১৩ সেপ্টেম্বর রাতে শরদিন্দু চিতাবাঘের হাতে মারা পড়ল। তখনও তলিয়ে কিছু ভাবিনি। পরদিন বুদ্ধ আবার টাকা চাইতে এসে বলল যে, সেই মেয়েটার ডেডবডি কোথায় পোঁতা আছে সে জানে। কাজেই তাকে দ্বিগুণ টাকা দিতে হবে।
তারপর আর দ্বিধা না করে কর্নেলের খােজে কলকাতা গেলুম। পাচদিন কলকাতায় থাকার পর তার ঠিকানা যােগাড় করা গেল। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকায় একটা খবর না পড়লে ঠিকানা যােগাড় করতে পারতুম না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কী লাভ হল ? উল্টে উনি আমাকেই সন্দেহ করে বসলেন। আমার ভয় হল, বুদ্ধরামের ব্ল্যাকমেলের কথা বললেই হয়তাে বুদ্বুরামকে গ্রেফতার করবেন এবং বুদ্ধরাম আমাকে অথবা জয়কে ফাসাবে।
মাধবজিও সাক্ষী দেবেন নিশ্চয়। তারপর কর্নেলের কথামতাে বুদ্বুরামকে ভাগলপুর পাঠানাের জন্য ডাকলুম। শয়তান বুদ্বুরাম বলল যে, আরও একটা ডেডবডির খোজ সে পেয়েছে। সেটা আছে বিপ্রদাসজির ঘরে। বডিটা না সামলালে কুমারসাবের বিপদ হবে। ওকে জিজ্ঞেস করলুম বডিটা কাকাবাবুর কি না। বুদ্ধ বলল যে তাই বটে। ভয় পেয়ে ওকে বললুম, “বড়িটা রাত্রেই সামলে দে। টাকা দিচ্ছি।” টাকা নিয়ে বুদ্ধ বলল, “নিশ্চিন্তে থাকুন ছােটোকুমারসাব। রাত্তিরেই সামলে দিব।”
কিন্তু সামলাতে পারেনি। হরটিলার শিবলিঙ্গের তলায় নাকি রমলার লাশ বিপ্রদাসজি লুকিয়ে ফেলেছেন। সকালে বুদ্ধ আমাকে সেকথা বলল। তারপর বলল, “বড়কুমারসাব কুকুর নিয়ে সারারাত পাহারায় ছিলেন। তাই লাশটা গুম করা গেল না।” বিপদ দেখে বললুম, “তুই কত পেলে চিরকালের জন্য রাজবাড়ি ছেড়ে চলে যাবি বল ?” বুদ্ধ পাঁচহাজার টাকা চাইল। ওকে তাই দিলুম। কবিতার বই ছাপানাের জন্য যে পাচহাজার টাকা ব্যাংকে আমার অ্যাকাউন্ট থেকে তুলে এনেছিলুম, তার সবটাই চলে গেল বুন্ধুর খপ্পরে।
কর্নেল সমগ্র ২য় খণ্ড এর অংশ-২২
দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকায় কর্নেলের ঠিকানার খোঁজে এক সাংবাদিক ভদ্রলােক—জয়ন্ত চৌধুরী বােধ করি তার নাম, হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ” ঘুঘুকে কী দরকার? রহস্যময় কিছু ঘটছে কি?” আমি বুড়াে ঘুঘু’ কথাটা শই প্রথম শুনি।
গতরাতে কর্নেলকে ইশারায় সজাগ করে দেবার জন্য ভূতের গল্প বলে একটা ছড়া উপহার দিয়েছিলুম বুড়াে ঘুঘুর নামে। এখন মনে হচ্ছে, উনি যদি আমাকে ছড়াটা নিয়ে জেরা শুরু করলে তাহলে রাতেই সব কথা বলে যেসতুম। উনি ছড়ার দিকে মনই দিলেন না। উল্টে জিগ্যেস করলেন, যে কবে থেকে আমি দাড়ি রাখছি। শুনেই বুঝলুম, রমলা ও শরদিন্দুর খুনের জন্য আমিই ওঁর সন্দেহভাজন। হায়, ওঁর সন্দেহ দূর করতে পারতেন হয়তাে কাবাবু। তিনি জানতেন বু আমাকে ব্ল্যাকমেল করছে। কারণ আভাসে আমাকে বলেছিলেন, “বুদ্ধকে প্রশ্রয় দিও না।”
কিছুক্ষণ আগে কাকাবাবুর ডেডবডি উদ্ধার করা হয়েছে। বুদ্ধরাম চলে গেছে। এবার আমি কর্নেলের হাতে বিপন্ন। খাল কেটে কুমির ঢুকিয়েছি। কী নির্বোধ আমি!
পুনশ্চ : জয়ের উদ্দেশে—জয়, তুই আর আমি একই আত্মার অংশ। আমরা যমজ ভাই। রমলার মেয়ে মিমি হয়তাে আমার, হয়তাে তাের—দুজনেরই কোনাে একজনের ঔরসে জন্ম নিয়েছে। মিমির মধ্যে একই আত্মার স্বাক্ষর আছে কি না ভেবে দেখিস। তুই ওকে মেনে নিস নিজের মেয়ে বলে। স্টেশন থেকে আসার পথে রমলা মিমির কথা বলেছিল আমাকে। আমার কী যে ইচ্ছে করছিল তাকে দেখতে। এ জীবনে তাে তাকে স্নেহ দিতে পারলুম না। তুই থাকলি আমার হয়ে ওকে স্নেহ দিতে। জয়, আমার এই শেষ ইচ্ছা কি তুই মেটাবি না? ইতি, হতভাগ্য বিজয়াদিত্য।”
কর্নেল সমগ্র ২য় খণ্ড এর অংশ-২২
সুন্দর বিভীষিকা আমার এই বৃদ্ধ বন্ধ কর্নেল নীলাদ্রি সরকার সম্পর্কে সব বলতে গেলে একখানা আঠারাে পর্ব মহাভারত হয়ে পড়ার ভয় আছে। আইন-আদালত সংক্রান্ত পত্র পত্রিকা এবং নানান জায়গায় পুলিশ জার্নালে যারা চোখ বুলিয়েছেন, তারাই জানেন লােকটা কে বা কী।
আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পুরনাে দলিল-দস্তাবেজ হাতড়ে যাঁরা যুদ্ধের ইতিহাস লিখতে চান, আফ্রিকা ও বর্মাফ্রন্টে মাঝে মাঝে এক যােদ্ধার উল্লেখ পাবেন—তার নাম কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। উনিশশাে বিয়াল্লিশে বর্মায় যে মার্কিন গেরিলাদলটি জাপানিদের পিছনে গিয়ে চোরাগােপ্তা লড়াই করেছিল,
তাদের রেকর্ডেও এই নাম পাওয়া যাবে। তখন উনি ছদ্মবেশে বর্মিদের গ্রামে থাকতেন এবং গেরিলাদলটিকে প্রচুর খবরাখবর যােগাতেন।
যুদ্ধ শেষ হল। তারপর একদা ভারতবর্ষ স্বাধীন হল। তারপর কর্নেল নীলাদ্রি সরকার অবসর নিলেন। এবার তার খ্যাতি ছড়াল প্রকৃতিবিদ হিসেবে। শিকারের নেশা বরাবর ছিল। সেই সুবাদে জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে উদ্ভিদ, পােকা মাকড় আর পাখি নিয়ে খোজখবর করনে। অবসর নেবার পর এটাই হয়ে দাঁড়াল একটা বড় নেশা। দেশবিদেশের পত্রপত্রিকায় এসব ব্যাপারে প্রবন্ধ লিখতেন। বিজ্ঞানীদের তাক লাগিয়ে দিতেন। অনেক তর্কবিতর্ক হত। কর্নেল নীলাদ্রি সরকার তাদের সরজমিনে নিয়ে গিয়ে নিজের প্রতিপাদ্য বিষয় প্রমাণ করে ছাড়তেন-এমনি জেদী মানুষ তিনি।
তখন অবশ্য আমার সঙ্গে পরিচয় ছিল না। হবার কথাও না। আমি কলকাতার এক প্রখ্যাত দৈনিক কাগজের রিপাের্টার। কাজের সূত্রেই এমন এক সাংঘাতিক ঘটনার মুখােমুখি গিয়ে পড়লুম, যার পরিণামে নিজেরই প্রাণ বাঁচানাে কঠিন হয়ে পড়ল এবং কর্নেল ভদ্রলােকের সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেল।
কর্নেল সমগ্র ২য় খণ্ড এর অংশ-২২
সে ছিল একটা আন্তর্জাতিক গুপ্তচর চক্রের ব্যাপার। স্থানীয় এক প্রখ্যাত রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে তাদের যােগসাজশ ছিল। সেটা দৈবাৎ আমি আবিষ্কার করি এবং আমার সহকর্মী এক ফটোগ্রাফার খুন হয়ে যায়। আমাকেও শাসানাে হয়। পুলিশ খুব একটা সুবিধে করতে পারছিল না। কারণ এই নেতার প্রভাব ছিল প্রচণ্ড। অথচ আমার কাছে তেমন কোনাে প্রমাণ ছিল না। যেটুকু ছিল, তা ফটোগ্রাফার বন্ধুটির ক্যামেরার মধ্যে ফিল্মে। সে খুন হবার সময় ফিল্মটাও খুনীরা হাতিয়ে নেয়।
যাই হােক, পুলিশ যখন খুনটা নিয়ে তদন্ত চালাচ্ছে, তখনই প্রথম কর্নেলের নাম আমি শুনি। প্রথমে ভেবেছিলুম, উনি কোনাে গােয়েন্দা অফিসার। পরে জানলুম, না—শৌখিন গােয়েন্দা। কিন্তু পুলিশ মহলে ওঁর সুনাম প্রচণ্ড। শেষ অব্দি কর্নেলের সহায়তায় আন্তর্জাতিক গুপ্তচরচক্র ধরা পড়ল এবং সেই রাজনৈতিক নেতাকেও পাকড়াও করা হল। আমাদের কাগজের বিক্ৰিসংখ্যা দু’লাখ থেকে রাতারাতি তিন লাখে দাঁড়াল। কর্নেলের নাম এবার সাধারণ মানুষও জানতে পারল।
এবং দেখতে দেখতে আমিও ওঁর ন্যাওটা হয়ে উঠলুম। | ঠিক কবে থেকে এবং হঠাৎ কীভাবে উনি গােয়েন্দা হয়ে উঠলেন, আমাকে খুলে বলেননি। প্রশ্ন করলে রহস্যময় হেসেছেন শুধু। তবে আমিও পুঁদে রিপাের্টার। আবছা অনুমান করেছি—অন্তত কীভাবে উনি ঘুঘু গােয়েন্দা হয়ে গেলেন।
প্রকৃতিবিদের পক্ষে সেটা মােটেও অস্বাভাবিক নয়। পােকামাকড়ের আচরণ পর্যবেক্ষণ কিংবা দুর্লভ জাতের পাখির পিছনে ঘুরে বেড়ানােতে তাদের প্রায় গােয়েন্দাগিরিই করতে হয়। কত সময় যায়, কত ধূর্তামির দরকার হয় এসব কাজে, কহতব্য নয়।
Read More