সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের কর্নেল সমগ্র ২য় খণ্ড এর অংশ-২৫

ওঁর কথা শুনে চাকফির নেশা মাথায় চড়ে। গেল। ব্যস্ত হয়ে উঠে বললাম—আপনি যদি অনুমতি দেন, তাহলে কিচেনে গিয়ে অনায়াসে চা কফির ব্যবস্থা করা যায়। 

আরাধনার মুখে এতক্ষণে হাসি ফুটল। বললেন—হ্যা, আপনার কাছে অস্ত্রশস্ত্র আছে। আর আমার ভয় করার কিছুই নেই। চলুন, যাওয়া যাক।

কর্নেল সমগ্র 

বলে হঠাৎ ঘুরে একটা টেবিলের দিকে এগােলেন আরাধনা-এক মিনিট। মােমবাতি নিই। কারেন্ট বন্ধ হলে এগুলাে কাজে লাগে। তাই রাখা আছে। 

দরজা খুলে বেরােলুম দুজনে। মধ্যেকার দশফুট বাই পনের ফুট খােলা বারান্দামতাে জায়গায় পা দিতেই ঝড়ের ধাক্কা লাগল শরীরে। টর্চ জ্বেলে দেখলুম, ওপাশের ঘর অর্থাং ডাইনিংকাম-কিচেনের দরজা বাইরে থেকে শুধু আটকানাে আছে মাত্র। 

আরাধনা ততক্ষণে আলােকিত বেডরুমের দরজাটা লক কার দিয়েছেন। মহিলা বুদ্ধিমতী কোনাে সন্দেহ নেই। 

ডাইনিং ঘরটা বেডরুমের ডবল। ওপাশে কিচেন ও কাউন্টার। গ্যাসলাইনও রয়েছে দেখলুম। আরাধনা উনুনটা পরীক্ষা করে দেখে বললেন–ঠিক আছে। গ্যাসলাইনটা ওরা নষ্ট করে যায়নি। | আমি ডাইনিং টেবিলে মােমবাতির সামনে আরাম করে বসলুম। গ্যাসের মীল আগুনে আরাধনা কেটলি চড়িয়ে দিলেন। তারপর কাববাের্ড খুলে কাজে ব্যস্ত হলেন।

কর্নেল সমগ্র ২য় খণ্ড এর অংশ-২৫

মােটামুটি ডিনারও খাওয়া যাবে—এই আশায় উৎফুল্ল হয়ে আমি কর্নেল ও সব বিপদের কথা বেমালুম ভুলে গেলুম, আর ঠিক তখনই জোর বৃষ্টির শব্দ কানে এল। ছাদের ওপর দড়বড় করে প্রচণ্ড বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। তারপর কাছাকাছি বাজ পড়ল। তারপরই শুরু হল মেঘগর্জন। বাড়িটা ৩ই তুমুল প্রাকৃতিক তাণ্ডবে কেঁপে কেঁপে উঠতে থাকল। | কর্নেল গােল্লায় যাক—মনে মনে একথা বলে টেবিলে রাখা রাইফেলটা তুলে একবার দেখে নিলুম তৈরি আছে কি না। তারপর তাকালুম আরাধনার দিকে। র মুখের একটা পাশে মােমের আলাে পড়েছে। ফরসা নিটোল গাল আর 

টের অংশ দেখা যাচ্ছে। গাউনের কিছুটা সরে ওঁর বুকের একটা দিকও oাখে পড়ছে। মনে হল, ব্রেসিয়ার পরেন না আরাধনা। আজকাল এ ফ্যাশান দেশে চালু হয়েছে—যদিও আমাদের গ্রামের মেয়েরা এবং আগের দিনে তাে নেককেই, দারিদ্র্য শ্রম ইত্যাদি কারণে ব্রেসিয়ার পরতেন না। আরাধনার 

দৈহিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হলুম। সেই সময় উনি ঘুরে আমার দিকে তাকালেন। মিষ্টি হেসে বললেন—একই সঙ্গে অল্পস্বল্প ডিনারটাও সেরে নেওয়া যাক। কী বলেন? 

সানন্দে জবাব দিলুম—অবশাই। 

এরপর টেবিলে কয়েক প্রস্থ খাবার এল এবং তার ফাঁকে ফাঁকে কথা চলতে থাকল দুজনের। 

—মিঃ চৌধুরী কি বিবাহিত ? 

না। 

কবে বিয়ে করবেন ? —ভেবে দেখিনি। 

কর্নেল সমগ্র ২য় খণ্ড এর অংশ-২৫

ঝড়টা একটু কমেছে মনে হচ্ছে না? মনে হচ্ছে! বৃষ্টি কিন্তু জোর হচ্ছে। নির্ঘাত ধস ছাড়বে সবখানে। -যা বলেছেন। 

—মিঃ চৌধুরী, তার মানে আমরা একেবারে বাইরে থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ব! বুঝতে পারছেন? যাবজ্জীবন দ্বীপশুর কিন্তু! (হাসি) 

সর্বনাশ! 

—সর্বনাশের কী আছে? আমার ভাড়ারে প্রচুর খাবার আছে। আর মদিনী হিসাবে নিশ্চয় আমি খুব একটা অযােগ্য নই ? 

—মােটেও না, মােটেও না! (নার্ভাস হয়ে হাসছিলুম) —আজকের রাতটা কিন্তু আপনাকে একটা বড় কাজ দেব। —নিশ্চয়ই তাে! ঠিকই তাে! —আপনার স্মার্টনেসটা কিন্তু চলে গেছে মিঃ চৌধুরী। —ও, হ্যা। মানে আমি ব্যাপারটা ভাবছি! 

কী ব্যাপার ? —আপনার এই বিপদ। ওদিকে আমার সেই কর্নেল ভদ্রলােক… —ধরে নিন না, আমরা ধসের ফলে বিচ্ছিন্ন। কিছু করার নেই। —তা যা বলেছেন। —ওকি! আপনি তাে কিছু খাচ্ছেন না। -না, না। খাচ্ছি তাে! 

—খান। মাঝে মাঝে আমাদের ভীষণ স্বার্থপর হয়ে যাওয়া ভালাে। এতে এক রকম স্যাডিজম আছে।। 

—নিশ্চয়, নিশ্চয়! 

এই সময় বাড়ির কাছাকাছি কোথাও ভয়ঙ্কর শব্দে বাজ পড়ল। আর সঙ্গে সঙ্গে আরাধনা ছিটকে সামনের চেয়ার থেকে চলে এসে আমার পাশে 

শসলেন। তারপর টেবিলে মুখ রেখে ঝুঁকে পড়লেন। আঁতকে উঠলুম। ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলেন নাকি? দুহাতে ওর কাধ ধরে ঝাঁকুনি দিলুম—মিসেস সিং। মিসেস সিং। 

আরাধনা সােজা হয়ে বসে কড়া চোখে বললেন—কে মিসেস সিং? আমি আরাধনা—জাস্ট এ লােনলি গার্ল! আমার কেউ নেই, কিছু নেই। 

ওরে বাবা! এ যে যথার্থ হিস্টিরিয়ার লক্ষণ। ভদ্রমহিলা অমন ভয়ানক ঘটনার পর নিশ্চয় তলে তলে মানসিক বিকৃতিতে ভুগছিলেন—এবার সেই বিকৃতিটা আত্মপ্রকাশ করেছে, তাতে কোনাে ভুল নেই। আমি ওর পিঠে হাত রেখে বললুম-আপনি নিশ্চয় অসুস্থ বােধ করছেন।

কর্নেল সমগ্র ২য় খণ্ড এর অংশ-২৫

 করছি। প্লিজ, আমাকে ওঘরে নিয়ে চলুন। এমন ক্লান্ত বিপন্ন কণ্ঠস্বরে অভিভূত হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। কিন্তু ওঁর খাদ্য অধভুক্ত পড়ে রইল যে! 

অগত্যা ওকে সাহায্য করতে হাত বাড়ালুম। কিন্তু একেবারে অবশ শরীরে আমার কাঁধে ভেঙে পড়লেন। তারপর দেখি, গড়িয়ে পড়ছেন, তখন ওঁকে তুলে নিয়ে গিয়ে কোনার একটা সােফায় শুইয়ে দিলুম। চোখ বুজে পড়ে ইলেন। টেবিল থেকে জলের গ্লাস নিয়ে যেই কাছে গেছি, উনি চোখ ললেন। তারপর বললেন 

—আমি কোথায় ? —আপনারই বাড়িতে। মানে…. আরাধনা আমাকে কথা বলতে দিলেন না। একটা হাত বাড়িয়ে রােগা আদুরে গলায় বললেন—আপনি আমাকে ধরে রাখুন না প্লিজ। বড় ভয় করছে। 

আহা বেচারা! মায়ায় গলে গিয়ে এবং লােভে তাে বটেই আরাধনার মাথাটা তুলে আমার উরুর ওপর রাখলুম। কোনাে আপত্তি এল না। বরং এবার মিঠে কুম হল—কপালে হাত বুলিয়ে দিন না প্লিজ! | আড়ষ্ট ও কাপ হাতে ওঁর সুন্দর কপালে হাত বুলােতে থাকলুম। বাইরে ঝড়বৃষ্টি তখনও থামেনি। মাঝে মাঝে মেঘ ডাকছে। বাড়িটা কেঁপে উঠছে। জীবনে এমন অদ্ভুত রাত আর একটাও আসেনি।

 

Read More.

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের কর্নেল সমগ্র ২য় খণ্ড এর অংশ-২৬

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *