কানাজোল রাজ এস্টেটের মালিক রাজবাহাদুর বাপ্পাদিত্য সিং-এর দুটি ছেলে আর একটি মেয়ে। ছেলে দুটি যমজ। একঘণ্টা আগে-পরে তারা ভূমিষ্ঠ হয়। প্রথমটির নাম রাখা হয় জয়াদিত্য, দ্বিতীয়টির নাম বিজয়াদিত্য। মেয়ের জন্ম আরও পাঁচ বছর পরে। তার নাম রাখা হয় জয়া। আশা ছিল রানী কুশলা পরের শারও কন্যা প্রসব করবেন এবং তার নাম রাখা হবে বিজয়া। কিন্তু তার আগেই কুশলা উৎকট হেঁচকি ওঠা রােগে মারা যান।
বাপ্পাদিত্যের মাথায় কেন কে জানে জয় শব্দটা ঢুকে পড়েছিল। হয়তো পার্শ্ববর্তী ভাণ্ডা এস্টেটের মালিক গৈৰীনাথ ছত্রীবাহাদুরের সঙ্গে বারবার মামলায় হেরে গিয়েই।
কিন্তু জয়-বিজয়-জয়া তাকে বাকি জীবনে আর জেতাতে পারেনি। হতাশা আর ক্রমাগত ক্ষোভ-বিদ্বেষে স্বাস্থ্যভঙ্গ হতে হতে বাপ্পাদিত্য চোখ বােজেন। নি জয়-বিজয়ের বয়স ষােল বছর আর জয়ার বয়স এগারাে বছর। তারা বালক হওয়ার দরুন উইল অনুসারে কানাজোল এস্টেটের ট্রাস্টি ছিলেন নায়েব বিপ্রদাস মুখুয্যে। মুখুয্যেমশাই বাঙালি। শিক্ষাদীক্ষার পক্ষপাতী।
জয় বিজয়-জয়াকে কলকাতার হােস্টেলে রেখে লেখাপড়া শেখান। জয় তত মেধাবী ছিল না। বি-এটা কোনােক্রমে পাশ কালে কালে ফিরে যায়। বিজ এম-এ পাশ করেছিল। আর জয়া বি-এ পড়ার সময় শরদিন্দু নামে এক বাঙালি যুবকের প্রেমে পড়ে। যুবকটি ছিল ব্যাংকের কেরানি। জয়াবে, পেনে বিয় করার কিছুদিন পরে নাকি ব্যাংকের ক্যাশ হাতিয়ে সে ফের হয়ে যায়। জয়া পুরো ঘটনা গােপন রেখেছিল।
কিন্তু মনে দারুণ আঘাত পেয়ে সে বি-এ পরীক্ষার আগেই পড়াশােনা ছেড়ে দেশে ফেরে। মুখুয্যেমশাই, তখন আর ট্রাস্টি নেই। কি নাতিগত কারণে রাজপরিবারের অভিভাবক থেকে গেছেন। জয়-বিজয়ের সঙ্গে পরামর্শ করে জয়ার বিয়ে ঠিক করেছিলেন। কিন্তু জয়া জোর গলায় ওনিয়ে দেয়, সে চিরকুমারী থাকবে। কারণ তার বাবা-মা দুজনেই স্বপ্নে দেখা দিয়ে তাকে চিরকুমারী থাকার আদেশ দিয়েছি। এদিকে জয় ও বিজ নিজেদের বিয়ের ব্যাপারে খুব অনুৎসাহী। দুজনেই শুধু বলেছিল, দেখা যাক। মুখুয্যেমশাই ও কথার অর্থ বুঝতে পারেননি। তবে জয়া ছিল ছােটবেলা থেকেই
কর্নেল সমগ্র ২য় খণ্ড এর অংশ-১
তেজী আর দুর্দান্ত প্রকৃতির মেয়ে। কৈশাের-যৌবনের সন্ধিকাল থেকে সে কিছুদিন শান্ত ও অমায়িক হয়ে উঠলেও কলকাতা থেকে ফিরে যাবার পর আবার পুরনাে স্বভাব ফিরে পায়। তার মধ্যে কিছু পুরুষালি হাবভাবও ছিল। খেলাধুলাে, দৌড়ঝাপ, সাঁতার কাটা, সাইকেল চালানাে—এসবে তার দক্ষতা ছিল। সে দাদাদের গ্রাহ্য করত না। ছােড়দা বিজয় তাে নম্র স্বভাবের মানুষ।
বইপত্র নিয়ে ডুবে থাকে। কবিতা লেখে। গঙ্গার ধারে টিলাপাহাড়ে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকে। সবসময় তাকে কেমন উদাসীন আর ভাবুক বলে মনে হয়। তাকে জয়ার আমল না দেওয়ারই কথা। কিন্তু জয় একেবারে বিপরীত। তার সঙ্গে জয়ার স্বভাবের বাইরে বাইরে বিত্তর মিল থাকলেও সে ভেতর-ভেতর ভিতু প্রকৃতির। ঝুঁকি নিতে ভয় পায়।
মুখে বড় বড় কথা এবং হাঁকডাক তার যথেষ্টই, কিন্তু ভেতরে সাহসের অভাব। একবার ভাণ্ডা এস্টেটের মালিক এবং তাদের চিরশত্রু গৈৰীনাথ ছত্রীবাহাদুরকে মুখের ওপর অপমান করে এসে কিছুকাল আর বাড়ি থেকে বেরুতেই সাহস পেত না। বাড়ির ছাদে ছােট ছেলের মতাে ঘুড়ি ওড়াত। কখনও পায়রা ওড়াত। তার এই একটা অদ্ভুত নেশা পাখি জন্তুজানােয়ার পাের। বাগানের আউট হাউসে, গঙ্গার ধারে উঁচু টিলার ওপর সেই বাড়িটা প্রমােদের জন্য বানিয়ে ছিলেন বাপ্পাদিত্য।
সেটাকে একটা চিড়িয়াখানা বানিয়ে নিয়েছিল জয়। সেখানে ছিল একটা চিতাবাঘ, একটা হায়েনা, একটা হরিণ, একটা ময়াল সাপ আর অনেকরকমের পাখি। একটা নিউগিনির কাকাতুয়াও ছিল। জয় মাঝেমাঝে তাকে কাঁধে নিয়ে ঘুরত। পরে তার মাথায় শিরে বাজ পােযা এবং তাই দিয়ে পাখি ধরার নেশা চাগিয়ে ওঠে। সে রাজস্থান থেকে একটা বাজপাখি পর্যন্ত আনিয়েছিল। পাখিটা পরে মারা যায়।
জয়া বড়দা জয়কেই সামান্য গ্রাহ্য করত। তবে সবসময় নয়। কিন্তু বৃদ্ধ নায়েব মুখুয্যেমশাইকে জয়া ভক্তিবশেই অগ্রাহ্য করতে পারত না। পারত না জয়াও। আর বিজয় তাে নম্র প্রকৃতির এবং সাদাসিধে ধরনের মুবক। সে মুখুয্যেমশাইকে বাবার মতােই দেখত।
কর্নেল সমগ্র ২য় খণ্ড এর অংশ-১
জয়-বিজয়ের বয়স যখন বত্রিশ আর জয়ার সাতাশ বছর, তখন এক বর্ষার রাত্রে সদর দরজার দিকে হইহল্লার শব্দ শােনা গেল। ঝিরঝির করে সারাদিন বৃষ্টি ঝরছে। রাত্রেও টিপটিপ করে ঝরার বিরাম নেই। জয় মাতাল অবস্থায় নিঃসাড় ঘুমােছিল। বিজয় তার ঘরে শুয়ে টেবিল বাতির আলােয় কবিতা লিখছিল আর জয়া তাে জেগেই থাকে। প্রথমে তারই কানে গিয়েছিল হইহার শব্দটা। সে দোতলার উত্তরের একটা ঘরে থাকে এবং পশ্চিমে বাড়ির ফটক। তার কানে এল, কেউ তার নাম ধরে চিৎকার করে ডাকছে।
অমনি তার বুকটা ধড়াস করে উঠল। গলার স্বর চেনা মনে হয়েছিল জয়ার। | সে নীচে হন্তদন্ত নেমে এসে দেখল, হলঘর বা ড্রয়িংরুমের দরজার পর্দা ফাক করে দাড়িয়ে ঝামেলা দেখছে কলাবতী আর রঙ্গিয়া—তারা মা মেয়ে
রাজবাড়ির দাসী। জয়াকে দেখে তারা মুখ টিপে হাসল। জয়া তাদের সরিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। দেখল, বিশাল হলঘরটার বাইরের দরজার মুখে দারােয়ান নছি সিং আর চাকর বুদ্বুরাম একটা লােকাকে ঠেলে বের করে দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। মুখুযেমশাই গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। জয়াকে দেখে চমকে উঠে বললেন, “আঃ জয়া!”
জয়া চমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল মেঝের মাঝামাঝি গিয়ে। বাঁদিকের কোণে সেকেলে সােফাসেট উল্টে রয়েছে। কয়েকটা চেয়ারও পড়ে আছে এদিকে ওদিকে। জীর্ণ কার্পেটও একপ্রান্তে অনেকটা উন্টে রয়েছে। ঘরে যেন তুমুল একটা লণ্ডভণ্ড ঘটে গেছে। কাচের ঝাড়ের ভেতর সেট-করা বিদ্যুৎবাতিগুলাে কম পাওয়ারের। তবু জয়ার চিনতে ভুল হল না। সে এগিয়ে গিয়ে নছি সিং আর বুদ্ধমের কাধ দুহাতে খামচে দুপাশে সরিয়ে দিল। তারপর লােকটার মুখােমুখি দাঁড়াল।
কর্নেল সমগ্র ২য় খণ্ড এর অংশ-১
লােকটার ঠোট কেটে রক্ত পড়ছিল। শার্টটা গলার কাছ থেকে বুক পর্যন্ত ফালাফালা। তার প্যান্টে প্রচুর জলকাদা লেগে আছে। একপায়ে জুতাে নেই ধস্তাধস্তির সময় ছিটকে কোথায় চলে গেছে। সে জয়াকে দেখে হাসবার চেষ্টা করছিল।
জয়া কয়েক মুহুর্ত তাকে নিষ্পলক চোখে দেখার পর ফোস করে বাস ছেড়ে বলল, “এস”।
সে জয়ার পেছন পেছন যখন ভেতরে যাচ্ছে, মুখুযােমশাই গলা ঝেড়ে নিয়ে ডাকলেন, “জয়া!”
জয়া ঘুরে তার চোখে চোখ রেখে বলল, “আমার স্বামী”।
মুখুয্যেমশাই হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। নছি সিং আর বুদ্রাম পরস্পরের দিকে তাকিয়ে ঠোট ফাক করে রইল। ভেতরের দরজার পর্দার দুপাশে কলাবতী আর রঙ্গিয়া পুতুলের মতাে প্যাটপ্যাট করে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বারান্দার চওড়া সিড়ির মাথায় এসে দাড়িয়ে ছিল বিজয়। জয় আর যুবকটিকে দেখে সে
অবাক হয়ে বলল, “কী রে জয়া ?”
জয়া আস্তে বলল, “আমার স্বামী। তারপর যুবকটির দিকে ঘুরে বলল, “আমার দাদা কুমার বিজয়াদিত্য নারায়ণ সিং।”
যুবকটি বিজয়ের পা ছুঁতে গেলে বিজয় ভয় পাওয়ার ভঙ্গিতে কয়েক-পা সরে গেল। তখন যুবকটি আহত স্বরে বলল, “প্রণাম নিলেন না দাদা? আমার নাম শরদিন্দু রায়। জয়া কলেজে পড়ার সময় আমরা বিয়ে করেছিলাম।
রেজিস্টার্ড বিয়ে, দাদা! ডকুমেন্ট দেখতে চাইলে
জয়া তাকে ঠেলতে-ঠেলতে নিজের ঘরে নিয়ে গেল।
ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে জয়া প্রথমে তার গালে আচমকা ঠাস করে একটা চড় মারল। শরদিন্দু হাসবার চেষ্টা করে বলল, “মারাে! তুমি রাজকন্যা,
Read more
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের কর্নেল সমগ্র ২য় খণ্ড এর অংশ-২