সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের কর্নেল সমগ্র ২য় খণ্ড এর অংশ-২

আমি রাস্তার লােক। মারবে তা তাে জানি! তৈরি হয়েই এসেছি। প্রথমে দারােয়ান মেরেছে, এবার তােমার পালা।” । 

জয়া হিসহিস করে বললে, “কোথায় ছিলে এতদিন?” দিন্দু মুখ নামিয়ে বলল, “জোলে”। জয়া বলল, “ব্যাংকের টাকা চুরি করেছিলে কেন?” শরদিন্দু মাথা সামানা দুলিয়ে বলল, “আমি টাকা চুরি করিনি।”

কর্নেল সমগ্র 

“চুরি করােনি, অথচ খামােকা তােমাকে জেলে যেতে হল ? বাজে কথা বােলাে না!” জয়া একটু চুপ করে থেকে ফের বলল, না করলে তুমি গা ঢাকা দিয়েছিলে কেন?” 

“প্রাণের ভয়ে।” “তার মানে?” 

শরদিন্দু করুণ হাসল । “আশ্চর্য! আমার এ অবস্থা দেখেও তুমি জেরা করতে পারছ, জয়া? কাপড়চোপড় বদলাতে দাও। একটু বিশ্রাম নিই। আর শােনাে, যদি পারে, আগে অন্তত এক কাপ চা খাওয়াও। আমার প্রচণ্ড খিদেও পেয়েছে।” 

জয়া ঠোট কামড়ে ধরে তার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। একটা শাস ফেলে সে বেরিয়ে গেল। বাইরে সে চড়া গলায় রঙ্গিয়াকে ডেকে চায়ের কথা বলল। তারপর ফিরে এসে আলমারির মাথা থেকে ফাস্ট এডের বাকসােটা নামাল। বাথরুম দেখিয়ে দিয়ে বলল, “যাও—আগে পরিষ্কার হয়ে এস।…” 

কিছুক্ষণ পরে শরদিন্দু মােটামুটি ফিটফাট হয়ে বসলে জয়া তার কাটা ঠোটে ওষুধ লাগিয়ে প্লাস্টার সেঁটে দিল। ইতিমধ্যে রঙ্গিয়া চা দিয়ে গেছে এবং তাকে খাবার আনতে বলেছে জয়া। চা খেতে খেতে শরদিন্দু একটু হেসে বলল, “তােমাদের দারোয়ানটা বড় বদরাগী। ডাকাডাকি শুনে বেরিয়ে এসে জিগ্যেস করল আমি কে, এত রাতে কেন এসেছি—তাে যেই বলেছি আমি রাজবাড়ি জামাই, অমনি ব্যাটা আমার মুখে আড়াই কিলাে ওজনের একটা ঘুসি বসিয়ে দি।” | জয়া গম্ভীর মুখে বলল, “তুমি চিরদিন বড় বােকা। এবার বলাে, টাকা না চুরি করলে কেন গা ঢাকা দিয়েছিলে—তাছাড়া মিছিমিছি তােমাকে জেলে যেতে হল কেন? আর কেনই বা তুমি আমাকে সেকথা জানালে না?” 

কর্নেল সমগ্র ২য় খণ্ড এর অংশ-২

শরদিন্দু পকেট থেকে তােবড়ানাে একটা সিগারেটের প্যাকেট বের করে বলল, “লজ্জায়। তুমি কী-ভাবতে!” 

“আশ্চর্য তােমার লজ্জা তাে!” জয়া ভুরু কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে থাকার পর ফের বলল, “আজ হঠাৎ এভাবে আমার কাছে আসতে তােমার লজ্জা হল না-অথচ এই পাঁচটা বছরে অন্তত একটা চিঠি লিখতেও লজ্জা হল! আমি বিশ্বাস করি না।” 

শরদিন্দু জেল থেকে বেরিয়ে আজই চুল-দাড়ি কামিয়েছিল। তাকে জয়া আগের তুলনায় সুন্দর আর স্বাস্থ্যবান দেখছিল। হয়তাে জেলে থাকলে মানুষের শরীরে একটা রূপান্তর ঘটে যায়। শরদিন্দু বলল, “তখন তােমাকে বলেছিলাম— (হাত প্রাণের ভয়ে।” 

“বুঝলাম না!” 

শরদিন্দু একটু চুপ করে থেকে চাপা স্বরে বলল, “আশা করি তােমার সঙ্গে আমার শেষবার দেখার তারিখটা মনে আছে। ১৭ আগস্ট, সন্ধ্যাবেলা। সেদিন শনিবার ছিল। ম্যাটিনি শাে দেখে দুজনে পেটপুরে শােসা খেলুম। তারপর তুমি গেলে তােমার হোস্টেলে। আমি ফিরলুম মেসে। ফিরেই একটা বেনামী চিঠি পেলাম। চিঠিতে লেখা ছিল, আমি যেন পরদিন সকালে কলকাতা ছেড়ে চলে যাই। কলকাতায় থাকলেই আমাকে প্রাণে মেরে ফেলা হবে।” 

“তুমি পুলিশের কাছে গেলে না কেন? আমাকেই বা জানালে না কেন?” 

“ভয়ে মাথার ঠিক ছিল না। তাছাড়া পুলিসকে কিছু জানাতে নিষেধ করা হয়েছিল চিঠিতে। আমি পরদিনই বর্ধমানে আমাদের বাড়ি চলে গিয়েছিলুম। ২১ আগস্ট বাইরে থেকে ঘুরে বাড়ি ফিরে শুনি, আমার খোঁজে পুলিস এসেছিল। এদিকে কাগজে খবর বেরিয়েছে, ফেডারেল ব্যাংকের ক্যাশ থেকে তিন লক্ষ আশি হাজার টাকা উধাও। ব্যাংকের এক কর্মী বেপাত্তা। বােঝাে কী অবস্থা । সঙ্গে সঙ্গে আমি বেনামা চিঠির রহসা বুঝে গেলুম। কিন্তু সব চেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার, সেই চিঠিটা বের করে দেখি, একেবারে শাদা কাগজ মাত্র। কালিতে লেখা হরফ উবে গেছে।” 

কর্নেল সমগ্র ২য় খণ্ড এর অংশ-২

জয়া দম আটকানাে গলায় বলল, “তারপর?” 

“আমার আত্মরক্ষার কোনো উপায় নেই দেখে গা ঢাকা দিলুম। কলকাতা যাওয়ার সাহস তো আর ছিলই না। জব্বলপুরে মামার বাড়ি কিছুদিন, তারপর বােম্বতে এক বন্ধুর বাড়ি—শেষে দিল্পি চলে গেলুম। দিল্লিতে”। 

জয়। বাধা দিয়ে বলল, “তুমি কানাজোলে আমাদের বাড়ি চলে এলে না কেন?” শরদিন্দু একটি ক্ষুব্ধ হয়ে বলল, “কোন মুখে আসব? কাজে তখন ব্যাংক চোর ফেরারী আসামি শরদিন্দু রায়ের নামে হুলিয়া : দুপানাে হয়েছে। দিল্লিতে পুলিস আমাকে অ্যারেস্ট করেছিল। মাসখানেক কলকাতার ব্যাংকশাল কোর্টে মামলা চলার পর পাঁচ বছর জেলের হুকুম হল। হাজতে থাকার সময় খুব আশা করতাম, তুমি অন্তত কাগজ পড়ে জানবে এবং দেখা করতে আসবে। অন্তত এখন যেমন কৈফিয়ত চাইছ, তেমনি কৈফিয়ত চাইতেও হাজতে ছুটে আসবে ভেবেছিলুম। তুমি আসনি।” 

জয়া শ্বাস ফেলে বলল, “আমি কিছু জানতুম না। কারণ তখন আমি এলকাতা ছেড়ে চলে এসেছি। তবে কলকাতায় থাকার সময় কাগজে একদিন দখেছিলুম ফেডারেল ব্যাংক থেকে টাকা চুরির খবর। একটু সন্দেহ হয়েছিল 

তােমাকে—কারণ তুমি নিপাত্তা। তবে এতখানি ভাবিনি। বিশ্বাস করিনি, তুমি সত্যি টাকা চুরি করেছ।” 

শরদিন্দু একটু হেসে বলল, “করলে ভালই হত দেখছি৷ দিব্যি জেল খেটে এসে এখন সে-টাকায় বাবুগিরি করা যেত।” 

জয়। আস্তে বলল, “তােমাকে ফাদে ফেলেছিল কেউ, কিন্তু কাউকে তােমার। সন্দেহ হয়নি?” 

শরদিন্দু আস্তে বলল, “বুঝতে পারিনি—এখনও পারি না। কলেজ স্ট্রিট ব্রাঞ্চের ক্যাশ ডিপার্টে আমার কলিগ ছিল চারজন। ভূপেশ, মণিশংকর, গােপাল নায়ার নামে একজন কেরলি—তাকে খুব সৎ মনে হত, আর ছিল পরিতােষ । সবাই আমার সমবয়সী। পরস্পর বন্ধুত্বও ছিল। তবে আমার সন্দেহ পরিতোেষই আমাকে বিপদে ফেলেছিল।” 

কর্নেল সমগ্র ২য় খণ্ড এর অংশ-২

জয়া উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “দেখি, তােমার খাবার ব্যবস্থা করল নাকি…” 

অন্ধ প্রজাপতি ৷ কর্নেস নীলাদ্রি সরকার ইলিয়ট রােডে অবস্থিত ‘সানি লজ’ নামে তিনতলা বাড়িটির ছাদে তার প্ল্যান্টওয়ার্ল্ডে একটি ফুলবতী অর্কিডের দিকে মুগ্ধ দুষ্টে তাকিয়ে ছিলেন। কদিন বৃষ্টির পর আজ সকাল থেকে আকাশ পরিষ্কার। সরে সূর্য উঠেছে। শরতকালের সকালের রােদ কলকাতায় স্বরূপ হারিয়ে ফেলে, আবহমণ্ডলের যা দুরবস্থা! কর্নেল ভাবছিলেন এই নীল-লাল অর্কিডল আগুনের মতাে দেখাত। মনে পড়ছিল, গত শরতে ভীমগােলা জঙ্গলে এই অর্কিডের ফুল দেখেছিলেন—যেন জঙ্গল দাউদাউ জ্বলছে মনে হচ্ছিল। কলকাতা কী যে হয়ে গেল দিনে দিনে। | ভূত ষষ্ঠীচরণ সিড়ির মাথায় মুখ বের করে বলল, “বাবামশাই! এক ভদ্রলােক এয়েছেন।” 

কর্নেল তার দিকে না ঘুরেই বললেন, “ধুতি-পাঞ্জাবি-জহর-কোট। কাবে কাপড়ের থলে। চোখে কালো চশমা। মুখে দাড়ি।” 

যষ্ঠার দাঁত বেরিয়ে গেল। “আজ্ঞে, আজ্ঞে !” ::: 

“মাথায় বড়-বড় চুল। ফর্সা রঙ। খাড়া নাক।” বলে কর্নেল ঘুরলেন তার দিকে। 

Read more

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের কর্নেল সমগ্র ২য় খণ্ড এর অংশ-৩

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *