কোথাও কেউ নেই পর্ব – ২৩ হুমায়ূন আহমেদ

কোথাও কেউ নেই পর্ব – ২৩

বাকের তার আধখাওয়া বেনসন বাড়িয়ে ধরেছে। রিকশাওয়ালা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল। কিন্তু সিগারেটের জন্যে কোনো আগ্রহ দেখাল না। ব্যাটা নবাবের বাচ্চা একটা চড় দিলে হারামজাদা তার বাপের নাম ভুলে যাবে। বাকের অবশ্যি চড় দিল না। দুটাকা বিকশিসের জায়গায় এক টাকা বকশিস দিল। বেয়াদবি না করলে দুটাকাই পেত। হারামজাদার কপালে নেই কি করা যাবে।জলিল মিয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।

সে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। জলিল মিয়ার চোখে চশমা, গায়ে ধবধবে পাঞ্জাবি। পেট আরো বড় হয়েছে। সে দোকানের বাইরে গ্যাসের চুলার কাছে বসে আছে। বিশাল কড়াইয়ে তেল গরম হচ্ছে। কারিগর এলেই জিলিপি ভাজা শুরু হবে। গত এক মাস ধরে তার দোকানে প্রতি বিকালে জিলিপি ভাজা হচ্ছে। সস্তায় ভাল কারিগর পাওয়া গেছে। রোজ আধমণের ওপর জিলিপি বিক্রি হয়। অবস্থা দেখে মনে হয় এই ব্যবসাটা তার কপালে লেগে গেছে। একবার যদি নাম ফেটে যায়–জলিল মিয়ার জিলিপি তাহলে আর দেখতে হবে না।

এই সব ব্যবসা হচ্ছে ভাগ্যের ব্যবসা। একই কারিগর তিন জায়গায় জিলিপি বানাবে এক জায়গায় লাগবে দুজায়গায় লাগবে না। লেগে গেলেও যন্ত্রণা, কারিগরকে চোখে চোখ রাখতে হবে। কে কখন ভাগিয়ে নিয়ে যায়। এখন বাজছে তিনটা। কারিগর আসছে না। লোক পাঠানো হয়েছে। জলিল মিয়া মনের উদ্বেগ চাপাতে পারছে না. এর মধ্যে উপস্থিত হয়েছে বাকের। আবার কোন যন্ত্রণ করবে। কে জানে?

বাকের দোকানে ঢুকতে ঢুকতে বলল, তারপর কেমন চলছে?……..জলিল মিয়া শুকনো গলায় হাসল। অতিরিক্ত দরদ ঢেলে জিজ্ঞেস করল, কবে ছাড়া পেলেন। বাকের ভাই?……………বাকের এই প্রশ্নের জবাব দিল না। হাজত প্রসঙ্গটা সে ভুলে থাকতে চায়। সে উদাস দৃষ্টিতে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, এখানকার খবর কী জলিল মিয়া?…………………………….জ্বি ভাল।

সিদ্দিক হারামজাদা কেমন আছে?…………..জলিল মিয়া চুপ করে রইল। বাকের উদাস গলায় বলল, হারামজাদাটাকে খুন করবার জন্যে এসেছি? বডি ফেলে দেব। টপ করে ফেলে দেব। আমার সাথে হুঁজ্জত। শালার পোঁদ পেকে গেছে। পোঁদ পাকার ওষুধ আমার কাছে আছে।

ইলেকশন করবেন। কমিশনার ইলেকশন। ৬নং ওয়ার্ড।……………ছয় নম্বর ওয়ার্ড আমি শালার পাছা দিয়ে ঢুকায়ে দেব। ছয় নম্বর ওয়ার্ড! শালা খবিস।………………..একটু আস্তে কথা বলেন বাকের ভাই।

আস্তে কথা বলব কেন? এটা কী মসজিদ নাকি?………….না মানে লাগানি-ভাঙানির লোক আছে তো।……………..আমি ভয় খাই নাকি? আমি ভয় খাওয়ার লোক?……..জলিল মিয়া বিমর্ষ মুখে তাকাতে লাগল।

সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে বড় রকমের ঝামেলা শুরু হতে যাচ্ছে। শুরুটা তার দোকান থেকে না হলেই ভাল হত। সিদ্দিক সাহেব বর্তমানে পাড়ার মুরুকিব। মানী লোক। উঠতি গুণ্ডী প্রায় সব কটাকে হাত করে ফেলেছেন। দু’একটা অচেনা মুখ আজকাল তার সঙ্গে দেখা যায়। ওদের চালচলন ভাল না। একজন সেদিন তার সঙ্গে এসে চা ওমলেট খেল। দাম না দিয়ে চলে যাচ্ছিল। আটকানোর পর দাম দিল ঠিকই কিন্তু এমন করে হাসল যে রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে যায়। নির্বিঘ্নে ব্যবসা করার দিন শেষ। জলিল মিয়া একা ক’দিন সামলাবে।

জলিল মিয়া!………..জি বাকের ভাই।…………ঐ বাড়ির খবর কি?……….কোন বাড়ির?……………….ঐ যে তিন কন্যার বাড়ি?……….কিছু জানি না তো।……….কিছু জানি না মানে? খোঁজখবর রাখেন না?………………নানান ধান্ধায় থাকি। ব্যবসা পাতির অবস্থা খুব খারাপ।

কি বল ব্যবসা পাতির অবস্থা খারাপ। দশ সেরা গোসত লেগেছে তোমার শরীরে। আধাসের আধাসের করে তোমার দুই গালেই আছে একসের। গোসত তো আর আপনা–আপনি হয় না।……………..চা দিব বাকের ভাই? কোন চা আছে। ইসপিসোল।

বাকের জবাব না দিয়ে উঠে পড়ল। পাড়ায় একটা চক্কর দেবে। এর মধ্যে পরিচিত কারো সঙ্গে দেখা হলে তো ভালই দেখা না হলেও ভাল। ভালমত সাবান দিয়ে একটা গোসল দেয়া দরকার। ইয়াদের বাসায় যাওয়া যেতে পারে। গোসলের পর গরম চা আর একটা বেনসন খেয়ে লম্বা ঘুম;

পরিচিতদের মধ্যে দুজনের সঙ্গে দেখা হল একজন হচ্ছে মোহসিন। বেশ কিছু দিন সে বাকেরের শাগরেদী করে এখন জগন্নাথ কলেজে বি কমে ভর্তি হয়েছে। শুক্রবারে জুম্মার নামাজ পড়ে। বাকেরের সঙ্গে দেখা হলে না চেনার ভান করে। আজ অবশ্যি তা করল না। চোখ কপালে তুলে বলল, বাকের ভাই না?……….হুঁ।

আছ কেমন?………..কবে ছাড়া পেলেন বাকের ভাই?………..বাকের গম্ভীর গলায় বলল, ছাড়া পাইনি। ছুটি নিয়ে এসেছি। সিদ্দিক হারামজাদাকে খুন করার জন্যে ছুটি নিলাম। খুন করে আবার গিয়ে ঢুকে পড়ব।

কি যে বলেন বাকের ভাই।………..কথাবার্তা পছন্দ হয় না? সত্যি কথা বললাম।……….আপনার চেহারা খারাপ হয়ে গেছে বাকের ভাই।………..চেহারা দিয়ে আমি করব কী বল, আমি তো আর সিনেমায় পার্ট করব না।

বাকের তাকে আর কিছু বলার সময় না দিয়ে এগিয়ে গেল। কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। পরিচিতদের সঙ্গে দেখা হবার ইচ্ছাটা মরে যাচ্ছে। তবু দ্বিতীয়জনের সঙ্গে দেখা হল জোবেদ আলি। এই চার মাসে লোকটা যেন আরো বুড়ো হয়ে গেছে। যে ভাবে মাথা নিচু করে হাঁটছে তাতে মনে হয়। পিঠে কুজ গজিয়ে যাবে। জোবেদ আলি বাকেরকে না দেখার ভান করে সরে পড়তে চাইছিল। বাকের সে সুযোগ দিল না।

এগিয়ে গেল এই যে ব্রাদার, পালাচ্ছেন নাকি?……….জোবেদ আলি আমতা আমতা করে বলল–কে?চিনতে পারছেন না? ভাল করে দেখেন। মাথাটা কামিয়ে ফেলেছি। বাকি সব ঠিকই আছে।……….আমার কিছু মনে থাকে না।

সুন্দরী সুন্দরী মেয়ে চারপাশে নিয়ে থাকেন মনে না থাকারই তো কথা। আমার নাম বাকের।……….ও আচ্ছা বাকের সাহেব।………….চিনতে পারছেন তাহলে?……..জি। অনেক’দিন আপনাকে দেখি নাই।

দেখবেন কি করে–আমি হাজতে ছিলাম। আপনাদের দোয়ায় আজ ছাড়া পেয়েছি।……জোবেদ আলির চোখ সরু হয়ে গেল। চশমা ঝুলে পড়ল। সে প্রায় ফিসফিস করে বলল, এখন যাই। কাজ আছে।

আরে ভাই এই চৈত্র মাসের দুপুরে কিসের কাজ? দাঁড়ান একটু গল্পগুজব করি। মেয়ে কি আপনাদের এখনো তিনটাই না। আরো বাড়িয়েছেন?

আপনার কথা বুঝলাম না।…………বিজনেস আরো বড় করেছেন না। আগের মত ছোটখাটো আছে?…………আপনি খুব বেতালা কথা বলেন।………….তাই নাকি?…………..বেতালা কথা বেশি বলা ভাল না।

জোবেদ আলি হাঁটা শুরু করল। মাথা নিচু করে চোরের মতো ভঙ্গিতে হাঁটা। একবার শুধু থমকে দাঁড়িয়ে পেছনে ফিরল। বাকের তাকিয়ে আছে। তার মুখ হাসি হাসি। কিছুক্ষণ আগে যে বিরক্তি তাকে ঘিরে ছিল এখন আর তা নেই। তার বেশ মজা লাগছে। ইয়াদের বাসায় যাবার ব্যাপারে এখন বেশ আগ্রহ বোধ করছে।

ইয়াদ বাসায় ছিল না।…………দরজা খুলল তার বৌ। ছোটখাটো একটা মেয়ে মাত্র গোসল করে এসেছে। চুলে গামছা জড়ানো গায়ের শাড়িও ভালমত পরা নেই। সে ভেবেছে ইয়াদ। কড়া নাড়া মাত্র দরজা খুলে এমন হকচাকিয়ে গেছে।

সে ক্ষীণ স্বরে বলল, উনি বাসায় নেই।………….কোথায় গেছে?…………..অফিসে।……………আমার নাম বাকের। আজ হাজত থেকে ছাড়া পেয়েছি।……….মেয়েটি কিছুই বলল না। সে শাড়ি দিয়ে নিজেকে ভালমত ঢাকতেই ব্যস্ত।…………………ইয়াদ আসবে কখন?…………..সন্ধ্যার পর আসবে। আপনি সন্ধ্যার পর আসুন।

মেয়েটি এমন ভাবে দরজা বন্ধ করল যেন সে একজন ভিখিরিকে পয়সা দিয়ে বিদেয় করে দিচ্ছে। বাকেরের মন অসম্ভব খারাপ হয়ে গেল। মেয়েটা বলতে পারত। আপনি বসুন। বসুন বললেই তো সে খালি বাড়িতে হুঁট করে ঢুকে যেত না। মেয়েটি তাহলে এ রকম করল কেন? কোথায় যাওয়া যায়? সারা গায়ে প্রচুর ফেনা তুলে ঠাণ্ডা পানি দিয়ে গোসল কবার জন্যে মন কেমন করছে। গোসলের পর গরম এক কাপ চা। একটা ফাইভ ফাইভ কিংবা বেনসন।

বাকের আবার রাস্তায় নামল। সূর্য হেলে পড়েছে। কিন্তু এখনো তার কী প্রচণ্ড তেজ। রাস্তায় পিচ গলে যাচ্ছে। জুতার সঙ্গে লেগে সমান মোটা হলে একটা কথা ছিল … একটা বেশি উঁচু অন্যটা। কম। যার জন্যে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হচ্ছে।

বাকের ভাই না? কবে ছাড়া পেয়েছেন?…………অচেনা একটা ছেলে। দাঁত বের করে আছে। ইয়ারকি দিতে চায় সম্ভবত। কিংবা তাকে দেখে যে কোন কারণেই হোক মজা পাচ্ছে।………..আপনাকে অবিকল কোজাকের মতো লাগছে।

তাই নাকি?…………ছেলেটি মাথা ঝাকাল। বাকের একবার ভাবল ব্যাপারটা গুরুত্ব দেবে না। চেংড়া ছেলে।পুলের সব কথা ধরতে নেই। তবু শেষ সময়ে মাথায় কি যেন হল বাকের প্রচণ্ড একটা চড় বসিয়ে দিল। ছেলেটি ছিটকে পড়ল। রাস্তায়–সেখান থেকে গড়িয়ে গেল আরো কিছু দূর। সে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। কপাল ফেটে গলগল করে রক্ত পড়ছে।

বাকের দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। চায়ের পিপাসা হচ্ছে। জলিল মিয়ার স্টলে গিয়ে এক কাপ চা খেলে হয়। মুখের ভেতরটা তেতো লাগছে। সারা শরীরে ঘামের কটু গন্ধ। আশ্চর্য কোথাও গিয়ে সে কি শান্তিমত একটা গোসল ও করতে পারবে না? মুনার কাছে গেলে কেমন হয়?……….ঠিক এই অবস্থায় মুনার সামনে উপস্থিত হবার কোন মানে হয় না।

তাছাড়া মুনাকে এখন নিশ্চয়ই পাওয়াও যাবে না। অফিস করছে। সন্ধ্যার আগে ফিরবে না। অফিস করা মেয়েগুলি আবার অফিস ছুটি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাসায় ফিরতে পারে না। সাজানো-গোছানো দোকান দেখলেই তার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে; ঘণ্টা খানিক চলে যায়।

বাকের সন্ধ্যর পর পর মুনাদের বাসার দিকে রওনা হল। ইতিমধ্যে তার বেশভূষা পাল্টে গেছে। গায়ে ইস্ত্রি করা পাঞ্জাবি (ইয়াদ দিয়েছে), নতুন স্যান্ডেল (কেনা হয়েছে), পকেটে নতুন রুমাল (কেনা)। গালে আফটার শেভ দেয়ায় ভুরিভুর করে গন্ধ বেরুচ্ছে। এটা একটু অস্বস্তিকর। আফটার শেভ না দিলেই হত।

মুনাদের বাসায় বিরাট এক তালা ঝুলছে। বাকের তালা ধরেই খানিকক্ষণ ঝাকাঝাকি করল। অফিস থেকে এখনো ফিরেনি তা কি করে হয়? আটটা বাজে। রাত আটটা পর্যন্ত মুনা বাইরে ঘুরবে: নাকি? তালার সাইজ দেখে মন হয় মুনা বেশ কিছু দিন ধরেই বাইরে। অফিসিযাত্রীরা এত বড় তালা লাগায় না।

রাত নটার দিকে বাকের আবার গেল। এখনো তালা ঝুলছে। ঘর অন্ধকার। বাড়িওয়ালার কাছ থেকে জানা গেল দিন দশেক আগে মুনা তাকে বলেছে সে কিছু দিনের জন্যে বাইরে যাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে কবে ফিরবে কিছু বলে যায়নি।

বাকের থমথমে গলায় বলল, কোথায় গেল জিজ্ঞেস করলেন না?…………..বাড়িওয়ালা বিরক্ত স্বরে বলল, আমার এত ঠেকা কিসের?……….কথার ধরনে বাকেরের রাগ উঠে যাচ্ছিল। অনেক কষ্টে সে রাগ থামাল।

মনে মনে কয়েকবার বলল, লাশা, লাশা। উল্টো করে শালা বললে রাগ নাকি কমে যায়। এই জিনিসটা সে হাজতে শিখে এসেছে। ব্যাপারটা সত্যি না। বাকেরের রাগ কমল না। তবুও সে কয়েকবার বলল–লাশা লাশা।………………..বাড়িওয়ালা হারামজাদা, মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিল।

জাহানারা গা ধুয়ে ছাদে গিয়ে বসেছে।…………..ক’দিন ধরেই অসহ্য গরম। গা ধুয়ে ছাদে বসে থাকলে কিছুক্ষণ ভাল লাগে তারপর আবার শরীর ঘামতে থাকে। ইচ্ছে করে বিরাট কোনো দিঘিতে ডুবিয়ে বসে থাকতে। পদ্মদিঘি–যার জলে টাটকা পদ্মের গন্ধ।

আজ ছাদে বসে থাকতে ভাল লাগছে না। বাতাস একেবারেই নেই। অনেক দূরের আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। লোক দেখানো বিদ্যুৎ। বৃষ্টি বাতাস হবে না। জাহানারা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল! ছাদে বসে থাকার কোনো অর্থ হয় না। এরচে বসার ঘরে ফ্যানের নিচে বসে থাকা ভাল। বাতাস খানিকটা লাগবে।

বড় আপা।………….জাহানারা চমকে তাকাল। মীরা উঠে এসেছে। সে তার স্বভাবমত পা টিপে টিপে এসে কানের কাছে চেঁচিয়েছে। বড় আপা।……….চমকে দিয়েছি আপা?……….হুঁ। খুব খারাপ অভ্যাস মীরা। মানুষকে চমকে দিয়ে তোর লাভটা কি হয়? কেন এ রকম করিস?…….আর করব না। নিচে যাও আপা। তোমার কাছে একজন ভদ্রলোক এসেছেন।

আমার কাছে এত রাতে?……….রাত তো বেশি হয়নি আপা। মোটে নটা একুশ। ভদ্রলোক আসার সঙ্গে সঙ্গে ঘড়ি দেখলাম।……..কে সে?…………জানি না কে? খুব ভীতু ভীতু চেহারা। আমাকে আপনি আপনি করে কথা বলল। এটা কি মিস জাহানারার বাসা? উনি কি আছেন? তাকে দয়া করে বলবেন মামুন সাহেব এসেছেন। নিজেকে চমৎকার করে সাহেব বলল। আমি আর একটু হলে হেসে ফেলেছিলাম।

জাহানারা বিস্মিত হয়ে নিচে নেমে এল। এত রাতে হুঁট করে বাসায় উপস্থিত হবার কোন মানে হয়? তার সঙ্গে এমন কোন ঘনিষ্ঠতা নিশ্চয়ই নেই।

মামুনের মুখে অপ্রস্তুত একটা ভঙ্গি। এত রাতে উপস্থিত হবার কারণে সে নিজেও যে লজ্জিত তা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। কাজটা যে ভাল হয়নি চলে যেতে পারলে সে বাঁচে এই ভাবটা স্পষ্ট। জাহানারার একটু মায়াই লাগল।

আরে আপনি।………..অসময়ে এসে পড়েছি। খুবই লজ্জিত। এত রাত হয়েছে বুঝতে পারিনি।……দাঁড়িয়ে আছেন কেন বসুন। রাত এমন কিছু বেশি হয়নি।……….আগেও কয়েকবার এসেছি আপনার সঙ্গে দেখা হয়নি। একবার অবশ্যি বাসাতেও এসেছিলাম।

কই আমাকে তো কেই কিছু বলেনি।…….না মানে আপনাকে বলবার কথাও নয়। আমি রাস্তা থেকে চলে গেছি।………..কি আশ্চর্য কেন?…………সেবার ও রাত হয়ে গিয়েছিল। ভাবলাম এত রাতে বিরক্ত করা।

আপনার বান্ধবী কেমন আছেন?…………প্রশ্নটা করে জাহানারা নিজেই খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে গেল। হঠাৎ করে বান্ধবীর প্রসঙ্গ নিয়ে আসার কোনোই কারণ নেই। কিংবা কে জানে হয়ত কারণ আছে। হয়ত তার অবচেতন মনে এই প্রসঙ্গটা আছে!………….মুনার কথা বলছেন?…………………..জি।

ওর কোন খবর পাচ্ছি না। বাসায় তালা। দু’দিন গিয়ে ঘুরে এসেছি। কোথায় গেছে তাও কেউ জানি না।………..অফিসে যান। অফিসে গেলেই নিশ্চয়ই খোঁজ পাবেন। অফিসে গিয়েছিলেন?…..জি না।

মামুনের মন একটু খারাপ হল। অফিসের কথা তার মনে আসেনি।…..চা খান।……….জি না চা খাব না। আজ উঠি।……….এসেই উঠবেন কেন? বসুন গল্পটল্প করুন। আপত্তি না থাকলে রাতে আমাদের সঙ্গে খান।

মামুন কিছু বলল না। জড়সড় হয়ে বসে রইল। তার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে খাওয়ার ব্যাপারে তার কোনো আপত্তি নেই। অথচ খাবার কথাটা জাহানারা নিতান্তই ভদ্রতা করে বলেছে। ঘরে আয়োজন খুবই সানান্য। দুপুরের তরকারির অবশিষ্ট দিয়ে রাতে চালানোর কথা। জাহানারা একবার ভাবল বলবে থাক আপনার খাওয়ার দরকার নেই মেনু খুব খারাপ। অন্য এক’দিন এসে খেয়ে যাবেন। কিন্তু এ জাতীয় কোন কথা বলাও সম্ভব নয়। একটু আগে খেতে বলে পরমুহূর্তে না বলা যায় না। জাহানারা তাকে বসিয়ে রেখে রান্নাঘরে চলে গেল।

অসহ্য গরমে রান্নাঘরে ঢোকা মানে নরকে প্রবেশ করা। নতুন কিছুই তৈরি করাও ঝামেলা। কয়েকটা শুকনো বেগুন ছাড়া কিছুই নেই। মা ভাল থাকলে এই নিয়েই কিছু-একটা করে ফেলতেন। মার শরীর দু’দিন থেকে খুব খারাপ। হাঁপানীর টান উঠেছে। ঘর অন্ধকার করে পড়ে আছেন।

রান্নাঘরে জাহানারার সামনে মুখ নিচু করে মীরা বসে আছে। সে একটু পর পর ফিক করে হেসে ফেলছে এবং সেই হাসি গোপন করবার জন্যে প্ৰাণপণ চেষ্টা করছেন। জাহানারা বিরক্ত হয়ে বলল, হাসছিস কেন?

মীরা বলল, ঐ লোকটা কে আপা?…………কেউ না। একজন চেনা লোক।……..মীরা আবার হেসে ফেলল। জাহানারা ঝাঁঝাল গলায় বলল, গ্রামে যখন পোস্টিং হয়েছিল তখন এই ভদ্রলোক অনেক সাহায্য করেছেন। এখানে বেড়াতে এসে আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। ভদ্রতা করে খেতে বলেছি তাতেই রাজি হয়ে আমাকে বিপদে ফেলেছেন–এর মধ্যে হাসির কি আছে?

তুমি কৈফিয়ত দিচ্ছ কেন আপা?…….কৈফিয়ত দিচ্ছি না। কৈফিয়ত দেবার কি আছে? তুই এখানে বসে না থেকে ভদ্রলোকের সঙ্গে গল্প কর। একা একা বসে আছেন।……….আমি বরং লায়লা আপাদের বাসা থেকে এক বাটি তরকারি নিয়ে আসি?………….কিছু আনতে হবে না।

মীরা তার আপার কথা শুনল না। পাশের বাসা থেকে তরকারি নিয়ে এল। সে ভেবেছিল আপা রাগ করবে। রাগ করল না। মুখ দেখে মনে হল খুশিই হয়েছে। মীরা চলে গেল বসার ঘরে। মামুন হাসিমুখে বলল, এস খুকি? কি নাম তোমার? মীরা বিরক্ত হল। লোকটা এখন আবার তুমি করে বলছে।

আমার নাম মীরা।…………..দু’বোন তোমরা?…………দু’বোন এক ভাই। ভাই গেছে নানার বাড়ি বেড়াতে।……….কি পড় তুমি?……ইউনিভার্সিটিতে পড়ি। সেকেন্ড ইয়ার। সাবজেক্ট হচ্ছে ফিলসফি।

কি সর্বনাশ। আমি ভেবেছিলাম। এইট নাইনে বোধ হয় পড়; আগে টের পেলে খুকি বলতাম না। তোমার আপা কোথায়?………..রান্নাঘরে। খেতে রাজি হয়ে আপনি আমাদের বিপদে ফেলেছেন। ঘরে খাবার কিছু নেই। পাশের বাড়ি থেকে বাটিতে তরকারি। আনতে হল।

সে কি!………….অবশ্যি ওরাও মাঝে মাঝে নিয়ে যায়। এটা কোন ব্যাপার না। শোধবোধ হয়ে যায়।…..মামুন এই চমৎকার চেহারার ফুটফুটে মেয়েটির প্রতি গাঢ় মমতা বোধ করল। কি সুন্দর মুখে মুখে কথা বলছে। জাহানারা এ রকম নয়। কথা সে প্রায় বলেই না।

আপনি নাকি আপাকে অনেক সাহায্য-টাহায্য করেছেন। কি সাহায্য করেছেন?……..আমি তো কোনো সাহায্য করিনি। উল্টো উনি আমাকে সাহায্য করেছেন। ব্যাংকের একটা লোনের ব্যাপারে খুব সাহায্য করেছেন।

উনি কিন্তু আপনার কথা আমাকে একবারও বলেননি।………আমার কথা কি বলবেন? আমার সম্পর্কে বলার তো কিছু নেই। আমি বরং উনার সম্পর্কে অনেক কিছু বলতে পারি।……………….বলুন শুনি।

মামুন হেসে ফেলল। মীরা কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে আছে। অপরিচয়ের সংকোচ বলে কিছুই তার মধ্যে নেই। মামুনের মনে হল এই মেয়েটি তার বোনের কিছুই পায়নি। তার মধ্যে প্রবল। কেমন অবলীলায় পা নাচাচ্ছে। .

মীরা বলল, চুপ করে আছেন কেন? আপার কথা বলুন।………..তোমার আপা একা একা শ্মশানে ঘুরত। খুব পছন্দ করত।…………সে কি?……….হ্যাঁ, গ্রামের লোকজনের ধারণা … তোমার আপার সঙ্গে জ্বীন আছে।………..কি বলছেন এসব?…….সত্যি কথাই বলছি। কেউ অদ্ভুত কিছু করলেই গ্রামের লোকজন মনে করে তার সঙ্গে জ্বীন আছে। অদ্ভুত কাণ্ডটা সে করছে না। জ্বীন তাকে দিয়ে করাচ্ছে।

আপনি কি কখনো জ্বীন দেখেছেন?……….না। তবে জ্বীন নামানোর একটা আসরে ছিলাম।…………ঐ গল্পটা বলুন।…………..অনেক লম্বা ব্যাপার–আরেক’দিন না হয় বলব।……..আপনি আবার কবে আসবেন তার কি কোনো ঠিক আছে? আজই বলুন।

গল্প শুরু করা গেল না। জাহানারা শাড়ির আঁচলে ঘাম মুছতে মুছতে বসার ঘরে ঢুকাল। ক্লান্ত গলায় বলল, খাবার নিয়ে আয় মীরা। রান্না হয়ে গেছে।………..একটু পরে আনি আপা? উনি একটা জ্বীনের গল্প মাত্র শুরু করেছেন।

জাহানারা বিরক্ত গলায় বলল, গল্প আরেক’দিন হবে। রাত হয়ে যাচ্ছে না? ঝড়-বৃষ্টি হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টি হলে উনি থেকে যাবেন। অসুবিধা কি? ভাইয়ার ঘর তো খালিই আছে।

অকারণে বকবক কারিস না তো।………..মীরা উঠে গেল। মামুন বলল, আপনার বোনটিকে চমৎকার লাগল। একেবারে বালিকা স্বভাব। ইউনিভার্সিটিতে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে, বিশ্বাস হয় না।…………ইউনিভার্সিটিতে পড়ে আপনাকে কে বলেছে? ও এইবার মাত্র ক্লাস টেনে উঠেছে। ওর কথাটাও বিশ্বাস করবেন না।

মামুন হেসে ফেলল। প্রথম বারেরমত জাহানারার মনে হল এই লোকটার হাসিটা তো বেশ সুন্দর। সহজ হাসি। সব মানুষ সরল ভঙ্গিতে হাসতে পারে না। মনের মধ্যে জটিলতা তাদের হাসির মধ্যেও অদৃশ্য ভাবে ছায়া ফেলে।

মামুন বলল, আমি হুঁট করে আসায় আপনি কি আমার ওপর রাগ করেছেন?……..না। রাগ করব কেন?……….বিরক্ত যে হয়েছেন এটা বুঝতে পারছি। তবু যেতে ইচ্ছা করছে না।……জাহানারা কি বলবে ভেবে পেল না।

মীরা এসে বলল, ভাত দেয়া হয়েছে।………….জাহানারার মা হাসিনা বিছানায় শুয়ে থাকলেও কোথায় কি হচ্ছে সব বুঝতে পারেন। আজ তার হাঁপানীর টান উঠেছে। শ্বাস নেবার কষ্টের সঙ্গে যোগ হয়েছে। গরমের কষ্ট। সন্ধ্যাবেলায় আধা কপালী মাথার যন্ত্রণায় ছটফট করছেন। তবু এর মধ্যেও টের পেলেন অপরিচিত একজন যুবকের জন্যে এ বাড়িতে রান্নাবান্না হচ্ছে।

তিনি বুঝতে পারছেন যুবক জাহানারার পরিচিত। অফিস করা মেয়েদের অনেক পরিচিত পুরুষ থাকে। এটা স্বীকার না করে উপায় নেই। কিন্তু তাই বলে তারা রাতে ভাত খাবার জন্যে থেকে যাবে কেন? তারা কি জানে না। একজন অবিবাহিতা মেয়ের কাছে রাত-বিরাতে যেতে নেই। মেয়ে বা মেয়ের আত্মীয়-স্বজন কিছু মনে না করলেও আশপাশে লোকজন আছে না? কেউ যদি হঠাৎ করে একটা কথা বলে ফেলে তখন? মানুষের মুখেই জয় আবার মানুষের মুখেই ক্ষয়। মেয়ের নামে বদনাম বের হতে সময় লাগে না। কেউ একটা কথা বললে দশজন সেই কথাটা দশ রকম করে একশজনকে বলবে।

হাসিনা বিছানায় উঠে বসে বেড সুইচে বাতি জ্বালালেন। এটা তার সংকেত। বাতি জ্বালানো মানে তিনি চান কেউ আসুক তার ঘরে। অন্ধকার ঘরের অর্থ হচ্ছে তিনি কারোর সঙ্গ কামনা করছেন না।

মীরা ঘরে ঢুকল। হাসিনা বললেন, কে এসেছে? মীরা গম্ভীর গলায় বলল, আপার বন্ধু।………..আপার বন্ধু আবার কে?………………আছে একজন। এতদিন আপা কাউকে বলেনি বলে আমরা জানতে পারিনি। এখন জানলাম।

তুই কি বলছিস?………………………..ঠিকই বলছি মা। খুব শিগগিরই এ বাড়িতে বিয়ে লেগে যাবে। হলুদ বাট, মেন্দি বাট বাট ফুলের মউ।

হাসিনা কাতর গলায় বললেন, জাহানারাকে ডেকে আন তো।……………মীরা আপা পাশে বসতে বসতে বলল, এখন ডাকা যাবে না। ওরা দু’জন সুখ-দুঃখের কথা বলছে।

হাসিনা অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে রইলেন। জাহানারার মত মেয়ে নিজে একটা ছেলেকে পছন্দ করেছে, আলাদা একটা ঘরে বসে গল্পগুজব করছে এই ব্যাপারটা তার বিশ্বাস হচ্ছে না। এখন যদি ইলেকট্রিসিটি চলে যায়? ইলেকট্রিসিটি চলে গেলে অবস্থাটা কি হবে? ঢাকা শহরের ইলেকট্রিসিটির কি কোন ঠিক আছে? হাসিনার প্রায় দম বন্ধ হয়ে আসছে।

হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। ইচ্ছা করছে উঠে বসার ঘরে চলে যান এবং কঠিন গলায় বলেন। এই ছেলে, তুমি কেমন ভদ্রলোক বল তো এত রাত পর্যন্ত…হাসিনা আর ভাবতে পারলেন না। ভাবা সম্ভবও নয়। দিনকাল পাল্টে গেছে। কিছু বলতে ইচ্ছা করলেও বলা যায় না।

জাহানারা ঘরে ঢুকে শান্ত গলায় বলল, মা উনি আপনার সঙ্গে দেখা করবেন।…………..হাসিনা তীক্ষ্ণ চোখে তাকালেন। এই ঘরের বাল্ব চল্লিশ পাওয়ারের। পরিষ্কার কিছু দেখা যায় না।……….উনার নাম মামুন। গ্রামে যখন পোস্টিং ছিল তখন আমাকে অনেক সাহায্য করেছেন।

 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *