থাকলে অবাক হবার কিছু নেই, বিজয়। তােমার কী মনে হয়?”
বিজয় বলল, “তাই তাে! ওটার কথা মনে ছিল না। আমাদের পুরাে এলাকা তন্ন তন্ন করে খোঁজা দরকার।”
এবার কর্নেল হাসলেন। “তবে জয়ার কাছ থেকে মূলাবান জিনিসটি হাতিয়ে সে নিশ্চয় লুকিয়ে থাকবে না আর। কী দরকার আর লুকিয়ে থাকার ?”
“তাহলে—”
কর্নেল টিলার গায়ে পাথরের ধাপে পা রেখে বললেন, “জিনিসটা কী হতে পারে বলে তােমার ধারণা ?”
বিজয় তাকে অনুসরণ করে বলল “কোনাে দামি রত্ন-টত হবে। কাকাবাবুকে হয়তাে বাবা রাখতে দিয়েছিলেন।”
কর্নেল আর কোনাে কথা বললেন না। টিলাটা একেবারে সিধে উঠেছে। পরিশ্রম হচ্ছিল সিঁড়ি ভাঙতে। ওপরে উঠে ছােট্ট মন্দিরটার সামনে একটা পাথরে বসে বিশ্রাম নিতে থাকলেন। বিজয় গঙ্গার শােভা দেখতে থাকল। এখান থেকে চারদিকে অনেক দূর অব্দি চোখে পড়ে। চিড়িয়াখানার টিলার দিকে বাইনােকুলার তাক করলেন কর্নেল। নানকু হরিণটাকে কিছু খাওয়াচ্ছে। ঘাড়ে হাত বুলিয়ে আদরও করছে। জয় কাকাতুয়াটা কাধে নিয়ে আউট-হাউসের ছাদে বসে আছে। সেও গঙ্গার শােভা দেখছে হয়তাে। বাইনােকুলার ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে কর্নেল চারদিকটা খুঁটিয়ে দেখতে থাকলেন।
কর্নেল সমগ্র ২য় খণ্ড এর অংশ-১০
সেইসময় হঠাৎ বিজয় চমকখাওয়া গলায় বলল, “আরে! ওটা কী? কর্নেল বাইনােকুলার নামিয়ে বললেন, “কী বিজয়?”। বিজয় এগিয়ে গিয়ে মন্দিরের পাশে জবাফুলের ঝােপের ভেতর থেকে একটা ছােট্ট ভেলভেটে মােড়া কৌটা কুড়িয়ে আনল। উত্তেজিভাবে বলল “কর্নেল ! কর্নেল ! জয়া তাে এরকম একটা কৌটোর কথাই বলছিল! সেইটেই সম্ভবত।” | কর্নেল কৌটোটা নিয়ে বললেন, “ভেতরের জিনিসটা নেই। খালি কৌটোটা ফেলে রেখে গেছে।”
বলে জ্যাকেটের পকেট থেকে আতস কাচ বের করে খুঁটিয়ে কৌটোর ভেতরটা দেখতে থাকলেন। বিজয় দমআটকানাে গলায় বলল, “কী আশ্চর্য! কী আশ্চর্য!”
একটু পরে কর্নেল বললেন, “তুমি বলেছিলে রত্নের কথা। কিন্তু কৌটোর ভেতর মরচের গুড়াে দেখতে পেলাম। পুরনাে লােহার কোনাে জিনিস ছিল সবতা…ই চাবি হতেও পারে।”
“কিসের চাবি?”“জানি না। এর জবাব বিপ্রদাসবাবুই দিতে পারেন। ওঁকে কালই লােক পাঠিয়ে খবর দিয়ে আনা দরকার।”
“বুদ্ধকে পাঠিয়ে দেব।” বিজয় চঞ্চল হয়ে বলল। “এখনও পাঠানাে যায়। সাড়ে ছটায় একটা ট্রেন আছে।”
“ভাগলপুরে রাত্রে গিয়ে কি ওঁকে খুজে বের করতে পারবে বুদ্বু? অবশ্য ঠিকানা জানা থাকলে—”।
কর্নেল বাধা দিয়ে বললেন, “তুমি বরং এখনই গিয়ে খোঁজ নাও, বুদ্ধ বা কেউ ভাগলপুরের ঠিকানা জানে নাকি। মাধবজিকে জিগ্যেস করে যেও।”
কর্নেল সমগ্র ২য় খণ্ড এর অংশ-১০
“আপনি থাকছে?” “হ্যা—আমি ঘুরি কিছুক্ষণ।”
বিজয় সিঁড়ির ধাপ বেয়ে নেমে গেল সবেগে। কর্নেল ফের কিছুক্ষণ বাইনােকুলারে চারদিক দেখে নিয়ে তারপর মন্দিরের ভেতর উঁকি দিলেন। বেলা পড়ে এসেছে। তবে পশ্চিমের অন্তগামী সূর্যের আলাে সােজা এসে মন্দিরে ঢুকেছে। তাই ভেতরটায় রােদ পড়েছে।
একটা শিবলিঙ্গ ছাড়া আর কিছু নেই। ধুসর গ্রানাইট পাথরের বেদির ওপর শাদা পাথরের যযানিপট্রে প্রােথিত কালাে পাথরের শিবলিঙ্গ। কর্নেল শুড়ি মেরে ঢুকে বেদিটার চারদিকে হাত বুলিয়ে পরীক্ষা করছিলেন। পেছনদিকে হাত বুলােতে গিয়ে হাতে শক্ত কাঠের মতাে কী ঠেকল। অত্যন্ত অপরিসর ভেতরটা। অনেক কষ্টে ওপাশে ঝুঁকে চমকে উঠলেন। একটা গর্তে যে জিনিসটা ঢােকানাে, সেটা একটা ভাঙা চাবি ছাড়া আর কিছু নয়। কারণ নিচেই গােলাকার চাকতির মতাে ভাঙা মাথাটা পড়ে আছে।
কেউ চাবি ঢুকিয়ে জোরে চাপ দিতে গিয়ে চাবিটা ভেঙে গেছে। হতাশ হয়ে চলে গেছে। হয়তাে অন্ধকার নামলে বেদিটা ভাঙার জন্য তৈরি হয়েই আসবে।
কী আছে বেদির ভেতর? বেদিটা তাহলে সম্ভবত পাথরের সিন্দই ঠাৎ কর্নেলের মনে হল একটা বিপদ আসন্ন। এই অদ্ভুত অনুভূতি জীবনে বহুবার আসন্ন বিপদের মুহুর্তে তাকে সজাগ করে দিয়েছে। এ যেন অতিবীন্দ্রিয়ের বােধ। দ্রুত ঘুরলেন। একপলকের জন্য বিকেলের লালচে আলােয় যেন একটা হায়া সরে যেতে দেখলেন। পকেট থেকে রিভলবার বের করে গুড়ি মেরে ঝাপ দিলেন মন্দির-গর্ভ থেকে।
কর্নেল সমগ্র ২য় খণ্ড এর অংশ-১০
কিন্তু কাউকে দেখতে পেলেন না। টিলার পেছন দিকটা খাড়া নেমে গেছে। তার পেছন চৌহদ্দিঘেরা ঊচু পাঁচিল। কিন্তু টিলার চারদিকই ঘন ঝােপে ঢাকা। রিভলবারটা অটোমেটিক। নল তাক করে মন্দিরের চারদিক ঘুরে খুঁটিয়ে দেখলেন। কোনাে ঝােপের পাতা পর্যন্ত নড়ছে না।
তাহলে কি মনের ভুল? অথবা যে এসেছিল, সে যেন অদৃশ্য হওয়ার মন্ত্র জানে। অস্বস্তিতে অস্থির হয়ে কর্নেল সিঁড়ির পাপে পা রাখলেন। ছায়া যে দেখেছেন, তা ভুল নয়। আর একটা বিষয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া গেল যে সে যেই হােক, তার কাছে আগ্নেয়াস্ত্র নেই। থাকলে গুলি ছুড়ত। তাকে রেহাই দিত না।… ভৌতিক ছড়া ॥ বুদ্বুরাম বা কেউই জানে না ভাগলপুরে কোন ঠিকানায় বিপ্রদাসবাবুর বােনর বাড়ি। তাই বুদ্ধরাম আগামীকাল ভােরের ট্রেনেই ভাগলপুরে যাবে। সেখানে তার এক দূরসম্পর্কের আত্মীয় থাকে। কাজেই দিনসবরে গিয়ে খুঁজে বের করতে অসুবিধে হবে না। বিজয় এসে জানাল কর্নেলকে।
কর্নেল জয়াকে দেখতে গিয়েছিলেন তার ঘরে। তার শরীর ভাল, কিন্তু মন ভাল নেই। কর্নেলকে বসিয়ে রেখে বিজয় হয়তাে কবিতা লিখতে গেল।
একথা-ওকথার পর কর্নেল বললেন, “আচ্ছা জয়া, তােমাকে শরদিন্দু কি পরিতােষ নামে কারুর কথা বলেছিল?”
জয়া একটু চমকে উঠে বলল, “হ্যা বলেছিল। ওদের ব্যাংকের ক্যাশডিপার্টে কাজ করত সে।”
তাকে কানাজোলে দেখতে পাওয়ার কথা বলেছিল কি?” জয়া বলল, “বলেছিল। কিন্তু আপনি কেমন করে জানলেন?” “কী বলেছিল, আগে বলাে। আমি পরে বলছি সেকথা।”
“বলেছিল, দেখার ভুল হতেও পারে। তবে বাজারের ওখানে যেন পরিতােষ নামে ওর কলিগকে দেখেছে। আসলে ওর সন্দেহ ছিল পরিতােষই ক্যাশ সরিয়ে ওকে বিপদে ফেলেছিল। কারণ পরিতােষের স্বভাবচরিত্র নাকি ভাল ছিল না।”
Read More.