কানকাটা রাজার দেশ – অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর

কানকাটা রাজার দেশ

এক ছিল রাজা আর তাঁর ছিল এক মস্ত বড়াে দেশ। তার নাম হল কানকাটার দেশ। সেই দেশের সকলেরই কান কাটা। হাতি, ঘােড়া, ছাগল, গরু, মেয়ে, পুরুষ, গরিব, বড়ােমানুষ সকলেরই কান কাটা। বড়ােলােকদের এক কান, মেয়েদের এক কানের আধখানা, আর যত জীবজন্তু গরিব দুঃখীদের দুটি কানই কাটা থাকত।

সে দেশে এমন কেউ ছিল না যার মাথায় দুটি আস্ত কান, কেবল সেই কানকাটা দেশের রাজার মাথায় একজোড়া আস্ত কান ছিল। আর সকলেই কেউ লম্বা চুল দিয়ে, কেউ চাপ দাড়ি দিয়ে, কেউ বা বিশ গজ মলমলের পাগড়ি দিয়ে কাটা কানা ঢেকে রাখত, কিন্তু সেই রাজা মাথা একেবারে ন্যাড়া করে সেই ন্যাড়া মাথায় জরির তাজ চাপিয়ে গজমােতির বীরবৌলিতে দুখানা কান সাজিয়ে সােনার রাজসিংহাসনে বসে থাকতেন।

একদিন সেই রাজা এককান মন্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে কানকাটা ঘােড়ায় চেপে শিকারে বার হলেন। শিকার আর কিছুই নয়, কেবল জন্তু জানােয়ারের কান কাটা। রাজ্যের বাইরে এক বন ছিল, সেই বনে কানকাটা দেশের রাজা আর এককান মন্ত্রী কান শিকার করে বেড়াতে লাগলেন। এমনি শিকার করতে করতে বেলা যখন অনেক হল, সূর্যদেব মাথার উপর উঠলেন, তখন রাজা আর মন্ত্রী একটা প্রকাণ্ড বটগাছের তলায় ঘােড়া বেঁধে শুকনাে কাঠে আগুন করে যত জীবজন্তুর শিকার করা কান রাঁধতে লাগলেন।

মন্ত্রী রাঁধতে লাগলেন আর রাজা খেতে লাগলেন, মন্ত্রীকেও দু-একটা দিতে থাকলেন। এমনি করে দু’জনে খাওয়া শেষ করে সেই গাছের তলায় শুয়ে আরাম করছেন, রাজার চোখ বুজে এসেছে, মন্ত্রীর বেশ নাক ডাকছে এমন সময় একটা বীর হনুমান সেই গাছ থেকে লাফিয়ে পড়ে রাজাকে বললে, – ‘রাজা তুই বড়াে দুষ্ট, সকলের কান কেটে বেড়াস, আজ সকালে আমার কান কেটেছিস ; তার শাস্তি ভােগ কর।

’ এই বলে রাজার দুই গালে চড় মেরে একটা কান ছিড়ে দিয়ে চলে গেল। রাজা যাতনায় অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। অনেকক্ষণ পরে যখন জ্ঞান হল, তখন রাজা চারিদিকে চেয়ে দেখলেন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, হনুমানটা কোথাও নেই, মন্ত্রীবর পড়ে পড়ে নাক ডাকাচ্ছেন। রাজার এমনি রাগ হল যে তখনি মন্ত্রীর বাকি কানটা এক টানে ছিড়ে দেন ; কিন্তু অমনি নিজের কানের কথা মনে পড়ল, রাজা দেখলেন ছেড়া কানটি ধূলায় পড়ে আছে।

তাড়াতাড়ি সেটিকে তুলে নিয়ে সযত্নে পাতায় মুড়ে পকেটে রেখে তাজ টুপির সােনার জরির ঝালর কাটা কানের উপর হেলিয়ে দিলেন যাতে কেউ কান দেখতে না পায়, তারপর মন্ত্রীর পেটে গুঁতাে মেরে বললেন,- ঘােড়া আন। এক হােয় মন্ত্রীর নাক ডাকা হঠাৎ বন্ধ হল, আর এক গুঁতােয় মন্ত্রী লাফিয়ে উঠে রাজার সামনে ঘােড়া হাজির করলেন।

রাজা কোনাে কথা না বলে একটি লাফে ঘােড়ার পিঠে চড়ে একদম ঘােড়া ছুটিয়ে রাজবাড়িতে হাজির। সেখানে তাড়াতাড়ি সহিসের হাতে ঘােড়া দিয়েই একেবারে শয়ন-ঘরে খিল দিয়ে পালঙ্কে আবার অজ্ঞান হয়ে পড়লেন।সকাল হয়ে গেল, রাজবাড়ির সকলের ঘুম ভাঙল, রাজা তখনও ঘুমিয়ে আছেন। রাজার নিয়ম ছিল রাজা ঘুমিয়ে থাকতেন, আর নাপিত এসে দাঁড়ি কামিয়ে দিত, সেই নিয়ম মত সকাল বেলা নাপিত এসে দাড়ি কামাতে আরম্ভ করলে।

এক গাল কামিয়ে যেই আর এক গাল কামাতে যাবে এমন সময় রাজা ‘দুর্গা দুর্গা’ বলে জেগে উঠলেন। নজর পড়ল নাপিতের দিকে, দেখলেন নাপিত ক্ষুর হাতে হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ কানে হাত দিয়ে দেখলেন কান নেই। রাজা আপসােসে কেঁদে উঠলেন। কঁাদতে কাদতে নাপিতের হাতে ধরে বললেন, ‘নাপিত ভায়া এ কথা প্রকাশ কর না। তােমাকে অনেক ধনরত্ন দেব।

পিত বললে, কার মাথায় কটা কান যে এ কথা প্রকাশ করব!’ শুনে রাজা খুশি হলেন। নাপিতের কাছে আর-আধখানা দাড়ি কামিয়ে তাকে দু-হাতে দু-মুঠো মােহর দিয়ে বিদায় করলেন। নাপিত মােহর নিয়ে বিদায় হল বটে কিন্তু তার মন সেই কাটা কানের দিকে পড়ে রইল।কাজে কর্মে ঘুমিয়ে জেগে কী লােকের দাড়ি কামাবার সময়, কী সকাল, কী সন্ধ্যা মনে হতে লাগল – রাজার কান কাটা, রাজার কান কাটা ; কিন্তু কারুর কাছে এ কথা মুখ ফুটে বলতে পারে না মাথা কাটা যাবে।

নাপিত জাত সহজে একটু বেশী কথা কয়, কিন্তু পাছে অন্য কথার সঙ্গে কানের কথা বেরিয়ে পড়ে সেই ভয়ে তার মুখ একেবারে বন্ধ হল। কথা কইতে না পা পেয়ে পেট ফুলে তার প্রাণ যায় আর কি।এমন সময় একদিন রাজা নাপিতের কাছে দাড়ি কামিয়ে সােনার কৌটো খুলে কাটা কানটি নেড়ে চেড়ে দেখছেন, আর অমনি কোথেকে একটা কাক ফস্ করে এসে ছোঁ মেরে রাজার হাত থেকে কানটি নিয়ে উড়ে পালাল।

রাজা বললেন – ‘হাঁ হাঁ হাঁ ধরাে! কাক কান নিয়ে গেল!’ রাজা মাথা ঘুরে সেইখানে বসে পড়লেন। ভাবতে লাগলেন, প্রজাদের কাছে কী করে মুখ দেখাব।এদিকে নাপিত ক্ষুর ভাড় ফেলে দৌড়। পড়ে-তা-মরে এমন দৌড়। শহরের লােক বলতে লাগল – নাপিত ভায়া নাপিত ভায়া হল কী? পাগলের মতাে ছুটছ কেন? নাপিত না রাম না গঙ্গা কাকের সঙ্গে ছুটতে ছুটতে একেবারে অজগর বনে গিয়ে হাজির।

কাকটা একটা অশ্বথ গাছে বসে আবার উড়ে চলল, কিন্তু নাপিত আর এক পা চলতে পারল না, সেই অশ্বথ গাছের তলায় বসে পড়ে হাঁপাতে লাগল, আর ভাবতে লাগল – ‘এখন কী করি? রাজার কান কাটা ছিল, অনেক কষ্টে সেকথা চেপে রেখেছিলুম; এখন সেই কান কাকে নিলে এ কথাও যদি আবার চাপতে হয় তাহলে আমার দফা একদম রফা! ফোলা পেট এবারে ফেঁসে যাবে, এখন করি কী?’ নাপিত এই কথা ভাবছে এমন সময় গাছ বললে – ‘নাপিত ভায়া ভাবছ কী?’ নাপিত বলল, – ‘রাজার কথা।’ গাছ বলল – ‘সে কমন?’

 

Read more

পেটুক – সুকুমার রায়

 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *