খোয়াবনামা – আখতারুজ্জামান ইলিয়াস – এদিক ওদিক থেকে নানারকম খবর

খোয়াবনামা – আখতারুজ্জামান ইলিয়াস - এদিক ওদিক থেকে নানারকম খবর
খোয়াবনামা – আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ৪৬. এদিক ওদিক থেকে নানারকম খবর

এদিক ওদিক থেকে নানারকম খবর পেয়ে কেষ্ট পাল আসল খবর জানতে আসে গোলাবাড়ি হাটে। ক্যা রে বৈকুণ্ঠ, বাবু কোটে? ইগলান কি সোমাচার শুনিচ্ছি, ক তো?

কেষ্ট পালের সঙ্গে পালপাড়ার আরো কয়েকজন। এরা সবাই জিগ্যেস করতে শুরু করলে বৈকুণ্ঠ ঘাবড়ে যায়, আমতা আমতা করে বলে, বাবু তো গেছে রাণাঘাট। বাবুর শ্বশুর সিরাজগঞ্জ থ্যাকা রাণাঘাট যাবার সময় কুটি য্যান মোসলমানের হাতে খাম হছে, পিঠেত চোট পাছে, বাঁচে কি না বাঁচে। বাবু তাক দেখবার গেলো।

পরিবার?

সোগলিক লিয়া গেছে। শ্বশুরের কী হয় না হয়! পালদের স্তম্ভিত মুখ দেখে সে তাদের আশ্বাস দেয়, রাণাঘাট কয়দিন থাকবি। তারপরে কলকাতা যাবি। কলকাতা থ্যাকা আসতে দিন বিশেক লাগবার পারে।

ইগলান বিত্তান্ত বাদ দে, কেষ্ট পাল চড়া গলায় বলে, বাবু বলে বাড়ি বেচ্যা দিছে?

এই গুজবটা বৈকুণ্ঠ শুনেছে কাল বিকালে। আলিম মাস্টার বলে গেলো, হাজারখানেক টাকা নিয়ে মুকুন্দ সাহা নাকি তার দুই বিঘা জমির ওপর বাড়ি, মানে একটা আটচালা আর দুটো চারচালা ঘর, দুইটা কাঁঠাল গাছ, ভালো জাতের আমগাছ গোটা বিশেক, চারটে লিচু গাছ এবং একটা করে বিলাতি আমড়া, জামরুল, কামরাঙা আর মেলা কূলগাছের বাগান আর পুকুর বেচে গেলো শরাফত মণ্ডলের কাছে। একে মোসলমান, তায় দাপটের মানুষ, ওদের হাত থেকে লুট করার সাধ্যি কারো হবে না।

আরে চাবি তো নিলো লুট করা পালপাড়ার অর্জুন এই কথা বললে কেষ্ট পাল তাকে থামায়। বৈকুণ্ঠকে ফের জিগ্যেস করে, দোকানের ব্যবস্থা কী করিছে?

হামাক কলো, দোকান ভালো করা দেখিস। ভালো দর পাস তো মাল যা আছে। ব্যামাক ছাড়া দিস। কলকাতা থাকা মালের অর্ডার দিয়াই আসবি। মুকুন্দ সাহার ওপর বৈকুণ্ঠের আস্থা এখনো অটুট, দোকান ছাড়ার মানুষ তাই লয়। দোকান হলো তার জান। দেখো না, কয়টা দিন যাক। গোলমাল, কাটাকাটি কমুক। শ্বশুরের কী হলো তাও তো জানি না। কয়টা দিন দেখি। আসার দেরি হলে বাবু হয়তো দুই চারের মধ্যে টেলিগ্রাম করবার পারে।

পালপাড়ার দল কাদেরের দোকানে গিয়ে গফুরকে একলা পেয়ে আসল খবর জানতে চায়। বলবে না বলবে না করেও সে শেষ পর্যন্ত বলে, ছোটোসাহেব ন্যাশনাল গার্ডের দুইটা মানুষ সাথে দিছে, তারা বর্ডার পার করায়া দিয়া আসিছে।

ভক্ষক গেছে রক্ষকের কাম করবার? পাকিস্তান ন্যাশনাল গার্ডের লোকদের তৎপরতা নিয়ে অসন্তোষ জানাতে কেষ্ট পাল প্রবাদটির উল্টো ব্যবহার করেও কেষ্ট পালের উদ্বেগ যায় না, মালপত্র ব্যামাক লিবার পারিছে? ব্যামাক। সোনাদানা তো বাবুর কম আছিলো না। কাঁসার বাসনকোসন, তামার বাসন, পূজার ঠাকুর,–জিনিস বাদ দেয়। নাই একটাও। বাড়ির দর কম হলে কী হয়, ব্যামাক হিসাব করলে তার লাভই হছে।

কেষ্ট পালের উৎকণ্ঠা, হতাশা ও ক্ষোভ বাড়ে চতুর্গুণ। তার মোটাসোটা পা দুটো কাঁপতে লাগলে গফুর তার পিঠে হাত রেখে সান্ত্বনা দেয়। বৈকুণ্ঠ অবশ্য বারবার বলে, আরে বাপু দুইটা দিন যাক না। বাবুর ব্যবসা আছে না?

বৈকুণ্ঠের কথা কেষ্টর কানে ঢোকে কি-না সন্দেহ। গফুর জানায়, বাড়ি বিক্রির কাজটা সাহাকে করতে হয়েছে একটু গোপনেই, নইলে কালাম মাঝি টাকাপয়সা না দিয়েই তার সম্পত্তি গ্রাস করে ফেলতো।।

কেষ্ট পাল এখন করেটা কী? লাঠিডাঙা কাছারির দিকে যাবার কথা বলতে গফুর জানায়, লায়েবাবাবু কাচারিত আসেই না।

কেষ্ট পালের তরুণ সঙ্গী একজন তাড়া দেয়, টাউনেত চলো। লায়েববাবু না থাকলেও সতীশ মুক্তার আছে।

টাউন বলে গরম হয়া আছে, গফুর কলু হুঁশিয়ার করে দেয়, ইনডিয়ার রিফিউজি আসিচ্ছে দলে দলে। কখন অরা কী করে, কওয়া যায় না।

কী করবার পারবি? অর্জুন পাল বীরত্ব দেখালেও পরবর্তী বাক্যেই তার তেজ। অর্ধেক ক্ষয় হয়ে যায়, পোড়াদহ মেলার আর তিন দিন। কাছারিত থাকা বরাদ্দ আসে নাই, সাহামশাই নাই।

বিকালবেলাতেই কালাম মাঝি উঠে আসে মুকুন্দ সাহার বারান্দায়। বৈকুণ্ঠকে ডেকে বলে, তোর বাবু খুব নিমকহারাম রে! বাড়িঘর তো দেওয়ার কথা হামাক। হামার বেটা পুলিস ফোর্স সাথে দিয়া বর্ডার পার কর‍্যা দিবি, কথা পাকা হয়া গেলো। তো আজ কেষ্ট পালের কাছে শুনি অন্য কথা। হামি বায়নাও করলাম পাঁচশো টাকা, দোকান দিবি, বাড়ি ঘর ব্যামাক দিবি। পাঁচ হাজার চায়, তা হামি তিন দিবার চাছিলাম। মণ্ডল কতো দিছে রে?

পালরা চলে গেলে অনেকদিন পর ছিলিমখানেক গাঁজা খেয়ে বৈকুণ্ঠ চমৎকার একটা ঘুম দিয়ে উঠেছিলো। মেলার দিন ছাড়া এসব নেশা সে ছেড়ে দিয়েছে বহু আগে, আজ কী হলো, বাবুও নাই, চুপচাপ কয়েকটা সুখ টান দিয়ে সে বেশ মৌজে আছে। এখন তার মুখভরা পান। মুখে জর্দা ঢেলে ঠোঁটে পিক চেপে রেখে জবাব দেয়, কী যে কও মাঝিকাকা। বাবুর ঠাকুর্দার আমলের দোকান, সেটা ছাড়া যাবার পারে? ব্যবসাপাতি ঠিকই চলিচ্ছে। যদি কিছু লেওয়ার থাকে তো কও। সস্তায় ছাড়া দেই।

কম দামে জিনিস কেনার টোপ গেলার বান্দা কালাম মাঝি নয়। প্যাচাল পাড়িস। সাহা ও বৈকুণ্ঠের দেশপ্রেমে সে কটাক্ষ করে, তোরা ভাত খাস এটি আর কুলিপানি খাস ঐপার। এটা কেমন কথা রে? বেটাবেটি রাখবি ইনডিয়াত, আর ব্যবসাপাতি করবি পাকিস্তানেত?

কালাম মাঝি বলে, এই দোকান তো তার দখলেই আসবে। তবে আরো কয়েকটা দিন সে দেখবে। দেরি হলে বৈকুণ্ঠকেই সে পাঠাবে মুকুন্দ সাহাকে ডেকে আনতে। বৈকুণ্ঠের রাহা খরচ বহন করবে সেই।

বৈকুণ্ঠ রাজি হয় না, তাই কী হয়? বাবু কোটে না কোটে থাকে, কেটা জানে? হামি কলকাতা যাই নাই জেবনে, বাবুর শ্বশুরবাড়ি, সেটাও দেখি নাই। পানের পিক একটু ফেলে সে ফের বলে, কয়টা দিন সবুর করো। পাকিস্তান ও হিন্দুস্থান কও, ইগলান কী হয় দেখা যাক।

পাকিস্তানের স্থায়িত্ব সম্বন্ধে বৈকুণ্ঠের এরকম সন্দেহে কালাম মাঝির দেশপ্রেম চোট খায়, বৈকুণ্ঠ, কথাবার্তা সামলায়া কোস। যে পাতেত খাস, সেই পাতেত তোরা হাগিস! ফল ভালো হবি না কচ্ছি।

বৈকুণ্ঠের গাঁজা কিংবা পানজার মৌজ এতেও কাটে না। এমন কি পরদিন তমিজ বৈকুণ্ঠদা, মানুষের মাথা খারাপ হওয়া আরম্ভ হছে, কাত্তিক মাসের কুত্তাগুলার লাকান মানষে এখন পাগলা হয়া ঘোরে। তোমার এ্যানা হুঁশিয়ার থাকা লাগে। বললে জেগে ওঠে তার পূর্বপুরুষের তেজ। পানের পিক গিলে বুক চিতেয়ে সে বলে, এটি হামাক হুঁশিয়ার থাকা লাগবি কিসক রে? এই হাট পিতিষ্টা করিছিলো কেটা সেই খবর রাখিস? খবর রাখতে বয়ে গেছে তমিজের। বৈকুণ্ঠ গোলাবাড়ি হাটের প্রতিষ্ঠাতার নাম উল্লেখ না করে তোলে তার পুরনো প্রসঙ্গ, শোন, হামার ঠাকুর্দার ঠাকুর্দা, না-কি তার বাপ নাকি তারও ঠাকুর্দা, যথাযথ প্রজন্মটিকে চিহ্নিত করতে না পারলেও তার কিছু এসে যায় না, গোরা সেপাইদের সঙ্গে ভবানী পাঠকের নেতৃত্বে তাদের লড়াইয়ের কাহিনী সে বলে ছাড়লো। তার সেনাপতি, নাকি মজনু ফকিরের সেনাপতি ছিলো পাকুড়গাছের মুনসি, ইগলান সোমাচার জানিচ্ছিলো তোর বাপ, পাকুড়গাছের মুনসিক লিয়া তোর বাপ কতো খবর পাচ্ছিলো।

পাকুড়গাছই নাই। তমিজ একটু তুচ্ছই করে, কিসের পাকুড়তলা পাকুড়তলা। করো? পাকুড়গাছ কাটা পড়লো কোনদিন, হামরা দিশাই পালাম না!

পাকুড়গাছ কাটা অতো সহজ লয় রে পাগলা!

কিন্তু এখন গোলাবাড়ি থেকে গিরিরডাঙার রাস্তা তো বিলের উত্তর সিথান দিয়েই, ইটখোলা হওয়ার পর সেখানে ঝোপজঙ্গল সাফ হয়ে কী সুন্দর রাস্তা হয়েছে। হাজার খুঁজেও তমিজ তো পাকুড়পাছের একটা পাতাও দেখতে পায় নি।

তা হলে কুলসুম এতো খবর পায় কোত্থেকে? ভর সন্ধ্যায় সেদিন খুব শীত পড়লে তমিজ ঘরে গেলো একটু সকাল সকাল। ঘর বন্ধ, ভেতরে ঘুটঘুটে আন্ধার, দরজা বন্ধ করে কুলসুম কথা বলে কার সঙ্গে? কেরামত আলি আসে নি তো? মানুষটাকে কুলসুম সহ্যই করতে পারে না, অথচ সুযোগ পেলেই সে প্যাচাল পাড়তে আসে তার সঙ্গে। আজ কি কুলসুম তাকে আস্কারা দিলো নাকি?। তা আন্ধার ঘরের মধ্যে জোয়ান মানুষটার সঙ্গে সে কিসের আলাপ করে? দরজার বাইরে কান পাতলে তমিজ শোনে কুলসুমের কথা, তুমি লিজে কবার পারো না? উদিনকা বেটার ওপরে আসর করিছিলা না? এখন আসর না করো, তাক বুঝায়া কও। তারপর কিছুক্ষণ চুপচাপ। কুলসুম ফের কথা শুরু : করলে বোঝা যায়, সে কারো কথার জবাব দিচ্ছে। কিন্তু আরেকজনের প্রশ্ন কিংবা অভিযোগ কিংবা প্রতিবাদের কিছুই শুনতে না পেলেও তমিজের বুক কাঁপে, কুলসুম তো কথা বলছে তমিজের বাপের সঙ্গে। তার এতোই ভয় করে যে, কুলসুমের গলার আওয়াজ পেলেও সেদিকে সে আর মনোযোগ দিতে পারে না। কতোক্ষণ পর সে জানে না, কাল আসো। ওটি তোমার খিদা নাগে না গো? বলতে বলতে কাউকে বিদায় দিতে দরজা খুলে তমিজকে দেখে কুলসুম খুশিতে খলবল করে ওঠে, ল্যাও বাপু, তোমরা বাপবেটা ফয়সালা করো। এই সময় তমিজের গায়ে হাওয়ার একটা ঝাপটা লাগে। কে গো? কাউকেই তো দেখা গেলো না।

অন্ধকার ঘরে দরজা খোলা পেয়ে ঢুকে পড়ে বাইরের কুয়াশা-ছাকা আলো। ঐ সুযোগে কুয়াশাও খানিকটা ঢুকে অদ্ভুত একটি সুরত নিয়ে ঝুলতে থাকে ঘরের ছোট্টো ঐটুকু শূন্যতায়, সেটা ছড়ানো একেবারে মাচার ওপর পর্যন্ত। নিজের ভয় কাটাতে তমিজ খ্যাক করে ওঠে, ঘরত বাতি দেও না কিসক?

তোমার বাপ তো আবার সলোক থাকলে ঘরত ঢুকবার পারে না। এখনি গেলো, তুমি দেখলা না?

তোমার মাথা খারাপ হছে! ইগলান কী কও?

কুলসুম কুপি জ্বালালে তার দিকে তাকাতেও তমিজের ভয় করে। নিজের ঘরের মেঝেতে পিড়ি পেতে সে ভাত খেতে বসে, সামনে বসে কুলসুম বলে খালি তমিজের বাপের গল্প। তোমার বাপ আজ কয়দিন খালি এক কথা কয়! কী?-বেটাক হুঁশিয়ার হবার কও গো। কাল্লাহার বিলেত আগুন লাগবি, পানি থ্যাকা আগুন উঠা ঘরত ধরবি।

তোমার মাথা পুরা খারাপ হছে। ইগলান হাবিজাবি কী কও গো? তমিজের শাসন করার চেষ্টা চাপা পড়ে তার ভয়ের নিচে। পাঁচাল পাড়া বন্ধ করো। আর চারটা ভাত দেও।

তমিজের ভয়-পাওয়া গলার ধমকে কাবু না হয়ে কুলসুম হাঁড়ি থেকে ভাত তুলে দেয় হাত দিয়ে। তারপর জানায় তার বাপের আজকের অভিযোগ-কাম-হুঁশিয়ারিটি, তুমি বলে হুরমুতল্লার ঘেগি বেটিটাক লিকা করিছো? তোমার বাপ কয়, বেটা যেটি খুশি লিকা করুক, কিন্তু বৌয়ের সাথে থাকবার পারবি না।

তমিজ চমকে উঠলে তার গলায় ভাত আটকে যায়। পানি খেয়ে ফের খেসারি ডাল দিয়ে ভাত মাখে আর ভাবে, শালা শরাফত মণ্ডল হুরমতুল্লাকে যেভাবে শাসাচ্ছে, বুড়া খুব ভয় পেয়ে গেছে। মাঝির বেটার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিলে মণ্ডল হুরমতুল্লাকে জমি বর্গা করতে দেবে না। ওর জমি বর্গা করার দরকার কী? ফুলজানের হিস্যা বিঘা দেড়েক জমি তমিজ পাবে, অন্য দুই মেয়ের ভাগও চাষ করবে সে নিজেই। হুরমতুল্লা তো থাকবেই, বুড়া চাষবাসের তদারকি করে ভালো। এই সাড়ে চার বিঘা জমিতে তমিজ যে ফসল তুলবে, তার সঙ্গে আর কারো জমি বর্গা করে তার ও তার শ্বশুরের ও কুলসুমের চমৎকার চলে যাবে। ধান বরং খাওয়ার পর আরো বাঁচবে। সেই থেকে তমিজ বাপের জমি আর ভিটাঘর সব উদ্ধার করবে।

এখন এই কথাগুলো বাপজানকে জানায় কে? তাকে জানাতে স্বপ্নে বাপকে আসার সুযোগ দিতে তমিজ তাড়াতাড়ি ঘুমাতে চায়। কিন্তু ঘুমাতে না ঘুমাতে স্বপ্নে বাপের বদলে সে দেখে কালাহার বিল সে পার হচ্ছে সাঁতরে। ফকিরের ঘাটে পানিতে নামলো, উত্তরপুবে সাঁতরে সে পাড়ি দিচ্ছে বিলের পানি। ওপারে ঘাট। ঘাট থেকে নামলেই মোষের দিঘি। মোষের দিঘির ওপর তালগাছের নিচে উঁইটিবির পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে ফুলজান। ফুলজানের কোলে বাচ্চাটার রোগ যেন সেরে গিয়েছে। সবই দেখছে। কিন্তু বিলের মাঝামাঝি পৌঁছুতেই তমিজের ঘুম ভেঙে যায়। পাশের ঘরে একা একাই কথা বলে চলেছে কুলসুম। অনেকক্ষণ এপাশ ওপাশ করতে করতে তমিজ ফের ঘুমিয়ে পড়ে।

অপশন দিয়ে পাকিস্তানে এসে এ এস আই পোস্টে প্রমোশন পেয়ে ও বাপকে দিয়ে ইসমাইল হোসেনকে ধরে নিজের জেলা সদর থানায় বদলি হবার পর তো বটেই, এর আগেও চাকরি জীবনে তহসেনউদ্দিনকে এমন কি হিন্দু বড়োবাবুদের হাতেও এরকম বিপাকে পড়তে হয় নি। বৈশাখের শুরুতে মাঝিদের উৎপাতে তার মেজাজটা খিচড়ে যায়। দিনে দিনে, মাসে মাসে এবং ঋতুতে ঋতুতে তার মেজাজ চড়ে চক্রবৃদ্ধিহারে। এটা কেমন কথা?—নিজের গাঁটের পয়সা খরচা করে রীতিমতো রশিদ নিয়ে তাদের লিজ নেওয়া বিল, সেখানে কাকে দিয়ে মাছ ধরাই আর নৌকা বাওয়াই আর পানি সেঁচি,-সেটা আমার ব্যাপার। তাতে কার কী করার আছে? বাবাকে তহসেন অনেকবার বলেছে, যমুনা পাড়ের মাঝিদের ডেকে একদিন শিমুলতলায়, একদিন ফকিরের ঘাটে, একদিন পাকুড়তলায় আরেক দিন কালাম মাঝির বাড়ির ঘাটে জাল ফেলা হোক। কিন্তু কালামের এক কথা, ধৈর্য ধরো, ধৈর্য ধরো। আরে ধৈর্যের তো একটা সীমা আছে।-মণ্ডলের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর থেকে সপ্তাহে অন্তত তিন দিন, হয় ভোরবেলা, নয়তো সন্ধ্যায়, এমনকি বর্ষার সময় ভরদুপুরে এখানে ওখানে ঝুপঝাপ করে কেউ না কেউ জাল ফেলছেই। বাবা বলে, বাপু, লিজেগোরে মানুষ, এরা নিনজর দেয় তো গাঁওত মানইজ্জত লিয়া থাকা যাবি? লিজের মানুষের বল না থাকলে মণ্ডলেক আঁটো করা। কঠিন। কখনো সে আবার আশ্বাস দেয়, সবুর করো। মাঝির জাত, এই কোদ্দো করে, আবার এই দরদ করে। এই আগুন, এই পানি। হামিও তো বাপু মাঝির বেটা, মাঝির রগ হামার জানা আছে।

কালাম মাঝি এরকম কথায় কথায় নিজেকে মাঝির বেটা বলে ঘোষণা করে, তহসেনের এটা পছন্দ হয় না। আবার বাপকে কষ্ট দিতেও মন থেকে সায় পায় না। ছেলের ওপর সন্মায়ের জুলুম সহ্য করতে না পেরেই কালাম মাঝি তাকে নিয়ে দিয়ে এসেছিলো তার প্রথম পক্ষের দূর সম্পর্কের এক বোনের বাড়ি। বোনাই ছিলো খেতলালের কনস্টেবল, পরে বদলি হয়ে চলে যায় অনেক দূরে, মালদা জেলার ইংরেজবাজার থানায়। খালার বাড়িতে থেকে তাদের কুয়ার পানি তুলে দিয়ে, বাজারঘাট করে, খালাতো ভাইদের চোপার বাড়ি খেয়ে তহসেন লেখাপড়াটা চালিয়ে গেছে অনেক কষ্টে। এক বছর বাদ দিয়ে দিয়ে সে ফেল করতো, কিন্তু বাপের মানি অর্ডার ফেল করে নি কোনোদিন। ক্লাস নাইনে একবার ফেল করতেই তার খালু পুলিস সাহেবকে ধরে তাকে পুলিসে ঢুকিয়ে দিলো, আবার ওই সঙ্গে বিয়েও দিলো নিজের মেয়ের সঙ্গে। বৌ তার মাঝির বংশের মেয়ে হলে কী হয়, মানুষ হয়েছে দূরে দূরে। তার ভাষা প্রায় ভদ্দরলোকদের মতে, সে উর্দু বলতে পারে ভাঙা ভাঙা এবং শ্বশুরবাড়ি এসে চালচলন দেখে নাক সিঁটকায়। ছেলেমেয়েরাও পেয়েছে মায়ের ধাত। এখন বাপদাদাকে তারা। যদি মাঝির বংশের মানুষ বলে শোনে তো তারাও কি ছোটো হয়ে যায় না?

আর এই মাঝির বংশ কালাম মাঝিকেও কম মুসিবতে ফেলে নি। এদের সে চেনে হাড়ে হাড়ে। চাষাদের সাথে বিবাদ বাধাও তো এরা থাকবে তোমার পাশে, ইশারা পাওয়া মাত্র দশটা চাষার মাথা ফাটিয়ে দেবে। যদি কলুর ঘরে আগুন লাগাতে চাও, ইঙ্গিত দিলেই কাম হাসিল। আবার এমনিতেই নরম স্বভাবের মানুষ, এক মাছ ছাড়া অন্য কোনো জীবের গায়ে আঁচড় লাগাতে গেলে এদের ঠ্যাঙে ঠ্যাঙ ঠেকে। কিন্তু একবার চেতে যায় তো মাছ মারার বর্শা দিয়েই পাঁচটা দশটা লাশ ফেলে দেবে পলকের মধ্যে। তহসেন এসব বুঝবে কোত্থেকে?

আবার তমিজের মতিগতি বোঝা তো কালাম মাঝির জন্যেও দিন দিন মুশকিল হয়ে পড়ছে। এর ওপরেই সে ভরসা করছিলো বেশি। তমিজের বাপ কম করে যায় নি। ঐ বছর পোড়াদহ মেলার মাছ ধরতে মণ্ডলের হাতে মানুষটার এতো হেনস্থা হওয়াতেই

মাঝিদের দখল এসেছে কালাহার। তারই বেটা, মণ্ডলের সঙ্গে লাগতে গিয়ে জেলও খাটলো। তাকে হাতে রাখাটা কালাম মাঝির খুব দরকার।

কয়েকবার তার ঘরে উঁকি দেওয়ার পর তমিজের দেখা মিললো। ভাত খেয়ে উঠে সশব্দে সে কুলকুচো করছিলো দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে। পেছনে কুপি হাতে কুলসুম। খোলা দরজা দিয়ে ঢোকা হাওয়ায় তার হাতে কুপির শিখা কাঁপে! এই ভরযুবতি মেয়েমানুষটা ঘরে থাকে একলা, পাশে তার সৎবেটা। তবে এই নিয়ে আরো কিছু ভাববার আগেই কালামের নাকে লাগে মাগুর মাছের গন্ধ। তার মগজে মাগুরের কাঁটা ফুটলে সে বলে, তমিজ মাছ ধরিস চুরি করা? খাবার হাউস করে হামাক কলেই তো হয়। মানষে তোক মাছচোর কয়, হামার গাওত লাগে!

কাৎলাহার বিল থ্যাকা মাছ নিলে চুরি করা হয় ক্যাংকা করা? বিল না মাঝিগোরে এ সোগলির?

সবই তো জানিস। কালাম মাঝি তাকে একটু বোঝাতেই এসেছিলো, কিন্তু এসেই কালাহারের মাগুরের গন্ধে এবং কুলসুমের কুপির আলোয়-কাঁপা মুখ দেখে তার গলা হঠাৎ চড়ে যায়, তোরা কি হামাক পুলিস ডাকবার কোস? তহসেনেক তো হামি বুঝসুঝ দিয়া রাখিছি। এখন তুই কি হামার লিজের চাচা ভাই জ্ঞাতিগুষ্টির কমোরেত দড়ি বান্দিবার কোস?

তমিজ জবাব না দিয়ে ভেতরে চলে গেলে কালাম মাঝি বলে, বাপের বুড়া বয়সের জোয়ান বৌটাক লিয়া একলা থাকিস, কিছু কই না। আবার বিলের মাছও চুরি করিস। কতো সহ্য করমু? কালাম মাঝি ফিরে যেতে যেতে কুলসুম ও তমিজের এভাবে একসঙ্গে থাকা নিয়ে কীসব বলে, তমিজ ওসব পাত্তাই দেয় না।

 

 

তমিজের ভাবনা এখন ফুলজানকে নিয়ে। সেদিন মোষের দিঘির ঢালে অনেকটা আমন কেটে সন্ধ্যাবেলা তমিজ দাঁড়িয়ে ছিলো দিঘির ধারে। রোজকার মতো ফুলজান এসেছে, কিন্তু কাজকামে তমিজের ভুল ধরার বদলে সে হঠাৎ ঢলে পড়ে তার বুকের ওপর। তমিজের হাতে তখন ধান কাটার কাস্তে, ভাগ্যিস সেটা পড়ে গিয়েছিলো তার হাত থেকে, নইলে ফুলজানের হাত পা বুক পেট যে কোনো জায়গায় জখম হয়ে যেতো। ফুলজান তার বুক থেকে মাথা ফিরিয়ে নিয়ে কাঁদতে শুরু করে। সে কাঁদে, কেবলি কাঁদে। তমিজ হতভম্ব হয়ে বলে, কান্দো কিসক? বারবার এই প্রশ্ন করলে ফুলজান বলে, আজ মা হামক পিঠেত খড়ি দিয়া পিটিছে। কেন? তার মা তাকে মারবে কেন? ফুলজান ফের ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে এবং জানায় যে, কয়েকদিন হলো ভাতে তার রুচি নাই। নতুন চালের ভাত সর্ষের তেল পেঁয়াজ মরিচ দিয়ে মেখেও সে মুখে তুলতে পারে না। তার খালি বমি বমি লাগে। এক পোড়া মাটি আর তেঁতুল ছাড়া আর কিছুই তার রোচে না।

তা তেঁতুল জোগাড় করা তমিজের জন্যে এমন কিছু কঠিন ব্যাপার নয়। মোষের দিঘির দক্ষিণে ভবানীর মাঠেই জোড়া তেঁতুল গাছ। দুটোতেই ভূত পেত্নী থাকে বলে লোকে ঐ গাছ থেকে তেঁতুল সহজে পাড়ে না। তা ফুলজানের জন্যে না হয় ভূত পেত্নীর সঙ্গে মারামারি করবে। তবে ভয়ও তার হয় বৈ কি। চুপচাপ বাজার থেকে তেঁতুল এনে দিলেই বা ফুলজান কি আর জিগ্যেস করতে যাবে? কিন্তু ফুলজান তাকে ধিক্কার দেয়, তুমি এক আবোর মাঝির আবোর বেটা, কিছুটা বোঝে না? এখন গলাত দড়ি দেওয়া ছাড়া হামার গতি নাই। তুমি হামাক একটা দড়িই না হয় কিন্যা দাও।

তখন ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরে তমিজের শরীর কাঁপে। তার বাপ কি তাহলে মরতে না মরতে এসে ঢুকে পড়েছে ফুলজানের পেটের ভেতরে? পাকুড়গাছ যদি চিরকালের জন্যে হারিয়ে গিয়ে থাকে তো লোকসান নাই, বাপ তার ঠাঁই একটা ঠিকই বেছে নিয়েছে। উত্তেজনা তার এতোই বাড়ে যে ফুলজানকে জড়িয়ে নিজের বুকের সঙ্গে সে আঁকড়ে ধরে প্রবল বেগে। তার মুখে, চোখে, কপাল, ঘ্যাগে ও বুকে নিজের মুখ ঘষতে ঘষতে তার মনে হয়, মাঝির বেটার সঙ্গে এবার বেটির বিয়ে না দিয়ে হুরমতুল্লার আর পথ নাই। তবে বিয়ের আগে জমির ব্যাপারটা সে ফয়সালা করে নেবে।

আজ কালাম মাঝির ঝাঝালো কথাবার্তা শোনার পর নিজের ঘরে শুয়ে তার বাম চোখের পাতা কাঁপতে থাকে প্রবল বেগে। লক্ষণ তো ভালো নয়। মেলার আর বাকি। দুইদিন। কাল বাদে পরশু কাৎলাহার বিলে ঝাঁপিয়ে পড়বে মাঝিপাড়ার সব মানুষ, সেখানে কালামের পক্ষে সে যদি দাঁড়ায় তো ফ্যাকড়া মিটে যায়। ফুলজানকে নিয়ে এখানে চলে এলে তাদের আগলে রাখবে কালাম মাঝিই।

কিন্তু ভোরবেলা কালাম মাঝির বাড়ি গিয়েও সে ফিরে আসে বাইরে থেকেই। তাকে সোজাসুজি না বলাই ভালো। কেরামত আলিকে বললে হতো! কিন্তু ফুলজানের সঙ্গে তার বিয়ের খবর কি কেরামতকে বলাটা ঠিক হবে? বুধাকে বলা যায়?—এসব ভাবতে ভাবতে দেখা হয়ে যায় কুদুস মৌলবির সঙ্গে। মৌলবি তাকে দেখে আক্ষেপ করে, কালাম মিয়া মসজিদের বেড়া নতুন কর‍্যা দিলো। তাও তোমরা জুম্মাঘরের দিকে একবার পাও দাও না? বাপু খাটাখাটনি যতোই করো, একদিন তো যাওয়াই লাগবি, ঐদিন কী লিয়া যাবা, কও তো?

তমিজ সঙ্গে সঙ্গে ওয়াদা করে, জমিতে যাবার আগে ফজরের নামাজটা সে জুম্মাঘরেই পড়ে যাবে। কিন্তু আপাতত সে যে একটা বিপদে পড়েছে, হুজুর ছাড়া তাকে উদ্ধার করবে আর কে? বিপদের কথায় কুদুস মৌলবি ঘাবড়ায়, আবার কাউকে উদ্ধার করার সাবাশি নেওয়ার লোভও তার কম নয়। মাঝিপাড়ার অসুখ বিসুখে সে পানিপড়া দেয়, কিন্তু নেমকহারামের বাচ্চাগুলো পয়সা দিয়ে মানত যা করার সব করে আসে পোড়াদহ মাঠে। তমিজের দিকে তাকিয়ে সে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, মানষের কাম করা লাভ নাই। এটিকার মানুষ বড়ো নেমকহারাম। কাম হলে আর ফিরাও দ্যাখে না।

তমিজ জানায়, তার দেওয়া থোওয়া সব আগাম-কাজটা কী?-হুরমতুল্লার বেটির সঙ্গে বিয়ে হলে তার বড়ো উপকার হয়। কিন্তু মণ্ডলের ভয়ে পরামাণিক সাহস পায় না। এক কালাম মাঝি যদি অভয় দেয় তো কাজটা সে করতে পারে, তার আর মুসিবত হবে না। সব শুনে কুদুস মৌলবি গম্ভীর হয়ে যায়। দাড়িতে কিছুক্ষণ হাত বুলিয়ে বলে, ঠিক আছে। আমার কথা কালাম মিয়া কোনোদিন ফালাবার পারে না। তুই মগরেবের পরে জুম্মাঘরত আয়।

দুপুরবেলা হুরমতুল্লার বৌ তাকে দেখে প্রথমে কটমট করে তাকায়। কিন্তু রাগী চোখে দেখতে দেখতে পানি জমে এবং এদিক ওদিক তাকিয়ে হুরতমুল্লার অনুপস্থিতি সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হয়ে কাঁদে আর বলে, তুমি আমাগোরে কী সব্বোনাশ করলা বাবা? ছোটোজাতের মানষেক ঘরত ঢুকবার দিয়া ফুলজানের বাপ ইগলান কী করলো? তোমার আর কী, হামাগোরে সব গেলো!

তমিজ মাথা নিচু করেই বলে, সব্বোনাশ কিসের? তোমার বেটিক বিয়া করমু। কও তো আজই করবার পারি। ফুলজানের বাপোক কও। ফুলজানের মা তবু চুপচাপ কাঁদতে থাকলে তমিজ আশ্বাস দেয়, বিয়া করার কথা ভো হামি আগেই কয়া রাখিছি।

মাঝির বেটার সাথে বিয়া দিলে হামরা এটি থাকবার পারমু?

তালে বিয়া দিও না, হাটোত যায়া সব কথা কয়া দেই তো কী হবি?

হুরমতুল্লাকে বাড়িতে ঢুকতে দেখে তমিজ হনহন করে বেরিয়ে যাচ্ছিলো। নবিতন তার পিছে পিছে গিয়ে তাকে আটকায়। চাপা গলায় বলে, তোমার কান একটা বোগদাক দেখ্যা বুবু যে ক্যাংকা করা আটক্যা গেলো হামি বুঝি না। তারপর শক্ত করে চেপে চেপে বলে, মাঝির বেটা, বুবুক লিকা তোমার করাই লাগবি। না হলে বুবু গলাত ফাঁস দিবি। হামি বাপজানেক কয়া বুঝ দেমো। বাপজান হামার কথা শুনবি। এই মেয়েটির প্রতি হুরমতুল্লার একটু বেশি দুর্বলতার কথা ফুলজানও তাকে নালিশ করে বলেছে। এই দুর্বলতা এখন ফুলজানেরই কাজে আসছে দেখে তমিজ হুরমতুল্লার এর প্রতি পক্ষপাতিত্ব অনুমোদন করে। নবিতন ফের বলে, আজ সকাল সকাল বাড়িতে যাও। আজ রাতে ভালো কাপড় পরা আসবা। বিয়া আজই হওয়া লাগবি।–

সারাটা দিন তমিজ ধানের আঁটি বয়ে বয়ে এই বাড়ির উঠানে গাদা করে রাখলো। আর গোনাগুনতি চললো, আজ তার সঙ্গে সঙ্গে থাকলো নবিতন। ফুলজানের কোনো দেখাই পাওয়া গেলো না। নবিতনের দাঁতগুলো উঁচু, কিন্তু নাক বেশ চোখা আর তার। গলায় ঘ্যাগের আভাস মাত্র নাই। কিন্তু ফুলজানকে না দেখে দেখে তমিজের কাজে ভুল হয়, গুনতে ভুল হয়, আঁটি সাজানো এলোমেলো হয়ে যায়। ফুলজানকে না হলে তার। চলবে কী করে?

জুম্মাঘরে যেতে যেতে তমিজের রাত হয়ে গেলো। এশার নামাজ শেষ করে মুসল্লিরা বাড়ি ফিরছে। কালাম মাঝি তাকে দেখে শব্দ না করে কেবল দাঁত ফাঁক করে হাসে।। তার হাসি মোলায়েম দেখাচ্ছে কি অন্ধকারে? না-কি তমিজকে সে অভয় দিচ্ছে বলে হাসিতে তার ছায়া পড়লো, তমিজ ঠিক বুঝতে পারে না। কুদুস মৌলবি বলে, আসার কথা কলাম মগরেবের বাদে, আর তোর সময় হলো এখন? নামাজ পড়ার ভয় কি তোরগোরে এতোই? আখেরাতে কী লিয়া যাবু, ক তো বাপু।

তমিজ কাচুমাচু হয়ে থাকলে কুদুস মৌলবি আসল কথা ছাড়ে, তোর কাম হবি। আরে কালাম মিয়া হামার কথা ফালাবার পারে? কলো, তুই বিয়া কর‍্যা বৌ লিয়া বাড়িতে উঠবু। মণ্ডলের ভয় করিস না। তোর বাপের কথা কয়া কালাম মিয়া কান্দিলো। কয়, তার বেটা, হামার দায়িত নাই? বিয়ার খরচও কিছু দিবার চাছে। চিন্তা করিস না। উপরে আল্লা, নিচে কালাম মিয়া।

তো আপনে চলেন। কালাম মাঝির এরকম আশ্বাস যেন তমিজ আশাই। করছিলো। তাই কোনো উচ্ছ্বাস দেখায় না। তার এখন দরকার মৌলবিকে, নিজগিরিরডাঙাত চলেন। লিকা আজই পড়ান লাগবি। মণ্ডলের জামাতের কোনো মুনসি লিকা পড়াবার রাজি হবি না। চলেন।

এখনি? ক্যাংকা করা? কুদুস মৌলবির আজ দাওয়াত আছে আবিতনের বাপের বাড়িতে। আজ হয় না। কালাম মিয়া কলো, মেলাটা পার হোক। মেলার দিন তোক থাকা লাগবি কালাম মিয়ার সাথে। মাঝিরা হুজ্জত করলে তোক সামলান লাগবি। মেলাটা পার হোক।

তা কালাম মাঝির পক্ষে থাকতে তমিজ তো একশোবার রাজি। কিন্তু হুরমতুল্লা বুড়াক তো হামি জবান দিয়া আসিছি। লিকা পড়ান লাগবি।

তোর শ্বশুর হবি, তাক তুই কোস বুড়া, তার নাম ধরিস? নাম তমিজ, কিন্তু কথাবার্তা বেতমিজি।

আদব ও তমিজ এস্তেমাল করার জন্যে কিংবা বিরক্ত হয়ে তমিজ কয়েক পুলক চুপ করে থাকে। কুদুস মৌলবি বলে, জবান দিলেই রাখা লাগবি, এমন কোনো কথা নাই। আল্লা সব বোঝে, বান্দার সুবিধা অসুবিধা তার নজর এড়ায় না।

না হুজুর। অপনাগোরে কথা আলাদা। নামাজ রোজা করেন, আল্লা আপনার। অসুবিধা দেখবি। আমার নামাজ নাই, বন্দেগি নাই, আল্লা হামাক দেখবি কিসক? জবান দিছি, হামাক আজ বিয়া করাই লাগবি।

কুদুস মৌলবি তমিজের সমস্যাটা বোঝে। কিন্তু কালাম মিয়ার সাথে একটু বোঝা লাগে।

বোঝার দরকার কী হুজুর? আজ আপনে খালি লিকা পরায় আসেন। বৌ তো হামি ঘরত লিয়া আসিচ্ছি না।

লিকা পড়ার খরচপাতি আছে, জানিস তো?

 

হুরমতুল্লার ঘরের মেঝেতে মাদুর পাতা হয়েছে, মাদুরের ওপর নবিতনের বোনা কাঁথা, সেখানে ফুল আছে, মাছের ছবিও আছে। আবার ছোটো একটা কথা, তার ওপর বসলো তমিজ আর মৌলবি। হুরমতুল্লার ছোটো শালা এসেছিলো ভাগ্নীদের মেলায় নাইওর নিতে, ছেলেটা প্রথমে গম্ভীর হয়ে বসেছিলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই নবিতন আর ফালানির সঙ্গে সে বিয়ের আমোদে মেতে ওঠে। অতো রাতে হুরমতুল্লা তাকে দিয়ে গোলাবাড়ি হাট থেকে বাতাসা কিনে আনায়।

নবিতনের বোনা মিনারের আর চাঁদ তারা আঁকা ছবির ছোটো কথায় বসে তমিজ অদ্ভুত বায়না ধরে, বড়ো বেটির নামে হুরমতুল্লা জমির ভাগ লিখে না দিলে সে বিয়ের আসর থেকে উঠে যাবে।

হবু জামায়ের আচরণে হুরমতুল্লা আহত হয়, উৎকণ্ঠিত হয় আরো, রাগও হয় তার। মাঝির ঘরে মেয়েকে দিচ্ছে বলে শরাফত এবারেই তার বর্গা কেড়ে নেবে। আর মাঝির বেটাকে সে জমি লিখে দিচ্ছে শুনলে নিজগিরিরডাঙার চাষাপাড়ার লোকদের দিয়ে তার বাড়িঘর সব উচ্ছেদ করিয়ে ছাড়বে।

কুদুস মৌলবিও বিরক্ত হয়, বৌ লিয়া তোক ভাগা লাগবি মাঝিপাড়াত তোর লিজের বাড়িত। এটিকার জমি তুই রাখবার পারবু?

হামার জমি ক্যাড়া লেওয়া অতো সোজা লয় হুজুর। তমিজ জেদ করে, হামি জেলখাটা মানুষ, হামার সাথে লাগার ক্ষমতা মণ্ডলের বাপেরও হবি না।

কুদুস মৌলবির দেরি হয়ে যাচ্ছে। আশে পাশে কোনো বাড়ি নাই। ভবানীর মাঠ পার হলেই চাষীপাড়া। মণ্ডল কোনোমতে খবর পেয়ে যদি একটু ইশারা দেয় তো তমিজ তো তমিজ, মৌলবি নিজেও জান নিয়ে ফিরতে পারবে কি-না সন্দেহ। সে তাই একটা সমঝোতার চেষ্টা করে, হুরমতুল্লা পরামাণিকের বেটা নাই। তার জমিজমা যা আছে, পাবি কেটা? তার তিন বেটিই তো? হামরা আছি? কালাম মাঝির জোর কি মণ্ডলের চায়া কম? তহসেন দারাগা তার বেটা লয়? মণ্ডল খালি খালি নাফ পাড়ে। তুই নিশ্চিন্ত থাক।

নিশ্চিন্ত না হলেও তমিজ মেনে নেয়। তবে মেয়ের ভালোমন্দ, বিয়েশাদির ব্যাপারে মণ্ডলের মাথাব্যথা নিয়ে হুরমতুল্লা জানায়, বাপু, হামরা একই গুষ্টি, ছোটোজাতের কাছে বেটি দিলে খানদান লষ্ট হয়, তাই মণ্ডল ইংকা কোদ্দ করে। আর কিছু লয়। ধরো শরাফত মণ্ডলের দাদার মামু আর হামার খালার মামুশ্বশুর, না, হামার মামুশ্বশুরের খালা আছিলো মামাতো ফুপাতো ভাইবোন, না, আমার মামুর—। সম্পর্কটি খুঁজতে খুঁজতে সে হয়রান হয়ে পড়লে কুদুস মৌলবি তাগাদা দেয়, লেও, হছে। এখন বিসমিল্লা করি। * বাতাসা দেওয়ার পরেও লাউ দিয়ে রাধা শলুক দেওয়া শোল মাছ দিয়ে পেট ভরে ভাত খায় সবাই। মৌলবির সঙ্গে তমিজও বাড়িই ফিরে যেতো কিন্তু ফুলজান আর নবিতনের থাকার ঘরটি আজ নবিতন সাজিয়েছে বড় সুন্দর করে। অনেক রাত্রে তাকে একরকম ঠেলে ঢুকিয়ে দেয় ফালানি। তমিজ দেখে, ফুলজানের চোখে খুব পুরু করে কাজল লাগিয়ে দিচ্ছে নবিতন। ফুলজান আপন মনে তার নিজের ঘ্যাগে হাত বুলাচ্ছে। হাত দিয়ে চেপে ধরে ঘ্যাগটাকে সে যতোটা পারে সমান করার চেষ্টা করছে কি-না বলা মুশকিল। তমিজ ঘরে ঢুকতেই নবিতন খিলখিল করে হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করতে করতে সে আরো হাসে, ও দুলাভাই, আবার মাছ মনে এই কর‍্যা বুবুর মুখের মধ্যে বড়শি আটকায়া দিবেন না কলাম।

পোড়াদহ মেলার আগের দিন জোহরের নামাজের পর ফকিরের ঘাটে জাল নিয়ে গেলো আবিতনের বাপ, সঙ্গে ভিড়ে গেলো ভিকু পাগলা। ভিকু সম্পর্কে তার কেমন খালাতো ভাই হয়, আবার শালাও হয়। বাড়ি থেকে হঠাৎ করে তিন চার মাসের জন্যে উধাও হয়ে যাওয়ার অভ্যাসের ফলে, সবসময় পরনে ধুতি ও ময়লা তেলচিটচিটে রামপুরি টুপি মাথায় পরে থাকে বলে এবং প্রায়ই উর্দু বাত করার চেষ্টা করার কারণেও বটে, নামের সঙ্গে সে ঐ উপাধিটি অর্জন করেছে।

মাঘের শেষ বুধবার, কিন্তু শীত পড়েছে বড়ো বেশি; পোড়াদহ মেলার সময় এমন হবেই। আবিতনের বাপ খালাতো ভাই-কাম-শালাকে দিয়ে হুঁকায় তামাক সাজায়, হুঁকায় লম্বা কয়েকটা টান দিয়ে এবং আল্লার নাম নিয়ে ও উত্তর দিকে পাকুড়তলায় মুনসির উদ্দেশ্য মাথা ঝুঁকে সালাম করে তৌড়া জালের একটা খেপ মারে আড়াআড়ি। বিলের এই জায়গাটায় একটা গর্ত আছে, সব সময়ই মাছ থাকে। দাদা পরদাদারা বলে গেছে, সেই কোন আমলে কোথায় ভুমিকম্প হলে যমুনা হঠাৎ করে ফুলে উঠলে তার গতরের উপচে-পড়া পানি ঢেলে দেয় বাঙালি নদীতে। বাঙালি উপচে পানি এলে ভাসিয়ে দেয় এই গিরিরডাঙা নিজগিরিরডাঙা গ্রাম। পাকুড়গাছ থেকে মুনসি তখন পা। বাড়িয়ে কষে একটা লাথি মেরেছিলো ছোটো ডোবাটার ঠিক এই জায়গাতেই। তাইতেই তো ডোবা হয়ে গেলো মস্ত কালাহার বিল। বাঙালি পেরিয়ে যমুনার পানি সেখানে ঢোকার জায়গা পেলে দুই গাঁয়ের মানুষ তাদের ভাঙার অনেকটা ফেরত পায়। সেই থেকে এখানটায় মাছের বরকত বেশি। পোড়াদহের মেলায় ফকিরের ঘাটের শিঙিমাগুরের খুব কদর।

আজও আবিতনের বাপের জাল ভরে মাছ উঠলো, তার বড়ো খলুইটা ভরে গেলে সে জাল তুলে দেয় ভিকু পাগলার হাতে। ভিকুও মাছ ভরা জাল টেনে তুলছে, এমন সময় কে চেপে ধরলো তার ডান হাতের কবজি। ভিকু ওই অবস্থাতেই বলে, আসসালামু আলায়কুম। কেয়া ভাই হাত পাকড়াতা কাহে? হাত ছাড়িয়ে।

তার হাত চেপে ধরেছে আলি মামুদ, যমুনার মাঝিদের সর্দার গোছের মানুষ। ভিকুর সালামের জবাব না দিয়ে, উর্দু ভাষায় করা তার প্রশ্নের তোয়াক্কা না করে শান্ত গলায়। হুকুম দেয়, জাল লিয়া বাড়িত যাও।

ততোক্ষণে ফকিরের ঘাটে ও ঘাটের ওপারে জমতে শুরু করেছে যমুনার মাঝিরা। আলি মামুদ খামাখা গোলমাল করার লোক নয়, বরং অতো বড়ো কালো কুচকুচে শরীর থেকে বার করে মিষ্টি বুলি, বুড়ার বেটা, আবিতনের বাপের দিকে সে তাকায়, তোমরাও মাঝি, হামরাও মাঝি। মোসলমান মাঝি দ্যাশোত আর আছে কি-না সন্দ। হামরা নিজেরা নিজেরা খালি খালি হুজ্জত করি কিসক ভিকুর হাত ছেড়ে সে বলে, কালাম মিয়া সরকারের কাছ থ্যাকা ল্যাখাপড়া করা ট্যাকা দিয়া বিল ইজারা লিছে। উগলান কাগজপত্র দেখা তাক খাজনা দিয়া হামরা আজ আসিছি বিলের মাছ ধরবার। আজকার দিন এই বিলের মাছ ধরমু হামরা যমুনার মাঝিরা। তুমি এক খলুই মাছ ধরিছো, এটি থুয়া তোমার জাল লিয়া বাড়িত যাও। আবিতনের বাপের হতাশ মুখ দেখে সে আরেকটু বলে, হামাগোরে মাছ ধরা শেষ হলে তোমাক কিছু মাছ হামি লিজে থ্যাকা দিমু।

রাগে ও দুঃখে হোক কিংবা পরে মাছ পাবার আশ্বাসেই হোক, আবিতনের বাপ। জাল ও খলুই রেখে বাড়ির দিকে রওয়ানা হয়। কিন্তু তার খলুইটা হাতে নেয় ভিকু এবং আলি মামুদকে বলে, ইগলান ফালতু বাত কেয়া বলতা? তোম যমুনা আর গঙ্গা কাহেকা মাঝি না জেলে না নিকারি কেয়া হ্যায় তো হামারা বাল ছিড়েগা? গিরিরডাঙার মাঝিরা পোড়াদহ মেলামে মাছ বেচেগা নেহি?

রীতিমতোন খাজনা দিয়ে একদিনের জন্যে জমা নিয়ে মাছ ধরতে আসা যমুনার বনেদি মাঝিসর্দারের পক্ষে এতোটা সহ্য করা সম্ভব নয়, শোভনও নয়। আলি মামুদ কারো গায়ে হাত তোলার মানুষ নয়। সে পেছনে আড়চোখে একবার তাকায়, অমনি তার বেঁটে খাটো এক সঙ্গীর হাতের প্রবল এক ধাক্কায় ভিকু পড়ে যায় একেবারে নিচে। তার মুখ থেকে পেট পর্যন্ত ড়ুবে যায় পানিতে, তবে কোমর থেকে বাকিটা থাকে ডাঙার ওপরেই। উত্তর পাড়ার নুলা শামসুদ্দিন ভিকুর শরীরের প্রথম আদ্দেকটা তুলতে নেমে পড়ে পানিতে। তবে তার বাঁ হাতটা নুলো বলে শুধু ডান হাতে কিছু করতে পারে না। তবে ততোক্ষণ ভিকু তার শরীরের ডাঙার অংশটিও টেনে নিয়েছে পানিতে এবং একটুখানি সাঁতার দিয়ে পুরো শরীরটাই সে তুলে ফেলে ডাঙার ওপর, কিন্তু পানিতে তার টুপিটা ভেসে গেছে, তার ধুতির হালও এমন হয়েছে যে ওটা পরার উদ্দেশ্যই এখন ব্যর্থ। ধুতিটা কোনোমতে জড়িয়ে পরে ভিকু বারবার তার মাথায় হাত দিতে থাকে, . সেটা কি টুপির শোকে, না চুলের পানি ঝেড়ে ফেলতে তা তারও জানা নাই।

আবিতনের বাপ হনহন করে ছোটে কালাম মাঝির বাড়ির দিকে। হাঁটে গজর আর গজর করে, তাদের গ্রামে এসে, তাদেরই বাপদাদাপরদাদার বিলে মাছ ধরে ভিন ঠেনের মানুষ, আবার তাদের মারধোর করে,-এ কেমন কথা? তাদের নেতা কালাম মাঝি কি এর একটা বিহিত করবে না?

কিন্তু কালাম মাঝির বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো বুধা, সে জানায়, মামু গেছে তমিজের বাপের গোর জেয়ারত করবার।

আবিতনের বাপের পিছে পিছে এসেছে ভিকু পাগলা। সে অবাক হয়, তমিজের বাপের গোর? উও তো কেয়া বলতা চোরাবালিমে–! মামা তার সেখানেই গেছে। বলতে বলতে বুধাও তাদের সাথ ধরে।

আবিতনের বাপ সেদিকে ছুটলে ভিকু পাগলাও যেতে যেতে একটা হাঁক ছাড়ে তমিজের বাড়ির সামনে এসে। কুলসুম ভেতর থেকে জানায়, কিছুক্ষণ আগে তমিজ গেছে পাকুড়তলায়। জাল নিয়েই গেছে।

চোরাবালির তিনদিকে ঘেরা খাটো দেওয়ালের এক কোণে দাঁড়িয়ে দুই হাত তুলে জিয়ারতের দোয়া পড়ছে কুদ্স মৌলবি, তার পাশে মোনাজাতের হাত তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে কালাম মাঝি। তার দুই চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে তার দাড়িতে। দাড়ি এখনো তার তেমন বাড়ে নি। তবে দাড়ি হচ্ছে বেশ চাপ বেঁধে। মাথায় পরিষ্কার কিস্তি টুপি। কয়েক গজ দূরে ইটখোলার ইটের সারির পাশে হাঁটতে হাঁটতে একটা বেড় জাল ফেলার জুতসই জায়গা জরিপ করছে যমুনার আরেক সর্দার মাঝি, আলি মামুদের ভাই শাকের মামুদ। তার আশে পাশে বেশ কয়েকজন মাঝি। মস্ত বড়ো জালটা ধরে রয়েছে অন্তত তিনজন লোক।

বুধা সবাইকে ছাড়িয়ে চলে যায় আরেকটু উত্তরে, সেখানে মস্ত একটা তৌড়া জাল উড়িয়ে দিচ্ছে তমিজ। ৰিলের ঠাণ্ডা সর-পড়া পানিতে ছপাস আওয়াজ করে জালটা পড়তেই কালাম মাঝি হাত মোনাজাতে রেখেই এদিকে তাকায়। বুধা গিয়ে ধরে ফেলে তমিজের হাত, চাচা, তমিজ চাচা, আকজার দিনটা বাদ দে। মামু যমুনার মাঝিগোরে কাছ থ্যাকা মেলা ট্যাকা লিয়া আজকার জন্যে বিল জমা দিছে। তুই আজ আর মাছ ধরিস না চাচা। আজ থাক।

জাল ওঠাও। জাল ওঠাও। শাকের মামুদের এই কড়া হুকুমে তমিজ ফিরেও তাকায় না। কিন্তু জিয়ারত ছেড়ে কিংবা জিয়ারত সেরে ছুটে আসে কালাম মাঝি। তমিজের পাশে দাঁড়িয়ে সে বলে, তুই পাগলা হলু? তোর বাপের মাজার জিয়ারত করা তার দোয়া লিয়া আজ কাম শুরু করনু। তোর বাপের অছিলাত হামরা মাঝিরা বিল ফেরত পানু। হামি বিল পত্তন নিলাম। আজ যমুনার মাঝিরা মাছ ধরবি, ওরা হামাক খাজনাও দিছে। তুই জাল ওঠা।

বুধা তমিজের কানের কাছে মুখ নিয়ে সাবধান করে দেয়, যমুনার মাঝিরা সব মারকুটা মানুষ। আবার তহসেন ভাই কয়া রাখিছে আমতলির দারোগাক। খবর পালেই

পুলিস আসবি মটোরেত চড়া। তুই ওঠ বাপু।

কিন্তু ততক্ষণ তমিজের হাতে শক্ত টান পড়েছে। জালে ঢুকছে মস্ত কোনো মাছ। বেশ বড়ো মাছ। তমিজ ফিসফিস করে বলে, বুধা, বাপজান বাঘাড় ধরিছিলো না? তুইও তো সাথে আছিলু? মনে হয় ওই বাঘাড়টা!

বুধার গা শিরশির করে উঠলে সে চুপ করে। তমিজ বোঝে ডাঙায় দাড়িয়ে এই মাছ তোলা অসম্ভব। সরসর করে সে নেমে পড়ে ঠাণ্ডা পানিতে। ডাঙার তুলনায় পানি কম ঠাণ্ডা আর উরুতে গত রাত্রির ফুলজানের উরুর তাপ পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু তার মনোযোগ এখন জালের দড়ি টানার দিকে। বড়ো মাছের আভাস পেয়ে তার সঙ্গে সঙ্গে পানিতে নেমে পড়েছে ভিকু পাগলা, নুলা শামসুদ্দিন আর শামসুদ্দিনের ভাগ্নে মংলু। সবাই মিলে তারা জাল টেনেও হাপসে হাপসে যাচ্ছে, মাগো! কী মাছু না জানি আজ ধরা পড়লো গো!

শাকের মামুদ এবার সরাসরি ফয়সালা করতে চায় কালাম মাঝির সঙ্গে, কালাম মিয়া, বিলের ব্যামাক ঘাটোত তোমাগোরে মাঝিপাড়ার মানুষ জাল লিয়া আসিছে। ইগলান কী? তুমি হামাগোরে পয়সা ঘুরা দাও। মাছ ধরবার আসা এংকা হুজ্জত করবার পারমু না আমরা। পয়সা ঘুরা দাও। হামরা যাই। তবে ফিরে যাবার কোনো লক্ষণ তাদের নাই। বরং যমুনার মাঝিদের হাতে জাল ও পলো ছাড়াও যেসব অস্তর দেখা। যাচ্ছে সেগুলো দিয়ে শুধু মাছই মারা যায় না। কালাম মাঝি সবই খেয়াল করে এবং চি স্কার করে বলে, শালা হামাগোরে মাঝিপাড়ার মানুষ ইগলান কী করিচ্ছে? শালারা তো মরবি গো! শাকের মামুদ বলে, না গো, পয়সা ঘুরা দাও। আগে শরাফত মিয়াক খাজনা দিয়া হামরা বছর বছর মাছ ধরিছি, কেউ ক্যাচাল করে নাই। তোমাক খাজনা দিয়া অ্যাসা মুসিবতে পড়লাম।

কালাম মাঝি ফের চেঁচায়, এ তমিজ, উঠা আয়। তোরা শালারা ঠিক থাকিস মণ্ডলের কোন খালে!

ভিকু পাগলা ও মংলুর দুই ও দুই চার হাত, নুলা শামসুদ্দিনের এক হাত এবং তমিজের দুই হাত,–এই সাত হাত এবং তমিজের সর্ব অঙ্গের জোরে মাছটা তখন হাঁসফাঁস করছে, শালাকে বেরুতে দেওয়া হবে না। ভিকু বলে, বহুত বড়া রুই হোগা। তমিজ আস্তে করে জানায়, না। বাঘাড়। কথা কয়ো না। তার কথা কেঁপে কেঁপে ওঠে, বাপটা কি চোরাবালির ভেতর দিয়ে পানিতে ঢুকে মাছ ধরে দিলো নাকি?

কালাম মাঝির আর সহ্য হয় না, এই কুত্তার বাচ্চা। তোর বাপ মণ্ডলের কোন খায়া ঠিক হছিলো। এখন কোন দেওয়া লাগে তোক। মনে হচ্ছে, তমিজের বাপের। দোয়া পাবার পর তার প্রতি ভক্তি রাখার দরকার কালাম মাঝির ফুরিয়ে গেছে। এর পরেও তমিজ জাল নিয়ে ব্যস্ত থাকলে কালাম মাঝি ছাড়ে তার মোক্ষম অস্তর, এই শালা হারামজাদা। কাল তুই কুদ্স মৌলবিক ওয়াদা দিছিল না। কাল শালা ঘেগি মাগীটাক লিকা করলু। এখনি মণ্ডলকে খবর দেই তো হুরমতুল্লাক ভিটাছাড়া করবি। ঐ মাগীক লিয়া তুই তখন উঠবু কুটি? হামার কাছে তোর ভিটাঘর বন্ধক আছে না? আজই ঘর ছাড়া করমু তোক। তারপর সে ডাকে কুদুস মৌলবিকে। কুদুস মৌলবি মিনমিন করে বলে, একটা মাছ তুল্যা তমিজ বাড়িত যা।

কালাম মাঝি কষে ধমক লাগায় মৌলবিকে, আরে মুনসির বেটা, চুপ করো। পয়সা খাও হামার, আর কথা কও উল্টাপাল্টা, না? যাও জুম্মাঘরত যাও। নামাজ পড়ান, লাগবি না?

জুম্মাঘর থেকে তার পদচ্যুতির সম্ভাবনায় কুদুস মৌলবি দমে যায়, যতোটা পারে চিৎকার করে সে বলে, তমিজ, তুই না কাল ওয়াদা করলু, কালাম মিয়া যা কয় তাই শুনবু। আজ আবার–।

তার কথা শেষ না হতেই একটা বর্শা এসে পড়ে মংলুর পিঠে, ঘাড়ের নিচে বর্শাটা লেগেই সেটার গতি শিথিল হয়ে এসেছিলো বলে বর্শা পড়ে যায় পানিতে। তমিজ আর ভিকু পাগলা এর পরেও জাল না ছাড়লে আরেকটি বর্শা বিধে গেল তমিজের কনুইতে। শিথিল হাতের ভেতর দিয়ে জালের দড়ি খুলে যায়। মুনসির পান্টিই কি বর্শা হয়ে বিধলো তার কনুইতে? তা মুনসি হোক আর যেই হোক তমিজ তাকে ছাড়ছে না। এখন ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো পানিতেই কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে-থাকা লোকটি ভয়ে কাঁপছে। বোগাপটকা, বয়স পঞ্চাশের কম নয়। দেখেই বোঝা যায়, এ শালার জাল নাই, নৌকা নাই; পরের মাছ-ধরা নৌকায় শালা জন খাটে। বর্শাটাও তেমন জোরে মারতে শেখে নি, এর কাছে বর্শা যা, পান্টিও তাই। তমিজ নিজের বাঁ হাতের কনুই থেকে বর্শা উপড়ে নিয়ে বড়ো একটা নিশ্বাস টেনে নিয়ে ছুঁড়ে মারলো লোকটার মুখ বরাবর। লোকটা লাফ দিয়ে ওঠায় বর্শাটা বেঁধে তার গলার নিচে। সঙ্গে সঙ্গে সে পড়ে যায় বিলের পানিতেই, অনেকটা জায়গা জুড়ে পানি দেখতে দেখতে লাল হয়ে ওঠে এবং তমিজের জালের বড়া মাছটাও জাল ছিড়ে বেরুবার সময় তার বহুকালের ল্যাজ, পেট, পিঠ ও মাথা ঝাকালে পানিতে ঢেউ ওঠে এবং রক্তাক্ত পানির ঝাপটায় মনে হয় বিলে বুঝি আগুন লেগেছে।

গলায় বর্শা বেঁধা মানুষটাকে ডাঙায় উঠিয়ে ফেলে যমুনার মাঝিরা। তাকে ঘিরে যমুনার মাঝিদের ভিড় দেখে শাকের মামুদ তাদের উঠিয়ে দেয়, এটি তামশা দেখবার আসিছে, না? যাও যাও বেড় জালটা খাটাও। শিমুলতলা এখনো খালিই পড়া আছে। যাও সোগলি যাও।

এদিকে তমিজের বর্শায় আহত মানুষটা বেহুঁশ হয়ে রইলো, তাকে শোয়াননা হয়েছে চোরাবালির বেঁটে দেওয়াল ঘেঁষে। কালাম মাঝি লোক পাঠিয়েছে করিম ডাক্তারকে ডাকতে। কিন্তু আলি মামুদ বলে, আগেই ডাক্তার কিসক? পুলিস জখম দেখবি না? জখম না দেখলে মামলা শক্ত হয় ক্যাংকা কর‍্যা?

আরে আমতলির দারোগা তো আমার বেটার কথাত উঠবি, তার কথাত বসবি। কালাম মাঝির এই আত্মবিশ্বাসে আলি মামুদ কিংবা শাকের মামুদ টলে না, দারোগা, তাই দারোগাই। দারোগা নিজের বাপেকও ছাড়ে নাকি?

এদিকে তমিজের দিকে তেড়ে এসেছিলো যমুনার মাঝিদের মেলা ছোঁড়া। মংলু, ভিকু পাগলা, আবিতনের বাপের নেতৃত্বে মাঝিপাড়ার ছোঁড়ারা তাদের ঠেকায়, তবে তমিজের পিঠে বাঁশের একটা চোট লেগেছে বেশ ভালো ভাবে। কিন্তু যমুনার নেতৃস্থানীয় মাঝিরা এখন গোলমাল সহ্য করছে না, আগে মাছ ধরো। বেলা তো ড়ুবাই গেছে, বাতি জ্বালাও, মাছ ধরো।

কালাম মাঝি তাদের আশ্বাস দেয়, তহসেন তো আর এটি আসবার পারে না। অর হুকুম পায়া আমতলির দারোগা ফোর্স লিয়া খাড়া হয়া আছে গোলাবাড়ি হাটেত। এখনি আসিচ্ছে।

না। এখন থাক। আলি মামুদ বাধা দেয়, হামাগোরে মাছ ধরা হোক। মাছ ধরা পোড়াদহ পাঠাঁই আগে। পুলিস আসলে শালারা আদ্দেক মাছ লিয়া যাবি।

তমিজের ওপর কালাম মাঝি এতোটাই রেগে গেছে যে পারে তো এখনি গলায় পা দিয়ে তাকে শেষ করে ফেলে। কিন্তু তার জন্যে তার উদ্বেগও অন্তত চার আনা। একবার ইচ্ছা করে, কোমরে দড়ি বেঁধে তৌড়া জালের মতো তাকে ছুঁড়ে ফেলে দেয় চোরাবালির ঠিক মাঝখানটায়। কুত্তার বাচ্চা বালুর মধ্যে মরুক দম বন্ধ হয়ে। আবার সঙ্গে সঙ্গে ভয়। হয়, ছোঁড়াটাকে যদি পুলিস একবার ধরে তো জেলের ঘানি টানবে সারাটা জীবন। এদিকে মাঝিপাড়ার মানুষ সব জোট বাঁধতে শুরু করেছে উত্তর পাড়ায়। সবাই যদি এদিকে আসে তো শালার মাঝির জাত, কোনো বিশ্বাস নাই, কালাম মাঝির টিনের নতুন আটচালায় আগুন ধরিয়ে দেবে। কালাম এখন কী করে?

পাকুড়তলা থেকে উঠে তমিজ ভিকু পাগলা আর মংলুর পিঠে হাত দিয়ে রওয়ানা হয়েছিলো উত্তরপাড়ার দিকে। কালাম তাকে ধরে আড়ালে নেয়। ভিকু পাগলাকেও ডাকে। গলা নামিয়ে বলে, তমিজ, যে নেমকহারামিটা তুই করলু তোর ফাঁসি হলেও হামি আটকাবার পারমু না রে।

উগলান পরে দেখা যাবি। মংলু বলে, দেখি আবিতনের বাপের ঘরত হামরা আগে বস্যা বুঝি।

আবিতনের বাপের ঘরে তমিজ একবার গেলে শালারা জোট বেঁধে এসে হাজির হবে। কালাম বলে, তমিজ তুই ভাগ। পুলিস আসলে ইগলান বুঝাবুঝি কিছু শুনবি না।

 

পুলিসের কথায় ভিকু পাগলা একটু ঘাবড়ায়, পুলিসকো হামরা সাচ কথা বলেঙে।

এদিকে রাত হয়ে যাচ্ছে। তমিজকে একরকম জোর করেই বুধা আর কালাম মাঝি তোলে নিজের ঘরে। অন্যদের বলে, তোমরা উত্তরপাড়াত যাও।

কিছুক্ষণ পর তমিজের শরীরে মাথায় ছাই রঙের একটা আলোয়ান জড়িয়ে বুধা তার পিঠে হাত ঠেকিয়ে গোলাবাড়ির পথ ধরে। ভিকু পাগলা তখনো দাঁড়িয়ে রয়েছে কালাম মাঝির বাড়ির বাইরের উঠানে। বুধা তার দিকে তাকিয়ে চোখ টেপে।

ভোর হওয়ার আগেই আমতলির দারোগা চলে আসে দুইজন কনস্টেবল নিয়ে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই যমুনার মাঝিরা নৌকা বোক্সাই মাছ নিয়ে রওয়ানা হয় পোড়াদহ মাঠের দিকে। জখম মাঝিটা রয়ে গেলো কালামের ঘরে, আর পুলিসকে সামলাতে রইলো আলি মামুদ।

সেদিন পোড়াদহ মেলা। গ্রামের ঘরে ঘরে নাইওর। গ্রামের প্রত্যেকটি প্রাণী মেলায় যাবার জন্যে তৈরি হতে ঘুম থেকে উঠেছে ভোর হওয়ার অনেক আগে। সুতরাং কাউকে জাগিয়ে তোলার কষ্ট পুলিসকে আর করতে হয় নি। ফুল ইউনিফর্মে হাফপ্যান্টের তলায় মাঘের হাওয়া ঢোকায় নিম্নাঙ্গ তাদের শীতে কুঁকড়ে কুঁকড়ে যায়। সেটা পুষিয়ে নিতে ঊর্ধ্বাঙ্গের অন্তর্গত মুখে তারা অবিরাম গালাগালি করে। দারোগাকে ধরলে তিনজন পুলিসের তিন দ্বিগুণে ছয়টা পা চলতে থাকে সারা গ্রাম জুড়ে। পা পিছু দুজন করে মোট বারোজনকে তারা ধরে। তাদের কোমরে দড়ি বেঁধে সবাইকে বসিয়ে রাখে কালাম মাঝির বাড়ির বাইরে। তহসেন সকালে এসেছে সাদা পোশাকে, বৌ ছেলেমেয়ে রেখে সে চলে যাবে বেলা সাড়ে দশটার মধ্যেই। বাপের কাছে সে বারবার আফসোস করে, এক নম্বর। আসামীই তো ধরা পড়লো না। কী মুশকিল। তমিজকে খুঁজতে পুলিস কোনো জায়গা। আর বাকি রাখে না। এমন কি তহসেনের কথায় তার নিজের বাড়ির ঘরে ঘরেও তমিজকে খোঁজা হয় তন্ন তন্ন করে। তহসেন তার দিকে বারবার আড়চোখে তাকালে কালাম মাঝি মুখ কাচুমাচু করে বলে, এ শালা মণ্ডলের কাম। হামার সাথে দুষমুনি করা মণ্ডলই বুঝি তমিজকে কোটে সরায়া দিলো। মণ্ডলবাড়ি একবার দেখবা নাকি?

তহসেন বলে, পাগল হলেন নাকি? শরাফত মণ্ডলের সঙ্গে বাপের বিবাদ করাটা তহসেন সায় দিতে পারে নি কখনোই। কাদেরের ক্ষমতা এখন মেলা। তার বড়োভায়ের ছেলেটা এবার ম্যাট্রিক দেবে, ছাত্র নাকি খুব ভালো। তার ছোটো বোনটা ভি এম গালর্স স্কুলে তহসেনের মেয়ের সঙ্গে পড়ে, সেটাও পরীক্ষায় ওপরদিকেই থাকে। আজিজ টাউনে বাড়ি কিনেছে হিন্দু পাড়ায়, কী সুন্দর বাড়ি। এইসব লোকের সঙ্গে তার বাপের গোলামাল। আর খাতির যতো সব ছোটলোকের সঙ্গে। গোমরা মুখ করে তহসেন বলে, আমি যাই। দুইটার দিকে ফোর্সের সঙ্গে যেতে হবে কাহালু, তেভাগার শয়তানগুলো আজ বিকালে ময়েজ সরকারের বাড়ির গোলা লুট করতে পারে। যাই। আমতলির দারোগার কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার সময় সে বলে, গোলাবড়িটা একবার দেখতে পারেন। তবে একটা রাত পুরো পেয়েছে, বেটা কি আর বসে আছে?

এবার পোড়াদহের মেলায় কেষ্ট পালের মুখে থমথমে মেঘ, চোখে ঘোলাটে লাল অন্ধকার। মেলার আগের দিন মঙ্গলবার সন্ন্যাসী ঠাকুরের প্রাণপ্রতিষ্ঠার পর কালো মুখে লাল চোখে সে চলে যায় বাড়ির দিকে এবং পরদিন মেলা না দেখে সারাটা দিন কাটায় বটতলায় ঠাকুরের বেদীর নিচে। তার প্রাণটা ধুকধুক করে : এভাবে হেলাফেলা করে আরাধনা হলে ঠাকুরের দৃষ্টি শুভ থাকে আর দ্রুততদিন? এভাবে পূজা হলে মানুষের ভক্তিই বা টেকে কদ্দিন?

মুকুন্দ সাহা তো ভাগলো পূজার আগে আগে, আর নায়েববাবুর দর্শন অনেক কষ্টে যদিও বা মিললো, সন্ন্যাসী ঠাকুরকে নিয়ে কথাবার্তা সে যা বললো নেহায়েৎ বামুনের ঘরে জন্ম হওয়ায় তার মাথায় বজ্রাঘাত হলো না; ছোটোজাতের মানুষ তারা, তাই শুনেই তাদের যা পাপ হলো তার প্রাচিত্তির কোনো শাস্ত্রে আছে কি-না সন্দেহ।

তা নায়েববাবুর আর কী? পরিবার তো ইনডিয়ায় রেখেই এসেছে, নিজেও চলে যাবে দুই এক বছরের মধ্যেই। ইনডিয়া গিয়ে তারা বড়ো বড়ো দেবদেবীর পূজা করবে প্রাণ ভরে। সেখানে কাশী বৃন্দাবন মথুরা, সেখানে কালীঘাট নদীয়া। জাগ্রত দেবদেবীর সেখানে লেখাজোকা নাই। কিন্তু তাদের গ্রামের এই সন্ন্যাসী ঠাকুরকেও যদি অসন্তুষ্ট করে রাখে তো তাদের হালটা হবে কী? মোসলমানদের কি আর বিশ্বাস করা যায়? একটু টাকা পয়সার মুখ দেখলে দুই পাতা পড়াশোনা করলে সন্ন্যাসী পূজায় এরা বাগড়া দিতে আসে। শরাফত মণ্ডল বলেছে, মেলায় তার আপত্তি নাই। কিন্তু পূজার জায়গায়, বটতলায় মোসলমানদের আসা যাওয়া চলবে না। সে হুঁশিয়ার করে দিয়েছে মোসলমানদের চলতে হবে পাক্কা শরিয়ত মোতাবেক। মেলার দিনে গোলাবাড়ি থেকে সন্ন্যাসীর থান পর্যন্ত এতকালের ঘোড়দৌড়টা সে একেবারে অনুমোদন করে না। কালাম মাঝি অবশ্য তার ওপর টেক্কা দিতে বড়ো বড়ো ঘোড়া আনতে চেয়েছিলো সেরপুরের পশ্চিমে খোন্দকারটোলা থেকে। ঘোড়া নাকি এসেও গিয়েছিলো গোটা পাঁচেক। কিন্তু মেলায় ঘোড়াদৌড়ে সওয়ারি তো সব আসে মাঝিপাড়া থেকে। এবার মেলার দিন ভোরবেলা মাঝিপাড়ার আদ্দেকের কোমরে দড়ি পড়লো। ঘোড়াদৌড় শেষ পর্যন্ত হলোই না। পাকুড়তলার মুনসি কি এটা সহ্য করবে? ঘোড়ায় করে ছুটে এসেছিলো তো মুনসির দলের সর্দার, মজনু শাহ, ভার বেশুমার ফকিরদের সঙ্গে ছিলো মুনসি। মানুষ সেই কথা ভুলে গেলে মুনসির অভিশাপ নেমে আসবে না?

পশ্চিমা সন্ন্যাসীও এবার এসেছে অনেক কম। মানতের গাঁজা ঠাকুরের থানের নিচে গড়াগড়ি যায়। কেষ্ট পাল পুরনো মানুষ, যতোটা পারে ধীরস্থির থাকতে চেষ্টা করে। কিন্তু মানুষটা খুব দমে গিয়েছে : বাবুদের ছায়া না পেলে ঠাকুর আর তুষ্ট থাকবে কতোদিন?

মেলা ভেঙে গেলে অনেক রাত্রে বৈকুণ্ঠ গিরি এসে বসে বটতলায় ঠাকুরের বেদীর নিচে। এ বছরেও ভোরবেলা ভবানী ঠাকুরের দর্শন তার ভাগ্যে জুটলো না। গতকাল রাতে, মেলার আগের দিন, পূজার বটতলা যখন পশ্চিমা সন্ন্যাসীতে, পূজায় আরাধনায়, গাজায়, আরতিতে, কামারে কুমারে, জোলায় কলুতে মাঝিতে গমগম করছে, বৈকুণ্ঠ তখন ফিরছিলো হাটের দোকানে। পরদিন ভোর থেকে মেলা, গোলাবাড়ি হাটের দোকানদারদের বেশিরভাগই আজ রাত কাটাবে পোড়াদহ মাঠে। কেষ্ট পালের ছোটভাই বিষ্ণু বলে, বৈকুণ্ঠ তুই হাটে যা। সাহার দোকান খালি না রাখাই ভালো। মানুষের লজর আছে ওই দোকানের উপরে। ঠাকুরের প্রসাদ কিছু নিয়ে এসেছিলো, তারই খানিকটা খেয়ে বৈকুণ্ঠ শুয়ে পড়ে। এমন সময় ফিসফিসে গলায় বৈকুণ্ঠদা শুনে দরজা খুলে দেখে * তমিজ। সন্ধ্যার পরপরই সে মাঝিপাড়া থেকে পালিয়ে এসে লুকিয়ে ছিলো হাটের কাছেই মুচিপাড়ার পাশে এক ঝোপের ভেতর। রাত হলে গোলাবাড়ি হাটে এসে দেখে কেউ নাই।

তার বিবরণ শেষ করতে না দিয়ে বৈকুণ্ঠ বলে, শুনিছি। মেলার মাঠেত সবই তো শুনলাম। আয় ঘরত আয়।

বাঁ হাতের কনুই তমিজের অসম্ভব ফুলে উঠেছে। পিঠের খোঁচাটা তেমন নয়। দিনমান না খেয়ে ছোঁড়াটা কাবু হয়ে গেছে। বৈকুণ্ঠ তাকে পূজার প্রসাদ দিলে সে গল্প গপ করে খায়। কিন্তু একটুখানি খেয়েই নেতিয়ে পড়ে মুকুন্দ সাহার গদির ওপর। তারপর কোঁকাতে থাকলে তার গায়ে হাত দিয়ে বৈকুণ্ঠ দেখে তার গা পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। বৈকুণ্ঠ কী আর করে, টিউবওয়েল থেকে পানি এনে সারারাত ধরে তমিজের মাথায় জলপট্টি দেয়। ভোর হওয়ার অনেক আগেই মুকুন্দ সাহার দোকানের দরজায় আস্তে আস্তে আওয়াজ হলে বৈকুণ্ঠ ফিসফিস করে বলে, পুলিস। তমিজ তার হাত ধরে থাকে। একটু পর বৈকুণ্ঠ বেরুবে ঠাকুরকে দেখার আশায়। এই সময় রাতভর বেজাতের মানুষের সঙ্গে হাত ঘষাঘষি কি কি হচ্ছে? কিন্তু উপায় কী? তমিজকে পুলিসে ধরলে ছোঁড়াটার ওপর কী জুলুমটা যে করবে!

ওদিকে দরজায় আস্তে আস্তে ধাক্কার সঙ্গে শোনা যায় এই বৈকুণ্ঠ। এই বৈকুণ্ঠ।

দোকানের শেষ মাথায় মরিচের বস্তার আড়ালে তমিজকে তুলে নিয়ে বৈকুণ্ঠ তাকে, শুইয়ে দেয় মেঝের ওপর। তারপর ফিরে দরজা খুলতেই গফুর কলু ঘরে ঢুকে দরজা আটকে দিয়ে ফিসফিস করে বলে, তমিজেক বার কর‍্যা দে। পুলিস মাঝিপাড়ার দিকে যাচ্ছে। তমিজ এক লম্বর আসামী।

তমিজ কোটে? বৈকুণ্ঠের এই কথায় গফুর রাগ করে, তমিজ তোর এটি ধরা পড়লে পুলিস তোক বত্তাই জবো করবি। কালামের বেটা খবর দিছে আমতলি থানাত। এই দোকানঘর থ্যাকা তোক সরাবার পারলে কালাম মাঝির আর কোনো কাঁটা থাকে না। বলতে বলতে সে নিজেই চলে যায় দোকানঘরের শেষ প্রান্তে এবং মরিচের বস্তার ওপার থেকে তমিজকে ধরে দাঁড় করায়। তোর বরাত! তার সৌভাগ্যের ব্যাখ্যাটা হলো এইরকম : কাদের কিছুক্ষণ আগে গফুরকে খবর দিয়েছে, তমিজ যেন মিছেমিছি পালাবার চেষ্টা না করে। তমিজকে পেলে গফুর নিজেই যেন তাকে নিয়ে চলে যায়। টাউনে, টাউনে কাদেরের বাসায় রেখে আসে। মেলায় কাদেরের বন্ধুদের নিয়ে আসতে গফুরের এমনিতেই তো টাউনে যাবার কথা, ঐ সময় তমিজকে সে যেন সঙ্গে নেয়। চল, হামি তো সাইকেলেত যামু, তুই ভালো করা আলোয়ান গাওত দিয়া নে। ভয় করিস না। পুলিস তো আসিচ্ছে পুব থ্যাকা, হামরা যামু টাউনের দিকে। চল।

বৈকুণ্ঠের খালি আফসোস হয়, ছোঁড়াটাকে নিয়ে আগেই সে টাউনের দিকে ভাগলো কেন? তমিজ তার গা ঘেঁষে দাঁড়ায়। গফুর কলুকে সে ভয় পাচ্ছে? গফুর কি তাকে নিয়ে কাদেরের টাউনের বাসায় যাবে, না পুলিসের হাতে তুলে দেবে? কাদেরের মতলবটাই বা কী? তমিজকে দিয়ে সে কি মাঝিপাড়ার মানুষকে খেপিয়ে তুলবে কালাম মাঝির বিরুদ্ধে? কালামকে তো সে সহ্যই করতে পারে না। বৈকুণ্ঠ এখন করে কী?

