এমন একটা চমৎকার দিনে মুকাটা লাশের সঙ্গে বন্দী থাকতে হল আমাকে–এর চেয়ে সাংঘাতিক ঘটনা কল্পনা করা যায় না। এক ধুরন্ধর মায়াবিনীর ফাঁদে পড়ে আমি অবশেষে কী বােকামি করেছি ভেবে আফসােস হতে থাকল। কিন্তু এখন তাে আর মাথা খুঁড়েও কোনাে লাভ হবে না।
হঠাৎ মাথায় একটা যুক্তি খেলল। আমার পকেটে তাে এখনও অনেকগুলাে কার্তুজ রয়েছে। অন্তত গােটা পাঁচ পর পর খরচ করা যাক না, যদি কাঠের দেওয়ালের কোনাে অংশে একটা ফাটল ধরাতে পারি। তারপর অবশ্য এক টুকরাে ধারালাে কিছু দরকার। তাই ব্যস্ত একোনা ওকোনা হাতড়ালুম। লােহার কোনাে জিনিস, কিংবা তেমন জুতসই কিছু পাওয়া গেল না। খাটের তলায় উঁকি মারবার সাহস নেই। ওই মুকাটা বীভৎস লাশ আবার চোখ মেলে দেখা আমার পক্ষে অসম্ভব।
সেই সময় মাথায় একটা কথা এল। আচ্ছা, খুন যা দিয়ে করা হয়েছে, অর্থাৎ মার্ডার উইপনটা কি লাশের কাছে রেখে যায়নি খুনী? ওটা দিয়ে নিশ্চয় কাজ হবে।
যেমন ভাবা, তেমনি কাজ। অনেক সাহসে ফের খাটের তলায় উকি দিলুন। এবার লাশটা ভালাে করে দেখা হয়ে গেল। গায়ের রঙ ফর্সা, বেঁটে মােটাসােটা একটা লােক, পরনে খুব দামি স্যুট, টাই রয়েছে। সম্ভবত বাটন হােলে আস্ত একটা গােলাপ গোঁজা ছিল, সেটা বগলের ফাক দিয়ে দেখা যাচ্ছে। দেখতে দেখতে নার্ভ শক্ত হয়ে গেল। লাশটা টেনে বের করলুম। মুণ্ডুটা একটু তফাতে নাক খুঁজে পড়েছিল। সেটাকেও বাঁহাতে চুল ধরে টেনে আনলুম। তারপর লাশটা চিত করে মুখটা ঠিক জায়গায় লাগিয়ে দিলাম। এসময় আমাকে নিশ্চয় একটা ভয়ঙ্কর পিশাচ দেখাচ্ছিল।
কর্নেল সমগ্র ২য় খণ্ড এর অংশ-২৭
লােকটার খােলা চোখে আতঙ্ক ঠিকরে বেরােচ্ছে যেন। আঙুলের চাপে চোখের পাতা বুজিয়ে দিলুম। কয়েক মুহূর্ত তার দিকে তাকিয়ে থাকার পর এবার অস্ত্রটার খোঁজে খাটের তলায় উঁকি দিতেই সেটা চোখে পড়ল। একটা
জালি দেখা গেল। খুনী ওটা আমার হিসেবমতােই রেখে গেছে দেখছি। | এড়িয়ে সেটা নিতেই কেমন যেন উষ্ণতা ভর করল আমার রক্তে।
যাকে খুশি আমি খুন করতে পারতুম ! ক, তাহলে এবার দেয়াল কেটে বেরিয়ে পড়ার অসুবিধে নেই। ভােজালি
করে এনে দেখি, সেটার গায়ে চাপ চাপ জমাট কালাে রক্ত শুকিয়ে । লাশেরও অবস্থা একই রকম। উত্তেজনার ঘােরেও বুঝতে পারলুম যে । এখানে হয়নি। অন্য কোথাও খুন করার পর লাশটা এভাবে এনে রাখা লি। নিশ্চয় কোনাে মতলব ছিল খুনীর। রাইফেলের গুলি খরচ করার আগে ভােজালিটা কাজ দেয় কি না দেখতে – হল। কিন্তু কয়েক জায়গায় কোপ বসিয়ে দেখলুম, অসম্ভব। সামান্য টের দাগ ছাড়া আর কিছু ঘটছে না। রাইফেলের একটা মাত্র বুলেট সহজেই c ফাটল ধরাতে পারে।
কয়েকটা ফাটল একই জায়গায় পাশাপাশি সৃষ্টি তখন ভােজালি ব্যবহার করলে কাজ হতে পারে। | ওই রাইফেলটা নিয়ে কোণের একজায়গায় তাক করলুম। কোণটা যেহেতু পড়ের জায়গা, ফাটল সহজেই হবে। রাইফেলের সেফটি ক্যাচ তুলে ট্রিগারে লের চাপ দিতে যাচ্ছি, অমনি এক অবিশ্বাস্য কাণ্ড ঘটল। সােফাসেটের কে ফোনটা মিঠে স্বরে ক্রিং ক্রিং বেজে উঠল।
সে কী! শয়তানীটা যে বলেছিল ফোনের লাইন কাটা! নিশ্চয় মিথ্যে বলেছিল তাহলে। ফোনটা সমানে বাজতে থাকল। কয়েক ও ইতস্তত করার পর রাইফেলটা রেখে ফোনটা ধরলুম। আমার কণ্ঠস্বর কেঁপে গেল। হলাে! হ্যালাে! এবার দ্বিতীয় চমক এল। আমি কি এখনও স্বপ্ন দেখছি? হতবুদ্ধি হয়ে সুম। এ যে প্রত্যক্ষ মিরাকল! অনাপ্রান্ত থেকে পরিষ্কার ভেসে আসছে চেনা এটা কণ্ঠস্বর।
কর্নেল সমগ্র ২য় খণ্ড এর অংশ-২৭
—হ্যালাে, জয়ন্ত নাকি! গুড মর্নিং ডার্লিং, জয়ন্ত! আশা করি নার কোনাে ব্যাঘাত ঘটেনি। আমি থ বনে শুনে যাচ্ছি। কর্নেল নীলাদ্রি সরকার নাকি তার ভূত কথা ? না—না, এ অবিশ্বাস্য! আমি এখানে আছি, তাই বা কেমন করে লেন উনি? | -ডার্লিং, বুঝেছি! তুমি এ বুড়াের ওপর রীতিমতাে খাপ্পা হয়েছ। সেটা ও স্বাভাবিক। ইয়ে—শােন, আমি—মানে আমরা শিগগির গিয়ে পড়ছি।
যে না। আর দেখ, আমরা না পৌছনাে পর্যন্ত-ধরাে জাস্ট পনের মিনিট – খুব সাবধানে থাকবে। আমার গলা না শুনলে কিংবা আমাকে না দেখলে
না দরজা খুলবে না। কেমন? ছাড়ছি ? এশার অনায়াসে খাপ্পা হওয়া যায় গােয়েন্দাপ্রবরের প্রতি। রেগে ওঠাও শক আমার পক্ষে। এতসব যে জানে, সে কেন এখনও বেলা ন’টা অব্দি
এখানে আমাকে উদ্ধার করতে এল না? অদ্ভুত কারবার তাে বুড়াের ! অথচ আসার সময় কত ভূলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে এসছিল। | উঁট দেখিয়ে গম্ভীর অনারকম গলায় বললুম—হ্যালাে, হ্যালাে! শুনুন আপনি কাকে চান। এখানে জয়ন্ত বলে কেউ নেই। হ্যালাে…হ্যালাে!
কখন ফোন রেখে দিয়েছেন গােয়েন্দামশাই, আর আমি সমানে অতগুলাে কথা বলে গেলুম! রেগে সশব্দে ফোনটা আমিও রাখলুম। কিন্তু লােকটা কি সত্যি কোনাে মন্ত্রতন্ত্র জানেন? আমি তাে মাত্র ‘হ্যালাে’ বলেছি দুবার—তাতে উনি কীভাবে টের পেলেন যে আমিই ফোন ধরেছি?
কর্নেল সমগ্র ২য় খণ্ড এর অংশ-২৭
তাহলে কি যে রহস্যময় ফাদে আমি বােকার মতাে পা দিয়েছিলুম তারই কোন আভাস হঠাৎ কাল বিকেলে উনি পেয়ে গিয়েছিলেন এবং তাই আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখে উধাও হয়েছিলেন?
খুব সম্ভব, তাই। রহস্যের ইশারা পেলে বরাবর ওঁর ওই বাতিকগ্রস্ত আচরণ আমি লক্ষ্য করেছি। মনে হল, কাল রাস্তার পশ্চিমের জঙ্গলে বা খালের ওদিকে হঠাৎ কীভাবে একটা রহস্যময় পরিস্থিতিতে পড়ে গিয়েছিলেন কর্নেল। এ ছাড়া, এই অদ্ভুত ঘটনার কোনাে ব্যাখ্যা হয় না।
এতক্ষণে আশ্বস্ত হতে পেরেছি। সিগারেট ধরিয়ে লাশটিকে খুঁটিয়ে দেখতে থাকলম। কে এই ভদ্রলােক ? আরাধনাই বা আসলে কে? কেন একে খুন করা হল? আরাধনাই কি খুন করেছে? সেটা অসম্ভব। ওর এত সাহস বা জোর নেই, বুদ্ধিতে যত খল সে হােক না কেন। আর রাতের ঝড়বৃষ্টিতে সেই মােটর গাড়িতে আসা আগন্তুকেরাই বা কারা ? তাদের দরজা খুলল না কেন আরাধনা তারা কি তার শত্রু?
Read More