খোয়াবনামা – আখতারুজ্জামান ইলিয়াস – অনেক রাতে বৈকুণ্ঠ আসে

খোয়াবনামা – আখতারুজ্জামান ইলিয়াস - অনেক রাতে বৈকুণ্ঠ আসে
খোয়াবনামা – আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ৪০. অনেক রাতে বৈকুণ্ঠ আসে

একদিন অনেক রাতে বৈকুণ্ঠ আসে তমিজের বাপের হাত ধরে। তমিজও তখন কেবল ফিরেছে। বৈকুণ্ঠ বলে, তোর বাপ নিন্দের মধ্যে পাকুড়তলাত ঘুরিচ্ছিলো। হামাক চিনবার পারলো না। ধর্যা লিয়া আলাম। মাচায় শুয়ে তমিজের বাপ তার ঘুম অব্যাহত রাখে। বৈকুণ্ঠ বলে, তমিজ, তোর বাপোক দেখ্যা রাখিস। আজ ক্যামা মুনসির ডাক শুনলাম রে। পাকুড়গাছ তো নাই, মুনসি কোটে বস্যা ডাক পাড়ে দিশা পাই না।

তমিজ বলে, বাজানেক ধরবি এক মুনসি। তোমাকে ধরার মানুষের অভাব নাই বৈকুণ্ঠদা। হুঁশিয়ার হয়া থাকা ভালো।

মুকুন্দ সাহাও বলে, বৈকুণ্ঠ রাতবিরাতে ঘোরাফেরা করিস, দিনকাল ভালো লয়। আসমান আর মোসলমান—এই দুয়ে বিশ্বাস নাই। এই মেঘ, এই ফর্সা। এই রোদ এই আন্ধার। কাদের মিয়া কয়া গেলো, ইনডিয়ার রিফিউজি দিয়া টাউন বলে ভরা গেছে। ইগলান কথা হামাক শোনায় কিসক?

যুধিষ্ঠির একদিন মুকুন্দ সাহার দোকানে এসে কেঁদে ফেলে, কন তো বাবু, ইগলান কী জুলুম! মাঝিপাড়ার কয়টা চ্যাংড়া সেদিন বাড়িত যায়া দুইটা কোদাল আর একটা দাও লিয়া আলো। দাম চালাম তো চেত্যা উঠলো। কয়, এই দাও দিয়া আফসারের মরার শোধ লেওয়া হবি। কন ভো বাবু, এখন কি করি? যুধিষ্ঠিরের দুজন সঙ্গীর একজন অতোটা ভীতু নয়, সে এটার বিহিত করতে যাবে নায়েববাবুর কাছে। নায়েববাবুর ভরসাতেই তো তারা দশরথের হত্যার প্রতিশোধ নিতে তৈরি হচ্ছিলো। তা মুকুন্দ সাহা কি আর করে, নায়েববাবুর কাছে চললো ঐ তিনজনকে নিয়ে। নায়েব কাছারিতে নাই, কয়েকদিন ধরে সে আসে না। কামারদের আবদারে মুকুন্দকে তখন দল নিয়ে ছুটতে হলো টাউনে। নায়েববাবু টাউনেও নাই। পরিবার ছেলেমেয়ে নিয়ে গেছে জলপাইগুড়ি। চাকরের কাছে শোনা গেলো, কোন মুসলমানের সঙ্গে বাড়ি বদল করার ব্যবস্থা করতে গেছে।নায়েবাবু অবশ্য আসবে, তাকে তো আসতেই হবে। নইলে জমিদারি দেখাশোনা করবে কে? কিন্তু সেরকম আসাযাওয়ায় মুকুন্দ সাহা কি কামাররা ভরসা পায় না।

বৈকুণ্ঠ অভয় দেয়, হামাগোরে সন্ন্যাসী ঠাকুর আছে না? মোসলমানরা কি তাক কম মানে?

ভরসা দিয়ে যায় কালাম মাঝি, সাহাচিন্তার কারণ নাই। কোনো শালা কিছু করবার পারবি না। তবে সে নিজেই খানিকটা চিন্তিত, মুশিকল কি, হিন্দুস্থানে মোসলমানেক কচুকাটা করিচ্ছে, টাউনের মানুষ দেখলাম খুব গরম।

হিন্দুর লাশভরা বগি নিয়ে পাকিস্তান থেকে রোজ ট্রেন যাচ্ছে শেয়ালদা। স্টেশনে আজ টাউন থেকে নিয়ে আসা তিন দিন আগের আনন্দবাজার পত্রিকার এই খবরটা বলতে মুকুন্দ সাহার ভয় করে। কালাম মাঝির মেজাজ যে কখন কী হয় বলা মুশকিল। এর এক সপ্তাহের মধ্যে টাউন থেকে ফিরে কালাম মাঝি তার দোকানে হাটের স্থায়ী দোকানদারদের সবাইকে ডাকে। বৈকুণ্ঠকে দশ টাকার নোট দিয়ে বলে, গোপালের দোকান থ্যাকা মিষ্টি লিয়া আয়। দশ টাকারই আনবু।

এতো খুশি কিসের?—আজ ইসমাইল হোসেনের সাক্ষাতে নায়েববাবুর সঙ্গে কালাম মাঝি বন্দোবস্ত করে এলো, কাৎলাহার বিলের পত্তন এখন থেকে তার নামে। লেখাপড়া সব শেষ। মণ্ডলের মেয়াদ চৈত্র পর্যন্ত। নায়েববাবুর তেমন ইচ্ছা ছিলো না, মণ্ডলের কাছ থেকে টাকা তো কম খায় নি। কিন্তু ইসমাইল হোসেন কলকাতা থেকে জমিদারের চিঠি নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেছিলো। নায়েব বাপ বাপ করে কালামের নামে লিখে দিলো।

মাঝিপাড়ায় খবর চলে যায়। কালাম মাঝি রাত্রে বাড়ি আসবে জেনেও মাঝিরা দলে দলে তার মুখে সব শুনতে ছুটে আসে গোলাবাড়িতে। মাঝিদের বিল মাঝিদের হাতে ফিরে এসেছে শুনে কেউ কেউ তখনি বিলে গিয়ে জাল ফেলতে চায়। কালাম মাঝি তাদের থামায়, উগলাম কাম করো না গো। ল্যাখাপড়া সব ফাইনাল। এখন মণ্ডলের কাছ থ্যাকা বুঝা লেওয়া বাকি।

তমিজও খবর পেয়ে ছুটে এসেছিলো হুরমতুল্লার জমি থেকে বাড়ি থেকে তার বাপটাও এসেছে। তমিজের বাপের হাত ধরে নিজের দোকানে তুলতে তুলতে কালাম মাঝি বলে, এই বুড়া মানুষটাক কী বেইজ্জতি না করিছে! এখন ইনসাফ কায়েম হবি। হামার কাৎলাহার বিলে পরথম জাল ফেলার হুকুম হামি দিমু এই বুড়া মানুষটাক। তোমরা সোগলি শুন্যা রাখো। বাঘাড় মাঝির লাতি, যি সি মানুষ লয়।

কিন্তু কালাহার বিলে জাল ফেলার সুযোগ তমিজের বাপের আর হলো না। ঐ দিন গোলাবাড়িতে কালাম মাঝির দোকানে মিষ্টি খেয়ে সে ঘরে ফেরে একটু রাত করে। তখন তার খিদেও পেয়েছে। শুধু নুনমরিচ দিয়ে ভাত, কুলসুম সেটাও একবারের বেশি দিতে পারে না। তবে তমিজের ধান তো এসে যাচ্ছে কয়েক দিনের মধ্যেই। আর কয়েকটা দিন এরকম এক বেলা কি আধপেটা খাওয়া। তারপর অন্তত মাস দুয়েক সানকি সানকি ভাত জুটবে। কয়েক মাসের মধ্যে বিলের দখল এসে গেলে ভাতের সাথে। বড়ো বড়ো মাছের চাকা। মাছভাত খাওয়ার সম্ভাবনায় তমিজের বাপের পেটে নতুন হাওয়া খেলে, সেই হাওয়ায় তার চোখে নামে রাজ্যের ঘুম। এক পশলা ঘুমের পর তার ঘুম তন্দ্রায় নেমে এলে সে উঠে পড়ে মাচা থেকে এবং হাঁটা দেয় কাৎলাহার বিলের। দিকে। কদমে কদমে ঘুম তার ফের ঘন হয়, সুতরাং চেনা পথ ধরে উত্তর সিথান পর্যন্ত যেতে তার একটুও এদিক ওদিক হয় নি।

সেই সন্ধ্যায় মাঝিপাড়ার অনেকেই বিলের এ মাথা ও মাথা ঘুরে এসেছে। কিন্তু তমিজের বাপ যখন পৌঁছলো তখন কেউ নাই। ইটের ভাটার পাশে খড়ের চালার নিচে ঘুমিয়ে রয়েছে ইটখোলার মিস্ত্রিরা। বিলের ধারে দাঁড়িয়ে নিজের পায়ের আঙুলে ভর করে ঘাড়ের রগ টানটান করে সে যতোটা পারে ওপরে তাকায়। পেছনের ইটের ভাটার মন্থর ধোয়া কুয়াশায় মিশে উত্তরের আসমানকে যতোটা পারে আড়াল করে রেখেছে। উত্তরের গাছ তার নজরে ঠেকে আর কি করে? ঐ আড়ালের সুযোগ নিয়ে লুকোচুরি খেলার টু-কি দেওয়ার মতো কে যেন ফুটো গলায় গলা খাঁকারি দেয়। তমিজের বাপের সারা শরীর কেঁপে ওঠে। তার হাত পা বুক চিনচিন করে, এমন কি আধপেটা খাওয়া পেটটাও মোচড় দিয়ে ওঠে, হাত পা বুক, পেট, ঊরুর ওপরকার ও হাঁটুর নিচের ঘা শিরশির করে; চোখে মুখে ও গালে শিরশির করে মুনসির গলার স্বর।

কিন্তু এই শোলোকের কথা তো বোঝা যায় না। এটা মুনসি ছাড়া কেউ নয়, চেরাগ আলি কখনো এমন কথাছাড়া শোলোক কয়নি, তার গলাও তো এটা নয়। শোলোক : আসছে উত্তর থেকে, সুতরাং এর উৎস খুঁজতে তমিজের বাপকে একটু পিছু হটতে হয়। উত্তরের আকাশ জুড়ে তখন ফুঁড়ে ওঠে নানান রঙের আলো। মুনসির মুখের আদল বড়ো ঝাপসা, কিংবা চারদিকের আলোতে তার মুখ ঢাকা পড়েছে আলোর নিচে। তার কালো। টুপিজুলছে কালো আগুনে, বন্দুকের গুলিতে-ফাকা গলার নিচে লোহার শেকলে লাল আগুনের আভা। আর সমস্ত কুয়াশা জ্বলে তার সাদা দাড়ির ঝাপটায়। মাছের মুখের নকশা-আঁকা লোহার পান্টি তার জ্বলছে দাউদাউ করে। সেই সঙ্গে পোড়ে তার পাকুড়গাছ। হায়, হায়, মুনসির আরস পুড়ে যাচ্ছে তার নিজের আগুনে? তমিজের বাপের গায়ে আগুনের আঁচ লাগলে সে তাড়াতাড়ি করে পেছনে হাঁটে। একটু দক্ষিণে। সরলে তার বামে বিলের ধারে অনেকটা জায়গা জুড়ে বালি, সেই বালির ওপর মুনসির আরস-পোড়া ছাই পড়তে দেখে সে সাহস করে ওপরে তাকায়। মণ্ডলের শিমুলগাছের পোষা ঝাকের উড়াল দেখে তার ভয় বাড়ে, বালির ওপর কি তাদের ডানার ছায়া পড়ে? না-কি পোড়া পাকুড়গাছের ছাই ঝরে পড়ছে তাদের ডানা থেকে? সেই ছাই থেকে বাচতে কিংবা গায়ে মাখার জন্যে সেই ছাই নিতে তমিজের বাম পা ফেলে আরো পুবদিকে। তার পা লাগে চোরাবালির সীমানা ঠিক করার জন্যে ইটখোলার মিস্ত্রিদের পোতা বাঁশের সঙ্গে। তার ভীতু ও তেজি কদমের তোড়ে বাঁশ উপড়ে তমিজের বাপ পড়ে যায় চোরাবালির ভেতর।

 

সকালবেলা তমিজের বাপের বাম পা প্রথম দেখতে পায় হঁটখোলার মিস্ত্রিরা। ওপড়ানো বাঁশের গাঁটের সঙ্গে মোটা কঞ্চির ফাঁকে আটকে ছিলো তার ভঁজ হওয়া হাঁটু। হাঁটুর ঘায়ের ওপর মলমের মতো লেগে ছিলো বালির একটা পরত। পশ্চিমা মিস্ত্রি বলে, ভাটার আগুন ঠিকমতো জ্বলছে কি-না দেখার জন্যে অনেক রাত্রে উঠে সে খেয়াল করে যে, ঐ আধ পাগলা মাঝিটা আসমানের দিকে তাকিয়ে দেওদানার সাথে কিসব বাতচিত করছে। তা লোকটা তো প্রায় রোজই আসে।-ভাটা ঠিকঠাক আছে দেখে মিস্ত্রি ঢুকে পড়ে ফের তার ঝোপড়ির মধ্যে। তারপর তোররাতের দিকে সে এদিকে হুটোপুটির আওয়াজ পায়, তখনি তার মনে হয়েছিলো কোনো দেও বুঝি কারো সঙ্গে মারামারি করছে।

বেলা হতে হতে খবর চাউর হয়ে যায় চার দিকে। গিরিরডাঙা, নিজগিরিরডাঙা, গোলাবাড়ি, পালপাড়া এমন কি লাঠিডাঙার কাছারি থেকেও মানুষ আসতে থাকে দলে দলে।

তমিজের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিলো হুরমতুল্লা, বুড়া খুব ভয় পেয়েছে, তমিজের কাছ ছাড়া হতে চাইছে না। তমিজ একেবারে চুপ। সে কেবল দেখছিলো বাপের হাঁটুর দিকে। বৈকুণ্ঠ একবার কাঁদছিলো তমিজকে জড়িয়ে ধরে, একেকবার সে ছুটে ছুটে যাচ্ছিলো চোরাবালির দিকে। তাকে ধরে রাখছিলো কেষ্ট পাল। কখনো কখনো চোরাবালি থেকে বৈকুণ্ঠকে দূরে সরিয়ে রাখার দায়িত্ব পালন করছিলো কেরামত আলি। তবে কুলসুমকে সমবেদনা জানানোটা আরো জরুরি বলে মনে হচ্ছিলো তার। স্বামীর এরকম অপঘাতে মরণে হতবিহ্বল মেয়েটির শোকমোচনের জন্যে যা কিছু করা সম্ভব। সবই করায় জন্যে কেরামত ছটফট করছিলো।

কালাম মাঝির আক্ষেপের প্রধান কারণ হলো, হায়রে, হামার বিলে পরথম জালটা হামি ফালাবার চাছিলাম বাঘাড় মাঝির লাতিক দিয়া। আল্লা হামার নিয়তটা পুরা করবার দিলো না। কপাল! হামার কপাল!

আবদুল আজিজ ও কাদের দুজনেই টাউনে। তবে শরাফত মণ্ডল এসেছে তার কামলাপাট নিয়ে। তার লোকদের দিয়ে লম্বা লম্বা বাঁশ বেঁধে আঁকসি তৈরি করিয়ে তমিজের বাপের হাঁটুর ভজের সঙ্গে আটকে তার লাশ তোলার আয়োজনও করলো মণ্ডলই । কিন্তু বাঁশের আঁকশি লাগিয়ে একটু টানতেই গোটা শরীর তার ড়ুবে যায় চোরাবালির ভেতরে। ওপরের কাঁপন দেখে মনে হয় তার শরীরটা বোধহয় নেমে যাচ্ছে অনেক নিচে। যাচ্ছে তো যাচ্ছেই।।

বৈকুণ্ঠ বারবার তার বুড়ো আঙুল কাটা হাতটার সঙ্গে সবগুলো আঙুলওয়ালা হাত জোড়া করে সবাইকে মিনতি করে, তমিজের বাপেক আপনেরা ওটি থাকবার দেন গো! তিনি লিজে তার আসন পছন্দ করিছে, হামরা বাধা দেই ক্যাংকা করা? কান্নায় তার গলা আটকে আসে, দলদলা দিয়া তমিজের বাপ কোটে গেছে হামরা তার কী জানি? পাকুড়গাছ লিয়া মুনসি কোনমুখে গেলো কেউ কবার পারে? তমিজের বাপ তার সাথ : ধরিছে! তাক লিয়া আপনেরা আর টানাটানি করেন না গো!

শরাফত মণ্ডল তার ওপর রাগ করে, আঃ তুই এতো কথা কোস কিসক রে? মোসলমানের মুর্দা, শরিয়ত মোতাবেক তাক গোসল করান লাগবি না? তার কাফন লাগবি না? তার জানাজা পড়ান লাগবি না?

কালাম মাঝি মণ্ডলের সঙ্গে একমত। তবে তার অতিরিক্ত প্রস্তাব হলো এই যে, তমিজের বাপের কবর হবে মাঝিদের পুরোনো গোরস্তানে। ওখানে তার বাপদাদা পরদাদার কবর। কেউ দখল করলেই ঐ গোরস্তান তার সম্পত্তি হয়ে গেলো না। পাকিস্তান কোনো মগের মুল্লুক নয়! আর তমিজের বাপের মাজার হবে গোরস্তানের ঠিক–মাঝখানে! সে তো আর যে সে মানুষ ছিলো না, এই এলাকার সবাই তাকে ইজ্জত করেছে।

তমিজের বাপের লাশ কিন্তু আর ভোলা গেলো না। তখন কালাম মাঝি প্রস্তাব করে, সে নিজেই চোরাবালির চারদিকে অনেকটা জায়াগা ইট দিয়ে বাঁধিয়ে দেবে।

এর মানে মণ্ডলদের ইর্টখোলার অনেকটা চলে যাবে এই মরা মাঝির দখলে। তবু গোরস্তান দখলের তুলনায় এতে লোকসান অনেক কম। শরাফত তখন নিজেই। প্রয়োজনীয় সমস্ত ইট বরাদ্দ করার কথা ঘোষণা করে।

তিন দিনের মধ্যে ইটখোলার এক নম্বর হঁট দিয়ে চোরাবালির সবটাই ঘিরে দেওয়া। হলো। চোরাবালির খানিকটা পড়ে পানির ভেতরে সেদিকটা অবশ্য ফাঁকাই রইলো। কুন্দুস মৌলবী তার তালেবেলেমদের নিয়ে কোরান খতম করতে লাগলো দেওয়ালের ধারে বসে। কালামের দোকান থেকে রোজ রোজ আগরবাতির কাঠি আসতে লাগলো গোছা গোছা।

তমিজ আজ এতো রাত করে কেন? দরজা খুলে চৌকাঠে বসলে কুলসুমের চোখের সামনে ঝোলে ঘন কুয়াশা। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলে চাঁদের ময়লা আলোয় কুয়াশা একটু তরল হয় এবং হালকা বাতাসে একটু দোলেও বৈ কি! মরার উঁদ যদি উঠলিই তো কয়টা দিন আগে উঠলি না কেন? সাত মাসের পোয়াতির মতো প্রায় ভরা ভরা চাঁদটা যদি দশ দিন আগে এমনি থাকে তো মানুষটা কী বিলের ধারে দলদলায় অমনি করে গড়িয়ে পড়ে। নিন্দের মধ্যে যে মানুষ হাঁটে তার সলকই কি আর আন্ধারই বা কি? কে জানে চোরাবালিকে পানি ঠাউরে সে নিজেই হয়তো ঝাঁপ দিয়েছিলো মুনসির ভেড়ায় সওয়ারি হবার আশায়। এ ছাড়া মুনসিকে সে আর ধরবে কোত্থেকে? পাকুড়গাছের নাকি চিহ্ন পর্যন্ত কোথাও নাই। তা মুনসি এখন তা হলে বিল শাসন করে কোন চুলায় বসে? চোরাবালির ভেতর থেকেই কী তমিজের বাপ এখনো উচাটন হয়ে খুঁজে বেড়ায় মুনসির কালো পাগড়িতে ঢাকা লম্বা দাড়িওয়ালা মুখ? তা টলতে টলতে মানুষটী কী একবার তার নিজের ভিটাটা দেখতে আসতে পারে না?

এক রবিবার আরেক রবিবার আট দিন, তারপর সোমবার গেলো মঙ্গলবার গেলো, কয়দিন হলো? এই দশ দিনে কুসুমের খোয়বেও সে কি একবার উঁকিটাও দিতে পারে না? এই কাৎলাহার ছেড়ে, গিরিরডাঙা নিজগিরিরডাঙা ছেড়ে, তাদের সবার মায়া কাটিয়ে নিজের পাকুড়গাছটাকে পর্যন্ত উপড়ে নিয়ে মুনসি যদি হাওয়া হয়ে যেতে পারে তো তার জন্যে তমিজের বাপের অতো দরদ কিসের?

মাটির হাঁড়িতে রেখে রোজ পান্তা খাওয়া হচ্ছে আজ কয়দিন থেকে। পান্তা মজে টক হয়, সেই ঘেরানে ভুরভুর করে সারা ঘর। সানকিতে পান্তা নিয়ে পেঁয়াজে কামড় দিতে গিয়ে কুলসুমের দাত বসে থাকে পেঁয়াজে, চিবানোর বল আর পাওয়া যায় না। দুই সানকি ভাত খেতে যে মানুষ শেষ করে ফেলে পাঁচটা পেঁয়াজ তার খোরাক এখন জোটে কীভাবে? কুলসুমের শুকনা চোখ খরখর করে। চাঁদের আলো তার চোখের সব পানি শুষে নিয়ে শিশিরের ফোঁটা করে ফেলে দিচ্ছে সামনের উঠানে, ঘরের চালে, নতুন খড়ের গাদায়। কুলসুমের চোখে পানি আর জমতে পারে না। তবে চোখে পানি না এ জমার একটি কারণ কিন্তু হতে পারে তার বড়ো বড়ো নিশ্বাস। গন্ধ নিতে নিতে কুলসুম হাপসে হাপসে পড়ে। কৈ তমিজের বাপের গন্ধ কোথাও নাই। মানুষটা তার গায়ের আঁশটে গন্ধ, মুখের পচা মাছের গন্ধ, হাঁটুর ওপরকার ঘায়ের পূজের গন্ধ, উরুর ঘায়ের বাসি গন্ধ সব নিয়ে গেছে মুনসিকে ভেট দিতে? এই যে দশটা দিন গেলো, কৈ কুলসুমের খোয়াবের মধ্যেও তো একবার এলো না।

আর মুনসিরই বা এ কেমন ধারা গো? তমিজের বাপকে কি মুনসি এতোই ভালোবাসে যে, তার নিজেরই খাস মানুষ ছিলো চেরাগ আলি, সারা জেবন কাটালো তারই শোলোক বলে বলে, তার নাতনিটার কথাটা কি একবার মনেও করলো না? আবার তমিজের বাপই বা কেমর মরদ যে, মুনসিকে বলতে পারলো না, তোমার নিজের আরস পাকুড়গাছের খবর নাই, ইটের ভাটায় ঢুকলো না কি উড়েই গেলো, তুমি আমাকে বসতে দেবে কোথায়? বলতে পারে না, এখানে আমি খাবো কী? আধপেটা খেয়ে কাটলো তার কতোগুলো দিন, এখন হুরমতুল্লার জমিতে ধান কেটে বেটা তার নতুন ধানের চালের ভাত খাওয়াবে। সে কি বলতে পারে না, তার বৌ আমন ধানের আতপ চালের পিঠা করবে, গুড় দিয়ে খির করবে, আমি এখন যাই!

হয়তো নতুন চালের ঘেরানে পিঠা খাবার লালচেই কুয়াশার ভেতর দিয়ে মাথায় শিশির নিয়ে এগিয়ে আসে তমিজের বাপ। তার ছায়া লেপ্টে থাকে জ্যোৎস্না মাখানো কুয়াশার সঙ্গে। কুলসুম চোখ বন্ধ করে রাখে, পাছে তার চোখের কাপনে মানুষটা ফেরম হারিয়ে যায়!

দরজাত বস্যা কী করো? ভাত খাছো? তমিজের গলা ঠাহর করতে পেরেও কুলসুম। কঁপে; ভয়ে কাঁপে, খুশিতে কাঁপে। মরার পর তমিজের বাপ বেটার রুহের সাথে মিশে এসেছে নিজের ঘর দেখতে।

ধান কিন্তু তমিজ এবারে তেমন পেলো না। মজুরি নিয়ে কাম করলেই ভালো হতো। হুরমতুল্লার মন খারাপ, তার ধানের ভাগ তো সেই আগের মতোই রয়ে গেছে। তমিজের সঙ্গে সে গজগজর করে, তোক কেটা কী কয়, আর তুই তাই লিয়া নাফ পাড়িস?

হুরমতুল্লা পরামাণিক হদ্দ চাষা, তার দৌড় বড়োজোর গোলাবাড়ি হাট পর্যন্ত।

আবদুল কাদের বলেছে। কেরামত গান বেঁধেছে। ইসমাইল হোসেনের মতো মানুষ পর্যন্ত কতবার করে বলেছে, পাকিস্তানে জমিদারি মহাজনি থাকবে না। তেভাগা নিয়ে বলেছে, পাকিস্তান হলে ওসব এমনি এমনি হয়ে যাবে। মোসলমান চাষারা অন্তত এসব নিয়ে হুজ্জত করা বন্ধ করলো কি মিছেমিছি? জেলখানায় তেভাগার নেতারা আফসোস। করেছে, তাদের কতো তেজি তেজি মুসলমান ছেলে পাকিস্তানের ডাকে মুসলিম লীগে ভিড়ে গেছে। তারা কি এমনি এমনি ভিড়েছিলো?

গোলাবাড়িতে কাদেরকে জিগ্যেস করলে সে গম্ভীর হয়ে যায়, উগলান কথা এখন রাখ। আমাদের নতুন রাষ্ট্র, ইনডিয়ার দালালরা মানুষকে খেপাতে চায়, মানুষ গোলমাল করলে ইনডিয়া সুযোগ নিয়া নয়া দেশটাকে খপ করা খায়া ফালাবি। ইনডিয়ার সমস্যাও কাদের তাকে বোঝায়, হিন্দুস্থানেত যারা চাষাদের নিয়া গোলমাল করে ঐ দেশের সরকার তাদের জেল দেয় : জহরলাল নেহেরু নিজে কতো জেল খাটিছে, এখন প্রধান মন্ত্রী হয়া কম্যুনিস্টদের জেলের মধ্যে ভরে।

তমিজ ধন্দে পড়ে। এই দলের মানুষ পাকিস্তানে গোলমাল করে হিন্দুস্থানের টাকা খেয়ে। আবার হিন্দুস্থানে গেলে তারা জেল পাটে। এর মানে কি? কিন্তু লোকে এখানে গোলমাল করবে কেন? ইসমাইল সাহেব না সেদিনও বলে গেলো, নতুন আইন পাস হলে বর্গাচাষাকে তার ন্যায্য পাওনা দেওয়া হবে।

সেই কথা বল। কাদের এবার তমিজের কথাটা বোঝে, জমিদারি উচ্ছেদের একটা। বিল সেদিন সরকারের মন্ত্রী তুলিছে। তার মধ্যে একটা কথা আছে, জোতদার ইচ্ছামতো বর্গাদারেক জমি থেকে উচ্ছেদ করবার পারবি না। হঁ্যা, বিল একটা উঠিছে।

এবার তমিজ খুশি, বিল হোক আর জমি হোক, মাঝি হোক আর চাষা হোক, হামরা ল্যায্য হক পালেই খুশি।

বিল সম্বন্ধে তমিজের ভুলটা ভাঙাবার ধৈর্য কাদেরের এখন নাই। সে হাসে, তোর এতো খবরের দরকার কী? তুই তো আর জমি বর্গা করিচ্ছিস না।

এবার না পারুক, সামনের আবাদ তমিজ বর্গায় করবে। জগদীশ সাহা আড়াই বিঘা জমি বেচলো হামিদ সাকিদারের কাছে। তবে তার এক দাগে প্রায় বারো বিঘা জমি বেচবে, কালাম মাঝি নাকি সবটাই কিনে নেবে। এই দুজনের যে কোনো একজনের কাছে গেলে তমিজকে কি আর খালি হাতে ফিরতে হবে? আবার একই জমিতে চিরকাল বর্গা করার হক পেলে তেভাগার আইন হতে আর কদ্দিন লাগবে?

নিশ্চিন্ত হলে তমিজের মনে পড়ে বাপের কথা। তিন চার দিন হয়ে গেলো বাজানের কাছে যাওয়া হয় নি।

চোরাবালির ধারে দাঁড়িয়ে তমিজের শীত শীত করে। বাপটা তার ঢুকে আছে ওর মধ্যেই, অথচ ঐ শরীর থেকেই তাপ নিতে তমিজের গা আইঢাই করে। সারা জীবন বিলের ধারে ধারে ঘুরলে কি হয়, বাজানের গতরে তাপ ছিলো অনেক। এখানে আছে,–একদিক থেকে ভালোই, বাপ তো তার এই বিলেরই মানুষ। তমিজকেও রাখতে চেয়েছিলো পানিতে পানিতে। বাঘাড় মাঝির বংশের ছেলে হয়ে সে লাঙল ধরবে বাজান এটা কখনোই চায়নি। আবার এই নিয়ে যে জেদ করবে সেই জোরটাও তো তার ছিলো না। এই দুনিয়ায় বাপ যদি কাউকে ভয় করতে তো সেই মানুষটা সে নিজে ছাড়া আর কে? খিয়ারে ধান কেটে বাড়ি ফিরে বাপকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখলে কি রাতভর বিলে কাটিয়ে তাকে ফিরতে দেখেলে তমিজ কী তারাতারা কথাই না বলতো! বাপের খাবার। লালচ নিয়েও কী না বলেছে! মানুষটা খেতে বড়ো ভালোবাসতো। তার খুব খাওয়ার হাউস ছিলো গো। খালি জেয়াফতের ধান্দায় থাকত। জেয়াফতে খেতে খেতে তার তবনের গেরো খুলে গেছে, বমি করে ফেলেছে, খেতে বসে পাদতে শুরু করে পাশের লোকের গালি খেয়েছে। এখানে এই শীতের মধ্যে তার খাওয়া নাই, পেট ছোেটানো নাই, বমি করা নাই। মরার আগে কতোদিন সে আধপেটা খেয়ে কাটিয়েছে। তখন নিত্যি রাত হলে বিলে চলে আসতো, পাকুড়গাছ খোঁজ করে করে খালি ঘুরপাক খেয়েছে। চোরাবালিতে ঢুকে মানুষটা এখন করে কী? এখানে না আছে পাকুড়গাছ, না আছে তার মুনসি। আবার বালির মধ্যে জেয়াফতের ধান্দাই কি সে করে বেড়ায়? খাওয়ার ঘেরান খুজতে খুঁজতে মানুষটা বালি খুঁড়ে খুঁড়ে কোথায় যে চলে গেলো কে জানে?

 

ডোবার এপার থেকেই ঘরের দরজার চৌকাঠে বাপকে বসে থাকতে দেখে তমিজ চমকে ওঠে, ভয়ও পায়। বাপ তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ঘরে নতুন চালের ভাত রান্না। হচ্ছে, সকালে পান্তা, দুপুরে ভাত, রাত্রে ভাত। এই দুটো মাস তিন বেলাই ভাত খাওয়া। বাজান এখানে হাজার বসে থাকুক, সেই ভাত খাবার অবস্থা কি তার আর হবে?

তবে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে কুলসুমকে সে ঠিক কুলসুম বলেই ঠাহর করে ফেলে এবং কুপির আলোয় তার চোখে বাজানের চাউনি দেখে সটান শুয়ে পড়ে বাজানের বিছানায়। বাজান! বাজান! কী খাবা গো? ডাকতে ডাকতেই শুরু হয় তার ফোঁপানো কান্না, এই কান্না তার জমতে শুরু করেছিলো চোরাবালির ধারেই, এবং কাঁদতে কাঁদতেই বাপকে তার প্রিয় খাদ্য সম্বন্ধে জিগ্যাসা করা অব্যাহত রাখে। পাশে বসে কুলসুম হাত রাখে তমিজের ঝাঁকড়া চুলে, তারপর ঐ চুলে নাক খুঁজে সে নিশ্বাস নিতে থাকে জোরে জোরে। এই ঝাঁকড়া চুলে মিশেছে তার বাপের পাটের আঁশ কিসিমের চুলের গন্ধ। এতোকাল পর গন্ধটাকে পাখির ডানা ঝাপটানোর গন্ধ বলে সনাক্ত করতে পারলো। তমিজের ঘাড়ের গন্ধে মিশেছে তার বাপের গায়ের আঁশটে গন্ধ, তার বুকে কাদার গন্ধ। তমিজের সারা গায়ের গন্ধ নিতে নিতে কুলসুমও কোঁপাতে শুরু করে এবং এখন কিছুক্ষণের মধ্যে সে কেঁদে ওঠে হাউমাউ করে। তমিজ তার বাপের গতরের ওম নিতে মুখ গুঁজে দেয় কুলসুমের উঁচু বুকে। কাঁদতে কাঁদতে কুলসুম বলে, প্যাট ভরা ভাতও খাবার পারে নাই গো মানুষটা, মুনসির ডাক শূন্য কোটে চলা গেলো, একবার কয়াও গেলো না। বাজান জেয়াফতের বাড়ি উটকাতে ঐ বালুর মধ্যে কোটে কোটে ঘুরিচ্ছে গো। এবার একটা পিটা মুখোত পড়লো না তার। শোলোক শুনবার গেলো, আর এই ফিরলো না। ত্যাল পিঠা হলে তাই একলাই এক কুলা শ্যাষ করিছে। তমিজ হামলে, কেঁদে ওঠে, মণ্ডলবাড়িত জিয়াফতের ভাত খাবার যায় কি কাউলটা তাই করিছিলো গো। কুলসুম জানায়, কালাহারের কৈ মাছ দিয়া নাউ দিয়া ভাত খাবার চাইছিলো গো উদিনকা, খাবার পারলো না।

পেটুক বাপের আধপেটা খাওয়া গতরের তাপ নিতে তমিজ হাত রাখে কুলসুমের পিঠে, তমিজের বাপের তাপ পোয়াতে তাকে নিবিড় করে টেনে নেয় নিজের শরীরে। পায়ের দুটো ঘা থেকে তার আধপেটা গতরের গন্ধ নিতে কুলসুম হাত বোলায় তমিজের হাঁটুতে আর উরুতে। আর তমিজের বাপ অনেক দূরে কাৎলাহার বিলের চোরাবালির ভেতর থেকে তার লম্বা হাত বাড়িয়ে কিংবা হাতটাই লম্বা করে আলগোছে টেনে নেয় তমিজের বন আর কুলসুমের শাড়ি। গরহাজির মানুষটার গায়ের ওম পেতে আর গায়ের গন্ধ শুকতে দুজনে ঢুকে পড়ে দুজনের ভেতরে।

মাঝরাত? না ভোরবেলা? বিকালবেলা না সন্ধ্যা? কী জানি মেঘলা দুপুরও হতে পারে। আবছা আন্ধারে ঘুটঘুটে কালা আন্ধার চলে গড়িয়ে গড়িয়ে, ওটা কী গো? কী! কুলসুম এতোক্ষণ দিশাই পায় নি। ওটা না তমিজের বাপ! তমিজের বাপের শরীরটা কয়েকদিনে একটু রোগা হয়েছে। আহারে! আধপেটা খেয়ে মানুষটা গেলো বিলের উত্তর সিথানে, আর ফিরলো না। যাবার আগে তার চুল ছিলো পাটের আঁশের মতে, কয়দিনে তাই ঘন হয়ে কেঁপে উঠেছে ঝাঁকড়া হয়ে। তার মাথায় আর দাড়িতে কী যেন চিকচিক করে, সেগুলি কি তার হাসির কুচি একরম হাসির কণা তো তমিজের বাপের মুখে কখনো দেখা যায়নি। জেয়াফত বাড়িতে ড়ুম ড়ুমা গোশত দিয়ে ভাত খেয়েও সে তো এতো খুশি কখনো হয়নি। তবে আজ এতো সুখ কিসের তার? মরার পর বেটার ভেতর ঢুকে পড়ে কি সে শরীরের স্বাদ এমন তারিয়ে তারিয়ে চেখে গেলো নাকি? দাড়ির: জঙ্গলে, চিকচিকে বালিতে তমিজের বাপ তাই কি এমন হেসে হেসে এভাবে ঘোরে? চেরাগ। আলিকে পেলে কুলসুম ঠিক জিগ্যেস করতো ও দাদা, মরার পরে মানুষ খাব দেখবার পারে? তমিজের বাপ এখন কী খাব দেখে? কী দেখিচ্ছে কও তো।

চেরাগ আলির দোতারার টুংটাং শোনা যায়। তার গানের প্রথম কথা শুনতে শুনতেই কুলসুম গলা মেলায় :

মরণ তাজ্জব বড়ো বুঝিবারে নারি।
তাজ্জব দ্রিাও সহোদর যে তাহারি।।
ভায়ে ভায়ে মোহাব্বত না বুঝি ফারাক।
সাপটিয়া থাকে যেন বীজ আর খাক।।

ও দাদা, খালি রহস্য করো কিসক গো? তমিজের বাপ এখন খেয়াৰ দেখে?

হাতের দোতারার টুংটাং অব্যাহত রেখে চেরাগ আলি বলে, তমিজের বাপ খোয়াব দেখিছে কুনোদিন? মানুষটা তো খোয়াবের মধ্যেই আছিলো! কুলসুম অবাক হয়ে দাদার দিকে তাকিয়ে থাকলে চেরাগ আলি বলে, তাই খোয়াব দেখবি ক্যাংকা করা? মরার পর তমিজের বাপ আসিচ্ছে তোর খোয়াবের মদ্যে, বুঝলু?

কুলসুমের বোঝ না বোঝার পরোয়া না করে ফকির শোলোক গায়,

নিন্দে জীব বিচরয় স্বপনে স্বপনে।
খোয়াব দেখায় মুর্দা নিজ প্রিয়জনে।।

গাইতে গাইতে চেরাগ আলি দোতারা বাজায় খুব দ্রুত লয়ে, দুনিয়া বাজে ঝমঝম করে। শোলোকের তালে দুলতে দুলতে তমিজের বাপ চলে যায় বাশঝাড়ের দিকে। তার দাড়ি আর চুলে হাসির কণা চিকচিক করে।

শোলোক তমিজের কানে না গেলেও তার ঘুম ভেঙে যায়। কাঁথার নিচে লুঙি গুছিয়ে নিতে নিতে বিছানা থেকে উঠে আড়চোখে সে তাকায় কুলসুমের মুখে। অন্ধকারেও বোঝা যায়, তার ঠোঁটের কোণে থুথুর মতো সেঁটে রয়েছে হাসির কুচি। তার একটা হাত জড়ানো ছিলো তমিজের গলায়। তমিজ উঠে বসলে হাতটা আস্তে পড়ে যায় কাথার ওপর। সেখানেও তমিজের পায়ের ওম। কিন্তু তমিজ বড়ো উসখুস করে, ঘুমের আগে কীভাবে যে কী হয়ে গেলো! মাথাটা তার নিচের দিকে ঢলে পড়ে। অন্ধকারেও সে তাকাতে পারে না কুলসুমের দিকে। ঢলে-পড়া মাথাটা নিচু করে তমিজ উঠে দাঁড়ায় মেঝেতে এবং ঐ ঘর থেকে বেরিয়ে যায় দরজাটা আস্তে করে ভেজিয়ে দিয়ে। নিজের ঘরে। গিয়ে শোয়, কিন্তু ঘুম আর আসে না। ভোর হওয়ার আগেই বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে।

সেদিন মোষের দিঘির পুবের জমিতে ধানখেতে তমিজের কাস্তের পোঁচ পড়ে এমন তেজে যে দেখতে দেখতে তার আঁটির পরিমাণ হয়ে যায় পাহাড় সমান, হুরমতুল্লা বলে, কেটা কবি চাষার ঘরের মানুষ তুই লোস!

খুশি হয়ে তমিজ ফুলজানকে তার নিকার কথাটা বলতে চায়। ফুলজানও একটু দূরে থেকে তাকিয়েছিলো তার ধানের দিকে। তার ঘ্যাগটা আজ বড়ো বেঢপ বড়ো, কুলসুমের গলার ওই জায়গাটা বড়ো মসৃণ, ওখানকটায় গাল দিলে বডেড়া আরাম লাগে। কিন্তু যতোই সন্ধ্যা হয়, বাড়ির দিকে মেলা করতে তার পা আর ওঠে না। অতো সুন্দর মসৃণ গলা সত্ত্বেও কুলসুমকে দেখতে তার ভয় ভয় করে। হুরমতুল্লার বাড়ির উঠানে একটার পর একটা কাজ হাতে নেয়, শেষকালে একবার গুণে-রাখা ধানের আঁটি সে ফের গুণতে শুরু করলে ফুলজান এসে দাঁড়ায় তার পাশে, বাড়িত যাবা না? মাও তোমার একলা আছে না বাড়িত? ফুলজান কুলসুমকে তার মা বলায় তমিজের গা ছমছম করে, তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে আসে, গলা শুকিয়ে যায়। ফুলজান ফের বলে, মরার বাড়ি, এখনো চল্লিশ দিন হয় নাই। তোমার মাও একলা থাকলে ভয় করবি না? বাড়িত যাও।

পাকুড়তলায় এখন তো মানুষ কিছু না কিছু থাকেই, ইটের ভাটা সেখানে জমজমাট। কিন্তু চোরাবালি এড়াতে তমিজ বাড়ি যায় একটু ঘুরে। বাপের যে হাত এখান থেকে তার লুঙি উঠিয়ে দিয়েছিলো সেই হাতই যদি সাঁড়াশি হয়ে চেপে ধরে তার গলা? ইটখোলার এক পাশে তমিজ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলে দুইজন পশ্চিমা মিস্ত্রি তাকে দেখে আফসোস করে, আহা, বাপের টানে ছেলেটা রোজ একবার এখানে আসে। একজন তাকে জানায়, তার বাপ প্রত্যেক বাত্রে বড়ো আওয়াজ করে। সংসারের টান সে এখনো কাটাতে পারে নি।

বাপের দুনিয়ার মায়ার কথা শুনে তমিজ তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরে। কুলসুমের দিকে তাকাতে তার ভয় হয়। ভাত দিছি। ভাত খাও। কুলসুমের এই আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে খিদে পেটে নিজের ঘরের দিকে যেতে যেতে বলে, ভাত খায়া আসিছি। তার পিছে পিছে কুলসুমকে আসতে দেখে সে দরজা ভেজিয়ে দেয় ভেতর থেকে।

চোরাবালির ভেতর থেকে তমিজের বাপ আজকাল রোজ রোজ আসে, কুলসুমের। সঙ্গে এটা ওটা কথাও বলে। তা মানুষটা আগের মতোই আছে, কথাবার্তা তেমনি কম। তবে রোগা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাকে কেমন খুশি খুশি দেখায়। সন্ধ্যার অনেক পরে বাড়ি ফেরে তমিজ। কিন্তু ভাত খেতে বসলে কুলসুমের সারা দিনের বৃত্তান্ত তাকে শুনতেই হয়। বাপের খুশি থাকার খবরে তমিজ একটুও খুশি হয় না। মরা মানুষ প্রতিদিন জীবিত মানুষের খোয়বে আসবে কেন? লক্ষণ তো ভালো নয়। কুলসুমকে কী তমিজের বাপ চোরাবলির ভেতরে টেনে নেবে নাকি? শাস্তিই যদি দিতে চায় তো তমিজ বাদ পড়ে কীভাবে?

মাথা নিচু করে তমিজ ভাত খায়, ভাত খেয়েই জোর করে হাই তুলতে তুলতে নিজের ঘরের ভেতর ঢুকে দরজা ভেজিয়ে দেয়। কুলসুমের মসৃণ গলাটা বারবার দেখতে ইচ্ছা করলেও সে দিকে তাকায় না।

ওদিকে শরাফত মণ্ডলের বাড়ি থেকে ফিরে হুরমতুল্লা একদিন খুব খুশি। জগদীশ সাহার এক দাগে বারো বিঘা জমি মণ্ডল পানির দামে কিনে ফেললো। রেজিষ্ট্রি করা হয়ে গেছে। কালাম মাঝি ভালো করে খবর পাবার আগেই আজিজকে নিয়ে মণ্ডল সাব রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়ে সব ঠিকঠাক করে ফেলেছে। মণ্ডলের সাফল্যে হুরমতুলা অনেকদিন পর হাসে, কাশিতে তার গলা বন্ধ হয়ে এলেও হাসি তার আর যায় না।

তমিজ কিন্তু গম্ভীর। হুরমতুল্লার কাশির দমক কমলে তমিজ বলে, জমি তুমি কিছু রাখবার পারলা না? এতো সস্তা!

হুরমতুল্লা হঠাৎ চুপ করে, তারপর আস্তে আস্তে বলে, পানিত বাস করি, কুমিরের সাথে লাগা ভালো লয়। মণ্ডলের ভাগত মুখ বসাবার যায় মাঝিপাড়ার কী দশাটা হলো, তুই বুঝিস না?

তমিজ অবশ্য বোঝার চেষ্টাও করে না। সে বরং তার পরিকল্পনা বোঝায় হুরমতকে হুরমত তো এখন ব্যস্ত থাকবে মণ্ডলের নতুন জমি নিয়ে, সে তো খালের পুবে। তো হুরমতুল্লার বাড়ির পেছনে তার পালানের জমিটা তমিজকে বর্গা দিক না। সবটাই দিক। চার বিঘার ওপর জমি, জমিতে তমিজ সোনা ফলিয়ে ছাড়বে। এই জমির ফসল বেচেই হুরমত নতুন জমি কিনতে পারে। এমন কি, তমিজ ভাগে যা পাবে তাই দিয়ে সে মণ্ডলের কাছ থেকে তার ভিটার লাগোয়া জমি ফেরত না-ও পায় তো অন্তত কালাম মাঝির হাত থেকে ভিটাটা উদ্ধার করবেই। লাঙল দিলে জমি তার বশে থাকে, তমিজ কভো ধান তোলে হুরমতুল্লা নিজেই দেখতে পাবে।।

তার কথা শুনতে শুনতে হুরমতের চোখ চকচক করে, নিশ্বাস ফেলে সে বলে, হামিও পারিচ্ছিলাম রে, এখন শরীলেত কুলায় না।

তুমি করবা কিসক? তুমি মণ্ডলের জোতের দেখাশোনা করো। তমিজ তাকে আশ্বাস দেয়, তোমার বিটি আমার সাথে থাকলে জমিত হামি কী করি তুমি দেখো। নিজের কথাতেই বুকে বল পায় সে, বিটিক তো তোমার লিকা দেওয়াই লাগবি। ইংকা রাড়ি করা রাখবার তো আর পারবা না। তা হামার সাথে!

মাঝির বেটার সাথে লিকা দিলে মানষে আবার? হুরমতুল্লার গলায় আগের তেজ নাই। তমিজকে রাখতে পারলে জমির ফসল সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়া যায়। ফুলজানটা তার বড়ো হতভাগী। মেয়েটার মুখের দিকে তাকাতে গেলেই তার বুক পোড়ে। তা তমিজের সঙ্গে তার নিকা হলে মেয়েটার মুখ আন্ধার থাকে না। হুরমতুল্লা আস্তে আস্তে বলে, হামার সমাজ আছে একটা বুঝিস তো? দেখি, সোগলির সাথে কথা কয়া।

কিন্তু শরাফত মণ্ডলের অনুমতি চাইতে গেলে মানুষটা গম্ভীর হয়ে বলে, হুরমতুল্লা, তোমার বিটি তুমি কাটো, তুমি মারো, যার কাছে খুশি তুমি তার হাতে দিবা। হামার কী? কিন্তু এরপর তার গলা চড়ে, কিন্তু ঐ বিটিজামাইক লিয়া তুমি এটি থাকলে হামার ইজ্জত থাকে কুটি? একটু থেমে সে ধীরেসুস্থে বলে, এখন আল্লা হামার অবস্থা ভালো করিছে। কিন্তু তোমার সাথে রক্তের সম্পর্ক তো আর বাদ দিবার পারি না। মাঝির বেটার সাথে তুমি কুটুম্বিতা করলে হামার ইজ্জত থাকে কুটি? হামার জমির তদারকি তুমি করবা। তোমাক কিসক দেই?–না, তুমি আমার আত্মীয়, না কী? তার সাথে তুমি আত্মীয়তা করলে তোমার সাথে হামি সম্পর্ক রাখি ক্যাংকা করা? তুমিই কও।

হুরমতুল্লা, কিন্তু তমিজকে এসব কিছুই বলে না। ফুলজানের ব্যাপারে তাকে একেবারে না করে দিতে হুরমতুল্লা মন থেকে সায় পায় না। ছোঁড়াটাকে দিয়ে তার জমির আয় উন্নতি হচ্ছে, তা হোক না! ফুলজানের পেছনে সে ঘুরবে আর কতদিন? নিজে নিজেই একদিন কেটে পড়বে। ছোঁড়াটাকে জামাই করে নিজের কাছে রাখতে পারলে ভালো হতো। তবে মণ্ডল সহ্য করবে না। ভিটামাটি থেকে তাকে উচ্ছেদ করবে না ঠিকই, কিন্তু মণ্ডলের এতোগুলো জমি বর্গা করা, বর্গাদারদের ওপর খবরদারি করা। এসব তার বন্ধ হয়ে যাবে। শরাফত তার সঙ্গে আত্মীয়তার কথাটা এভাবে বললো, তাতেও হুরমতের বুকটা একেবারে ভরে গেছে। তার মানে আবদুল আজিজ, আবদুল কাদের আর সে একই বংশের মানুষ। আজিজ কাদের এদের ছেলেরা সব বড়ো অফিসার। হবে। তারাও তার আত্মীয় হবে। মাঝির বেটার হাতে বেটিকে তুলে দিয়ে হুরমতুল্লা বংশের ইজ্জত হারায় কী করে?

এসব নিয়ে তার মাথার কামড়াকামড়ি অবশ্য হুরমতুল্লা খুব একটা টের পাচ্ছে না। কেন?-বুড়া বয়সে মণ্ডল তাকে যে দায়িত্ব দিয়েছে তাই দেখতে তাকে দিনমান থাকতে হয় বাইরে বাইরে। হামিদ সাকিদার জগদীশের কিছু জমি কিনে নেওয়ার পর নিজেই এখন জোতদার, তার বর্গা খাটে বেশ কয়েকজন চাষা। হুরমতুল্লার কাজ এখন অনেক।

তমিজের ওপর ভরসা না করে তার আর উপায় কী? হুরমতুল্লার জমি সে বর্গা তো করেই, এর ওপর মোষের দিঘির পুবে মণ্ডলের জমিটার খাটাখাটনি বেশিরভাগ করতে হয় তাকেই। শমশের হয়েছে হুরমতুল্লার বড়ো কামলা। কিন্তু বেলা ডোবার আগেই তার বাড়ি ফেরা চাই; সন্ধ্যা হতেই তার জ্বর আসে, জ্বর একবার এসে পড়লে হাঁটতে তার ভারি কষ্ট। ওই জমি থেকে পেঁয়াজ আর মরিচ তোলা হলো, এখন চলছে আউশ বোনার জন্যে জমি তৈরি। এই গরমে অবশ্য সন্ধ্যার পর ওখানে কাজ করতে তমিজের ভালোই লাগে। ওই সময় মানুষজন থাকে না, ফুলজান এসে একটু আধটু হাত লাগায়, তবে ভুল। ধরে অনেক বেশি। চৈত্রের এক সন্ধ্যায় মোষের দিঘির ঢালে দাড়িয়ে তমিজ বলে, তুই কি খালি হামাক ইংকা হেলাই করবু? এতো করাও হামি মাঝির বেটাই থাকি? ফুলজান বসে পড়েছে মোষের দিঘির পুবের ঢালে। সে সঙ্গে সঙ্গে মুখ ঝামটা না দেওয়ায় তমিজ হয়তো একটু দমেও যায় আবার একটু লাইও পায়, সে তোলে তার মরা বেটার কথা, হামার কাছে থাকলে তোর বেটা ওংকা কর‍্যা মরে? কৈ, গেরস্থ চাষার ঘর তো করলু। তাও আবার ল্যাখাপড়াজানা মানুষ, শোলোক বান্দে, বই বেচে। সেই মানুষটা কী করলো?

তার কথায় ফুলজান এই প্রথম বড়ো বিচলিত হয়, তার পায়ের নিচে মাটি কঁপে, কাঁদতে কাঁদতে সে বলে, হামার নসিব! তুমি মাঝির বেটা হলা কিসকঃ তমিজ তার গা ঘেঁষে বসে পড়লে ফুলজান তার বুকে হঠাৎ করে কিল মারে আর অভিযোগ করে, তুমি মাঝির ঘরত জর্ম লিলা কিসক? কিসক? কিসক?

এই কঠিন প্রশ্নের জবাব নিয়ে তমিজ মাথা ঘামায় না। ফুলজানের কিল খেতে খেতেই সে তাকে জড়িয়ে ধরে দুই হাতে। মোটা ঠোঁটে ফুলজানের চোখের নোনতা পানি চুষে নিতে নিতে নুনের ধকে তার সারা শরীর জ্বলে। ফুলজানের গালে, ঠোঁটে ও ঘ্যাগে অবিরাম মুখ ঘষতে ঘষতে সে তাকে নিয়ে শুয়ে পড়ে মোষের দিঘির ঢালে। তাদের কয়েক হাত পরেই চৈত্রের খরখরে চষা জমি। তাদের মাথার কাছে হুরমতুল্লার জোড়া বলদ। আকাশে তারা ফোটে। ফুলজান নিজের শাড়ি গুছিয়ে নিতে নিতে বলে, মাঝির বেটা, কাপড়খানা ছিড়া ফালালা।

অনেকদিন পর সেদিন বাড়ি ফিরে তমিজ কুলসুমের সঙ্গে খুব গল্প করে তার মুখের . দিকে সোজা তাকিয়ে। তমিজের বাপ নাকি অনেক রাত্রে রোজই কুলসুমের কাছে একবার না একবার আসে। তমিজ কিন্তু ভয় পায় না; বরং খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিগ্যেস করে বাপের কথা।

জুম্মাঘরে কুদুস মৌলবির মিলাদ পড়াবার পর মাঝিদের হাতে হাতে বাতাসা। এর ওপর তহসেন দারোগা টাউন থেকে নিয়ে এসেছে ঘিয়ে-ভাজা জিলাপি। মিলাদে এতো এতো তবাররক পেয়ে মুখ ভরে সেসব চিবোতে চিবোতে মাঝিরা বিলের ধার ধরে দাঁড়ায় সার করে। বুধা মাঝি কেরামত আলির তিন বছর আগের গানটা ধরলে সবাই খুব হৈ চৈ করে। ওঠে এবং বুধার ভুলভাল কথার সঙ্গে কেউ কেউ বেসুরো গলা মেলায়। মুখ ভার শুধু আবিতনের বাপের। ধরা গলায় সে আক্ষেপ করে, হামার লাতিটা এটি মরিছিলো গো! ও মুনসি, আপনে তার জন্যে দোয়া করেন। মিলাদের শেষে অবশ্য তমিজের বাপের জন্যে কুদুস মৌলবি দোয়া করেছে, আবিতনের ছেলের কথাটা তাকে কেউ মনে করিয়ে দেয় নি। এখন সে হাত তুলে পরওয়ার দিগারের দরবারে মাসুম শিশুটির জন্যে দোয়া করে। তবে ঐ স্মৃতি ঘটতে মাঝিদের উৎসাহ নাই। এমন কি চোরাবালির ধারে তমিজের বাপের পাশে দাঁড়িয়ে প্রথম জালটা ফেলার জন্যে কালাম মাঝির প্রস্তাবটিও অগ্রাহ্য করে তারই ছেলে তহসেন, না না। আজ ওখানে যাবার দরকার কী? ইটখোলায় একটা ঝামেলা করে লাভ নাই।

তবে ফকিরের ঘাটে কালাম মাঝি প্রথম জালটা ফেলায় তমিজকে দিয়ে, হাজার হলেও কোন বাপের বেটা সেটা দেখা লাগে। আবার বাঘাড় মাঝির লাতির বেটা তো, এর পরদাদার দোয়া লিয়া কাম শুরু করলে বরকত হবি।

বৈশাখ মাসে তমিজের হাতে কৈ জাল দেখে অনেকেই ঠাট্টা করছিলো। বিলে পানি কম, এখন ওই জাল দিয়ে সে করবেটা কী। কিন্তু বাঘাড় মাঝির ওয়ারিশের হাতে ওই জালে ঠিকই ধরা পড়ে বারোটা কৈ মাছ, তার নয়টাই পাকা কৈ। সেগুলোর লালচে আভা লাগে তমিজের কালো গালে।

অবশ্য তার জালে মাছ পড়তে পড়তে আবিতনের বাপের তৌড়া জালে ধরা পড়েছে। রুই কাতলের মাঝারি আকারের কয়েকটা বাচ্চা। বেশিরভাগ মাঝির জালে কিছু না কিছু মাছ উঠলোই। যাদের তেমন কিছুই ওঠে না, তারা পলো দিয়ে, বড়শি দিয়ে পুঁটি, খলসে, ট্যাংরা, এমন কি ছোটো পাবদা পর্যন্ত ধরে। পাকুড়গাছশূন্য পাকুড়তলা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ছিলো মাঝিরা। কিন্তু তহসেন তাদের থামিয়ে দেয়, আজ ওদিকটা থাক।

দুপুরবেলা শেষ হতে না হতে কালাম মাঝির ভাগ্নে বুধা মাঝি সবাইকে বলে, এখন তোমরা থামো গো। আর মাছ ধরা হবি না। কালাম মাঝির বাড়ির ঘাটে নতুন আমগাছের নিচে কয়েকটা কলাপাতা পেতে বুধা জোরে হাঁক দেয়, এটি সোগলি মাছ দিয়া যাও। যা ধরিছো তার ছয় আনা করা মাছ ঢালো।

মাছ ধরার উৎসাহে মাঝিরা এই আহ্বান কানে তোলে না। কিন্তু বুধার ডাকটি বারবার শুনে এবং তাতে হুকুমের স্বর পেয়ে সেদিকে তাদের মন দিতেই হয়। মাছ ধরলো, এখন আবার মাছ দিতে হবে কাকে?

আবিতনের বাপ বুধাকে ওংকা চিক্কুর পাড়িস কিসক রে? জিগ্যেস করে নিজেই খুব জোরে চিৎকার করে।

কালাম মাঝি এতোক্ষণ এদের সঙ্গেই ছিলো। একটু আগে সে বাড়ির ভেতরে গিয়েছিলো। এখন ফিরে এসে বলে, বাপু, আজ মাঝিগোরে বিল ফেরত পাবার পয়লা দিন। খাজনা টাজনা কিছু লাগবি না। মাছ যা ধরিছো তার ছয় আনা, না হয় চার আনা, কিছু না হলে অন্তত দুই আনা ভাগ হামাক দিয়া যাও।

তিন বছর আগে এই বিলে মণ্ডলের অধিকার অগ্রাহ্য করে জাল ফেলার কথা মনে পড়ে আবিতনের বাপের। নাতির জন্যে তার শোক খুঁচিয়ে তোলার চেষ্টা কারো কাছে আমল না পাওয়ায় সে শোধ নিতে চায় এইভাবে, শালা মাঝিগোরে আবার খাজনা দেওয়া কী? মাঝির আবার খাজনা লিবি কেটা রে?

নুলা ভিকুর পাঁচটা ট্যাংরার দুটোই যদি দিতে হয় তো তার আর থাকে কী? সে নিম সমর্থন করে আবিতনের বাপকে, খাজনা কিসের গো? কালাম মিয়া না কলো, মাঝিগোরে। বিল মাঝিরাই মাছ ধরবি? তো এখনো মণ্ডলেক পয়সা দিয়া মাছ ধরা লাগবি?

ফকিরের ঘাটে শ্যাওড়া গাছের নিচে জমায়েত মাঝিদের সবাই এই নিয়ে চঁচামেচি শুরু করলে ঠিক কে কোনটা বলছে বোঝো কঠিন হয়ে পড়ে।

মণ্ডল বিল পত্তন লিছিলো লায়েবেক ঘুষ দিয়া। শালা লায়েব তো শুনি ভাগিছে। কিসের লায়েব, কিসের পত্তন?

লায়েব? আরে পাকিস্তানে জমিদারিই থাকিচ্ছে না। কিসের জমিদার? তার আবার পত্তন দেওয়ার ক্ষমতা আছে নাকি?

পাকিস্তানেত আবার জমিদার আর লায়েবেক পোঁছে কেটা?

এর মধ্যে চলে আসে তহসেন দারোগা। লুঙিপরা আর খালি পায়ে থাকলেও তার হাতে ঘড়ি, সাদা শার্টের পকেটে সিগ্রেটের প্যাকেট। গলা এতোটুকু উঁচু না করে সবাইকে সে বোঝায়, বাবা এই বিল ইজারা নিয়েছে। বিলের মালিকানা–

কালাম মাঝি তাড়াতাড়ি তাকে থামায়, রাখো, হামি কই। শোনো, বিল তো হামি ইজারা লিছি। দস্তুরমতো টাকাপয়সা খরচ করা ইজারা লিছি এই বৈশাখ মাস থ্যাকা। মণ্ডলের কবজা থ্যাকা বিল খালাস করতে হামার খরচ তো কম হয় নাই বাপু। হামাক খাজনা না দিলে হামার চলবি ক্যাংকা করা?

আবিতনের বাপ বলে, সেই পয়সা না হয় আমরা সোগলি মিল্যা তুল্যা দেই। তো খাজনা চাও কিসক? খাজনা হলে তো এই বিলেত জাল ফেলালেই টাকা দেওয়া লাগবি। না কী?

তহসেন এবার এদের মূখতায় বিরক্ত হয়, অতো কথা কিসের? বিল তো বাবা ইজারা নিয়েছে। রীতিমতো দুই বছরের টাকা জমা দিয়ে ইজারা নেওয়া হলো। এখন খাজনা না দিয়ে বাবা কাউকে মাছ ধরতে দেবে কেন?

তহসেনের কথায় কালাম মাঝির অস্বস্তি হলেও ছেলের ন্যায্য কথা সে অনুমোদন। করে। তবে তহসেনের দারোগাগিরি এখানে করাটা ঠিক নয়। মাঝির জাত বড়ো তঁাদোড়। কোন কথায় যে কী করে বসে তার ঠিক নাই। তমিজকে হাত করলে সেই বরং সবাইকে বুঝিয়ে বলতে পারবে। তাকে একটু সরিয়ে নিয়ে কালাম মাঝি ফিসফিস করে বলে, তমিজ, দেখ তো ভাই ইগলান কী কচ্ছে? তুই একটু ভালো করা বুঝায়া দে না বাপু!

তমিজ মাঝিদের বোঝাবে কী, সে তো নিজইে ধন্দে পড়েছে। মণ্ডলের ইজারার মেয়াদ শেষ, এখন এই বৈশাখ থেকে বিল তো ফিরে আসবে মাঝিদের হাতে। তা হলে খাজনা দিতে হবে কাকে? সে জিগ্যেস করে, বিল তো মাঝিগোরে হাতেত ফির‍্যা আসিছে। না কী?

আসে নাই? আসে নাই? কালাম মাঝি গলা চড়ায়, হামি মাঝি লই? হামার বাপদাদা চোদ্দ পুরুষ মাঝি আছিলো না? তোরা মাঝি লোস? তোরা হামার রক্তের আত্মীয় লোস? তা হামার নামে বিল পত্তন লিছি। তা হলে বিল কি মাঝির কাছে আসলো না?

বাপকে থামিয়ে তহসেন বলে, সম্পত্তি তো কারো না কারো নামেই থাকতে হয়। তো বাবা এটা দুই বছরের জন্যে কিনে নিয়েছে। সামনের বার আপনারা কেউ নেবেন। এখন যে মাছ ধরলেন তার সামান্য একটা ভাগ এখানে দিয়ে যান। এর পর থেকে মাছ ধরতে হলে খাজনা দিয়ে জাল ফেলবেন। একটু তাড়াতাড়ি করেন। খালি খালি ঝামেলা করে লাভ কী?

তার শুদ্ধ কথা ও বলার ভঙ্গিতে মাঝিরা একটু থমকে যায়। কয়েক মিনিট কেউ কথা বলে না। তহসেন হাতের ছাতাটা খুললো। আবিতনের বাপ হঠাৎ সামনে এসে তার খলুই উপুড় করে দেয় কলাপাতার ওপর। কালাম মাঝি বলে, বামাক মাছ দাও কিসক? তোমার ভাগ তুমি লিয়া যাও। আবিতনের বাপ শোনে না, হনহন করে চলে যায় নিজের বাড়ির দিকে। কালাম মাঝি ফের ডাকে, ও আবিতনের বাপ। আবিতনের বাপ ফিরে তাকায় না। আরো দুই তিনজন মাঝি মাছের ভাগ দিয়ে গেলেও হঠাৎ ঝড়ের আভাস পেয়ে কিংবা এর সুযোগ নিয়ে খলুই ও জাল নিয়ে আর সবাই হাঁটা দেয় নিজের নিজের ঘরের দিকে। ছোটো ছেলেদের সবাই হঠাৎ করে দৌড় দেয়, তাদের অন্তত দুইজন আছাড় খেয়ে পড়লে খলুইয়ের মাছ পড়ে যায় মাটিতে। তমিজ কী করবে, মাছ ঢেলে দেবে কি-না, এই নিয়ে দোনোমননা করতে করতে ঝড় শুরু হয়ে যায়, সেও ছুট দেয় নিজের ঘরের দিকে।

এর মধ্যে ঝড় শুরু হয়েছে বেশ ভালোভাবেই। কালাম মাঝির ঘরের বারান্দা থেকে তহসেনের চিৎকার শোনা যায়, বুধা, কে কে মাছ দিয়ে গেলো সেই হিসাব রাখলি না কেন? পরে যখনি কেউ মাছ ধরতে আসে, হিসাব করে আজকের পাওনা আদায় করা হবে

কুলসুমের ঘরে মাটির একটা হাঁড়িতে কৈ মাছগুলো পনিতে জিইয়ে রাখতে রাখতে তমিজ বলে, কাল শলুক দিয়া নাউ দিয়া পাক করো। পাকা কৈ!

এর মধ্যে ঝড়ের পর এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। সোঁদা সোঁদা গন্ধে মাথা ভরে যায়, এই গন্ধে আবার খিদেও লাগে। কিন্তু এখন তমিজের যাওয়া দরকার হুরমতুল্লার জমিতে। এমন সুন্দর বৃষ্টি হলো, এখনো সন্ধ্যা হয় নাই, মোষের দিঘির ঢালে জমিটায় একটা চাষ দেওয়া যায়।

কুলসুম বলে, এখন আবার জমিত যাবা? ভাত খায়া যাও।

বিলে যাবার আগে ঘরে বসে কড়কড়া ভাত খেয়েই বেরিয়েছিলো, গরম ভাতের লোভে তমিজ ফের বসে পড়ে।

খেয়ে উঠে মাটির হাঁড়ি থেকে বেছে বেছে পাঁচটা মাছ খলুইতে তুলে তমিজ রওয়ানা হলে কুলসুম বলে, মাছ কয়টা কুটি লেও?

পাঁচটা মাছ কালাম মাঝিক খাজনা দেওয়া লাগবি। বলেই সে মিথ্যা কথাটা শোধরায়, কিসের খাজনা? অর বাপের সম্পত্তি নাকি? খাজনা দেওয়া লাগবি কিসক? এইসব ঝাঝালো কথা বলে বলে তমিজ খাজনা না দেওয়ার সিন্ধান্তটি পাকা করে। তারপর বলে, দেখি, পরামাণিক বুড়া একদিন কৈ মাছ খাওয়ার হাউস করিছিলো। লাজুক খুশিতে সারা মুখ তার হালকা কালো আলোতে চুবিয়ে নিয়ে তমিজ বেরিয়ে পড়ে।

কালিতলায় আবদুল আজিজের নতুন বাড়ি চিনতে কেরামত আলির বেগ পেতে হয় না। কার্তিক ভাদুড়ির বাড়ি বলতেই রিকশাওয়ালা এক কথায় চিনে ফেললো। মাধবীলতায় ছাওয়া কাঠের গেটের সামনে রিকশা থেকে নামতে কেরামতের সংকোচ হয়, এই বাড়িতে রিকশায় আসাটা বোধ হয় বেয়াদবিই হয়ে গেলো! গেটের পরে ঘাসে ঢাকা ছোটো মাঠ পেরিয়ে বারান্দা, বারান্দায় সতরঞ্চির ওপর বসে রয়েছে ১৫/২০ জন মানুষ। আবদুল কাদের কেরামতকে দেখে হাসলো।

ছোটোখাটো দালানটার ছাদের দিকে দেখতে দেখতে কেরামত সহজ হতে চেষ্টা করে। ছাদের রেলিঙের মাঝখানটা উঁচু, সেখানে সিমেন্টে খোদাই করা ওঁ এবং এর নিচে লেখা শ্ৰীশঙ্করালয় এবং তার নিচে ১৩০৭।—এসবের কোনো কিছুই সাম্প্রতিক

চুনকামে মুছে ফেলা যায় নি। রেলিঙটা না ভাঙলে ওগুলো ওঠানো মুশকিল।

আরে আসো, আসো। বসে পড়ো। বাবর টেস্ট পরীক্ষায় ফাস্ট হছে। স্কুলের স্যারদের একটু মিষ্টিমুখ করানো হচ্ছে আর কি। আবদুল কাদের সরে বসে কেরামতকে বসার জায়গা করে দেয়।

মিষ্টির প্লেট সাবাড় হলে আসে চা। বাবরের মেধা ও শ্রম নিয়ে সংক্ষিপ্ত প্রশংসা ও উপদেশ পর্ব শেষ হলে শিক্ষকগণ দেশের শিক্ষাব্যবস্থার দ্রুত অবনতি সম্বন্ধে নিজেদের উদ্বেগ ও বেদনা জানাতে থাকে, কখনো একে একে, কখনো একসঙ্গে। ভালো টিচাররা সবাই চলে যাচ্ছে ইনডিয়া। স্কুল কলেজে কি তালা ঝুলবে নাকি? আবদুল আজিজ বিশেষভাবে উৎকণ্ঠিত : বাবর অঙ্ক কষতে অখিল বসুর কাছে, দিন পনেরো হলো তার বাড়িতে তালা ঝুলছে। শোনা যাচ্ছে অখিলবাবু চলে গেছে বালুরঘাট, তার বাড়ি একসচেঞ্জ করেছে এক মুসলমান রিটায়ার্ড সাব-ডেপুটির সঙ্গে।

শেরোয়ানি, পাজামা ও জিন্না টুপিপরা লম্বা ও রোগা হেডমাস্টারের কষ্টটা একটু বেশি। তার ব্যক্তিগত বন্ধু বলে কেউ থাকছে না। আবার স্কুলে পড়াশোনার মান ঠিক রাখতে তার হিমসিম খাবার জোগাড় হয়েছে।

হেডমাস্টারের কাছ থেকে একটু তফাতে বসেছিলো নীরেন লাহিড়ী, ২৫/২৬ বছরের যুবক, ওপরের ক্লাসে ভূগোল পড়ায়। বাবরের সবচেয়ে প্রিয় স্যার। নীরেন বারবার ওপরে তাকিয়ে বারান্দার ছাদের বিম, একদিকের দেওয়াল এবং অন্যদিকে বারান্দা ঘেঁষে পঞ্চজবা, টগর ও কামিনীর ফুলভরা গাছগুলো দেখছিলো। কিছুক্ষণের মধ্যে তাকে দেখা গেলো সামনের ছোটো বাগানে। বাড়ির সংস্কার করতে গিয়ে দোপাটি ও গাদা গাছগুলো চাপা পড়েছে বাশের নিচে, সে ঘুরছিলো ঐ জায়গাটায়। বাবর তাকে বারবার বলছিলো, চলেন না স্যার, ভেতরে চলেন। আমার পড়ার ঘরটা দেখবেন স্যার। আবদুল কাদের বারান্দা থেকেই ডাকে, নীরেনবাবু, যান না, ভেতরে যান।

নীরেন বারান্দায় ফিরে এলে আবদুল আজিজ বলে, বাবরের মুখে দিনরাত খালি নীরেন স্যারের নাম। যান, ওর পড়ার ঘরটা দেখে আসেন। তারপর জিগ্যেস করে, আগে এদিকটায় আসেন নাই, না? আপনার বাড়িতে মালতিনগর, না? আপনারা রেল লাইন পারই হতে চান না।

নীরেন কিছুক্ষণ ফাঁকা চোখে তার দিকে তাকিয়ে থেকে বলে, এটা আমার পিসিমার বাড়ি।

তাই নাকি? কার্তিকবাবু আপনার–।

পিসেমশাই। বড়োপিসেমশাই।

তাই নাকি?

পিসিমা মারা গেলো ফর্টি ওয়ানে, পিসেমশাই ফের বিয়ে করলেন। তারপরেও আমরা আসতাম। আর পিসিমা বেঁচে থাকতে তো প্রায় রোজই আসা হতো। আমার বড়োপিসিমা এই পঞ্চজবা, কামিনী লাগিয়েছিলেন। পিসিমার হাতের গাছ হতো! যা লাগাতেন তাই হতো! নীরেন লাহিড়ীর মনে হয় কথার ব্যামোতে পেয়ে বসেছে। তার প্রিয় শিক্ষক ও বর্তমান বস এই হেডমাস্টারের সামনে অনেক দিন মাথা নিচু করে বসে থাকাটা সে হঠাৎ করে পুষিয়ে নিতে যেন মরিয়া হয়ে উঠেছে, আর পিসেমশাই লাগিয়েছিলেন কনকচাপার গাছটা। কলকাতা থেকে কলম নিয়ে এসে দুটো লাগান, একটা মরে গেলো, আর একটা বাঁচলো। কী সুন্দর ফুল যে হতো! ঐ যে ওদিকটায়, তাই না? গাছটা দেখছি না। কনকচাঁপার গাছ খুঁজতে সে এদিক ওদিক তাকালে আবদুল আজিজ কৈফিয়ৎ দেয়, ওখানেই ছিলো। লম্বা গাছটা তো? পাঁচিল তোলার সময় গাছটা আর রাখা গেলো না।

অতো সুন্দর ফুলের গাছটা নষ্ট করলা? কী সুন্দর গন্ধ! ইসমাইল ভাইয়ের বাড়িতে দুইটা আছে। কাদেরের এই আফসোসে আজিজ রাগ করলেও নীরেন লাহিড়ীর কাছে। গাছ কাটার কারণ ব্যাখ্যা করে, এই বাড়িতে তো চুনকাম হয় নি বহুদিন। ঘরের দেওয়াল টেওয়াল সব নষ্ট হয়ে গেছিলো। পাশের বাড়ির সঙ্গে সীমানা নিয়ে গোলমাল, তাই পাঁচিল ছিলো না ওদিকে। পাঁচিল দেওয়ার সময়।

বাড়ির সংস্কার ও উন্নয়নে নীরেনের উৎসাহ নাই, সে দাড়িয়েই থাকে। বাবর তাকে ভেতরে যাবার জন্যে পীড়াপীড়ি করলেও সে নড়ে না।।

এর মধ্যে বড়ো রাস্তায় শোনা যায় নারায়ে তকবির আল্লাহু আকবর আওয়াজ। বারান্দার লোকজনের মধ্যে উসখুস শুরু হয়। এদের অনেকেই এই দুই বছর আগেও এই স্লোগানে উত্তেজিত, এমন কি উদ্দীপ্ত হয়েছে। আবদুল কাদের উঠে দাঁড়ায়, শালা শুকুর শেখ বোধহয় এসেছে। শালা রিফিউজিদের নিয়ে গোলমাল পাকাবার তালে আছে।

একজন শিক্ষক বলে, গত কয়েক দিনে টাউনে খালি রিফিউজি আসছে। যতীন রায়ের বাড়িটা রিফিউজিতে ভরে গেছে।

যতীন রায়? আমাদের যতীনবাবু? তাঁর বাড়ি কি রিকুইজিশন করা হয়েছে নাকি? হেডমাস্টারের এই উদ্বেগের জবাবে কাদের বলে, উপায় কী? এতো এতো রিফিউজি আসছে। তাদের শেলটার দিতে হবে তো।

হেডমাস্টার সন্তুষ্ট নয়, বিড়বিড় করে বলে, এতো বড়ো লিডার। তার মতো লোকের বাড়ি নিয়ে নেওয়া।

এই আক্ষেপের দিকে খেয়াল না করে কাদের নির্দেশ দেয়, আপনারা কয়েকজন আমার সঙ্গে আসেন। হিন্দু পাড়া, শুক্কুর আলি যা তা কিছু করে ফেলবে। হিন্দু শিক্ষকদের সে অভয় দেয়, আপনারা বরং বাড়ির ভেতরে যান। নিশ্চিন্ত থাকেন।

কয়েকজন নিয়ে সে বেরিয়ে গেলে হেডমাস্টারও তাদের সঙ্গে যায়।

বাইরের নারায়ে তকৃবির আল্লাহ আকবর-এর বুলন্দ আওয়াজের সাড়ায় এই। বাড়ির ভেতর থেকে মেয়েলি গলার তীক্ষ্ণ চিৎকারে লোকজনের কাপড়চোপড়ের ভাঁজে ভাজে ও কোঁচায় কেঁচায় এবং বারান্দায় ঝুঁকে পড়া পঞ্চজবা ফুলের লাল আভায়, টগরের সাদা পাপড়িতে, এমন কি কেটে-ফেলা কনকচাপার হারিয়ে-যাওয়া ছায়ায়। শিরশির করে ছমছমে কোলাহল, ও বাবরের বাপ! ও বাবর! আসিচ্ছে রে, আসিচ্ছে। ভাইজানের গলাত কোপ তুললো রে। হুমায়ুনেক টান দিয়ে লিয়া আসো গো। ও বাবরের বাপ।

আবদুল আজিজের স্ত্রীর ব্যারামের কথা বাইরের লোকদের মধ্যে জানে কেবল নীরেন। বাবরের মুখে তার মায়ের কষ্টের কথা শুনে ছেলেটির মাথায় সে হাত রেখেছে কয়েকবার। কিন্তু মহিলার সরাসরি আর্তনাদ নীরেনকে বড়ো বিভ্রান্ত ও বিব্রত করে তোলে। ছেলেটিকে কোনোভাবে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাবনাও তার মাথায় আসে না নারায়ে তকবির-এর সঙ্গে হামিদার চিৎকার বাড়ে পাল্লা দিয়ে। আবদুল আজিজ বলে, মুশকিল, রাস্তায় সামান্য গোলমাল হলেই বাবরের মা অসুস্থ হয়া পড়ে। কলকাতায় হিন্দুরা তার ভাইকে মারলো–। বাবরের শিক্ষকদের মুখেচোখে ভয় দেখতে পেয়ে সে থামে।

ভাইজান, তাবিজ দিছিলেন? আজিজের কানের কাছে মুখ নিয়ে জিগ্যেস করে কেরামত আলি। সে এসেছে ফকির চেরাগ আলির বইটা নিতে। বইটা হাতছাড়া করার পর থেকে কুলসুমের সঙ্গে সে দেখাই করতে পারে না। তার স্বামী মরেছে, তমিজটা। বাইরে বাইরেই থাকে। কুলসুমের সঙ্গে দেখা করার, কথা কওয়ার কতো সুযোগ! অথচ তার ঘরে গিয়ে দাঁড়াবার জো নাই। কুলসুমের এক কথা, তুমি হামার দাদার বই বেচা খাছো। তোমার ভালো হবি না। কেরামতের পদ্য আর আসে না, খোয়াবনামার মধ্যে কী যে আছে, তার হাতে পড়লেই কপাল খুলে যাবে। এখানে এসে সে একটু সুযোগ খুঁজছিলো। গোলমালের মধ্যে যাওয়াটা নিরাপদ নয় বলে কাদের সবাইকে ডাকলে সে মুখ লুকিয়েছিলো মোটা থামের আড়ালে। এখন আজিজকে বাবরের মায়ের কথা জিগ্যেস করলে আজিজও মহা বিরক্ত হয়ে বলে, দূর! ডাক্তারবদ্যি হেঁচা খাওয়ালাম। তাবিজ দিলো আমার মামাশ্বশুর। কৈ, তার ব্যারাম তো খালি বাড়েই দেখি।

আবদুল আজিজের কোঁচকানো ভুরুতে দমে গেলেও কেরামত আলি মরিয়া হয়ে বুকে বল সঞ্চয় করে, ফকিরের ঐ বইটা যদি পাই তো না হয় একটু চেষ্টা করা দেখা গেলে নি। কেতাবটা দেবেন?

কেতাব? কিসের কেতাব? আবদুল আজিজ একটু ভেবে বলে, তোমার ঐ ঘেঁড়া বইটা? তমিজের বাপের বই? আরে উগলান হাবিজাবি শোলোক শূন্যাই তো তার এই হাল। আমার মামাশ্বশুর কলো–।

মামাশ্বশুরের উক্তি প্রকাশ না করেই সে জানায়, নয়া বাড়িত ওঠার সময় গোলমালের মধ্যে বইটা যে কোথায় গেলো! আরে কতো দামি দামি জিনিস হারালো। আর তোমার ঐ বই!

আবদুল আজিজ বাড়ির ভেতরে লোকজনের ও তার স্ত্রীর খোঁজখবর নিতে গেলে এ কেরামত আরেকটি সুযোগ নেয়। বাবরকে সে কাছে টেনে বলে, বাবা, বইটা তোমার আব্বা কোটে থুছে তুমি কবার পারো?

তার কথা শুনে এবং তাকে আরো কিছু প্রশ্ন করে বার মনে করতে পারে, ও হঁ্যা, আপনার ওই বই? খোয়াবনামা না কী যেন নাম না?–বইটা তো আব্বা কাউকে দেখতেই দেয় না। ওই বই হাতে পাওয়ার পর আব্বা নাকি এতো সস্তায় এই বাড়ি কিনতে পারলো! তারপর—।

বইটা তোমার আব্বা কোথায় রাখিছে কবার পারো?

না। তা ওই বই দিয়ে আপনি করবেন কী? পিকিউলিয়ার বই! কী সব স্বপ্ন টপ্ল নিয়ে আজগুবি কথা। আবার লাইন টানা স্কয়ার, ট্রায়াঙ্গল,মাথামুণ্ডু বোঝা যায় না। বাবরের হাসিতে বিজ্ঞানমনস্ক বালকের অবজ্ঞা। তা ছাড়া তার সঙ্গে কথা চালিয়ে যাওয়াও মুশকিল। এই বাড়ির উত্তর দিক থেকে বাচাও! বাচাও! আর্তনাদ এবং তার। জবাবে বাড়ির ভেতর থেকে হামিদার ও বাবরের বাপ, ভাইজানেক কোপ মারলো গো! চিৎকারে সবাই চুপ মেরে গেছে। আবার এর মধ্যে কে যেন রাস্তা দিয়ে বলতে বলতে দৌড়ে যায়, বোসবাড়ি লুট হলো গো! আবদুল কাদেরের এক কর্মী এসে বলে যায়, আপনারা কেউ বাইরে যাবেন না। এখানে থাকলে ভয় নাই। পুলিসে খবর দেওয়া হয়েছে। সে ফিরে যেতে যেতে জানিয়ে যায়, লুটের সময় বাধা দিতে গেলে শুক্কুরের লোকদের হাতে বুকে ছুরি খেয়ে সিড়ির ওপর পড়ে রয়েছে ফণীবাবু। বড়োভাই মণীন্দ্র বোস আগেই সরে পড়েছে, সে বোধহয় লুকিয়ে রয়েছে কোথাও।

এসব খবর আসছে তো আসছেই। এমন সময় এক গাদা ছেলেবুড়ো ও মেয়েমানুষকে নিয়ে আজিজের বাড়িতে ঢোকে কাদের। আজিজ যে কী করবে বুঝতে পারে না। তার মায়ের পেটের ভাই তার নতুন বাড়িটা মনে হয় সহ্য করতে পারে না, যতো সব উৎপাতের আখড়া বানাবার তালে আছে। দেখো, এর পরেই আবার হেডমাস্টারের নেতৃত্বে মণীন্দ্র বোস তার দুই ছেলে ও খুড়তুতো ভাই মিলে চ্যাংদোলা করে নিয়ে আসে এক বুড়িকে। মহিলা হলো মণীন্দ্র বোসের বিধবা পিসি, সিঁড়ি থেকে লাফিয়ে নামতে গিয়ে নিচে পড়ে মাথা ফাটিয়ে ফেলেছে। তিরিশ পঁয়ত্রিশ বছর ধরে সিঁথি খা খা করে রাখার পুণ্যে আজ তার মাথা ভরা তরল সিঁদুর। ভেতরের ঘরে একটা তক্তপোষে তাকে শুইয়ে দিতেই বয়স, লিঙ্গ ও সর্বোপরি জাতের কাণ্ডজ্ঞানশূন্য হয়ে হামিদা ভাইজান, ভাইজান গো বলে চিৎকার করে তার বুকে লাফিয়ে পড়তে গিয়ে পড়ে যায় মেঝেতে এবং কাণ্ডজ্ঞানের সঙ্গে হারায় তার এমনি জ্ঞান। দুইজন বেহুঁশ মহিলার গায়ে গা লাগে নি বলে পরম নিষ্ঠাবতী ও ভক্তিময়ী পিসি মৃত্যুর মুহূর্তেও স্লেচ্ছাস্পর্শমুক্ত থাকায় মণীন্দ্রনাথ বসু স্বস্তি পায় এবং এই অবসরে তার তিন পুরুষের বনেদি বাড়ির মূল্যবান সম্পত্তি নিয়ে উৎকণ্ঠিত হবার সুযোগটির সদ্ব্যবহার করে। মিনিট পঁচিশেক পর তার ছোটোভাই ফণীন্দ্রের মৃত্যুসংবাদ না পাওয়া পর্যন্ত তার উৎকণ্ঠার টার্গেট অপরিবর্তিত ছিলো।

নীরেনকে এর আগেই বাবর নিয়ে গেছে তার পড়ার ঘরে। চৌকাঠে দাঁড়িয়ে ভেতরে ঢুকতে নীরেনের বাধো বাধো ঠেকছিলো, পিসি থাকতে এই ঘরে সে কখনো ঢুকতে পারে নি। এটা পিসিমার ঠাকুরঘর। খুব ছোটোবেলায় চুপ করে এই ঘরে ঢুকে সে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো পিসিমার পিঠে। পূজা ছেড়ে পিসিমা তাকে কোলে নিয়ে বারান্দায় তার মায়ের কোলে তুলে দিয়ে বলেছিলো, দুষ্টু ছেলে, তোমার জন্যে আমাকে আর এখন ফের ঠাকুরের ভোগ রাঁধতে হবে। সেই থেকে ঠাকুরকে নীরেন একটু হিংসাই করতো। বড়ো হতে হতে সেই হিংসা আর রাগ তার আপনাআপনি ঝরে যায়। ঠাকুর কেউ থাকলে তো তার ওপর হিংসা হবে! ঠাকুরুদেবতা নিয়ে স্কুলে ছেলেদের সামনে নীরেন কম ঠাট্টা করে না। বাবরদের ক্লাসেই একদিন বলেছিলো, পৈতার অসম্মান করলে নাকি মাথায় বজ্রপাত ঘটবে। তা কলেজে ভর্তি হয়েইে তো পৈতা দিয়ে সে খাতা। সেলাই করেছে। কৈ তার মাথায় তো একটা দেশলায়ের কাঠিও জ্বললো না। আর এখন তার প্রিয় ছাত্রের দেওয়াল জুড়ে টাঙানো পৃথিবীর মানচিত্র, আলমারির ওপর গ্লোব, টেবিলে ইনস্ট্রমেন্ট বক্স, রঙের বাক্স, বই খাতাপত্র। তার সবচেয়ে প্রিয় জিনিসগুলো দেখেও ঠাকুরের অভাবে নীরেনের বুকটা পিসিমার জন্যে হু হু করতে থাকে।

পুলিসের গাড়ি এসে জীবিত, আহত, মৃতপ্রায় ও নিহত সবাইকে নিয়ে গেলে আবদুল আজিজের বাড়িতে প্রকট হয়ে ওঠে হামিদার চিৎকার। জ্ঞান ফিরে পেয়ে লাভ হয় নি, তার পাশ থেকে হুমায়ুন অথবা আহসানকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে বলে সে চিৎকার করে, বিলাপ করতে থাকে।

আজিজ তার স্ত্রীর ব্যারামে ত্যক্ত হয়ে বাড়ির সামনে গেটের কাছে গেলে তাকে অনুসরণ করে আবদুল কাদের। বড়োভাইয়ের কানের কাছে মুখ নিয়ে সে বলে, বাড়ির খবর শুনিছেন?

এই প্রশ্নে সে বাড়ির প্রতি আজিজের উদাসীনতাকে খোটা দেয়। আজিজ একটু বিব্রত হলেও পরিবারের নতুন সম্পত্তি হাতাবার জন্যে কাদেরের সন্দেহজনক প্রবণতার দিকে ইঙ্গিত দিয়ে বলে, মুকুন্দ সাহার বাড়ির চাবিটাবি তুই রাখিছিস? দলিল দস্তাবেজ ঠিক রাখিছিস?

চাবি বাজানের কাছে। দলিলও তার সিন্দুকের মধ্যে। পাহারা মোতায়েন করিছি আমি।

রাস্তায় বেরিয়ে কাদের দেখে তার পাশে পাশে চলছে কেরামত।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *