হ্যা।” কর্নেল এমনভাবে হ্যা বললেন, যাতে বােঝা যায় না কার কাছে শুনেছেন।
বিজয় জোরে মাথা নেড়ে বলল, “জয়া বড় বানিয়ে বলে। এ আমি বিশ্বাস করি না।”
“কেন?” বিজয় নড়ে বসল। “দাদার কোনাে ব্যাপার আমার অজানা নেই। বিশেষ করে কলকাতায় হােস্টেলে থাকার সময় দাদার কোনাে প্রেমের ব্যাপার থাকলে আমি নিশ্চয় জানতে পারতুম।”
লি একটু হাসলেন। “ছােটভাইকে ওসব কথা বলা যায় না—অথবা ‘? ভাইয়ের চোখের আড়ালেই দাদার গোপন প্রেম করা স্বাভাবিক।” বিজয় জোর গলায় বলল, “জয় সেরকম দাদা নয়। মাত্র ছ’ঘণ্টা পরে জন্ম। কাজেই আমার বন্ধুর মতাে। ওকে আমি নাম ধরে ডাকি, নিশা প। করেছে?”
লে হাসলেন। কিন্তু ইদানীং জয়ের অনেক গােপন ব্যাপার তােমার না নেই। এ নেই বলেই তুমি রহস্যের ধাঁধায় পড়ে আমার কাছে ছুটে গিয়েছিলে। আমাকে নিয়ে এসেছ তার জট ছাড়াতেই।”
“হ্যা। ইদানীং শরদিন্দু মারা যাবার পর থেকে জয় আমাকে কিছুই জানতে দিচ্ছে না আগের মতাে।”
“অথচ সেটাই তুমি জানতে চাইছ, এই তাে?” বিজয় একটু চুপ করে থেকে বলল, শুধু তাই নয়। আপনাকে বলেছি আমার ভয় হচ্ছে জয় সুইসাইড না করে। ওর পাগলামি যে হারে বাড়ছে।”
কর্নেল সমগ্র ২য় খণ্ড এর অংশ-১৪
কর্নেল একরাশ ধোয়া ছেড়ে বললেন “জয়ের গােপন রহস্যের একটা আমি ধরতে পেরেছি।
“কী বলুন তাে?” | “রাতে জয়ের ঘরে তুমি জয়াকে কার সঙ্গে কথা বলতে শুনেছিলে এবং এক রাত্রে কাউকে ব্যালকনির ওই ঘােরানাে সিঁড়ি বেয়ে নেমে যেতে দেখেছিলে।
আশা করি, কে সে এবার বুঝতে পারছ।”
বিজয় শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলল, “পরিতােষ ?”
“ঠিক ধরেছ। তুমি বুদ্ধিমান।” বিজয় চাপা স্বরে বলল, “পরিতােষের সঙ্গে জয়ের কী ব্যাপার চলছে বলে মনে হয় আপনার?”
“এখনও এতটা এগোতে পারিনি। তবে বিজয় দ্রুত বলল, “পরিতােষ কি তার বােন রমলার ব্যাপারে জয়কে ব্লাকমেইল করেছে?”
“বােঝা যাচ্ছে না ঠিক। আরও একটু গােপন দরকার।”
কর্নেল, আমার মনে হচ্ছে, তাহলে পরিতােষকে জয় এ বাড়িতে গােপন আশ্রয় দিয়েছে। তিনটে ঘর বন্ধ আছে ওপরে। তারই কোনােটাতে পরিতােষ লুকিয়ে থাকতে পারে।”
বিজয় খুব উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল। কর্নেল বললেন, “তাও সম্ভব। বিপ্রদাসবাবু ফিরলে তাে ওসব ঘরের চাবিও পাওয়া যাবে না। দেখা যাক।” বিজয় দমআটকানো গলায় বলল, “সব স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে, কার্নেল। আজ পরিতােষই তাহলে জয়াকে ক্লোরােফর্ম দিয়ে অজ্ঞান করে কৌটো হাতিয়েছে। নিশ্চয় ওর মধ্যে কিছু দামি জিনিস ছিল!”
“চাবি।”
কর্নেল সমগ্র ২য় খণ্ড এর অংশ-১৪
“কিন্তু কিসের চাবি?” বিজয় একটু হাসল। “হাঁ—হরটিলায় তখন আপনি চাবির কথা বলেছিলেন।”
কর্নেল আস্তে বললেন, “হরটিলার মন্দিরের ভেতর যে শিবলিঙ্গ আছে, তার বেদিটা সম্ভবত একটা গােপন সিন্দুক। চাবিটা সেই সিন্দুকের। চাবিচোর তাড়াতাড়ি জোর করে সিন্দুকের তালা খোেলবার চেষ্টা করতে গিয়ে চাবিটা ভেঙে ফেলেছিল।”
“সর্বনাশ! আপনি দেখেছেন?
“হ্যা।” কর্নেল একটু হাসলেন। তবে ব্যাপারটা কীভাবে জয়ও জেনে গেছে। সে তার কুকুরটাকে হরটিলায় পাহারায় রেখেছে দেখে এসেছি।”
বিজয় চমকে উঠল। তারপর বলল “চাবি-চোর পরিতােষ। পরিতােষই জয়কে বলেছে, ওখানে গুপ্তধন আছে। ভাগ দেবে বলে লােভ দেখিয়েছে। সত্যি, জয় এমন বােকা হবে ভাবতে পারিনি। যাতে অন্য কেউ টের পেয়ে ওখানে হানা দেয়, তাই সনিকে পাহারায় রেখেছে। সনি তাে পরিতােষকে কিছু বলে না। তাই তার অসুবিধে নেই।”
কর্নেল হাসলেন। “আচ্ছা বিজয়, সিন্দুকের ভেতর যদি গুপ্তধনের বদলে অন্য কিছু থাকে?”
“আর কী থাকবে? পরিতােষকে নিশ্চয়ই জয়ই নেশার ঘােরে বলেছে ওর ভেতরে আমাদের পূর্বপুরুষের গুপ্তধন আছে। জয় বড় বােকা। গায়ের জোর ছাড়া আর কিছু নেই ওর।”
“বিজয়, যদি সিন্দুকের ভেতর একটা ডেডবডি লুকোনাে থাকে?” বিজয় ভীষণ চমকে গেল। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বলল, “ডেডবডি? কার ডেডবডি ?”।
“ধৱাে পরিতামের বােন কমলার?” বিজয় শিউরে উঠে শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলল, “প্লিজ! প্লিজ কর্নেল ! এসব কথা বললে আমি হার্টফেল করে মারা পড়ল। আমার হাত-পা কাপছে!”
কর্নেল উঠে দাড়িয়ে বললেন, না। জাস্ট কথার কথা। শুয়ে পড়াে। এগারােটা বাজে।”
বিজয় মশারি টেনে দিয়ে শুয়ে পড়ল। তারপর বলল, “আজ রাতে আমার ধুম হবে না।”
ফ্যানের স্পিড বাড়িয়ে মশারি খাটিয়ে শুয়ে কর্নেল ফের বললেন, “ঘুমােও।” একটু পরে বিজয় ডাকল, “কর্নেল!” “বললা ডার্লিং !”
“পদ্যটা তাহলে পরিতােষই লিখেছে তাই না! বাংলা তার মাতৃভাষা। কাজেই”
“আচ্ছা বিজয়।” “বলুন। “তুমি দাড়ি রাখতে শুরু করেছ কবে থেকে?” “তা অনেকদিন হয়ে গেল। কেন?” “এমনি জিজ্ঞেস করছি। ঘুমোও।”
কর্নেল সমগ্র ২য় খণ্ড এর অংশ-১৪
তারপর কর্নেলের নাক ডাকতে থাকল। বিজয় ডাকাডাকি করে আর সাড়া পেল না।…
জয়কে নিয়ে সংশয় ॥ ভােরে অভ্যাসমতাে কর্নেল প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে ছিলেন। বিজয় তখন গুটোসুটি মেরে ঘুমােচ্ছে। রাতে ও ঘুমােয়নি ভেবেই কর্নেল তাকে ডাকেননি আজ।
প্রধান ফটক দিয়ে বেরিয়ে রাস্তা ধরে গঙ্গার ধারে হাঁটতে হাঁটতে রাজবাড়ির আউটহাউসের ওপাশ ঘুরে যখন পূবের ভাঙা ফটাকের কাছে পৌছলেন, তখন সূর্য উঠেছে। ফটকের এধারে প্রচুর পাথরের স্তুপ। তার ফাকে গুলুলতায় শরতের সজীবতা ঝিকমিক করছিল। শিশিরের ফোঁটায় প্রতিফলিত হচ্ছিল রক্তাভ রােদ। গঙ্গার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে সৌন্দর্য দেখলেন। তারপর পাচিলের ভাঙা জায়গা দিয়ে রাজবাড়ির এলাকায় ঢুকলেন কর্নেল।
বাঁদিকে হরটিলা পর্যন্ত অসমান জমি জুড়ে আর ঝােপঝাড় শিশিরে চবচব করছে। সংকীর্ণ পায়ে চলা পথ ধরে হরটিলার দিকে যেতে জুতাে-প্যান্ট ভিজে সপসপে হয়ে গেল। এখানে দাঁড়িয়ে বাইনােকুলারে চোখ রেখে মন্দিরটা দেখতে দেখতে চমকে উঠলেন।
জয় মন্দিরের সামনে পাথরের ওপর বসে আছে একা। পাশে দাঁড়িয়ে তার কুকুর সনি।
Read More