এবার ষষ্ঠী হা করে ফেলেছে। তার চোখ বড়াে হয়ে গেছে। কর্নেল হাতের খুরপিটা রেখে গ্লাভস খুলে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন। মুচকি হেসে বললেন, “আমার চোখের দৃষ্টি দেয়াল-কংক্রিট সব ফুড়ে চলে যায়। কাজেই ষষ্ঠী, সাবধান! তাছাড়া তুই একটু আগে আবার প্রজাপতিটাকে ধরে পরীক্ষা করে দেখছিলি যে আমার কথা সত্যি কি না—তার মানে প্রজাপতিটা সত্যিই কানা কি না।
এ পর্যন্ত শুনে যা জিভ কেটে বলল, ‘না, না। শুধু একটুখানি ছুঁয়েছিলাম। দেখতে বড় ভাল লাগে না বাবামশাই ? কিন্তু আপনি কথাটা আন্দাজেই বলছেন । কেমন করে জানলেন, আগে শুনি ?”
মাঝেমাঝে ষষ্ঠী কর্নেলকে চ্যালেঞ্জ করে বসে। কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন, “ওরে হতভাগা! তের আঙুলে প্রজাপতিটার ডানার রঙ মেখে আছে—ওই দ্যাখ।” | “ওঃ হাে!” যষ্ঠী তার আঙুল দেখে লাফিয়ে উঠল। একগাল হেসে বলল, “আপনার নজর আছে বটে বাবামশাই! কিন্তু ওই ভদ্রলােককে দেখতে পেলেন কী করে?”
কর্নেল মৃদু হেসে চাপা গলায় বললেন, “একটু তাগে ওই নিমগাছ থেকে একঝাক কাক এসেছিল। তাড়াতে গিয়ে দেখলুম, নিচের রাস্তায় এক ভদ্রলােক বাড়ির দিকে তাকিয়ে উল্টোদিকের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে আছেন। ছাদের কার্নিশে আমাকে দেখতে পেয়েই রাস্তা পেরিয়ে আসতে থাকলেন হন্তদন্তভাবে। কাজেই…” ষষ্ঠী তারিফ করে বলল, “ওরে বাবা! আপনার সবদিকেই চোখ !…”।
কর্নেল সমগ্র ২য় খণ্ড এর অংশ-৩
একটু পরে কর্নেল গার্ডেনিং-স্যুট ছেড়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে ড্রইংরুমে ঢুকে নমস্কার করে বলে উঠলেন, “আশা করি, কানাজোল রাজবাড়ির ছােট কুমারবাহাদুরকে দেখছি।”
আগন্তুক বিজয় ভীষণ অবাক হয়ে বলল, “আশ্চর্য তাে! কর্নেল একটু হেসে বললেন, “কিছু নয় কুমারবাহাদুর। এযুগে খবরের কাগজে দুরকে কাছে আর অচেনাকে চেনা করে দেয়।”
বিজয় বলল, “হা—কাগজে খবর বেরিয়েছিল বটে! কিন্তু যে ছবিটা ছাপা হয়েছিল, তাতে তো আমি ছিলাম না। আমার দাদা জয়ের ছবি ছিল, চিতাবাঘটার খাঁচার পাশে দাঁড়ানাে। আমার অবাক লাগছে এই ভেবে যে, দাদাকে দেখে আমাকে চেনা তাে কঠিনই। কারণ আমার মুখে দাড়ি আছে। আমরা, যমজ ভাই হলেও—’ | কর্নেল তাকে থামিয়ে নিজের শাদা দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন, “আমাকে অহংকারী ভাববেন না কুমারবাহাদুর! প্রকৃতি কোনাে দুর্বোধ্য কারণে আমার ইন্দ্রিয়গুলোকে সাধারণ মানুষের চেয়ে তাক্ষ করে দিয়েছে।
কোনাে মানুষের মুখতা সে ছবিতেই হােক, আর বাস্তবে, যদি কোনাে কারণে আমার লক্ষ্যবস্তু হয়, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে সেই মুখের একটা পৃথক ফিচার বলুন বা বৈশিষ্ট্য বলুন, আমার দৃষ্টির ফিল্টারে ঘেঁকে তার নিখুত নিজস্বতা নিয়ে স্মৃতিতে ঢুকে যায়। আপনার দাদার মুখের সেই পৃথক নিজস্বতা স্মৃতিতে এখনও টাটকা বলেই আপনাকে দেখামাত্র সনাক্ত করে ফেলেছি। তাছাড়া খবরসহ কাগজে বেরিয়েছে মাত্র গত সপ্তাহে। ছবিতে বড় কুমারবাহাদুরের মুখে দাড়ি ছিল না। দ্বিতীয়ত, যিনি চিতাবাঘ বা জন্তুজানোয়ার পােয়েন, যিনি শিকারী এবং স্বাস্থ্যচর্চাও করেন,
তিনি ধুতি-পাঞ্জাবি-জহরকোট পরে অমায়িকভাবে সােফায় বসে থাকবেন বলে বিশ্বাস করা যায় না। যাই হােক, এবার বলুন কুমারবাহাদুর, আপনার জন্য কী করতে পারি ?”
কর্নেল সমগ্র ২য় খণ্ড এর অংশ-৩
বিজয় সপ্রশংস চোখে তাকিয়ে বলল, “দয়া করে আমাকে কুমারবাহাদুর বলবেন না। বিজয় বলে ডাকলে খুশি হলাে। আমাকে তুমি বললে আরও ভাল লাগবে।” ষষ্ঠী কফি ও স্ন্যাকসের প্লেট রেখে অভ্যাসমতাে আগন্তুককে আড়চোখে দেখতে দেখতে ভেতরে চলে গেল এবং অভ্যাসমতােই পর্দার ফাকে একটা চোখ রেখে দাঁড়িয়ে রইল ডাইনিং ঘরের দরজার ওপাশে।
কর্নেল এটা জানেন। তাই চোখ কটমটিয়ে সেদিকে তাকালে ষষ্ঠি সারে গেল। কনেল বিজয়ের হাতে কফির পেয়ালা তুলে দিয়ে মৃদুস্বরে বললেন, “মর্গের রিপাের্টে তাে বলেছে চিতার নখের আঘাতেই মৃত্যু। খবরের কাগজে পড়ে যেটুকু জেনেছি, তাতে মনে হচ্ছে, সেটাই সম্ভব। তাছাড়া তােমার ভগ্নীপতি শরদিন্দুবাবুর পেটে নাকি অ্যালকোহলও পাওয়া গেছে। মাতাল অবস্থায় রাত দুপুরে গিয়ে চিতার খাচা খুলে দিয়েছিলেন নাকি । তাহলে আর সন্দেহ কিসের?”
বিজয় কফিতে চুমুক দিয়ে বলল, “জয়া বিশ্বাস করে না। জয়া—আমাদের একমাত্র বােন।”
“কাগজে তােমাদের পারিবারিক পরিচয় বেরিয়েছিল। পড়েছি।”
“হ্যা স্ক্যান্ডাল রটানাের সুযােগ পেলে আজকাল খবরের কাগজ মেতে ওঠে।” বিজয় দুঃখিত হয়ে বলল।…“জয়া-শরদিন্দর ব্যাপারটা নিয়ে কেচ্ছার চুড়ান্ত করেছে। শরদিন্দু ব্যাংকের টাকা চুরি করে জেল খেটেছিল, তাও লিখেছে। লজ্জায় আমাদের মাথা হেঁট হয়ে গেছে।
‘জয়া কেন বিশ্বাস করে না যে স্বামীর মৃত্যু চিতার আক্রমণে বাধা দিয়ে বিজয় বলল, “জয়া খুব জেদী। তার মাথায় একটা কিছু ঢুকলে তাই নিয়ে চুড়ান্ত করে ছাড়ে।
কর্নেল মুচকি হেসে বললেন, “মাথায় তােমারও সম্ভবত কিছু ঢুকে থাকবে। তা নাহলে তুমি ছুটে আসত না।”
বিজয়কে একটু চঞ্চল ও উত্তেজিত দেখাল। চাপা স্বরে বলল, “শরদিন্দুর মৃত্যু নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। তবে আমি আরও এসেছি দাদার ব্যাপারে।”
কর্নেল সমগ্র ২য় খণ্ড এর অংশ-৩
কর্নেল সােফায় হেলান দিয়ে চোখ বুজে বললেন, “বলাে!”
“দাদা কিছু দিন যাবৎ মনমরা হয়ে গেছে। জিগ্যেস করলে বলে, বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে না। তার নাকি সবসময় মনে হচ্ছে, সুইসাইড করে ফেলবে।”
“তােমাকে তাই বলছে বুঝি?”
“হ্যা। কিছু জিগেস করলে পরিষ্কার কোনাে জবাব দেয় না। খালি বলে, দেখবি বিজয়, কখন আমি সুইসাইড করে বসেছি।”
“জয়া জানে এ কথা ?”
“না। জয়া দাদার সঙ্গে কথা বলে না। কারণ দাদা চিতাটাকে মেরে ফেলতে চায়নি।”
“তুমি ছাড়া আর কাউকে বলেছে সে ?” “না। আর কাউকে বলতে নিষেধ করেছে।”
কর্নেল হাসলেন। “কিন্তু আমি তাে সাইকিয়াট্রিস্ট ডাক্তার নই। আমার কাছে কেন এসেছ?”
বিজয় আরও চাপা স্বরে বলল, “পরশু অনেক রাতে একবার বেরিয়েছিলুম ঘর থেকে। আমি রাত দুটো অব্দি জেগে লেখাপড়া করি। কবিতা লেখার নেশা আছে। তবে কোনাে কাগজে ছাপতে পাঠাই না। নেশায় লিখি। তাে একটা লাইন লিখে পরের লাইনটা কিছুতেই মাথায় আসছিল না। তাই ভাবলুম, একবার গিয়ে খােলামেলায় দাঁড়াই। রাতের আকাশ দেখে যদি পরের লাইনটা মাথায় আসে। সিঁড়িতে নামার মুখে দাদার ঘরের জানালায় আলাে দেখে একটু অবাক হলুম। দাদা রাত্রে মদ খায়। তারপর নেশার ঘােরে ঘুমিয়ে পড়ে। অবশ্য মাতলামি করে না কখনও। কিন্তু দাদার ঘরে আলাে দেখে তারপরই আমার আতঙ্ক হল, সুইসাইড করে ফেলল নাকি-তা না হলে আলাে কেন এখনও? দরজার কাছে যেতেই কানে এল, দাদা কার সঙ্গে যেন চাপাগলায় কথা বলছে। ভীষণ অবাক হয়ে দরজার কড়া নেড়ে ডাকলুম ওকে। অমনি ঘরের আলাে নিভে গেল।
Read more