কৃষ্ণপক্ষ পর্ব – ৫ হুমায়ূন আহমেদ

কৃষ্ণপক্ষ পর্ব – ৫

অরু গোসল শেষ করে এসে দেখল, বাবুর ডিম ভক্ষণ পর্ব শেষ হয়েছে। এখন চলছে দুধপান পর্ব। দুধও ডিমের মত চামুচে করে খাওয়ানো হচ্ছে। চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে অরু বলল, আপা একটা কাজ কর, ফুটবলের পাম্পার কিনে আন। তারপর সেই ফুটবল পাম্পারে দুধ ভরে বাবুর মুখে পাম্প করে দাও।মীরু বলল, এইসব রসিকতা আমার ভাল লাগে না। ‘তোমার তো এখন পৃথিবীর কোন কিছুই ভাল লাগে না।‘ মীরু বলল, তুই সব সময় আমার পেছনে লাগিস না তো অরু, আমার অসহ্য লাগে। আর শোন আজ বিকেলে বাসায় থাকবি – আবরার সাহেব টেলিফোন করেছিলেন। কথার ভঙ্গি দেখে মনে হল বিকেলে আসবেন। ‘আসবেন বলেছেন?‘

‘সরাসরি বলেন নি। জিজ্ঞেস করছিলেন তোর কথা। আমি বললাম, বন্ধুর বাড়িতে গেছে। রাতে থাকবে। সেই বন্ধুর টেলিফোন আছে কি-না জিজ্ঞেস করছিলেন।‘ ‘ও।‘ ‘তুই আজ বিকেলে বাসায় থাকবি কি-না জানতে চাচ্ছিলেন। আমি বলেছি থাকবে। আপনি আসতে চাইলে আসুন।‘ ‘কি বললেন, আসবেন?‘ ‘কিছু বলেন নি। আসবেন তো বটেই। তুই বিকেলে বাসায় থাকিস।‘ ‘আমি বাসায়ই থাকব। যাব আর কোথায়?‘

গোসল করে এক কাপ গরম চা খাবার পর পর অরুর ঘুম কেটে গেল। একটু আগে ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছিল – এখন ঘুম নেই।শরীরে কোন ক্লানি-বোধও নেই। সে ঠিক করল, আবরারকে লেখা চিঠিটা শেষ করে ফেলবে। আজ যদি আসেন তাঁকে হাতে হাতে দেবে। না এলে বাসায় গিয়ে দিয়ে আসবে। সে বিয়ের জন্যই অপেক্ষা করছিল। বিয়ে হয়ে গেছে আর অপেক্ষা করার কিছু নেই।অরু দীর্ঘ চিঠি লিখতে পারে না। অনেক কিছু লেখার জন্যে সে কাগজ কলম নিয়ে বসে, খানিকটা লেখার পর মনে হয় সব লেখা হয়ে গেল। সেই অর্থে আবরারকে লেখা তার চিঠিটা বেশ দীর্ঘ বলা যেতে পারে। চিঠিতে সম্বোধন নেই। কি সম্বোধন দেয়া যায় অনেক ভেবেও সে বের করতে পারেনি – সুজনেষু, প্রিয়জনেষু, শ্রদ্ধাষ্পদেষু … কোনটাই মানায় না।

তাছাড়া চিঠি যতটুকু লিখে রেখেছে তার কাছে ভাল লাগেনি। মনে হয় পুরো ব্যাপারটা আরো সুন্দর করে আরো গুছিয়ে লেখা যেত।“আপনি নিশ্চয়ই আমার এই দীর্ঘ চিঠি দেখে আঁৎকে উঠে ভাবছেন, ব্যাপারটা কি? হাতের লেখা দেখেও নিশ্চয়ই বিরক্ত হচ্ছেন। ভাবছেন এই মেয়েটার হাতের লেখা এত বাজে কেন। এ জীবনে আমি যত বকা খেয়েছি তার শতকরা ৬০ ভাগ হচ্ছে খারাপ হাতের লেখার জন্যে। এস.এস.সি. এবং এইচ.এস.সি.-তে আমি কোনমতে টেনে টুনে ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছি। আমার ধারণা, আমি আরো ভাল করতাম। একজামিনাররা হয়ত আমার হাতের লেখা পড়তেই পারেন নি। আপনিও পড়তে পারছেন কি-না জানি না। পুরো চিঠি যদি না পড়েন তাহলে একজামিনারদের মত আপনিও আমাকে অনেক কম নম্বর দেবেন। দয়া করে পড়ুন।

