সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের কর্নেল সমগ্র ২য় খণ্ড এর অংশ-২৬

হঠাৎ আরাধনা এক কাণ্ড করে বসলেন। দুহাত নিজের মাথার উপর দিয়ে বাড়িয়ে আমার গলা আঁকড়ে ধরলেন। তারপর আমার মাথাটা টেনে নামালেন। তারপরই আমার ঠোট দুটো নিজের ঠোটে চেপে ধরলেন। চুমু খাওয়া—বিশেষ করে এই আশ্চর্য সুন্দরী যুবতীর ঠোটের চুমু, নিশ্চয় এক দুর্লভ সৌভাগ্য ; কিন্তু মানসিক প্রস্তুতি না থাকায় ব্যাপারটা আমাকে হতচকিত করে ফেলল। আরাধনা কিন্তু পাগলের মতাে আমার ঠোটটা দিয়ে কেলেঙ্কারি শুরু করেছেন ততক্ষণে।

কর্নেল সমগ্র 

তার ফলে অনিবার্যভাবে শারীরিক উত্তাপ জাগছিল আমার। একটু পরে  

আরাধনা ধনুকের মত বৌকে আমার দিকে ঘুরলেন এবং উঠে বসলেন। তারপর বুকে মাথা গুজে হিপিয়ে হিপিয়ে কাঁদতে শুরু করলেন। এতক্ষণে আমার ভুলটা ভাঙল। | না—এ কোনাে অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। এক অতৃপ্ত যুবতী, স্বামী প্রৌঢ় ও গোঁয়ার, আজকের এই মারাত্মক ঘটনা, তারপর এই নির্জন পরিবেশে আমার মতাে এক রাইফেলধারী যুবক—এই উপাদানগুলাে মিলেমিশে যা ঘটা উচিত তাই ঘটেছে। বন্যায় ভেসে যেতে একটুকরাে খড়কুটো পেলেই তা আঁকড়ে ধরা মানুষের স্বভাব। 

কর্নেল সমগ্র ২য় খণ্ড এর অংশ-২৬

আমি পরম স্নেহ ও প্রেমে ওর মুখটা দুহাতে তুলে একটি এক মিনিটের চুমু দেওয়ার পর বললুম—আরাধনা লক্ষ্মীটি, শান্ত হও। চলাে আমরা কফিটা নিয়ে বরং বেডরুমে যাই। 

আরাধনা উঠল। এখন সে আমার প্রেমিকা ছাড়া আর কী! কফির ট্রে নিয়ে আমরা দুজনে বেডরুমে ফিরে গেলুম। দরজাটা ভেতর থেকে আটকানাে হল। 

সেফায় পাশাপাশি এবার দুজনে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে কফি খাচ্ছি, হঠাৎ আরাধনা বলল—চৌধুরী, আমি কিন্তু তােমার সঙ্গে কলকাতা যেতে চাই। 

বললুম-বেশ তাে। 

—বেশ তাে নয়। কথা দাও, আমাকে নিয়ে যাবে! 

দিলুম। 

—এই শৈলেশ লােকটা নিজেই আসলে সেই স্মাগলিং র্যাকেটের অন্যতম নেতা, চৌধুরী তােমাকে জানিয়ে দিচ্ছি। ওর বিশ্বাসঘাতকতায় এখন দলের বাকি লােকেরা—যারা ফেরারী হয়েছিল, প্রতিশােধ নিতে খেপে গেছে। আমি এই শয়তানের পাল্লায় পড়ে শেষ হয়ে গেছি। আমাকে বাঁচাও, তুমি। 

—তা আর বলতে? তবে কর্নেল… 

কর্নেল সমগ্র ২য় খণ্ড এর অংশ-২৬

-ড্যাম ইওর কর্নেল। আমি তােমাকে ভালবেসে ফেলেছি চৌধুরী তােমাকে দেখামাত্র টের পেয়েছি, সারাজীবন যাকে খুঁজছি, সে এই! তুমি আমাকে ফেলে যাবে না তাে? 

—পাগল! আমিও তােমাকে ভালবেসে ফেলেছি আরাধনা। -ওঃ চৌধুরী! কা ফাইন ছেলে তুমি! চলাে, এবার শুয়ে পড়া যাক। হ্যা, বিছানায় যাবার জন্য তখন আমি খুব ব্যস্ত। তবে আসল কারণ, কেন হঠাৎ যেন ঘুম পাচ্ছে। কিন্তু সবে সে আমার হাত ধরে বিছানায় টেনে নিয়ে গেছে, আমি প্যান্ট-শার্ট খুলতে শুরু করেছি, হঠাৎ বাইরে ঝড় বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে গাড়ির শব্দ শােনা গেল। আরাধনার মুখে চমক লক্ষ্য করলাম। তারপরই কাদের পায়ের ধুপ-ধুপ শব্দ ভাসল কাঠের পাটাতনে। এবং দরজায় ধাক্কা পড়ল। কে ভারী গলায় ডাকতে থাকল-আরাধনা! দরজা খােল! 

আরাধনা আমার দিকে ইশারা করল—-চুপ! 

সে কী! নিশ্চয় ওটা মিঃ সিংয়ের গলার আওয়াজ। আমি ব্যস্তভাবে চাপা নালায় বললাম–তােমার স্বামী এসেছেন যে! 

আরাধনা ফিসফিস করে বলল-আমার স্বামীর গলা আমি চিনি। ও অন্য ৬। কক্ষনাে দরজা খুলবে না। বরং তুমি জানলার ফাক দিয়ে একবার গুলি ৬ জানিয়ে দাও যে আমরা নিরস্ত্র নই। 

দরজায় দমাদম কয়েক জোড়া পায়ের লাথি পড়তে শুরু করেছে ততক্ষণে। জাটা ভেঙে যাবে মনে হল। ওরা যেই হােক, ঘরে এলে সকলে আমাকে 

য়েই পড়বে তাতে কোনাে ভুল নেই। অতএব আমি একলাফে জানালা ফঁক শবেই রাইফেলের তিনটে গুলি পর পর ছুড়ে বসলুম। আওয়াজ হল প্রচণ্ড এবং তক্ষুনি লাথি-মারা বন্ধ হল। বাইরে চাপা স্বরে ওরা কথা বলছে। আমি শকি দুটো গুলিও ঝােকের বশে জানালা দিয়ে ছুড়লুম। তারপর পকেট থেকে আবার পাঁচটা কার্তুজ বের করে রাইফেলটা তৈরি রাখলাম। 

কর্নেল সমগ্র ২য় খণ্ড এর অংশ-২৬

 আর কোনাে আওয়াজ নেই এবার। সাবধানে জানলা ফাঁক করে পর্দার একটুখানি তুলে দেখি, সম্ভবত জনা তিন লােক দৌড়ে গেটের ওপাশে চলে গেল। তারপর গাড়ির আলাে জ্বলে উঠল। গাড়িটা তক্ষুনি বৃষ্টির মধ্যে জঙ্গলের দিকে নেমে যেতে দেখলুম। ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। ঘুরে দেখি, আরাধনার ভুরু দুটো কুঁচকে রয়েছে। আমার চোখে চোখ পড়ামাত্রা সে হেসে উঠল—চমৎকার শিক্ষা হয়েছে। আর ওরা হামলা করতে আসবে না। এসসা, শুয়ে পড়া যাক। 

এই রহস্যময়ী যুবতীর পাশে রাত কাটানাে এবং বিপদের সম্ভাবনা—দুইয়ে মিলে আমাকে নিশ্চয় উদ্বিগ্ন দেখাল। কিন্তু শেষ অব্দি ঘুমে চোখের পাতা জড়িয়ে এল। আর বাগ মানাতে পারলুম না। শােয়র সঙ্গে সঙ্গে মনে হল, আমি কোন পাতলে তলিয়ে যাচ্ছি। পাশের সঙ্গিনীকে আঁকড়ে ধরতে চাইলাম কিন্তু তাকে যেন খুঁজেই পেলুম না। 

| চোখ খুলে দেখি ঘরভরা আলাে। অভ্যাসমতাে ঘড়ি দেখলুম সাড়ে আটটা! কী প্রচও না ঘুমিয়েছি। তারপর সব মনে পড়ল। হুড়মুড় করে উঠে বসলুম। ঘরে কী একটা তীব্র গন্ধ। পাশে আরাধনা নেই। ডাকলুম তাকে। কিন্তু কোনাে সাড়া পেলুম না। উঠে গিয়ে দেখি দরজাটা বাইরে থেকে আটকানাে। অমনি অজ্ঞাত ভয়ে শিউরে উঠলুম আবার ডাকাডাকি করলুম। কিন্তু সাড়া নেই। 

কর্নেল সমগ্র ২য় খণ্ড এর অংশ-২৬

ব্যাপার কী? আমাকে আটকে রেখে কোথায় গেল সে? হতাশ হয়ে সিগারেট জ্বাললুম। দেশলাই কাঠিটা মেঝের কার্পেটে অন্যমনস্কভাবে ফেলেছি। ৩াই সেটা কুড়িয়ে নিয়ে ছাইদানিতে ফেলার জন্যে হেঁট হলম। অমনি খাটের ৩লায় চোখ গেল। খাটের তলায় কে উবুড় হয়ে পড়ে রয়েছে। তার মুখটা একেবারে ধড়ছাড়া। রক্ত জমাট বেঁধে রয়েছে। 

কয়েক মিনিটের মধ্যেই ভয়ে-উৎকণ্ঠায় প্রায় পাগল হয়ে গেলুম। দরজায় লাথি মেরে মেরে পায়ে ব্যথা ধরিয়ে ফেললুম। বাজখাই চিৎকার করে ডাকাডাকি করলুমবাঁচাও, বাঁচাও, কে কোথায় আছ, বাঁচাও! সেই বিকট আর্তনাদ কয়েকমাইল দূর থেকে লােকের শােনা উচিত ছিল। কিন্তু শােনার মতাে কেউ ছিল না হয়তাে। এরপর জানলাগুলােও ভাঙার চেষ্টা করলাম। রাইফেলের নল রডে টোল খেয়ে গেল দেখে ক্ষান্ত হলুম। বােঝা গেল, এই বাড়িটা মজবুত করেই বানানাে হয়েছে। 

এতসব তুমুল হুলুস্থূলের পর স্বভাব ক্লান্তি ও হতাশা আসে। তখন একটা জানলায় মুখ রেখে তাকিয়ে রইলুম গেটের দিকে। সকালের উজ্জ্বল আলােয় পৃথিবী ঝকমক করছে। আকাশে কোথায়ও মেঘের চিহ্ন নেই।

 

Read More

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের কর্নেল সমগ্র ২য় খণ্ড এর অংশ-২৭

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *