সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের কর্নেল সমগ্র ২য় খণ্ড এর অংশ-১৯

কর্নেল আস্তে বললেন, “যত শিগগির পারেন, বুদ্বুরামকে গ্রেফতার করুন।” “কে বুদ্বুরাম?” 

“এই রাজবাড়ির চাকর। আমার ধারণা, পুরনাে রেকর্ডে ওর পরিচয় থাকা সম্ভব।”

কর্নেল সমগ্র 

রাঘবেন্দ্র তার সঙ্গে আসা সাব-ইন্সপেক্টরের দিকে ইশারা করলেন। তখন কর্নেল দ্রুত বললেন, “বুরাম রাজবাড়িতে নেই। তাকে পাঠানাে হয়েছে বিপ্রদাসজির খোঁজে। আমার মনে হয়, এই সুযােগে আসলে সে গা ঢাকা দিয়েছে। তাকে খুঁজে বের করা দরকার।” 

সাব-ইন্সপেক্টর বেরিয়ে গেলেন সাঙ্গে সঙ্গে। রাঘবেন্দ্র কর্নেলের দিকে তাকালেন। কর্নেল বললেন, ‘আপনাদের রুটিন ওয়ার্কস শেষ হােক। তারপর কথা হবে।” 

একটু পরে অ্যামবুল্যান্স এল। ফোটোগ্রাফার এল। মর্গের লােকেরা এল। প্রাথমিক তদন্ত ও একে একে বাড়ির সবাইকে ডেকে স্টেটমেন্ট নেওয়া হল শুধু জয় আর নানকু বাদে। 

কর্নেল বললেন, “আপনার কলিগরা বাকি কাজ সেরে ফেলুন। ততক্ষণ আউটহাউসে বড়কুমার আর নানকুর স্টেটমেন্ট নেবেন চলুন মিঃ শর্মা।” 

দক্ষিণের বাগান আর পােড়ড়া জমি দিয়ে যাবার সময় ঠাকুরদালানের কাছে 

এতে কর্নেল দেখলেন, মাধবজি তার ঘরের ভেতর রান্না করতে বসেছেন। 

বেন্দ্র বললেন, “এখানে কে থাকে?” 

কর্নেল সমগ্র ২য় খণ্ড এর অংশ-১৯

কর্নেল দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। রাজবাড়ির ভেতর দেড়ঘণ্টা যাবৎ যে হুলুস্থুল চলেছে, মাধবজি নিশ্চয়ই টের পাননি। তাহলে এমন নিশ্চিন্তে বসে রান্না করতে পারতেন না। ছুটে যেতেন। 

আসলে লােকটিকে কেউ গণ্য করে না রাজবাড়ির একজন বলে। কর্নেল রাঘবেন্দ্রের প্রশ্নের জবাবে বললেন “মাধবজি এই ঠাকুরদালানের সেবায়েত। মিঃ শর্মা, উনি আপনার কেসের একজন শক্ত সাক্ষী।” 

“বলেন কী! তাহলে তাে আগে ওঁর সঙ্গেই কথা বলতে হয়।” 

কর্নেলের ডাকে মাধবজি বেরিয়েই ভড়কে গেলেন। কাপা কাপা স্বরে বললেন, “নমস্তে”। 

কর্নেল বললেন, “খবর খারাপ, মাধবজি। আপনি জানেন না কিছু?” মাধবজি ভাঙা গলায় বললেন, “বড়কুমারকে গ্রেফতার করেছেন, মালুম হচ্ছে।’ 

না। বিপ্রদাসজিকে কে খুন করে গেছে!” মাধবজি আর্তনাদের সুরে বললেন, “হায় ভগবান! কে এমন কাজ করল? অমন সাচ্চাদিল মানুষটাকে—তার হাতে কুষ্ঠব্যাধি হবে। আমি অভিশাপ দিচ্ছি!” 

নাক ঝেড়ে চোখ মুছে মাধবজি ফের বললেন, “হাম সমঝ লিয়া, হুজুর! আমি সব বুঝতে পেরেছি কেন বিপ্রদাসজিকে খুন করেছে।” 

“কেন মাধবজি ?”  “সেই অচেনা বে-পহচান লেড়কিকে খুন করার কথা বিপ্রদাসজি আর আমিই শুধু জানি। তাই প্রথমে বিপ্রদাসজিকে খুন করে মুখ বন্ধ করে দিল। এবার আমাকেভি খুন করবে। আমাকে আপনারা বাঁচান, হুজুর!” 

মাধবজি করজোড়ে কান্নাকাটি করতে থাকলেন। রাঘবেন্দ্র অবাক হয়ে বললেন, “মনে হচ্ছে, আরও একটা মার্ডারের ব্যাপার আছে এবং সেজন্যই আপনার এখানে আসা, কর্নেল ! 

কর্নেল সমগ্র ২য় খণ্ড এর অংশ-১৯

কর্নেল বললেন, “দ্যাটস এ লং স্টোরি, মিঃ শর্মা। একটু অপেক্ষা করুন।” বলে মাধবজির দিকে ঘুরলেন, “মাধবজি, হরটিলার শিবলিঙ্গের বেদিটা কীভাবে খােলা যায় আপনি তাে জানেন!” 

“জি হাঁ কর্নেলসাব! বিপ্রদাসজির কাছে চাবি ছিল। সেই চাবি দিয়ে খােলা যায়।” “ওই গােপন সিন্দুকটা—” বাধা দিয়ে মাধবজি বললেন, “ 

সিক নয় হুজুর, ওটা একটা পাতাল-খন্দক। ইদারার মতাে। নিচে পাতাল-গঙ্গা বইছে। আমি কেমন করে জানব বলুন? বিপ্রদাসজি বলেছিলেন। 

“বলেন কী! তাহলে তাে সেই লাশটা পাওয়া যাবে না?” 

না পাতাল গঙ্গায় গিয়ে পড়লেই তাে মাগঙ্গা ওকে টেনে নেবেন।” মাধবজি আবার ফোস ফোস করে নাক ঝেড়ে বললেন, “বিপ্রদাসজি বলেছিলেন, আগের আমলে রাজাবাহাদুররা দুশমন লােকেদের মেরে ওইখানে লাশ ফেলে দিতেন। কেউ জানতে পারত না।” 

কর্নেল পা বাড়িয়ে বললেন, “আপনি রান্না করুন নিশ্চিন্তে। আর কোনাে ভয় নেই আপনার। বিপ্রদাসজির খুনীকে ধরতে পুলিশ বেরিয়ে পড়েছে।” 

মাধবজি অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। কর্নেল বললেন, “মিঃ শৰ্মা, একটু ধৈর্য ধরুন। দ্যাটস এ লং স্টোরি।” 

আউটহাউসের দিকে যেতে যেতে কর্নেল ভাবছিলেন, বিপ্রদাসজি জয়াকে ডেকে ওই পাতাল-খন্দকের চাবি দেন। তার খুনী ওঁত পেতে বেড়াচ্ছিল তাকে খুন করার জন্য। ভাগলপুর যাচ্ছেন শােনামাত্র সে সুযােগ পেয়ে যায়। তখনই খুন করলে সে লাশ পাচারের জন্য একটা রাত্রি সময় পাবে। কলাবতী ঘরে ঝাড় দিতে ঢুকবে পরের দিন সকালে—সে জানে। রাত্রে লাশটা সরিয়ে ফেললে আর কেউ টের পাবে না কিছু। সবাই ভাববে, বিপ্রদাসজি ভাগলপুরে বােনের বাড়ি গেছেন এবং তারপর তার নিপাত্তা হওয়া নিয়ে পুলিশ অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াবে। 

কর্নেল সমগ্র ২য় খণ্ড এর অংশ-১৯

তাহলে সে জনত, লাশ নিপাত্তা করে দেওয়ার একটা চমৎকার জায়গা আছে এবং ওই হরটিলার শিবলিঙ্গের তলায় পাতাল-খন্দক। এমন কি সে আরও জানত জানত, বেদিটা ভােলার জন্য গােপন তালা ও চাবি আছে। বিজয় ও জয়ার সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, তারা এই পাতাল খন্দকের কথা জানে না। জানে তাদের ভাইবােনের মধ্যে একমাত্র জয়। কারণ জয় বলেছে, রমলার লাশ ওখানে লুকানাে আছে। কিন্তু জয় জানে না ওটা পাতাল-খন্দক। জানেন শুধু মাধবজি, আর জানাতেন বিপ্রদাসজি। তার চেয়ে বড় কথা, তার হত্যাকারী কে সেকথা ভালই জানতেন। 

: অতএব সে কি বিপ্রদাসজির অনুগত লােক? কিংবা দৈব|ৎ জানতে পেরেছিল? 

ঘটনাটা সাজানো যাক : খুনী ওঁত পেতে বেড়াচ্ছিল।জয়াকে বিসিজি চাবির কৌটোটা গােপনে দিচ্ছেন, তার নজর এড়ায়নি। জয়া সেটা নিয়ে ওপরে চলে গেলে সে বিপ্রদাসজির ঘরে ঢােকে। ওই সময় কর্নেল বিজয়কে নিয়ে গঙ্গার ধারে অন্ধ প্রজাপতি খুঁজে বেড়াচ্ছেন। বিপ্রদাসজির ঘরে ঢুকে হঠাৎ কর্নেলের মনে পড়ল, ও-ঘরেও জয়ার মতাে আবছা ক্লোরােফর্মের গন্ধ পাচ্ছিলেন। ঠিক তাই। খুনী প্রথমে ক্লোরােফর্মে বিপ্রদাসজিকে অজ্ঞান করে তারপর মাথায় শক্ত কিছুর আঘাত করে। খুলি ফেটে যায়। বডিটা খাটের তলায় ঢুকিয়ে পকেট হাতড়ে চাবি নিয়ে দরজায় তালা এঁটে সে ওপরে চলে যায়। জয়াকে অজ্ঞান করে চাবির কৌটো হাতিয়ে নেয়

। কাল বিকেলে হরটিলায় গিয়ে সে কি পরীক্ষা করে দেখছিল পাতাল-খন্দক আছে কি না? চাবিটা ভেঙে যায়। তারপর নল ও বিজয় গেলে সে লুকিয়ে পড়ে। হ্যা, কর্নেল তারই ছায়া দেখেছিলেন। সম্ভবত তার মতলব ছিল কর্নেলকেও খুন করাবে। সাহস পায়নি। রাতে জয় ও তার কুকুর পাহারা দিচ্ছিল। কাজেই সে ওখানে আর যেতে পারেনিনইলে বেদি ভেঙে ও বিপ্রদাসজির লাশ নিপাত্তা করে দিত।

 

Read More

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের কর্নেল সমগ্র ২য় খণ্ড এর অংশ-২১

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *