পরিতােষ গুড়ি মেরে তাড়াখাওয়া প্রাণীর মতাে বসে ছিল। দাঁত বের করে ঠে দাড়াল। তারপর নমস্কার করে বলল, “পালাইনি স্যার, এখানকার বাথরুমটা ভেঙে গেছে। তাই”।
“আসুন। ঘরে গিয়ে বসি।” পরিতােষ একটু ইতস্তত করে বারান্দায় ফিরে এল এবং ঘরে ঢুকল। কর্নেল রে ঢুকে এদিকের দরজা বন্ধ করে দিলেন এবং করিডরের দিকের দরজাটা খুলে দিলেন। ঘরের ভেতর একটা তক্তাপপাশে যেমন তেমন করে বিছানা পাতা য়েছে। কয়েকটা ভাঙা বেতের চেয়ার আর একটা টেবিল রয়েছে একপাশে। পরিতােষ কোণঠাসা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। কর্নেল নােংরা বিছানাটা সরিয়ে বসেলেন, “বসুন পরিতােষবাবু।”
পরিতােষ বসে বলল, “আমাকে আপনি চেনেন স্যার?” কর্নেল সে কথার জবাব না দিয়ে বললেন, “আপনার নামে তাে পুলিশের লিয়া আছে।”
পরিতােষ মুখ নামিয়ে আঙুল ফুটতে থাকল। “নিখোঁজ বােনের খোঁজে কানাজোল এসেছিলেন আপনি। তারপর যখন জানতে পারলেন যে তাকে খুন করে লাশ লুকিয়ে রাখা হয়েছে, তখন কী উদ্দেশ্যে কানাজোলে থেকে গেলেন আপনি? উহ—আমিই বলছি। বােনের
ত্যার প্রতিশােধ নিতে। কেমন? ঠিক বলছি তাে?”
পরিতােষের হাত কাঁপছিল। মুখ তুলে আস্তে বলল, “আমি খারাপ। কিন্তু আমার বােন রমলা—” সে ঢােক গিলে ফের বলল, “রমলা ছিল খুব ভাল মেয়ে। সরল বলেই ভীষণ বােকা। আমার একমাত্র বােন কর্নেল ! আমি চোর, মহাপাপী, কিন্তু রমলা তাে পাপী ছিল না। তবুও কেন তাকে এমন করে মরতে ল?” পরিতােষ দুহাতে মুখ ঢেকে বসে রইল।
কর্নেল সমগ্র ২য় খণ্ড এর অংশ-১৭
কর্নেল বললেন, “পরিতােষবাবু, বড়কমার জয়াদিত্যের সঙ্গে আপনার কীভাবে পরিচয় হয়েছিল ?”
পরিতােষ রুমাল বের করে চোখ মুছে বলল, শরদিন্দু বকে তামার কলিগ, সে আলাপ করিয়ে দিয়েছিল। আমি কমবয়স থেকেই মদ খাওয়া
রেছিলাম। তাই ভেবেছিলাম রাজামহারাজা লােকের ছেলে জয়াদিত্য। তার নজে ভাব করলে বিনাপয়সায় রােজ মদ খাওয়া যাবে। তাই জয়কে প্রথম আলাপের দিনই বারে নিয়ে গিয়েছিলাম। শরদিন্দু মদ খাওয়া পছন্দ করত না। যাই হােক, জয় প্রথমদিকে মদের মজাটা পেয়ে গেল। সে নিজেই পােপােজ মল, পরদিন সব খরচ তার, এটাই নিয়ম। পরদিন কথামতাে পার্কস্ট্রিটের সেই রে গিয়ে দেখি জয় হাজির। তারপর থেকে সে রােজ সন্ধ্যা ছটায় বারে জির থাকতাে। কিছুদিন পরে দুদিন সে এলাে না। তখন শরদিন্দুর কাছে খােজ নিয়ে তার হােস্টেলে গেলুম। কিন্তু তখনও আমি জানি না ওরা যমজ
ভাই-—যদিও শরদিন্দু বা জয় বলে বিজয়ের কথা, কিন্তু ওরা বলেনি যে জয় ও বিজয় যমজ ভাই। তাই হােস্টেলের গেটে জয় ভেবে যাকে বারে নিয়ে যাবার জন্য সাধছি, সে বিজয় তা জানতুম না। আপনি নিশ্চয় লক্ষ্য করেছেন, দুভাইয়ের গলার স্বর, হাবভাব প্রায় একইরকম—মেজাজ বা স্বভাবচরিত্র যা
আলাদা। শুধু আলাদা নয়, উল্টো।”
“ঠিক তাই। তারপর ?”
“বিজয় ব্যাপারটা ফাস করে বলল, আপনি আমাকে জয় ভেবেছেন। জয়কে আপনিই তাহলে মদ ধরিয়েছেন। এইসব বলে বিজয় আমাকে খুব শাসাল। ব্যাপারটা শরদিন্দুকে বললে সে খুব হাসল। যাই হােক, তার দিনকতক পরেই সকালে জয় আমার বাসায় হাজির। আমার ঠিকানা সে শরদিন্দুর কাছে যােগাড় করেছে। সে বিজয়ের হয়ে ক্ষমা চাইলাে। তাকে খুব খাতির করে বসালাম। রাজকুমার শুনে মা—তখন মা বেঁচে ছিলেন, একেবারে অস্থির। রমলার সঙ্গে আলাপ হল জয়ের। সেই শুরু। এবার বাকিটা বুঝে নিন।” ।
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের কর্নেল সমগ্র ২য় খণ্ড এর অংশ-১৭
“বিজয় এম. এ.-তে ভর্তি হয়েছিল। কিন্তু জয় বি. এ. পাশ করে চলে এল কেন জানেন?”
পরিতােষ মুখ নামিয়ে বলল, “সঠিক জানি না। তবে যে জানত, সে তাে আর বেঁচে নেই।”
রমলা জানত?”
পরিতােষ গলা ঝেড়ে একটু কেসে বলল, “আমার ধারণা রমলাকে নিয়ে দুভাইয়ে মনােমালিন্য হয়েছিল। তবে জয় গোঁয়ার, পাগলাটে স্বভাবের ছেলে।” | ‘রমলারও নিশ্চয় আপনার মতাে ভুল হয়ে থাকবে কে জয় বিজয় না চিনতে পেরে?”
পরিতােষ আস্তে বলল, “হ্যা। রমলার ভুল করা স্বাভাবিক। সেজন্য আমি রমলাকে সাবধান করে দিইনি, তা নয়। কিন্তু রমলা বড় বােকা ছি বরাবর। খুব সেন্টিমেন্টালও ছিল সে। | “কিন্তু আপনি কি মনে করেন, রমল। যদি বিজয়কেই জয় বলে ভুল করে, বিজয় কি সেই সুযােগ নেবে?”
পরিতােষ গম্ভীর হয়ে গেল। একটু পরে বলল, “বিজয়ের সঙ্গে আদৌ মিশিনি। কাজেই জানি না কেমন স্বভাবের ছেলে। তাবে জয় বিজয়ের প্রশংসাই করেছে বরাবর। বিজয় খুব নীতিবাগীশ।”
কর্নেল চুরুট ধরিয়ে কয়েকটা আলতাে টান মেরে ধোঁয়া ছাড়লেন। তারপর বললেন, “আপনি বােনের হত্যার প্রতিশােধ নিতে এখনও কানাজোলে আছেন। কিন্তু আপনি কি জানেন, কে রমলাকে খুন করেছে?”
পরিতােষ গলার ভেতর বলল, “আমি খুঁজছি। এখনও বুঝতে পারছি না।” “কাকে সন্দেহ বেশি ?”
কমবেশির প্রশ্ন নয়, স্যার! আমার সন্দেহ এ বাড়ির সকলকেই।” “জয়কেও ?”
উ।” “বিজয়কে ?”
কর্নেল সমগ্র ২য় খণ্ড এর অংশ-১৭
ইউ।” কর্নেল বললেন, “জয় আপনাকে বলেনি তার কাকে সন্দেহ?” “জয় তাে রমলাকে ভালবাসত।” “বাসত বটে।” “তাহলে রমলা তার কাছে এলে কেন সে তাকে খুন করবে?” পরিতােষ চুপ করে রইল। কর্নেল বললেন, “বলুন পরিতােষবাবু!” | পরিতােষ আস্তে বলল, “আপনার কথা আমি কাগজে প্রচর পড়েছি। আমি মানি, আপনি একজন বিখ্যাত প্রাইভেট ডিটেকটিভ। আপনাকে রাজবাড়িতে দেখে আমি মনে বল পেয়েছি স্যার। রমলাকে যেই খুন করুক, আপনি তাকে খুঁজে বের করবেন, আমি বিশ্বাস করি। দয়া করে আমার কাছে জানতে চাইবেন মা আর।”
কর্নেল হাসলেন। “আমার কোনাে অলৌকিক শক্তি নেই পরিতােষবাবু। আমি বাস্তব তথ্য থেকে যুক্তির সাহায্যে সিদ্ধান্তে আসি। আমি আপনার কাছে তথ্য চাইছি।”
পরিতােষ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বলল, “জয় কলকাতা ছেড়ে যখন চলে আসে, তখন রমলা প্রেগন্যান্ট ছিল।”
“মাই গুডনেস!” কর্নেল সােজা হয়ে বসলেন।
“রমলা পেটের বাচ্চাটা নষ্ট করেনি। মা তাকে রাজি করাতে পারেনি। শেষে সেই শােকে মা মারা গেল। বমলাকে আমি ভীষণ স্নেহ করতুম। তাই আমি ওকে কিছু বলিনি।”
তারপর কী হল, বলুন? “মলার একটি মেয়ে হল নার্সিংহােমে। জয়কে চিঠি লিখলুম। জয় অপমানজনক ভাষায় জবাব দিল যে রমলার সন্তান তার নয়। এমন কি লিখল মলাকে সে ঘৃণা করে।”
Read More