বুধবার আমার বিয়ে হবার কথা, আজ সোমবার। বিয়ের এখনো দু‘দিন দেরি। আমি ঠিক করে রেখেছি চিঠি শেষ করে রাখব, আপনাকে দেব না। আপনাকে দেয়া হবে বিয়ের এক দিন পর। যেহেতেু আপনি এখন চিঠি পড়ছেন আপনি ধরে নিতে পারেন যেদিন বিয়ে হবার কথা ছিল সেদিনই হয়েছে। যার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে আপনার তুলনায় সে অতি নগন্য মানুষ, কমনার। এম.এ. পাশ করেছে – কোনমেতে একটা সেকেণ্ড ক্লাস জোগাড় করেছে। চাকরির সন্ধানে ঘুরছে শিকারী কুকুরের মত। যেখানেই তার মনে হয়েছে চাকরির সম্ভাবনা আছে সেখানেই সে উপস্থিত হয়েছে। আপনি শুনলে নিশ্চয়ই হাসবেন চাকরির জন্যে সে ময়মনসিংহের মদনের এক পীড় সাহেবের মাজার জিয়ারত করে এসেছে। এখনো কিছু হয়নি। চট করে যে হবে সে সম্ভাবনাও ক্ষীণ। দেশের চাকরি-বাকরি এখন পীর-ফকিরদের হাতে না। যাদের হাতে তারা মুহিবকে চাকরি দেবে না।

বুঝতেই পারছেন ওর নাম মুহিব। যেসব জিনিস মেয়েরা পছন্দ করে না তার সবই মুহিবের মধ্যে আছে। রুচি এক বস্থ তার নেই। এমন সব কুৎসিৎ রঙের শার্ট পরে সে আসে যা সুস্থ মাথায় কোন মানুষ কিনতে পারে না। একবার সে গোলাপী রঙের এক হাওয়াই শার্ট পরে উপস্থিত হয়েছিল। সিল্কের শার্ট। সেকেণ্ড হেণ্ড মার্কেট থেকে তেত্রিশ টাকায় কিনেছে এবং তার ধারণা হয়েছে এত সুন্দর শার্ট সে তার জীবনে আগে কখনো পরে নি। সে অসম্ভব ভীরু। একদিন তাকে নিয়ে আমি পাবলিক লাইব্রেরীর সামনে রাস্তা দিয়ে হাঁটছি হঠাৎ বদ টাইপের এক আধবুড়ো লোক ইচ্ছে করে আমাকে ধাক্কা দিয়ে এগিয়ে গেল। আমি থমকে দাঁড়িয়ে বললাম, ঐ বুড়োটাকে ডেকে জিজ্ঞেস কর তো এটা কেন করল। মুহিব বলল, আহা বাদ দাও না। পথ চলতে ধাক্কা লাগে না?

আমি কঠিন গলায় বললাম, পথ চলতে ধাক্কা এটা নয়। তুমি এক্ষুণি গিয়ে বুড়োকে ধরে আন।মুহিব সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, আমি নাটক করতে পারব না। বুড়ো যদি ইচ্ছে করে ধাক্কা দিয়েই থাকে তাহলে আমি এখন বললে তো ধাক্কা ফেরত চলে যাবে না।‘তা যাবে না – তবে সে সাবধান হবে।‘ ‘তাকে সাবধান করার দায়িত্ব নিতে ইচ্ছা করছে না। তুমি পুরো ব্যাপারটা ভুলে যাও তো। তুচ্ছ জিনিস মনে ধরে রাখলে চলে না।‘ রাগে আমার গা জ্বলে গেল। তার কাছে সবই তুচ্ছ জিনিস। সে থাকে তার বোনের সঙ্গে। তার দুলাভাই তাকে দিনরাত অপমান করে।

অপমানের দু‘একটা নমুনা শুনে আমার মাথায় আগুন ধরে গেছে। সে নির্বিকার – তার কাছে এসব হচ্ছে তুচ্ছ জিনিস। তার টাইপ সম্পর্কে বুঝবার জন্যে একটা ঘটনার শুধু উল্লেখ করি। আপনি অসম্ভব বুদ্ধিমান। একটি ঘটনা থেকে তার চরিত্র ধরে ফেলতে পারবেন। বেশিদিন আগের কথা না, মাস তিনেক হবে। তার সঙ্গে গল্প করতে করতে আসছি। সে হঠাৎ বলল, এক সেকেণ্ড দাঁড়াও বাথরুম সেরে আসি।আমি হতভম্ব হয়ে বললাম, কোথায় বাথরুম সারবে? সে নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, রাস্তার পাশে। ড্রেন আছে তো। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝামেলা চুকিয়ে ফেলব। নো প্রবলেম।আমি বললাম, রাস্তায় শত শত লোক যাচ্ছে এর মধ্যে তুমি বাথরুম সারবে?

‘হ্যাঁ।‘ ‘তুমি কি প্রায়ই এরকম কর?‘ ‘আমার মত যুবক, যাদের কাজই হচ্ছে সারাদিন শহরে ঘুরে বেড়ানো – বাথরুম সারার কাজ তাদের এভাবেই করতে হয়। এটাতো সানফ্রানসিসকো শহর নয় যে রাস্তার মোড়ে মোড়ে পাবলিক টয়লেট থাকবে।‘ ‘তুমি যদি সত্যি এরকম কর তাহলে আমি কিন্তু চলে যাব। আর কখনো আমার দেখা পাবে না।‘ ‘তুমি চাও আমি ব্লাডার ফেটে মারা যাই?‘ এই বলে সে আমাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে রাস্তার পাশের একটি আম গাছের দিকে এগিয়ে গেল। এ থেকে আপনি নিশ্চয়ই ওর মানসিক গঠন বুঝতে পারছেন … আপনার সঙ্গে ওর কোনই মিল নেই …‘

চিঠি এই পর্যন্ত পড়েই অরুর ঘুম পেয়ে গেল। ময়নার মা ঘরে ঢুকে বলল, আফা আপনেরে বড় আফা ডাকে। অরু বিরক্ত মুখে বলল, কেন? ‘বাবু বমি করতেছে।‘ ‘বমি করবে তা তো জানা কথাই – এতক্ষণ যে করে নি তাই ভেবে আশ্চর্য হচ্ছি। আপাকে গিয়ে বল আমি যেতে পারব না। আমি এখন ঘুমুব। খবর্দার দুপুরে আমাকে ডাকতে পারবে না। ভাত খাওয়ার জন্যেও ডাকবে না। যদি টেলিফোন আসে বলবে আমি বাসায় নেই।‘ ময়নার মা চলে যাবার পর মীরু দরজা ধরে দাঁড়াল। রাগী গলায় বলল, বাবু বমি করছে আর তুই আসছিস না। তুই তো দিন দিন অমানুষ হয়ে যাচ্ছিস অরু।অরু বলল, আমি ঘুমুচ্ছি আপা। আমাকে ডিসটার্ব করো না। বমি করে বাবুর পেট খালি হয়ে গেছে। ওকে আবার ডিম দুধ খাওয়াও।‘তুই এমন হয়ে যাচ্ছিস কেন?‘ ‘কেমন হয়ে যাচ্ছি?‘ ‘একজন ইনসেনসেটিভ মানুষ। দয়ামায়া নেই …।‘

‘আমার দয়ামায়া দেখানো ঠিক হবে না আপা। আমি দয়ামায়া দেখাতে গেলেই সবাই বলবে মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি। এটা ঠিক হবে না।‘ ‘তোর দুলাভাই তোকে গত মাসে চিঠি লিখেছে। তুই জবাব দিয়েছিস? ‘না।‘ ‘না কেন?‘ ‘সবাইকে কি চিঠি লিখতে ইচ্ছে করে? চিঠি লেখা যায় খুব সিলেকটেড ক‘জনকে। দুলাভাই তার মধ্যে পড়েন না।‘ মীরু রাগ করে চলে গেল। অরু আবরারকে লেখা চিঠিটা আবার পড়ল। পছন্দ হল না। আরো গুছিয়ে লিখতে হবে। হাতের লেখাও ভাল হয় নি। লাইন টানা কাগজে লিখতে হবে।ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে। ঘুম ঘুম অবস্থায় লেখা চিঠিগুলো সুন্দর হয়। কেমন করে যেন চিঠিতে কিছু স্বপড়ব ভাব চলে আসে।

অরু খাতা নিয়ে উপুড় হল। পায়ের উপরে চাদর ছড়িয়ে দিল। জানালা দিয়ে রোদ এসে গায়ে পড়েছে। খুব আরাম লাগছে। অরু লিখতে শুরু করল। প্র মেই সম্বোধন। সম্বোধনটাই কঠিন। সম্বোধনে অনেকখানি বলা হয়ে যায়। অরু লিখল ‘প্রিয়তমেষু‘। এই সম্বোধনের চিঠি আবরার সাহেবকে পাঠানো যায় না। এই চিঠি মুহিবের জন্যে। এটা মন্দ না। মুহিব ফিরে এলে সে অনেকদিন দেখা করবে না। পালিয়ে পালিয়ে বেড়াবে, কিংবা চলে যাবে মামারবাড়ি – কেন্দুয়ায়। মুহিব যখন চিন্তায় চিন্তায় অস্থির তখন হঠাৎ চিঠি পাবে।

প্রিয়তমেষু,

তুমি ভোরবেলা হুট করে চলে গেলে। এটা একদিকে ভালই হয়েছে। আমি নিজেকে গুছিয়ে নেবার সময় পেয়েছি। বিরহে কাতর হইনি। গল্প উপন্যাসের নায়িকারা সম্ভবত বিরহে কাতর হয়ে কাঁদতে বসত। আমি কি করেছি জান? আমি খুব সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে নিজে নিজেই আরেক কাপ চা বানিয়ে খেলাম। চা শেষ করার আগেই তোমার বন্ধু এবং বন্ধুপতড়বী এসে উপস্থিত। রাতে আমাদের ফেলে রেখে দু‘জনেই চলে গিয়েছিল এই দুঃখে তারা কাতর। তোমার বন্ধু বজলু সাহেব একটু পর পর বলছেন – ভাবী, আমি একটা ছাগল। শুধু ছাগল না, রামছাগল। আমাকে দয়া করে ক্ষমা করে দিন। বেচারার ক্ষমা প্রার্থনার ভঙ্গি দেখে মায়া লাগছিল।

তিনি অবশ্যি তোমাকেও একটু পর পর রামছাগল বলছেন কারণ তুমি আমাকে ফেলে চলে গেছ। বজলু সাহেবের স্ত্রী আমাকে আরালে নিয়ে একগাদা প্রশ্ন করলেন। সেই সব প্রশ্নের সত্তুর ভাগ চুড়ান্ত রকমের অশ্লীল। এই মহিলার অশ্লীল কথাবার্তার দিকে মনে হয় খুব ঝোঁক আছে। শুরুতে তাঁর কথাবার্তা শুনে রাগ লাগছিল। তারপর অবশ্যি রাগ দূর করে হেসে হেসে আমিও বানিয়ে বানিয়ে অনেক কথা বলেছি।বাসায় ফেরার সময় খুব টেনশান হচ্ছিল। ভেবেছিলাম বাসায় ভয়াবহ কিছু হয়ে গেছে। বাবার হার্টের অসুখ। তাঁর মাইল্ড স্ট্রোক জাতীয় কিছু হওয়া বিচিত্র না। হবার সম্ভাবনাও অনেকখানি। কারণ হচ্ছে বাবা তাঁর পছন্দের একটি ছেলের সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক ঠাক করে

রেখেছেন। বাবা হচ্ছেন সেই জাতের মানুষ যাঁরা মনে করেন এই পৃথিবীতে তাঁদের মতামতটাই প্রধান। অন্য কারোর কোন মতামত থাকতে পারে না। থাকা উচিত না। ঐ ছেলের সঙ্গে বাবার পরিচয় কি করে হল শোন। একদিন বাবার খুব মাথাব্যাথা। তিনি প্যারাসিটামল কেনার জন্যে একটা ফার্মেসীতে গেলেন। দশটাকার প্যারাসিটামল কিনে মানিব্যাগের জন্যে পকেটে হাত দিয়ে দেখলেন মানিব্যাগ আনেন নি। বাবা বললেন, টাকা আনতে ভুলে গেছি।পরে এসে টাকা দিয়ে নিয়ে যাব। দোকানদার বলল, আচ্ছা। সে ওষুধ তুলে রাখল।

দোকানে বসা অল্প বয়স্ক একটা ছেলে বলল, রমিজ মিয়া ওষুধ দিয়ে দিন। ছেলেটা বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি আবার যখন এদিকে আসবেন তখন টাকা দিয়ে দিবেন।বাবা বললেন, তার প্রয়োজন নেই। আমি টাকা দিয়েই ওষুধ নেব। আপনার ভদ্রতার জন্যে ধন্যবাদ। এই ভদ্রতা কি আপনি সবার সঙ্গে করেন? ‘জ্বি না। আপনি দশ টাকার ওষুধ কিনেছেন বলে ভদ্রতাটুকু করতে পারছি। এক হাজার টাকার ওষুধ কিনলে করতে পারতাম না। তার কারণও আছে, একবার একটা লোক দু‘শ টাকার ওষুধ কিনে বলল, টাকা আনতে ভুলে গেছি। এক্ষুণি টাকা এনে দিচ্ছি। সেই এক্ষুণি এখনো শেষ হয় নি। তিন মাস হয়ে গেল।‘

বাবা বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে গেলেন। ওষুধ কিনলেন। ছেলেটির সঙ্গে আরো খানিকক্ষণ কথাবার্তা হল, জানা গেল সে ডাক্তার। গত বছর মাত্র পাশ করেছে। কথা বলে বাবা মুগ্ধ। বাবা সহজে মুগ্ধ হন না। তিনি সহজে যা হন তা হল বিরক্ত। তিনি যখন মুগ্ধ তখন ধরে নিতে হবে মানুষটার মধ্যে মুগ্ধ হবার মত কিছু আছে।ভদ্রলোক কয়েকবার এলেন আমাদের বাসায়। আমি খুব আগ্রহ নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বললাম। বাবা কেন মুগ্ধ হলেন তা জানাই ছিল আমার আগ্রহের প্রথম কারণ। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে বাবার প্রিয় মানুষটির সঙ্গে তোমাকে মিলিয়ে দেখতে চাচ্ছিলাম। মিলিয়ে মন খারাপই হল। আবরার সাহেবকে একশতে নব্বুই দিলে তুমি পাও চলি−শ। মানুষটা অসম্ভব ভদ্র। মেকি ভদ্রতা না – আসল জিনিস। বাবা একদিন জিজ্ঞেস করলেন, কি রে, ছেলেটা কেমন?

আমি বললাম, ভাল।বাবা ধমক দিয়ে বললেন, বি স্পেসিফিক। কেন ভাল? ‘তার সঙ্গে কথা বলে আরাম পাওয়া যায়। বুদ্ধিমান মানুষ।‘ ‘আর কিছু?‘ ‘উনি খুব ভদ্র।‘ ‘আর কিছু আছে?‘ ‘আর মনে পড়ছে না বাবা।‘ ‘তার খারাপ কোন দিক চোখে পড়েছে?‘ ‘উনি খানিকটা ফর্মাল।‘ ‘ইনফর্মাল হবার মত পরিচয় তো হয় নি যে ইসফর্মাল হবে। এ ছাড়া আর কোন পয়েন্ট আছে?‘ ‘উনার মধ্যে এক ধরনের কাঠিন্য আছে।‘ ‘কাঠিন্য মানে?‘ ‘উনার সঙ্গে যখন কথা বলি তখন উনাকে আমার কেন জানি মাস্টার মাস্টার মনে হয়।‘ ‘এ ছাড়া আর কিছু মনে পড়ছে না?‘

‘জ্বি-না।‘ ভাল কথা। আমি এই ছেলের সঙ্গে তোর বিয়ে দেবার কথা চিন্তা করছি। প্রাথমিক আলোচনা ছেলের বাবার সঙ্গে করেছি। তাঁরা যথেষ্ট আগ্রহী। আমি ছেলের ব্যাকগ্রাউণ্ড সম্পর্কে আরো কিছু খোঁজ নেব। তারপর ফাইনাল কথা বলব। তোকে খবরটা দেয়া দরকার বলেই দিচ্ছি। তোর মতামত চাচ্ছি না। বুঝতে পারছিস?‘ ‘পারছি।‘ ‘একটা কথা তোকে বলা দরকার – এই ছেলে এম বি বি এস ফাইন্যাল পরীক্ষায় গত পনের বছরের রেকর্ড ভেঙ্গেছে। জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয় তাকে স্কলারশীপ দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। একটা গাধা টাইপ ছেলের সঙ্গে মহা সুখে জীবচন যাবন করার চেয়ে, ব্রাইট ছেলের সঙ্গে মোটামুটি সুখে জীবন যাপনও আনন্দের – এই কথাটা মনে রাখবি। আচ্ছা এখন যা।‘

তুমি তো বাবাকে চেন না। কাজেই বুঝতে পারছ না যে বাবার মুখের উপর কথা বলা সম্ভব না। আমি কিছুই বললাম না। তার চারদিন পরে ছেলের মা আমাকে দেখতে এলেন। মহিলার মনটা মায়ায় ভর্তি। তিনি এসে কি করলেন জান? আমাকে জড়িয়ে ধরে খানিকক্ষণ খুব কাঁদলেন। তারপর একটা মুক্তো বসানো আঙটি আমার হাতে পড়িয়ে দিলেন। সেই আঙটি আমি সারাক্ষণ হাতে পরে থাকি। এখনো আমার হাতে আছে। শুধু বিয়ের দিন খুলে ভ্যানিটি ব্যাগে রেখেছিলাম। আঙটি পরে থাকতে হয় বাবার ভয়ে। বুঝলেন সাহেব?

আপনি কি বুঝতে পারছেন আমি কি সমস্যায় আছি? না পারছেন না। শুধু রাগ করছেন এত ঘটা করে ঐ ছেলের কথা লিখলাম বলে। এখন যে কথাটি লিখব তা পড়লে তোমার সব রাগ চলে যাবে। কথাটা হচ্ছে – আমি আমার সমগ্র জীবনের বিনিময়ে তোমাকে চেয়েছিলাম। তোমাকে পেয়েছি। পৃথিবীর কাছে আমার আর কিছুই চাইবার নাই।অরুর চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসছে। সে খাতা বন্ধ করে বালিশের নীচে রেখে ঘুমিয়ে পড়ল। গাঢ় ঘুম। ঘুমের মধ্যে বিচিত্র একটা স্বপড়ব দেখল – মুহিব বেড়াতে এসেছে তাদের বাসায়। খালি গায়ে এসেছে। মুহিব গম্ভীর মুখে বলল, অরু তুমি তোমার বাবা মা‘কে ডেকে আন। আমি উনাদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। খালি হাতে আসিনি। মিষ্টি নিয়ে এসেছি। দু‘কেজি স্পঞ্জ রসগোল্লা।অরু বলল, তুমি খালি গায়ে এলে?

‘খালি গায়ে না এসে কি করব? তুমি আমার পাঞ্জাবীটা পুড়িয়ে ফেললে না? পাঞ্জাবীটা পরে আসব বলে ভেবেছিলাম।‘ ‘এইভাবে তো তুমি বাবা-মা‘র সঙ্গে দেখা করতে পারবে না।‘ ‘তাহলে কি করব, চলে যাব?‘ ‘না, চলে যাবে কেন? আমার ঘরে চুপচাপ বসে থাক। আমি তোমার জন্যে চট করে একটা পাঞ্জাবী বানিয়ে দি।‘ ‘পারবে?‘ ‘অবশ্যই পারব। কাপড় কেনা আছে।‘ ‘সময় লাগবে না তো?‘ ‘না, সময় লাগবে না। সিম্পল পাঞ্জাবী বানাবো। গলায় একটু হালকা সুতার কাজ করে দেব।‘ ‘দেরী হবে না তো?‘ ‘না, দেরী হবে না।‘

স্বপ্নের পরবর্তী অংশে দেখা গেল অরুর বিছানায় শুয়ে মুহিব ঘুমুচ্ছে। তার গায়ে সাদা চাদর। অরু মেঝেতে বসে পাঞ্জাবীর গলায় সুতোর কাজ করছে। কাজটা খুব দ্রুত করতে হচ্ছে বলে সুচ বার বার আঙ্গুলে ফুটে যাচ্ছে। রক্ত বেরুচ্ছে। সেই রক্ত লেগে যাচ্ছে পাঞ্জাবীতে। অরু যতই তাড়াহুড়া করছে ততই পাঞ্জাবীর গায়ে রক্ত মেখে যাচ্ছে।

 

Read more

কৃষ্ণপক্ষ পর্ব – ৬ হুমায়ূন আহমেদ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *