ফোনটা দেখে আশ্বস্ত হলাম। তারপর বললুম—আমার ব্যাপার নিয়ে আপাতত আর কিছু বলতে চাইনে, কারণ, মনে হচ্ছে বিপদ আপনারাই বেশি। কী হয়েছে বলবেন কি? আর ইয়ে আপনার পরিচয় এখনও আমি পাইনি কিন্তু!
যুবতী সােফার অন্যদিকটায় বসে পড়লেন। তারপর আস্তে আস্তে বললেন দেখতেই তাে পাচ্ছেন, আমি এ বাড়ির একজন মানুষ। আমার নাম মিসেস আরাধনা সিং। এটা আমাদের শৈলাবাস বলতে পারেন। মাধ্যে মধ্যে স্বামীর সঙ্গে এখানে এসে থাকি।
বাধা দিয়ে বললুম-কিন্তু আপনি এখন একা কেন?
একটু ইতস্তত করার পর আরাধনা বললেন—আপনি একজন সাংবাদিক জেনেই আমার সাহস হল। সব কথা খুলে বলতে কোনাে সংকোচের কারণ দেখছিনে। মিঃ চৌধুরী, আপনি শিলিগুড়ির বিখ্যাত টিম্বার মার্চেন্ট মিঃ শৈলেশ সিংয়ের নাম কি শােনেননি? সেই যে একবার নিউজপৈপারে ওঁর নামে খবর বেরিয়েছিল।
তক্ষুনি মনে পড়ে গেল। শৈলেশ সিং গতবছর নিজের জীবন বিপন্ন করে এক আন্তর্জাতিক স্মাগলিং র্যারেট পুলিশকে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। জনসাধারণ খবরের কাগজে এই অমিতসাহসী নেপালি ভদ্রলােকের কীর্তিকাহিনী কয়েকটি কিস্তিতে পড়েছিল। সেই শৈলেশ সিং! আর ইনি তাঁর স্ত্রী? অবাক হলুম। কাগজে মিঃ সিংয়ের ছবি দেখেছিলুম মনে আছে। কিন্তু তিনি তাে প্রৌঢ়! আর আরাধনা সিংয়ের বয়স বড় জোর তেইশ থেকে পঁচিশের মধ্যে হবে। শুধু বললাম—কী আশ্চর্য!
কর্নেল সমগ্র ২য় খণ্ড এর অংশ-২৪
আরাধনা বললেন-“আশ্চর্য নয়, ব্যাপারটা খুবই স্বাভাবিক। যে র্যাকেট উনি ওতে সাহায্য করেছিলেন, তার সব লোেক মােটেও ধরা পড়েনি। তারাই সেই থেকে ওঁর পিছনে লেগে আছে। অনেকবার একটুর জন্যে প্রাণে বেঁচে গেছেন। যেমন আজকের ঘটনা।
ওঁকে থামতে দেখে বললুম—থামবেন না প্লিজ, বলে যান।
আরাধনা এরপর যা বললেন, শুনে আতঙ্কে শরীর কাঠ হয়ে গেল। হাত ঘেমে রাইফেলটা পিচ্ছিল হয়ে উঠল।…
ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ হচ্ছে এই ঃ শৈলাবাসটা ক’মাস আগে শৈলেশ কিনেছেন। একজন বিদেশি প্ল্যান্টার ছিলেন এটার মালিক। অনেক খরচা করে একটা ফোন ও ইলেকট্রিক লাইনও টেনে এনেছিলেন বাড়িটা অব্দি। যাই হােক, নির্জন পাহাড়ী জঙ্গলে সভ্যতার সবরকম সুখসুবিধা এখানে রয়েছে। কেনার পর মাঝে মাঝে স্ত্রীকে নিয়ে শৈলেশ এখানে এসে কাটিয়ে যান। সঙ্গে আরাে দুজন আসে-পরিচারিকা লতা আর বাবুর্চি-কাম-ভৃত্য রঘুবীর। এবার এসেছেন গতকাল বিকেলে। একটা লান্ডমাস্টার গাড়ি করেই শৈলেশ এখানে আসেন।
..আজ বিকেলে, তখন বেলা আড়াইটে—আচমকা একটা জিপ আসে। তারপর জনাচার সশস্ত্র লােক জিপ থেকে দৌড়ে আসছে দেখে এরা দরজা বন্ধ করে দেন। শৈলেশ জানালার ফাঁক দিয়ে রিভলবারের গুলি ছােড়েন। তারাও কয়েকবার গুলি ছােড়ে। দেয়ালে লাগে। তারা দরজা ভাঙার চেষ্টা করে। কিন্তু পারে না। তখন তারা বারান্দার ইলেকট্রিক লাইন আর ফোন লাইনটা কেটে রেখে চলে যায়।
কর্নেল সমগ্র ২য় খণ্ড এর অংশ-২৪
…ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করার পর শৈলেশ দরজা খােলেন। কিন্তু সবচেয়ে অবাক কাণ্ড, ওদিকের ঘরে লতা আর রঘুবীর ছিল, তাদের কোনাে পাত্তা নেই। তাহলে কি ওদের তারা খুন করে গেল ? অনেক খোঁজাখুঁজি করেও কোনাে পাত্তা পাওয়া গেল না। তখন শৈলেশ হীরাকুণ্ডা থানায় যাবেন বলে পিছনের গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করলেন। আরাধনা অবাক হলেন দেখে যে স্বামী তাকে ফেলে পাগলের মতো একা গাড়ি নিয়ে চলে গেলেন।
…আরাধনা গাড়ির পেছনে-পেছনে কিছুদুর ছুটে যান এবং চেঁচামেচি করেন। কিন্তু শৈলেশকে যেন ভূতে পেয়েছিল। একা এই জঙ্গলে অসহায় স্ত্রীকে ফেলে রেখে চলে গেলেন।
…..আরাধনা অগতা কী আর করেন। প্রতিমুহূর্তে স্বামীর ফেরার প্রতীক্ষায় কাটাচ্ছেন। অথচ ভদ্রলোেক এখনও ফিরলেন না…
ঘটনাটা শুনে কিছুক্ষণ আতঙ্কে চুপচাপ থাকার পর আমি শুধু বললুম— আশ্চর্য তাে! মিঃ সিং আপনাকে এমনি করে একা ফেলে রেখে গেলেন ?
আরাধনা করুণ মুখে বললেন—উনি বরাবর ওইরকম খামখেয়ালি আর গোঁয়ার। ঝোক উঠলে দেবতাদেরও সাধ্য নেই ওঁকে কেউ ম্যানেজ করে ।
—কিন্তু আপনাকে একা ফেলে বলে আমি ওর মুখের দিকে তাকালুম।। আরাধনার চোখে জল দেখা যাচ্ছিল। এবার দুহাতে মুখ ঢেকে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলেন—আমার ওপর ওঁর তাে কোন মায়া-মমতা নেই মিঃ চৌধুরী। আমি ওর শখের পােশ জানােয়ার মাত্র। আপনি জানেন না, আমি কীভাবে কাটাচ্ছি।
বুঝলুম, ভদ্রমহিলা এবার আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না। নার্ভের ওপর প্রচণ্ড চাপ গেছে, এবার তার বিস্ফোরণ ঘটছে। তাই দাম্পত্য সম্পর্কের ভেতরের ব্যাপারটা বেরিয়ে পড়ছে। সেটাই তাে স্বাভাবিক। একজন ধনী প্রৌঢ় তাঁর মেয়ের বয়সী এক মহিলাকে নিতান্ত শখ অথবা স্রেফ উপভােগ ছাড়া আর কেনই বা বিয়ে করবেন ? কিন্তু যে মানুষ অমন দেশপ্রেমিক তিনি একটু মানবপ্রেমিক হলে কী ক্ষতি ছিল?
কর্নেল সমগ্র ২য় খণ্ড এর অংশ-২৪
আরাধনা মুখ নামিয়ে হু-হু করে কাঁদছেন। কী বলে সান্ত্বনা দেব, ভেবে পেলুম না। কর্নেল বুড়াে এখন পাশে থাকলে চমৎকার ম্যানেজ করতে পারতেন। তিনিই বা কোথায় উধাও হয়ে রইলেন ?
চুপচাপ বসে ঐ কান্না শােনা কঠিন। তাই সান্ত্বনা দিয়ে বললুম-মিসেস সিং। প্লিজ! এ অবস্থায় কেঁদে শুধু মনােবল হারানাে। আপনি শান্ত হােন! আমি যখন এসে পড়েছি, তখন কোনাে চিন্তা করবেন না।
আমার কথা শুনে মুখ তুললেন আরাধনা। কোখেকে রুমাল বের করে চোখ মুছে শান্তভাবে বললেন, আপনাকে ভগবান আমার জন্যে পাঠিয়েছেন মিঃ চৌধুরী। এতক্ষণ আপনি না এলে আমি নিশ্চয় আত্মহত্যা করে বসতুম!
ব্যস্তভাবে একটা কিছু বলতে যাচ্ছি, হঠাৎ বাইরে বাতাসের শনশন শব্দ শােনা গেল। তারপর একমাত্র খােলা জানালাটা জোরে নড়ে উঠল। (ওই জানলাটা খুলে রাখার কারণ যে বাইরের কোনাে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা, তা ততক্ষণে বেশ টের পেয়ে গেছি।) আরাধনা দ্রুত উঠে গিয়ে জানালা বন্ধ করে দিলেন। তারপর বললেন—প্রতিদিন সন্ধ্যার পর আজকাল ওই ঝড়টা ওঠে। পাহাড়া আবহাওয়া বড় খামখেয়ালি! দেখুন না, হয়তো বৃষ্টি শুরু হবে।
কর্নেল সমগ্র ২য় খণ্ড এর অংশ-২৪
বাইরে চাপা শনশন শব্দটা বাড়তে শােনা যাচ্ছিল। কর্নেলের জন্যে এবার উদ্বেগ জাগল মনে। বেঘােরে প্রাণ খােয়ালেন না তাে হটকারি গােয়েন্দাবর ? এইসব পাহাড়ী ঝড়বৃষ্টি যে কী সাংঘাতিক, তাও তাে ওর অজানা নয়। সেপ্টেম্বর মাসে একটু বৃষ্টিতেই পাহাড়ে বড় বড় ধস নামে। আমার শরীর আবার শিউরে উঠল।
আরাধনা তখন সামলে উঠেছেন। অনেকটা সপ্রতিভ দেখাচ্ছে ওকে। বললেন—কিচেন আর ডাইনিং বারান্দার ওপাশে। সেই লাঞ্চের পর এখনও একফোটা চা বা কফি খাওয়া হয়নি। মিঃ চৌধুরী কীভাবে মাননীয় অতিথির সৎকার করব, জানি না।
আমরা পরস্পর ইংরিজিতেই কথা বলছি। আরাধনার মুখের গড়নে পর্বতকন্যার আদল। মিশনারিদের দৌলতে বহুকাল আগে এসব পাহাড়ে সভ্যতা ও ইংরিজি ঢুকে পড়েছে। কিন্তু আরাধনার ইংরিজিতে বিলিতিয়ানার ছাপ এত স্পষ্ট যে মনে হল নির্ঘাত কনভেন্টে পড়া মেয়ে। আমার ইংরিজি এদিকে এমন ভারতীয়, কহতব্য নয়।।
Read More