রাঘবেন্দ্র উঠে দাঁড়ালেন। “চলুন—দেখি ওদিকে কী হল।” টিলা থেকে নামার সময় বললেন, “এটাই আশ্চর্য লাগছে, বিজয় কেন আপনাকে ডেকে নিয়ে এল ? সে তাে জানে, আপনি রহস্যভেদী ধুরন্ধর মানুষ। আপনি জেনে ফেলবেন সব কথা। অথচ সে আপনাকে একটা বাজে অজুহাত দেখিয়ে নিয়ে এল।”
কর্নেল বাইনােকুলারে পাখি দেখছিলেন নামিয়ে বললেন, “কী বলছিলেন যেন।”
“বিজয় আপনাকে নিয়ে এল কেন? নিজেকে ধরিয়ে দেবার জন্য নিশ্চয়
নয়?”
“নিশ্চয় নয়। “তাহলে?”
কর্নেল আবার বললেন, “আগে বুদ্বুরামকে গ্রেফতার করুন। লেট হিম কনফেস।”
“কর্নেল ! তাহলে দুঃখের সঙ্গে বলব, রহস্যভেদী হিসেবে আপনি নিশ্চয় একজায়গায় এসে ব্যর্থ হয়েছেন।”
“ঠিকই বলেছেন মিঃ শর্মা!” কর্নেল শাস ফেলে অন্যমনস্কভাবে বললেন, “একটা জায়গায় এসে আমি সামনে দেয়াল দেখছি। আর এগােনাে যাচ্ছে না।”
“—সম্ভবত সেটা হল ঃ কেন বিজয় আপনাকে ডেকে আনল-এই তাে ?”
“ইউ আর এগেন ড্যাম রাইট।” বলে কর্নেল লম্বা পায়ে হঠাৎ জোরে হাঁটতে থাকলেন।
রাঘবেন্দ্র সঙ্গ ধরার চেষ্টা করে বললেন, “কেন হঠাৎ আপনি এমন উত্তেজিত হয়ে উঠলেন কর্নেল ?”
“শিগগির চলুন! রাজবাড়িতে আবার কী ঘটেছে মনে হচ্ছে?” উপসংহার । বিজয় তার ঘরের কড়িকাঠ থেকে ঝুলছিল। তার লেখার টেবিলে কবিতার খাতায় তার জবানবন্দী পাওয়া যায়। বিজয় লিখেছিল ?
কর্নেল সমগ্র ২য় খণ্ড এর অংশ-২১
“আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। জানি, আমার জন্য সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাবে জয়। জয়ার মনটা শক্ত। সে সহ্য করতে পারবে। জয়ের জনেই মরতে একটু দ্বিধা ছিল। নইলে ৯ই সেপ্টেম্বর রাতেই ঠিক করেছিলুম আমি মরব। পারিনি। শেষে শরদিন্দু খুন হল। তখন ঠিক করলাম, যে পাপ করেছি-জয়ের প্রতি বিশ্বাসভঙ্গের মহাপাপ, তার প্রায়শ্চিত্ত করার আগে অন্তত একটা ভাল কাজ করে যাই। জয়াকে জানয়ে দিই যে সতাি আমি রমলাকে খুন করিনি। শরদিন্দুর খুনী যে, সেই রমলার খুনী। কিন্তু জয়া আমার কথা যদি আর বিশ্বাস
করে! তাই কলকাতায় গিয়ে কর্নেল নীলাদ্রি সরকারকে নিয়ে এলাম। আমার বিশ্বাস ছিল, কর্নেল শরদিন্দুর মৃত্যুরহস্য ভেদ করলেই রমলার মৃত্যুরহস্য জেনে ফেলবেন এবং জয়কে জানিয়ে দেবেন যে বিজয় রমলাকে খুন করেনি-জয়ের ধারণাটাই ভুল। কিন্তু কর্নেলের দেখলুম পাখি-প্রজাপতির দিকে যত মন, আমার কাজটার দিকে তত নেই। ওয়ার্থলেস! আমি চাইছিলুম, উনি নিজের বুদ্ধির জোরে সব জেনে নিন। তাহলে জয়ের বিশ্বাস হবে। আমি বলেছি শুনলে জয় বিশ্বাস করবে না। কারণ জয়ের বিশ্বাস হারিয়েছি কলকাতায় থাকার সময়েই।
হা–আমার পাপের সুত্রপাত কলকাতায় থাকার সময়। রমলা আমাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে কোনাে তফাত বুঝতে পারত না প্রথম ম। শুধু চেহারার জনা নয়, জয় আমাকে রমলার ব্যাপারে কোনাে কথা লালন করত না বলেই। রমলা আমাকে জয় ভেবে সেইরকম ব্যবহার করত এবং আমি সেই সুযােগ নিতুম। জয়ের মেজাজ নকল করতুম। জয় ওর সঙ্গে মেলামেশার জন্য গােপনে ফ্রিল স্ট্রিটে একটা ঘর ভাড়া নিয়েছিল।
জয়ের অনুপস্থিতির সুয়ােগে রমলাকে সেখানে নিয়ে যেতুম। বিস্তারিত লেখার প্রয়ােজন দেখি না। এভাবেই চলছিল। কিন্তু জয় এবং রমলা দুজনেই ব্যাপারটা ধরে ফেলেছিল কিছুদিনের মধ্যেই। তারপর জয় আমার সঙ্গে ঝগড়া করে আর এম. এ.-তে ভর্তি হল না। কলকাতা ছেড়ে চলে গেল। তারপর আমি রমলাকে পাওয়ার চেষ্টা করেছিলুম। রমলা আমাকে ঘৃণায় প্রত্যাখ্যান করেছিল।
কর্নেল সমগ্র ২য় খণ্ড এর অংশ-২১
কিন্তু রমলাকে আমি ভালবেসে ফেলেছিলাম। তার কথা কিছুতেই ভুলতে পারিনি। তার নামে অসংখ্য কবিতা লিখেছি। সব রেখে যাচ্ছি। সে জয়ের প্রেমিকা, তাই আমারও প্রেমিকা। কারণ জয় আর আমি যে একই আত্মার দুটি অংশ। কেমন করে ভুলব রমলাকে ?
গত ৯ই সেপ্টেম্বর যখন জয় আমাকে জানাল, রমলার চিঠি এসেছে আজই সাড়ে ছটায় আপ দিল্লি এক্সপ্রেসে সে আসছে, আমি লােভে অস্থির হয়ে উঠলম। জয়ের জুতে গিয়ে সাপটার খাঁচা খুলে দিলাম। জানতুম, জয় সাপটাকে আগে না খুঁজে কোথাও যাবে না। রমলার চেয়েও ওর এই নেশাটা এখন বেশি। স্টেশনে রমলা আমাকে ভাল করে যাচাইয়ের চেষ্টা করছিল। কিন্তু তার চিঠিটা আমার কাছে। জয় আমাকে দিয়েছে সেটা। রমলা আমাকে জয় না ভেবে যাবে কোথায় ? ওকে মিথ্যা করে বললুম, এখন সরাসরি বাড়ি নিয়ে গেলে স্ক্যাণ্ডাল উঠবে রাজবাড়ির ব্যাপার।
তাই আপাতত আউটহাউসে যাই। কিন্তু জয়ের কথা ভেবে ওকে হরটিলার দিকে নিয়ে চললুম। আমনি রমলার সন্দেহ হল। সে টিলার নিচে গিয়ে বেঁকে দাঁড়াল। আমি তখন ওকে পাওয়ার জন্য উন্মাদ। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। নির্জন জঙ্গল। আমি ওকে জড়িয়ে ধরলুম। সে আমাকে চড় মারল। গালাগালি দিতে শুরু করল। জানাজানির ভয়ে আমি তখন ওকে ফেলে দৌড়ে পালিয়ে গেলুম। হঠকারিতায় এতখানি এগিয়ে আমার জ্ঞান ফিরে এসেছিল এতক্ষণে।
কর্নেল সমগ্র ২য় খণ্ড এর অংশ-২১
তারপর লজ্জায়, দুঃখে, অনুতাপে আমি আর বাড়ি থেকে বেরােইনি। প্রতিমুহূর্তে ভাবছি, জয় এসে আমাকে চার্জ করবে। কিন্তু জয়ের সাড়া নেই। রঙ্গিয়া খেতে ডাকতে এল। বললুম, “খাব না। শরীর ভালাে নেই।” রাত দশটায় হঠাৎ বুদ্বুরাম এসে সেলাম দিল। বললুম “কী চাই?” বুদ্ধরাম একটু হেসে বলল, “হরটিলার নিচের জঙ্গলে একটা লাশ পড়ে আছে।” চমকে বললুম, “কী বাজে কথা বলছিস হতভাগা ?” বুদ্ধ বলল যে, লাশটার কথা সে কাউকে বলবে না—যদি আমি তাকে একশাে টাকা দিই। থরথর করে কেঁপে উঠলুম। রমলাকে কি জয়ই রাগের বশে খুন করে ফেলেছে?
তবে সেই শুর হল বুদ্ধরামের ব্ল্যাকমেল করা। যখন-তখন সে টাকা দাবি করে। শুধু জয়ের কথা ভেবে মুখ বুজে থাকি। টাকা দিই। অবশেষে শরদিন্দুকে গােপনে ব্যাপারটা জানালুন। শরদিন্দু বলল, যে একজন প্রাইভেট ডিডেটিভ লাগিয়ে রমলার ডেডবডিটা উদ্ধার করে বুদ্বুকে সরিয়ে দেওয়া দরকার। কারণ তার বিশ্বাস খুনটা বুদ্ধই করেছে। অথচ মাধবজি আভাসে বলেছেন, হরটিলার নিচে একটা ডেডবডি পড়ে থাকতে দেখেছিলেন। বিপ্রদাসজিকে গােপনে বলে সেটা শুম করে দিয়েছেন। তার আগে জয়কে নাকি ওখান থেকে পালিয়ে আসতে দেখেছিলেন। শুনে আমি আরও ভয় পেয়ে গেলুম। শরদিন্দুই আমাকে কর্নেলের কথা বলেছিল।
Read More