সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের কর্নেল সমগ্র ২য় খণ্ড এর অংশ-৬

কর্নেলের সঙ্গে গত সন্ধ্যায় আলাপ হয়েছিল জয়ের। বিজয় বলল, “সনি তেড়ে এসেছিল। কর্নেল ভাগ্যিস”। 

কথা কেড়ে জয় একটু হেসে বলল, “সনির তাে সেটাই কাজ। “কিন্তু সনি দ্যাখাে গে ভীষণ জব্দ হয়ে গেছে কর্নেলের পাল্লায় পড়ে। বিজয় হাসতে লাগল । জয় শিস দিল। তারপর সনিকে বারকতক ডাকাডাকি করে বলল, “সনির আজ মেজাজ ভাল নেই। যাক, গে, বলুন কর্নেলসায়েব, কেমন লাগছে আমার জু?”

কর্নেল সমগ্র 

“অসাধারণ। কর্নেল ঘুরে চারপাশটা দেখে নিয়ে বললেন। তারপর জিগ্যেস করালেন, “চিতাবাঘটা কোথায়? 

“আসুন দেখাচ্ছি। বাহাদুরকে আজকাল ঘরবন্দি করেছি। বড্ড বেয়াদপি করছে।” 

একটা ঘরের দরজায় তালা আটকানাে। তালা খুলে জয় ভেতরে ঢুকল। পেছন-পেছন্ন কর্নেল ও বিজয় ঢুকলেন। ঘরটা আন্দাজ বারােফুট-দশফুট। একপাশে মজবুত খাঁচার ভেতর চিতাবাঘটা চুপচাপ শুয়ে ছিল। মুখ ঘুরিয়ে তাকাল। কর্নেল খাঁচার কাছে গেলে চিতাটা খা খা শব্দে বিরক্তি প্রকাশ করে কোনায় সেঁটে গেল। | জয় বাঁকা মুখে বলল, “শরদিন্দ নিজের দোষে মারা পড়েছে। মদ তাে আমিও খাই। কেউ বলতে পারবে না আমি মাতলামি করি। খাই, চুপচাপ শুয়ে পড়ি। ব্যস! আর শরদিন্দু মাতাল হয়ে আমার জুতে ঢুকে বাহাদুরের সঙ্গে ফাজলেমি করতে গিয়েছিল। 

“খাচা খুলে দিয়েছিলেন বুঝি শরদিন্দুবাবু?” 

“চিতাটা ওঁকে মেরে পালিয়ে যায়নি শুনলুম?” 

“পালাবে কেন? পােষা চিতা। ফের খাঁচার ভেতর ঢুকে চুপচাপ বসে ছিল। কেউ কিছু টের পাইনি আমরা। ভােরে আমি এসে দেখি, শরদিন্দু ক্ষতবিক্ষত হয়ে পড়ে আছে খাঁচার পাশে। সঙ্গে সঙ্গে খাঁচার দরজাটা আগে আটকে দিলুম। তারপর—” 

“রাত্রে যে শরদিন্দুবাবু বাড়ি ফিরলেন না, জয়া তার স্বামীর খোঁজ করেনি?” 

কর্নেল সমগ্র ২য় খণ্ড এর অংশ-৬

“সেকথা জয়াকে জিগ্যেস করবেন।” জয় হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠল। তারপর বিকৃত দৃষ্টে তাকিয়ে ফের চড়া গলায় বলল, “আপনি কে মশাই? আমাদের ফ্যামিলির ব্যাপারে আপনার দেখছি বড় কৌতূহল। কাল রাত একটায় দেখলুম, আপনি বাগানে ফোয়ারাটার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। আমার এসব ভাল লাগে না। আপনি বিজয়ের চেনাজানা লােক এবং গেস্ট না হলে আপনি কর্নেলসায়েব হােন আর লেফটন্যান্ট জেনারেলই হােন, আমি ছেড়ে কথা কইতুম না।” 

বিজয় বলে উঠল, “জয় ! জয় ! কাকে কী বলছ? ছিঃ!” 

জয় ঢােক গিলে বলল, “সরি ! আমাকে ক্ষমা করবো কর্নেলসায়েব!” কর্নেল মৃদুস্বরে বললেন, “বিজয় আমার অন্ত স্নেহভাজন। তাকে আমি তুমি বলি। সেই কারণে তার দাদাকেও তুমি বলতে পারি কি?” 

জয় তার মুখের দিকে শূন্য দৃষ্টে তাকিয়ে তখনই মুখটা নামিয়ে বলল, “নিশ্চয় পারেন। 

“তােমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে জয়।” “কী কথা? 

কর্নেল বিজয়ের দিকে তাকালেন। বিজয় বলল, “আপনারা কথা বলুন। আমি বাইরে যাচ্ছি।” 

সে বেরিয়ে গেলে কর্নেল বললেন, “তােমার এই কাকাতুয়াটি বেশ। বিজয় বলছিল এর নাম রেখেছে রাজা। নামটাও চমৎকার! রাজাকে কথা বলতে শেখাওনি কেন?” 

জয় গলার ভেতর বলল, “আপনার কথাটা কী?” কর্নেল একটু হাসলেন। “কাকাতুয়াটা কথা বলতে পারলে দারুণ হত। তাই না?” 

জয়ের চোখদুটো জ্বলে উঠল। “এই কথা বলার জন্যই কি বিজয়কে সরে যেতে ইশারা করলেন?” 

“যা।” কর্নেল এবার গলা চেপে খুব আস্তে বললেন, “রাজাকে যখন কিনেছিলে তখন কিন্তু সে বােৰা ছিল না শুনেছি। হঠাৎ একদিন সে বােবা হয়ে যায় নাকি। তুমি ” । 

কর্নেল সমগ্র ২য় খণ্ড এর অংশ-৬

জয় আবার উত্তেজিত হল। বলল, “আপনি আবার নাক গলাচ্ছেন কিন্তু ! কে আপনি?” 

জয়! প্লিজ! উত্তেজিত হয়াে না। রাজাকে তুমি নিশ্চয় এমন একটা কথা শেখাতে চাইছিলে, যেটা কারুর পক্ষে হয়তাে বিপজ্জনক। তাই সে তােমার রাজাকে রাতারাতি অপারেশন করে বােবা করে দিয়েছিল। তাই না?” 

জয় ফোস করে শাস ছেড়ে বলল, “হ্যা। দিনকয়েক আগে ভােরে এসে দেখি রাজার মুখ দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে। ধড়ফড় করছে দাঁড়ে। ভেবেছিলুম মারা পড়বে। শেষে কুড়ি জঙ্গল এলাকা থেকে এক আদিবাসী বদ্যিকে ডেকে পাঠালুম। তার চিকিৎসায় প্রাণে বেঁচে গেল। তবে গলা দিয়ে নিছক শব্দ করা ছাড়া কথা বলা ওর পক্ষে অসম্ভব। কোনাে শুওরের বাচ্চা ওর জিভটা কেটে ফেলেছে।” 

“কী কথা শেখাচ্ছিলে জয়?” 

জয় একটু সরে গিয়ে বলল, “আপনি যেই হােন, বড্ড বেশি ট্রেসপাস করছেন কিন্তু।” 

“জয়! আমি তােমাদের ভাইবােনের হিতৈষী।” 

জয় অদ্ভুত হাসল। উদভ্রান্ত একটা হাসি। বলল, “পৃথিবীসুদ্ধ সবাই কানাজোল রাজবাড়ির হিতৈষী। কিন্তু কোনাে হিতেষীর সাধ্য নেই এ রাজবাড়িকে বাঁচায়। এ বাড়ির ওপর পাপের ছায়া পড়েছে। প্লিজ, আমাকে সার ঘটাবেন না। আমার মাথার ঠিক নেই।” 

বলে সে জোরে বেরিয়ে গেল। তারপর গলা তুলে ডাকতে থাকল, “সনি! সনি! কোথায় গেলি? এই রাস্কেল ! থাম, দেখাচ্ছি মজা!” 

বিজয় তারের বেড়ার কাছে দাড়িয়ে ছিল। হরিণটা তার হাত শুকছিল। কর্নেলকে দেখে পিছিয়ে গেল। উল্টোদিকে হায়েনার খাঁচাটা দেখা যাচ্ছিল। হায়েনাটা পা ছাড়িয়ে শুয়ে ছিল। বিজয় একটু হেসে আস্তে বলল, “কী বুঝলেন?” 

কর্নেল জবাব দিতে যাচ্ছেন, একটা লােক সাইকেল ঠেলতে ঠেলতে চড়াই ভােঙে এদিকে আসছে দেখে বললেন, “ও কে, বিজয় ?” 

বিজয় দেখে নিয়ে বলল, “নানকু। ও দাদার এই চিড়িয়াখানার দেখাশােনা রে। খাবার আনতে গিয়েছিল বাজারে। কসাইখানা থেকে রােজ হাড়গােড় আর নিকটা করে মাংস আনে। পাখিদের জন্য নিয়ে আসে কাংনিদানা, ছােলা, মটর ইসব। 

কর্নেল সমগ্র ২য় খণ্ড এর অংশ-৬

“নানকু কোথায় থাকে?” “দাদার ঘরের ঠিক নিচে একটা ঘর আছে, সেখানে। তবে ও সারাদিন এই তেই থাকে, শুধু খাওয়ার সময়টা ছাড়া।” | নানকু সাইকেলটা বেড়ার গেটের পাশে রেখে বিজয় ও কর্নেলকে সেলাম ল। তারপর ব্যাকসিটে আটকানাে চটের বোঁচকা আর রডে ঝােলানাে একটা স্কেট খুলে নিয়ে ভেতরে ঢুকল। সঙ্গে সঙ্গে চিড়িয়াখানা জুড়ে একটা সাড়া পড়ে গল। হায়েনাটা উঠে দাঁড়াল এবং জিভ বের করে খাচার রডের ভেতর দিয়ে কটা ঠ্যাং বাড়িয়ে দিল।

একজোড়া বানর গলার চেন টানটান করে একটা ছােট্ট ছি থেকে ঝাপিয়ে পড়ল। হরিণটা বেড়ার বাইরে মুখ বাড়াল। একদল ক্যানারি খি তুমুল চেঁচামেচি জুড়ে দিল! ঘরের ভেতর থেকে চিতাবাঘের চাপা ও ও গর্জন শােনা গেল। বিজয় হাসতে হাসতে বলল, “প্রকৃতির জাগরণ। তাই না কর্নেল?” কর্নেলও হেসে বললেন, “তুমি কবি। তােমার কাছে তাই মনে হওয়া উচিত। বে আমার কাছে ক্ষুধার্তের কান্নাকাটি বলেই মনে হচ্ছে। সম্ভবত নাকু ওদের কমতাে খেতে দেয় না।” 

বিজয় চাপা স্বরে বলল, “নানক এক নম্বর চোর—দাদাও জানে! যে টাকা দেয় নিকুকে, তার তিনভাগ নানকর পকেটে যায়, সে আমি হলপ করে বলতে পারি।” | দুজনে কথা বলতে বলতে টিলার ঢাল বেয়ে একটা নালার ধারে এলেন। লাির ওপর কাঠের সাঁকো আছে। একসময় গঙ্গা থেকে এই নালা দিয়ে বাগানে সচের জল আনা হত। রাজবাড়ির চৌহদ্দি পাচিল-ঘেরা।

 

Read more

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের কর্নেল সমগ্র ২য় খণ্ড এর অংশ-৭

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *