কোথাও কেউ নেই পর্ব – ০৮ হুমায়ূন আহমেদ

কোথাও কেউ নেই পর্ব – ০৮

মুনা কী জবাব দেবে ভেবে পেল না। তাকাল বাকেরের দিকে। বাকের দাঁত বের করে হাসছে। কেন হাসছে কে বলবে। এটা একটা লজ্জায় ফেলার প্রশ্ন, এতে হাসির কিছু নেই।

উকিল সাহেব অ্যাসট্রেতে একগাদা থুথু ফেলে সেদিকে গভীর মনোযোগের সঙ্গে তাকিয়ে রইলেন। যেন এই মুহূর্তে থুথুটায় বিরাট একটা কিছু ঘটবে। সেই ঘটনা তিনি প্রত্যক্ষ করতে চান। এক সময় তার দেখা শেষ হল। তিনি গম্ভীর গলায় বললেন–চুরি যদি না করে থাকেন। তাহলে খালাস করে আনা মুশকিল। আর যদি সত্যি চুরি করে থাকেন। সহজেই খালাস হয়ে যাবে।

মুনা অবাক হয়ে বলল, তার মানে?……অপরাধীদের খালাস করা অতি সহজ। এরা যখন অপরাধ করে কিছুটা সাবধান হয়েই করে। কোর্টে অপরাধ প্রমাণ করা কঠিন হয়। আর যারা অপরাধী না, ভাল মানুষ–তারা পড়ে যায় প্যাঁচকলে। হা হা হা।

মুনা অবিশ্বাসী চোখে তাকিয়ে রইল। ভদ্রলোক গম্ভীর হয়ে বললেন, অপরাধীদের খালাস করে আনার মধ্যে একটা আনন্দ আছে। আইনের পশ্চাৎদেশে লাথি বসানোর আনন্দ। আমি এটা খুব এনজয় করি।

বাকের শব্দ করে হাসতে লাগল। সে মুগ্ধ। মুনা কিছু বলল না। উকিল সাহেব জড়ানো স্বরে বললেন। এই জাতীয় ছোটখাটো মামলা আমি নিই না। তবে আপনারটা নেব।

মুনা একবার ভাবল বলে আমারটা কেন নেবেন? কিন্তু সে কিছু বলল না। উকিল সাহেবের চোখ তার বুকের ওপর স্থির হয়ে আছে। শাড়ির আঁচল টেনে দেয়া উচিত। সেটা অভদ্রতা হবে। এতটা অভদ্র হওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। মুনা বলল, আমরা কী তাহলে উঠব?

হ্যাঁ উঠবেন। যাবতীয় কাগজপত্র এবং আসামিকে সঙ্গে নিয়ে আসবেন। কবে আসবেন সেটা আমার মুহুরির কাছ থেকে জেনে যান।………মুহুরি কোথায়?…………..পাশের ঘরে। আর শুনুন–আমার ফিস কিন্তু বেশি এবং ফিসের টাকার সবটা আমি অ্যাডভান্স নেই। আজ এক টাকা কাল আট আনা–এই ভাবে নেই না।

আপনার ফিস কত?…………সেটা বলব কাগজপত্র দেখে।……….বাকের দাঁত বের করে বলল, একটু সার কনসেশন করতে হবে। গরিব মানুষ সার ভেরি নিডি।…….কনসেশন কিছু নেই। অনোর বেলায় যা আপনাদের বেলাতেও তা। মাছের বাজার তো না।

মুনা বেরিয়ে এসেই বিরক্ত স্বরে বলল ভেরি নিডি, গরিব মানুষ, এসব বলার দরকার কী?…..দরাদাম করতে হবে না? বল কী তুমি? বাড়িতে তো তোমার টাকার গাছ নেই।………লোকটাকেও আমার পছন্দ হয়নি। আস্ত ছোটলোক।

ছোটলোক কী বড়লোক এটা দিয়ে আমাদের দরকার কী? আমরা দেখব কাকে দিয়ে কাজ উদ্ধার হয়। এই শালাকে দিয়ে হবে। এ হচ্ছে নাম্বার ওয়ান ধনুকর।…………ধনুকর মানে?

ধনুকর মানে হচ্ছে যে, ধুনে দেয়। এই শালা ধুনে দেবে। এক ধাক্কায় মামাকে খালাস করে নিয়ে আসবে। এখন যে জিনিসটা লাগবে সেটা হচ্ছে টাকা। মানি। এখন শুরু হবে টাকার খেলা। টাকা-পয়সা কেমন আছে তোমাদের?

মুনা জবাব দিল না। টাকা-পয়সা তেমন কিছু নেই। মামার কাছে ছ-হাজার টাকা ছিল। তার থেকে এখন কত আছে কে জানে। তার নিজের একাউন্টে পাঁচ হাজার টাকার মত আছে। বেতনের টাকা থেকে জমানো। মামির কিছু গোপন সঞ্চয় আছে। তাঁর ভাই তাকে ঈদ উপলক্ষে টাকা-পয়সা যা দেন তার সবটাই মামি জমিয়ে রাখেন। একটা পাই পয়সাও খরচ করেন না।

বাকের বলল, কোল্ড ড্রিংক-ট্রিংক কিছু খাবে? ফান্টা, পেপসি?………মুনা বিরক্ত স্বরে বলল–ঠাণ্ডার মধ্যে ফান্টা-পেপসি খাব কী জন্যে?…………..তাহলে গরম কিছু খাও। চা খাবে?………..আমি এখন কিছু খাব না। আপনি চলে যান, আমার অন্য কাজ আছে।

কী কাজ?………….এক জায়গায় যাব।…………চল আমি দিয়ে আসি। আমার এখন কোনো কাজ নেই, ফ্রি আছি।………………..আপনি তো সব সময়ই ফ্রি।

বাকের শুকনো মুখে বলল, মামুন সাহেবের কাছে যাচ্ছো? তিনি তো আমার মত ফ্রি না। কলেজ-টলেজ আছে। তাকে কী এখন পাবে?

মামুন সত্যি সত্যি ছিল না। গতকাল রাতের ট্রেনে দেশের বাড়িতে চলে গেছে। কেন গিয়েছে তা মেসের কেউ বলতে পারে না। কাউকে জানিয়ে যায়নি। মুনা বড়ই অবাক হল। এমন হুঁট করে চলে যাবে? কিছু বলেও যাবে না। কবে ফিরে আসবে তাও কেউ বলতে পারল না।

বেলা সাড়ে এগারোটা। মুনা বাসায় ফিরে যাবার জন্যে রিকশা নিল, কিন্তু মাঝপথে ঠিক করল। অফিসে যাবে। পর পর দু’দিন কামাই হয়েছে। আজ নিয়ে তিন দিন হবে। এটা ঠিক না। কিন্তু অফিসে যেতে ইচ্ছা করছে না। কিছুতেই মন বসছে না।

আকাশে মেঘ করেছে। বৃষ্টি হবে বোধ হয়। রিকশাওয়ালা প্রচণ্ড গতিতে রিকশা টানছে। একটা অ্যাকসিডেন্ট-ট্যাকসিডেন্ট বাধাবে। মুনা একবার ভাবল বলবে আস্তে চালাও ভাই। কিন্তু কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। কেন যেন শুধু কান্না পাচ্ছে। দুঃসময়ে কাউকে কাছে থাকতে হয়।

শওকত সাহেব সারাদিন কোথায় কোথায় যেন ঘুরে বেড়ান। বাসার সঙ্গে সম্পর্ক নেই বললেই হয়। নাশতা খেয়েই বেরিয়ে পড়েন, ফেরেন সন্ধ্যা মেলাবার পর। কারো সঙ্গে কোনো কথা বলেন না। হাত-মুখ ধুয়ে বারান্দায় ক্যাম্পখাটে শুয়ে থাকেন। বকুল ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে–চা দেব?

তিনি হ্যাঁ-না কিছুই বলেন না। তবে চা এনে দিলে নিঃশব্দে খান। আগের মত চিনি কম হয়েছে, লিকার পাতলা হয়েছে বলে চেঁচামেটি করেন না। বকুল যদি বলে চায়ের সঙ্গে আর কিছু খাবে? মুড়ি মেখে দেব? তিনি মৃদু স্বরে বলেন না লাগবে না।

রাত বাড়তে থাকে। তিনি বারান্দার বাতি জ্বালান না। অস্পষ্ট আলোতে পত্রিকার একটা পাতা চোখের সামনে ধরে রাখেন। বকুলের বড় মন খারাপ লাগে। খুব ইচ্ছা করে বাবার পাশে এসে বসতে, কিন্তু সাহসে কুলোয় না।

আজও তিনি অন্য দিনের মত ক্যাম্পাখাটে বসে আছেন। খালি গা। ঠাণ্ডা বাতাস দিচ্ছে। এবার শীত পড়ে গেছে আগেভাগে। শীতে একেকবার তিনি কেঁপে কেঁপে উঠছেন, বকুল একটা পাঞ্জাবি তাকে এনে দিল। তিনি যন্ত্রের মত পাঞ্জাবি গায়ে দিলেন। বকুল ভয়ে ভয়ে বলল বাবা তোমার কী শরীর খারাপ? তিনি কিছুক্ষণ থেমে বললেন শরীর ঠিক আছে রে মা; বকুলের চোখ ভিজে গেল। গলা ব্যথা ব্যথা করতে লাগল। আর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে সে হয়ত কেঁদেই ফেলবে। সে মাথা নিচু করে তার মার ঘরে ঢুকে পড়ল।

লতিফা বললেন তোর বাবা কী করছে?…………..বসে আছেন।………….মুনা? মুনা এখনো আসেনি?……………….এসেছে। শুয়ে আছে। মাথা ধরেছে।………..ওকে একটু ডেকে আন।………….বললাম না মাথা ধরেছে। এখন ডাকলে রাগ করবে।

লতিফা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। তাঁর অসুখ খুবই বেড়েছে। নতুন একটা উপসর্গ দেখা দিয়েছে শ্বাস কষ্ট। এত বাতাস চারদিকে অথচ প্রায়ই নিঃশ্বাস নেবার মত বাতাসের টান পড়ছে তার। সারারাত এ ঘরের সব ক’টি জানালা খোলা থাকে, ফ্যান চলে ফুল স্পিডে। তবু তিনি বাতাস পান না।

আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে শ্বাস কষ্ট শুরু হলেই শওকত সাহেব তাঁর পাশে এসে বসেন। মাথার ওপর ফ্যান ঘুরছে, তবু তিনি একটা হাতপাখা নিয়ে বাতাস করেন। লতিফার লজ্জা লাগে। আবার ভালও লাগে।

শওকত সাহেব অনেক’দিন পর এ ঘরে ঘুমুতে এলেন; মিনমিন করে একটা অজুহাত ও দিলেন বিছানায় পিঁপড়া উঠেছে। লাজুক ভঙ্গি। বিয়ের প্রথম ক’দিন এ রকম হয়েছিল। দীর্ঘদিন পর যেন বিয়ের প্রথম দিকের রাত ফিরে এল। পৃথিবীতে কিছুই বোধ হয় শেষ হয় না। পুরনো ঘটনা আবার ঘুরেফিরে আসে। অর্থহীন কথাবার্তাও তাদের মধ্যে হল। লতিফা বললেন, বকুলের বিয়ে সত্যি সত্যি হলে মন্দ হয় না, কী বল? তিনি বললেন, ভালই হয়।

এ রকম ছেলে পাওয়া ভাগ্যের কথা ঠিক না?…………..হুঁ।……….তবে বড় বেশি বড়লোক। এত বড়লোকের সঙ্গে সম্পর্ক করতে ভয় ভয় লাগে।……………ভয়ের কী?………শওকত সাহেব অন্ধকারে একটা সিগারেট ধরান; বড় মায়া লাগে লতিফার। ইচ্ছা করে একটা হাত গায়ের ওপর উঠিয়ে দিতে কিন্তু লজ্জার জন্যে পারেন না।

যৌবনের কথা অস্পষ্ট ভাবে তার মনে পড়ে; কত রহস্যময় রাত গিয়েছে। গল্প করতে করতেই কতবার ভোর হল। পাখ-পাখালি ডাকতে লাগল। কতবার আফসোস করেছেন রাতগুলি এত ছোট কেন?

মানুষের সব কিছুই ছোট ছোট। জীবন ছোট। ভালবাসা বাসির দিন ছোট শুধু দুঃখের কাল দীর্ঘ। ভাবতে ভাবতেই নিজের অজান্তে ফুঁপিয়ে ওঠেন। শওকত সাহেব ব্যস্ত হয়ে বলেন কী হয়েছে?

কিছু হয়নি।…………..শ্বাস কষ্ট?………….হুঁ।……………..পানি খাবে? পানি এনে দেই?…..না, কিছু আনতে হবে না। তুমি ঘুমোও।

লতিফা তার রোগজীৰ্ণ শ্ৰীহীন হাত বাড়িয়ে দেন। গত রাতটা তারা দু’জন জেগেই কাটিয়েছেন। আজও কী সে রকম হবে?…..বকুল কেমন রাগী রাগী মুখ করে বসে আছে বিছানার পাশে। এমন বিরক্ত তার মুখের ভাব যে কিছু বলতেই ভরসা হয় না।

তবু লতিফা ক্ষীণ স্বরে বললেন তোর বাবা কী করছে?……..একবার তো বলেছি মা; কিছু করছেন। ক্যাম্পখাটে বসে আছে।………….ডেকে নিয়ে আয় না।………….কী জন্য?……এমনি। তোকে ডাকতে বলছি ডাক।

বকুল চলে যায়। লতিফা আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করেন। কেউ আসে না এই ঘরে। বকুল নিশ্চয়ই বলেনি কিছু। বাবার সঙ্গে ছেলেমেয়েদের যোগাযোগ খুব কম! সবাই কেন তাকে এত ভয় পায়? ভয় পাওয়ার মত কী আছে এই মানুষটার?…………রাত নটার দিকে ঝমঝম কবে বৃষ্টি পড়তে লাগল। মুনা ঘুম ঘুম চোখে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। দুটো প্যারাসিটামল খেয়েও তার মাথাধরা সারেনি। কেমন যেন বমি বমি ভাব হচ্ছে এখন। হাত ধড়িয়ে সে বৃষ্টির ফোঁটা ধরতে চেষ্টা করল। তার কিছুই ভাল লাগছে না। তবু সে ফুর্তির আগলা একটা ভাব এনে উঁচু গলায় বলল। এই বাবু, বৃষ্টিতে ভিজবি? বাবু কিছুই বলল না। বকুল ও রাজি হল না।

একা একাই উঠোনে নামল মুনা। বৃষ্টির ফোঁটাগুলি অস্বাভাবিক ঠাণ্ডা! গা কেঁপে কেঁপে উঠছে। তবুও ভালই লাগছে। বাবু বাবান্দায় দাঁড়িয়ে দেখছে। মুন আবার ডাকল এই বাবু আয় না। বাবু কোনো জবাব দিল না। আকাশ ভেঙে বৃষ্টি পড়তে লাগল।

স্কুল টিচারদের বাড়ি যে রকম থাকে রেহানা আপার বাড়ি সে রকম নয়। বাড়ি দেখেই মনে হয় স্কুল মাস্টারি তিনি সখের জন্যে করেন! মুনা অবাক হয়ে চারদিক দেখতে লাগল; ভারী ভারী সোফা। লাল কাঁপেট ঝকমক করছে। দেয়ালে কামরুল হাসানের ছবি। তিনটি মেয়ে নদীতে নাইতে নেমেছে। রেহানা আপা বললেন অরিজিনাল পেইনটিং; মুনা বলল চমৎকার তো।

উনি আমাদের দূর-সম্পর্কের আত্মীয় হন। বাসায় প্রায়ই আসেন।……….তাই নাকি?………হ্যাঁ। তুমি চা-টা কিছু খাও।…………..জি না। আমার শবীর ভাল না, গলাব্যথা। রেহানা।আপা সঙ্গে সঙ্গে উৎসাহী হলেন।

টনসিল নাকি?………….জি।…….এক গ্রাস গরম পানির মধ্যে কয়েক দানা লবণ আর পেয়াজের রস দিয়ে গার্গল কর, দেখবে সেরে যাবে।………….জি আচ্ছা করব।……………………এখানেই করা, আমি এনে দিচ্ছি।

মুনা না বলবার সময় পেল না। রেহানা আপা ভেতরে চলে গেলেন। মুনা বসে রইল একা একা। এ বাড়িতে অনেক লোকজন। কিন্তু কেউ বসবার ঘরে উঁকি দিচ্ছে না। তবে বেশ কয়েকবারই টের পাওয়া গেল পর্দার ওপাশে কৌতূহলী মেয়েরা উঁকি দিচ্ছে! কৌতূহলের কারণটি স্পষ্ট হচ্ছে না! তারা কী জেনেছে সে বকুলের বোন; যার সঙ্গে এ বাড়ির কোনো একটি ছেলের বিয়ের কথা প্রায় পাকাপাকি! সে কথাও জানার কথা নয়। মুনা শুধু রেহানা আপাকেই বলেছে আমি বকুলের বোন। আপনার সঙ্গে কথা বলতে এসেছি। তিনি নিশ্চয়ই সে কথা বাড়ির ভেতরে সবাইকে বলেননি। তাকে সে রকম মনে হয় না।

মুনাকে গার্গল করতে হল। অপরিচিত কোনো বাড়িতে বেড়াতে এসে শব্দ করে গার্গল করা খুব অস্বস্তিকর। কিন্তু উপায় নেই, রেহানা আপা পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি বললেন, এখন একটু আরাম লাগছে না?

জি লাগছে।………..এস, আমরা বসার ঘরে না বসে অন্য কোথাও বসি।…………চলুন।…রেহানা আপা তাকে দোতলার বায়ন্দায় নিয়ে এলেন। চমৎকার বারান্দা। ছবির মত সাজানো। ধবধবে সাদা বেতের চেয়ার। ছোট্ট একটা লেতের টেবিল। এই সাত সকালে ও টেবিলের ফুলদানিতে টাটকা ফুল রাখা হয়েছে। রোজই কী এ রকম রাখা হয়? রেহানা আপা বললেন বল কী বলবে? মুনা ইতস্তত করতে লাগল। কীভাবে কথাটা শুরু করা যায় বুঝতে পারল না।

কোনো রকম সংকোচ বা লজ্জা করবে না বল।…….বকুলের ঐ বিয়েটার ব্যাপারে খোঁজ নিতে এসেছিলাম। আমার মামা-মামির খুধ আগ্রহ।…….আমাদেরও আগ্রহ। তোমার বোন মেয়েটি ভাল। একটু বোধ হয় বোকা সেটাও ভাল। বোকা মেয়েরা বৌ হিসেবে ভাল হয়।

মুনা তাকিয়ে রইল। এই নিয়ে আলাপ চালিয়ে যেতে তার ইচ্ছা হচ্ছে না। তবু সে ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, আপনারা একবার বলেছিলেন, পনেরো দিনের মধ্যে কাবিনের ঝামেলা মিটিয়ে ফেলতে চান।

হ্যাঁ তা চাই।…….আমাদের কোনো আপত্তি নেই। আপনারা যখন বলবেন তখনই আমরা রাজি আছি।……..রেহনা আপা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন একটা বড় রকমের প্রবলেম হয়েছে। তোমার সঙ্গে খোলাখুলি বলি; বকুলের বাবা শুনলাম অ্যারেস্ট হয়েছে। কথাটা বোধ হয় সত্যি। সত্যি না?

জি। ওঁকে একটা মিথ্যা মামলায় জড়িয়েছে।…….সেটা তুমি জানো এবং আমরা জানি। কিন্তু অন্যরা তো জানে না। তারা নিজেদের মত করে ঘটনাটা ব্যাখ্যা করবে! করবে না?……..জি করবে।….ব্যাপারটা কী রকম সেনসেটিভ বুঝতে পারছ।

পারছ না?……………পারছি!………..ধর, তোমার নিজের একটি ছেলের তুমি বিয়ে দিচ্ছি। বিয়ের এক সপ্তাহ আগে হঠাৎ দেখলে মেয়ের বাবাকে পুলিশ চুরির দায়ে ধরে নিয়ে যাচ্ছে কেমন লাগবে তোমার?……….আপা ওটা একটা মিথ্যা মামলা। বিশ্বাস করেন না!

বিশ্বাস করব না কেন? বিশ্বাস করছি। চা খাও, দাঁড়াও চা দিতে বলি।…মুনা না বলবার আগেই রেহানা আপা চা আনতে ভেতরে চলে গেলেন। ফিরে এলেন প্রায় সঙ্গে সঙ্গে! চা বোধ হয় তৈরিই ছিল। শুধু চা নয় সঙ্গে প্রচুর খাবার-দাবার।

রেহানা আপা অন্তিরিক স্বরে বললেন, খাও কিছু খাও। আমার বাড়ি থেকে কেউ না খেয়ে যেতে পারে না! মুনা ক্ষীণ স্বরে বলল বিয়েটা তাহলে হবে না?…………না। তারা অন্য মেয়ে দেখেছে। কথা ও মোটামুটি পাকা করে ফেলেছে।

ও।……………দিনাজপুরের মেয়ে। হোম ইকনমিক্সের ছাত্রী। বাবা রিটায়ার্ড সেশন জজ।………মুনা কিছু বলল না। রেহানা আপা বললেন বকুলের বিয়ে নিয়ে চিন্তা করবে না। ওর বিয়ে আমি দিয়ে দেব। এই ছেলের চেয়েও অনেক ভাল ছেলে জোগাড় করব।

কী ভাবে করবেন? ওরাও নিশ্চয়ই বাবা সম্পর্কে জানতে চাইবে।…….তা চাইবে। কিন্তু এ সব কথা লোকজন বেশি দিন মনে রাখে না। প্রথম কিছু দিন খুব হৈচৈ হয়, তারপর সবাই ভুলে যায়।

মুনা বলল আমি উঠি।………………একটু বস।………আমার অফিসে যেতে হবে দেরি হয়ে যাচ্ছে।…..না দেরি হবে না। আমার এক ননদ গাড়ি নিয়ে এসেছে, তাকে বলেছি সে তোমাকে পৌঁছে দেবে।

মুনা বসে রইল। রেহানা আপা বললেন কেইস শুরু হবে কবে?………খুব শিগগিরই শুরু হবার কথা।………………ভাল উকিল দিয়েছো তো?…………..দিয়েছি।

আমার নিজের জানাশোনা কিছু উকিল আছে। আমি বললে ওরা বিনা ফিতে মামলা দেখে দেবে। বলব?………..তার দরকার নেই।………..বকুল স্কুলে আসে না অনেক দিন থেকে। ওকে স্কুলে আসতে বলবে। পরীক্ষার ডেট দিয়ে দিয়েছে।

মুনা বিস্মিত হল। বকুল স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে তার জানা ছিল না। রেহানা আপা বললেন, বাবা কী করেছে না করেছে তার জন্যে মেয়ে কেন লজ্জিত হয়ে ঘরে বসে থাকবে? তুমি খুব কড়া করে ধমক দিয়ে তাকে স্কুলে পাঠাবে।

জি আচ্ছা!……মুনাকে দিয়ে আবার তিনি গার্গল করালেন; এবং সত্যি সত্যি তার গলাব্যথা অনেকখানি কমে গেল!

সে অফিসে ঢুকল ভয়ে ভয়ে; গত দু’দিন নানান ছোটাছুটিতে অফিসে আসা হয়নি। ঘন ঘন কামাই হচ্ছে। বড় সাহেবের কানে উঠেছে নিশ্চয়ই। নিজের জায়গায় বসে মুনার ধারণা আরো দৃঢ় হল। সবাই তাকাচ্ছে তার দিকে। পাল বাবু এসে বললেন বড় সাহেব খোঁজ করেছিলেন আপনাকে।

কবে?…………পরশু খোঁজ করলেন। কাল খোঁজ করলেন। আমরা বলেছি অসুস্থ!……..কি জন্যে খোঁজ করেছেন জানেন?…………..না! যান জেনে আসুন! স্যার আছেন।…………মুনা ঠাণ্ডার মধ্যে ঘামতে লাগল।

বড় সাহেব শুকনো গলায় বললেন বসুন, দাড়িয়ে কেন?……….মুনা বসল। এই ঘরটায় ঢুকলেই তার এমন অস্বস্তি লাগে দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়। সব সময় মনে হয় এক্ষুণি এই ছোটখাটো লোকটি চেঁচিয়ে উঠবে। যদিও কোনো সময়ই তিনি তা করেন না।

শরীর খারাপ ছিল?……..জি না স্যার, একটা ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছি। খুব ছোটাছুটি করতে হচ্ছে।……….ঝামেলাটা কী বলুন? অবশ্য যদি আপত্তি না থাকে। আপনার ঝামেলার জন্যে অফিসের কাজকর্মের ক্ষতি হচ্ছে। কাজেই আপনার সমস্যা জানার রাইট আমার আছে।

মুনা রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছলো এবং ক্ষীণ স্বরে তার মামার কথা বলল। বড় সাহেব চোখ বন্ধ করে সিগারেট টানতে লাগলেন। তার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে তিনি কিছু শুনছেন না কিন্তু মুনা জানে তিনি খুব মন দিয়েই শুনছেন।

আপনিই সব দেখাশোনা করছেন?…………জি।…………বাড়িতে পুরুষ মানুষ কেউ নেই?………..আছে স্যার; আমার ছোট ভাই। খুব ছোট। ক্লাস সেভেনে পড়ে।…..মামলাটা শেষ হতে কতদিন লাগবে?………উকিল সাহেব বলেছেন এক মাসের মত লাগবে।

বড় সাহেব সিগারেট অ্যাসট্রেতে গুঁজে রাখলেন। গম্ভীর গলায়, আপনি মেডিক্যাল গ্রাউণ্ডে এক মাসের ছুটির দরখাস্ত করুন; আমি ব্যবস্থা করে দেব। নিজের সমস্যা ভালমত মেটান।…..মুন্না ক্ষীণ স্বরে বলল, থ্যাংকয়্যু স্যার।

বড় সাহেব সহজ গলায় বললেন, আমরা বাবা মারা যান যখন আমরা সবাই খুব ছোট। সেই সময় আমার বড় বোন শুধু এম.এ. পড়তেন। তিনি একটা চাকরি নেন! নানান রকম ঝামেলার মধ্যে দিয়ে আমাদের বড় করতে থাকেন। তিনি কোনোদিন ঠিকমত অফিসে যেতে পারতেন না। প্রায়ই অফিস কামাই হত। তার বস প্রতি সপ্তাহেই বলতেন, তোমার চাকরি শেষ। আগামীকাল থেকে আর আসবে না।

মুনা চুপ করে রইল। বড় সাহেব দ্বিতীয় সিগারেট ধরিয়ে হাসি মুখে বললেন, কিন্তু ওটা ছিল মুখের কথা। ঐ বড় সাহেব একজন অসাধারণ মানুষ ছিলেন। তিনি আমাদের অনেক সমস্যার সমাধান করলেন এই অজুহাতে যেন আমার আপা ভালমত অফিসের কাজে মন দিতে পারেন। সবাই বলে মানুষের খারাপ সময়ে কাউকে পাশে পাওয়া যায় না। কথাটা ঠিক না। মানুষকে পাশে পাওয়া যায় দুঃসময়ে। আচ্ছা আপনি যান।

স্যার স্লামালিকুম।………………………….ওয়ালাইকুম আসসালাম। যদি কখনো মনে করেন আমাকে দিয়ে কিছু করানো সম্ভব, জানাবেন। আমি করব।

অফিসের বাইরে এসে মুনা চোখ মুছল। বড় সাহেবের এই সামান্য কথা তাকে অভিভূত করেছে। মাঝে মাঝে আমরা অতি অল্পেই অভিভূত হই। নিজের টেবিলে ফিরে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই তারেক এসে উপস্থিত। তার মুখ হাসি হাসি। যেন খুব মজার একটা ঘটনা ঘটেছে। তারেক খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বলল, আপনাকে একটা খবর দেয়া হয়নি, আমি বিয়ে করেছি।

সে কি! কবে?……………হুট করে হয়ে গেল। গত পরশু। মায়ের অসুখ শুনে দেখতে গিয়েছিলাম, গিয়ে এই কাণ্ড। তারেক লজ্জিত ভঙ্গিতে মানি ব্যাগ থেকে ছবি বের করল। লম্বা রোগা একটি মেয়ে। মিষ্টি চেহারা। তারেক মৃদু স্বরে বলল, অফিসে আপনিই প্রথম জানলেন, আর কাউকে বলিনি। মুনা অস্পষ্ট স্বরে বলল, খুব সুন্দর বউ হয়েছে।

ছবিতে যত সুন্দর দেখা যাচ্ছে, তত সুন্দর সে না। ফটো জিনিস ফেস আর কী। নাম হচ্ছে তনিমা।…………………………..সুন্দর নাম।…………………………………….ডাকনামটাই সুন্দর। ভাল নাম শুনলে চেয়ার থেকে লাফ দিয়ে উঠবেন। হা হা হা।

তারেক বেশ শব্দ করে হাসতে লাগল। একজন সুখী মানুষের হাসি। দেখতে ভাল লাগে।………………………….তুমি মনে হয় খুব খুশি?………………তা বলতে পারেন। আপনাদের বিয়েটা কবে হচ্ছে আপা?

বুঝতে পারছি না।………………….শুধু শুধু ঝুলিয়ে রাখবেন না। দি আরলিয়ার দি বেটার।…………………..বিয়ে করার পর এ রকম মনে হচ্ছে?………………………..হ্যাঁ তা হচ্ছে।

বিয়ের ব্যাপারটা তাহলে খুব খারাপ না?………………….তারেক মৃদু হাসলো। মুনা ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। অস্পষ্ট ভাবে তার মনে হল মামুন কী তার কাছে থেকে দূরে সরে যাচ্ছে? কী করছে সে এখন গ্রামে? একটা চিঠি লিখবে নাকি? চিঠি লেখার ইচ্ছা দীর্ঘস্থায়ী হল না। প্রচুর কাজ জমে আছে।

শওকত সাহেব সকাল থেকে বসে আছেন। উকিল খুব ব্যস্ত, সময় দিতে পারছেন না। বাকের শওকত সাহেবের পাশেই বসে আছে। মাঝে মাঝে বারান্দায় গিয়ে সিগারেট টেনে আসছে। একবার মুহুরি বলে এল আমাদের একটা কাজ আছে ভাই, কাইন্ডলি একটু দেখেন না। মুহুরি তাকে পাত্তাই দিল না। বাকের একবার ভাবল গরম দেখাবে। কিন্তু জায়গা খারাপ, গরম দেখানো ঠিক হবে না। ডাক্তার এবং উকিল। এই দুজায়গায় গরম দেখানো যায় না।

মামা, চা খাবেন?………………..শওকত সাহেব হ্যাঁ-না কিছুই বললেন না।…………চলুন গলাটা ভিজিয়ে আসি, দেরি হবে মনে হয়। মারাত্মক উকিল। ভিড়টা কেমন দেখলেন। বিকালের আগে চান্স পাওয়া যাবে না।

শওকত সাহেব চা খেতে গেলেন না। একা একা বসে রইলেন। তার খুব-একটা খারাপ ও লাগছে না। এমনিতেও তো বসেই থাকতেন। অফিস-টফিসের ঝামেলা তো আর নেই। অবশ্য গতকাল অফিসে গিয়েছিলেন। কোনো কাজের যাওয়া না, এমনি হঠাৎ গিয়ে উপস্থিত হওয়া একুশ বছরের অভ্যাস চট করে ছাড়া মুশকিল। তাকে দেখে সাধারণ ভাবে একটা মৃদু উত্তেজনা হল। শমসের আলি হঠাৎ খুব আন্তরিক ভঙ্গিতে দু’হাত তুলে চেঁচিয়ে উঠলেন আরে শওকত ভাই যে, আসেন আসেন। চেঁচানোটা এত উঁচু স্বরে হল যে অফিসের সবাই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল।

কোনো কাজে এসেছেন নাকি?…………….নাহ। ‘কাজ থাকলে বলেন। এতদিনের সম্পর্ক এক কথাম শেষ করে দিলেন। এটা একটা কথা হল? শমসের আলি জোর করে তাকে কান্টিনে নিয়ে গেলেন। হঠাৎ করে এই লোকটির এরকম দরদী হয়ে ওঠার কারণ তার কাছে স্পষ্ট হল না।

তারপর বলেন মামলার তদ্বির কেমন চালাচ্ছেন?………………..চালাচ্ছি।…………………ঢিল দেবেন না। একটু ও ঢিল দেবেন না। নেন সিগারেট নেন।

শওকত সাহেব সিগারেট নিলেন। শমসের অ্যালি গলা অনেকখানি নিচু করে বললেন ভেতরের খবর দেই একটা, সাদেক সাহেবের বিবরুদ্ধে মামলা উইথড্র করা হচ্ছে। আগে তো দুজনের বিরুদ্ধে চার্জ ছিল। এখন শুধু আপনার বিবরুদ্ধে।

তাই নাকি?…………………………………………….গুজবটা এ রকমই; গত মঙ্গলবারে সাদেক সাহেব অফিসে এসেছিলেন খুব হাসি হাসি মুখ। বিপদ আসে গবিবের উপরে, বড় কাতলা পার পেয়ে যায়।

 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *