সময় বলিদান হয়।
কর্নেল সমগ্র প্রথম খন্ড এর অংশ -২৮
মন্দিরে প্রণাম করে সবে দুজনে উঠেছেন, ফার্মের একটা লােক হন্তদন্ত এসে হরনাথবাবুকে একান্তে ডেকে চুপিচুপি কী বলে। অমনই আশ্চর্য ব্যাপার, হরনাথবাবু ‘এক্ষুণি আসছি’ বলে লোেকটার সঙ্গে চলে যান।
হালদারমশাই ভেবেছিলেন, ফার্মে চুরি-টুরি হয়েছে। কারণ প্রায় নার্কি ফার্মে চোর পড়ে। গুদামঘরে প্রচুর ফসল মজুত আছে। হালদারমশাই অ্যালসেসিয়ান কুকুর পাের পরামর্শও দিয়েছিলেন।
মন্দিরচত্বরে সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করেও হরনাথবাবু ফেরেননি। তখন হালদারমশাই নদীর দিকে হাঁটতে থাকেন। হঠাৎ তাঁর চোখে পড়ে দুটো মস্তানমার্কা লােক
চুপিচুপি জঙ্গলের ভেতর দিয়ে মন্দিরের দিকে যাচ্ছে। তাঁকে দেখেই তারা ঝােপের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে।
গােয়েন্দার চোখে এ-ও খুব রহস্যময় ঘটনা। কাজেই হালদারমশাই হনহন করে নদীর দিকে যাচ্ছেন, এমন ভঙ্গিতে এগিয়ে ঝােপের আড়ালে বসে পড়েন। সেখান থেকে মন্দিরটা দেখা যাচ্ছিল। লােক দুটো মন্দিরের কাছে যায়। তারপর মন্দিরের পেছনে গিয়ে বসে পড়ে।
ততক্ষণে অন্ধকার হয়ে গেছে। অন্যদিক থেকে টর্চের আলাে ফেলে কারা আসছে দেখে হালদারমশাই ভেবেছিলেন হরনাথবাবু। কিন্তু না—এক ভদ্রমহিলা এবং একজন যুবক আলাে ফেলে কথা বলতে বলতে আসছে।
হালদারমশাই ভেবেছিলেন পুজো দিতে আসছে ওরা। কিন্তু চত্বরের সামনে প্রণাম করে ভদ্রমহিলা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, এই রইল টাকা। আমার স্বামীকে তােমরা ফিরে দাও।
মন্দিরের পেছন থেকে সম্ভবত সেই লােক দুটোর একজন হেঁড়ে গলায় বলে, ‘কত আছে?
ভদ্রমহিলা বলেন, গুনে দেখ। পুরাে টাকা আছে।
হেঁড়ে গলায় আওয়াজ আসে, “ঠিক আছে, চলে যান। আপনার হাজব্যান্ডকে বাড়িতে পেয়ে যাবেন।
কর্নেল সমগ্র প্রথম খন্ড এর অংশ -২৮
ভদ্রমহিলা এবং যুবকটি চলে যায়। ততক্ষণে হালদারমশাই গুড়ি মেরে মন্দিরের চত্বরের কাছে পৌঁছেছেন। লােক দুটো টাকাভর্তি প্লাস্টিকের ব্যাগটার দিকে এগিয়ে আসতেই হালদারমশাই উঠে দাঁড়ান। হাঁক ছাড়েন, ‘ডােষ্ট টাচ! সঙ্গে টর্চ ছিল না, রিভলভার ছিল। কিন্তু রিভলভার বের করার আগেই ব্যাগ তুলে নিয়ে ওরা উধাও হয়ে যায়। অন্ধকারে আর কী করা যাবে? টর্চ নিতে ভুল হয়েছে।
মনমরা হয়ে হালদারমশাই ফিরে আসছিলেন। নদীর ধারে পৌঁছতেই কাঠের ব্রিজে দুজন লােককে কথা বলতে শােনেন। কাছাকাছি হওয়ামাত্র লােক দুটো হালদারমশাইয়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। স্বাভাবিকভাবে কথা বলছে, এমন লােকেরা যে একই দলের, সেটা কেমন করে বুঝবেন হালদারমশাই?
তারা ওঁকে পিঠমােড়া করে বেঁধে ফেলে। (হালদারমশাইয়ের ভাষায় আমারে বান্ধো ক্যান?) তারপর তারা ওঁকে ধরে নিয়ে যায় জঙ্গলের ভেতর সেই মন্দিরের সামনে। তারা হাড়িকাঠে হালদারমশাইয়ের মাথা গলিয়েছে, সেই সময় টর্চের আলাে এসে পড়ে এবং হরনাথবাবুর চিৎকার শােনা যায়, এই ব্যাটাছেলেরা। লােক দুটো হালদারমশাইকে ফেলে পালিয়ে যায়।
Read More