গফুর বিরক্ত হয়, এই শালা মাঝির জাত, ইগলানেক ভালো করবার গেলেও দোষ হয়। থাক শালা এটি থাক। হিন্দুই হোর লিজের মানুষ হলো? শালা হিন্দুটাকও তো মারবু রে।

তমিজ বৈকুণ্ঠকে জড়িয়ে ধরলে সে আস্তে করে বলে, তমিজ, তুই যা, কাদের ভাইয়ের মেলা ক্ষমতা।

তমিজ গফুরের সঙ্গে টলতে টলতে হাঁটে। দরজা পেরোবার সময় সে বৈকুণ্ঠের দিকে একবার তাকায় তার তপ্ত ও লাল দুই চোখ ভরে। বৈকুণ্ঠের মাথাটা দপ করে ওঠে : তমিজের বাপ যেন চেরাগ আলির দিকে তাকিয়ে কারো কোনো দুঃস্বপ্নের ব্যাখ্যা শুনছে।

দরজা দিয়ে বেরিয়ে গফুর ভেতরে তাকিয়ে দরজা ভালো করে বন্ধ করার ইশারা দেয়। তমিজ কিন্তু আর একবারো ফিরে তাকায় না।

দেখতে দেখতে রোদ উঠে গেলো। এবারও বৈকুণ্ঠের ঠাকুর দর্শন হলো না। এবার বরং ঠাকুরের সঙ্গে দেখা হওয়ার দরকারটা ছিলো বেশি। বৈকুণ্ঠ যদি রাত থাকতেই তমিজকে নিয়ে মোষের দিঘির পাড়ে চলে যেতো! বৈকুণ্ঠ তো একরকম ধাক্কা দিয়েই তাকে বার করে দিলো। তমিজকে দেখে মনে হচ্ছিলো, এক পুলিসের হাত থেকে বাঁচাতে তাকে যেন ঠেলে দেওয়া হচ্ছে আরেক পুলিসের কবজায়। তমিজকে নিয়ে বৈকুণ্ঠ যদি মোষের দিঘির ওপর থেকে সন্ন্যাসী ঠাকুরের দর্শন একবার পায় তো ঠাকুরই তাকে বুকে টেনে নিতো। তমিজের বাপের বেটা কি রাগ করে গেলো তার ওপর? ঘর থেকে বেরিয়ে একবারও ফিরে তাকালো না কেন?

মেলার পর মানুষজন চলে গেছে। কিছু কিছু দোকানের ভেতর ঘুমিয়ে পড়েছে দোকানদাররা। আলো জ্বলে নটিপট্টিতে। আর এখানে সন্ন্যাসীর বেদি ঘেঁষে বটগাছের নিচে পশ্চিমা সন্ন্যাসী শুয়ে রয়েছে জনা ছয়েক। আর যারা এসেছিলো তারা কেটে পড়েছে। এই ছয়জন ঘুমিয়ে থাকে চারটে কম্বলের নিচে। সন্ন্যাসীরা নিজ নিজ নাভিমূল থেকে ব্রহ্মাকে টেনে হিচড়ে বার করে দিচ্ছে যার যার নাক দিয়ে। একেকজনের নাক ডাকার একেকরকম আওয়াজ বৈকুণ্ঠের কানে বড়ো এলোমোলো ঠেকছিলো। কিছুক্ষণের মধ্যে ওই গোলমেলে ধ্বনিতে একরকম বিন্যাস তৈরি হয়। ভবানী পাঠকের আশীর্বাদে ওই আওয়াজ থেকে নাক ডাকার শব্দ আড়ালে চলে যায়। অচেনা তাল ও লয়ের বাজনা। শুনে বৈকুণ্ঠ বোঝে, এখনি শুরু হবে চেরাগ আলি ফকিরের গান। ঠাকুরের থানে মাথা রেখে সে জিগ্যেস করে, একেবারে নতুন কিসিমের গান বান্ধিছছা ফকির?

মনুষ্যের কী সাধ্য এই সংগীত রচনা করে?-এরকম কঠিন সমস্কৃত কথা চেরাগ আলির জিভে আসবে কী করে?—চমকে উঠে এবং খানিকটা ভয় পেয়েও বটে, বৈকুণ্ঠনাথ গিরি ধোয়া ও উৎকণ্ঠা, নেশা ও উদ্বেগ এবং ভয়ে ও উত্তেজনায় ভারী মুণ্ডু ওপরে তুলে দেখে, তার নয়নের সুমুখে জটাশির, বিভূতিমণ্ডিত ও ঊধ্ববাহু সন্ন্যাসীর বিশাল মূর্তি। সন্ন্যাসীর হাতের ত্রিশূলের তিনটে কাঁটা কুয়াশা ফুড়ে ঢুকে গেছে আকাশের খোপের ভেতর। কাঁটার আঁকশি তিনটেতেই আলো জ্বলে, তিনটেতেই মাছের নকশা জ্বলে জ্বল জ্বল করে। ত্রিশূল দিয়ে সন্ন্যাসী ঠাকুর বিজলি শিকার করবে নাকি? এই মাছের নকশা সন্ন্যাসী কি চেয়ে নিয়েছে মুনসির পাণ্টি থেকে? না-কি মুনসিই ত্রিশূল থেকে একটি এনে বসিয়ে দিয়েছে তার পাণ্টির মাথায়? মাছ কেন? বিজলির কি মাছের লালচ একটু বেশি যে তাকে ধরতে মাছের টোপ লাগাতে হয়? সন্ন্যাসীর মস্ত মাথা নিজের মাথায় নিয়ে বটগাছ ছড়িয়ে পড়েছে গোটা পোড়াদহের মাঠ জুড়ে। বৈকুণ্ঠনাথ চোখ বুজলে তার কানে বেজে ওঠে : সুখনিদ্রাপরিত্যাজে জাগো মৃগরাজতেজে
মীন জাগে তরু জাগে জাগো গিরিগণ।
তোমরা সুপ্ত শয্যাপরি গৃহে প্রবেশিল অরি
বান্ধিল শৃঙ্খলে তোমরা ড্রিাতে মগন।
ভবানী হুঙ্কারে জাগো জাগো গিরিগণ।।

বৈকুণ্ঠের সারা শরীর কাঁপে থরথর করে, এই শাস্তর তো চেরাগ আলির নয়। এরকম শক্ত শক্ত কথা চেরাগ আলির পেটে যদি কোনোদিন থেকেও থাকে তো তার গলা পর্যন্ত আসতে না আসতে তা গলে গেছে, জিভে চড়ার বল তার হয় নি। চেরাগ আলির গলা ভারি, কিন্তু নদীর পানিতে, পানির বাতাসে আর বাতাসের হিমে ও তাপে সেই স্বরে ভাঙনের চিহ্ন, চিড় খাওয়ার দাগ। সেখানে বিজলির এরকম রাগী গর্জন নাই। এই গর্জন আসছে বটগাছের অনেক ওপর থেকে। বটগাছের নিচে দাঁড়ালে বৈকুণ্ঠ টের পায়, সন্ন্যাসীর গান হুঙ্কার দিতে দিতে চলে যাচ্ছে উত্তর পশ্চিমে। এই গানের নিচে নিচে সে চলতে শুরু করে।

হাঁটার জন্যে দুই পা ফেলতে পায়ের নিচে পড়ে বটফল, হাঁটুতে আর কোমরে ঠেকে বটগাছের কচি চারা। একটা দুইটা তিনটা চারা। বটগাছের কচি চারা গায়ে লাগলে তাঁর সর্বাঙ্গ শিরশির করে। ঐ পাতার ছোঁয়া কাটাতে এবং ঐ পাতাওয়ালা চারা থেকে বল পেতেও বটে, বৈকুণ্ঠ তার হাঁটুসমান একটা বটের চারা উপড়ে নেয় বেশ জোরে টান দিয়ে। না, এই অন্ধকার কুয়াশার রাতে খালি হাতে সে যাত্রা করে কীভাবে?

বটতলা থেকে পোড়াদহ মাঠ পেরিয়ে গান এখন উড়াল দিচ্ছে উত্তর পশ্চিমে। বাঙালি নদীর রোগা স্রোতের ওপর দিয়ে গান ওড়ে, বাঙালির স্রোতে তার ছায়া ফেলে, তার বিনিময়ে গান তার ডানায় মেখে নেয় কুলুকুলু বোল। কাৎলাহার বিলের উত্তর সিথানে পাকুড়তলা থেকে গানের প্রতিধ্বনি ফিরে আসে, ফেরার সময় তার পাখায় লাগে পাকুড়গাছের ঝিরিঝিরি কথা আর বিলের ঢেউ আর বাঙালি নদীর স্রোতের ভিজে হাওয়া :

জাগো কাতারে কাতারে গিরিরডাঙা কাৎলাহারে
জোট বান্দো দেখো টেকে কয়টা দুষমন।
জোট বান্দো ভাঙো হাতের শিকল ঝন ঝন।
শিকল মিলায় রৌদ্রে শিশির যেমন।।

এই তো মুনসির গান, রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, হাওয়ায় হালকা হয়ে ঝরে পড়ছে চেরাগ আলির ভাঙাচোরা ভারি গলায়। কালাহার বিলের রুই কালা, পাবদা ট্যাংরা, শিঙি মাগুর খলসে পুঁটির আঁশটে গন্ধে, ভেড়ার আদলে জেগে-ওঠা গজারের ভেড়ার লোমের বোটকা গন্ধে ম ম করতে করতে চেরাগ আলির গলায় মুনসির গান বারবার ধাক্কা দিচ্ছে বটগাছের নিচে, সন্ন্যাসীর থানে। আর দেরি করা যায় না। তমিজটা কাদেরের হাতে ধরা দিতে গফুরের সঙ্গে রওনা হয়ে বৈকুণ্ঠের দিকে একবারো ফিরে তাকালো না। ছোঁড়াটা তার কাছে ঠাঁই চেয়েও না পেয়ে কী অভিমানটাই করে গেলো গো। বেটার কষ্টে চোরাবালির ভেতরে বাপটা তার না জানি কী ছটফট করে মরছে।–তমিজের বাপের পাশে একবার বসা দরকার। চোরাবালির দিকে যাবার জন্যে বটের চারা হাতে লম্বা লম্বা কদম ফেলে চলে বৈকুণ্ঠ।

 

খোয়াবনামা – আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ৫০. কামিজের ওপরে ওড়না

কামিজের ওপরে ওড়না, ওড়না ময়লা হলেও একটু খেয়াল করলে বোঝা যায় যে, মেয়েটির একটি স্তন নাই। বিহারে হিন্দুরা মেয়েটির অন্যান্য অঙ্গের সঙ্গে দুটো স্তনই আশ মিটিয়ে চাটা ও চোষার পর একটি কেটে ফেলেছে, খবরটা এই রিফিউজি ক্যাম্পে সবাই জানে এবং এর ফলে তার আত্মীয়স্বজনের রিলিফের হিস্যাটা একটু বেশি। কাদেরের হুকুমে কেরামত আলি একটা শাড়ি তার দিকে এগিয়ে ধরতেই সেটা চালান হয়ে যায় অন্য একটি হাতে। ওড়নার ভেতর থেকে মেয়েটি চোখ মেলে তাকালে ঘোমটা একটু সরে যায়। তার নিশ্বাস নেওয়ার আওয়াজে কেরামতের কান ঝাঁ ঝাঁ করে ওঠে এবং ঐ নিশ্বাসের আওয়াজে বা নিজের কানের ঝাঁ ঝাঁ গোলমালে কেরামতের বাবরি চুল এলোমেলো হয়ে যায়। এও কি গন্ধ শুকে কে মানুষের ভেতরের কথাবার্তা সব জেনে ফেলবে নাকি? কিন্তু এর গায়ের রঙ তো রীতিমতো ফর্সা, এর নাক তোক টিকালো। কুলসুমের মতো এর চোখ অতো বড়ো নয়, এর চোখে পটলচেরা ভাব।–তা হলে মিলটা কোথায়?

মেয়েটির কাটা স্তন এবং কুণ্ডবাড়ির একতলা, দোতলা ও ছাদ জুড়ে উর্দু ও দেহাতি হিন্দিতে প্রকাশিত রিফিউজিদের ক্ষোভ, রাগ, বিলাপ ও অভিযোগ ভাষার দুর্বোধ্যতা মুছে ফেলে এবং কেরামতের বাবরি চুল ছুঁড়ে খোঁচাতে থাকে অবিরাম। খোঁচায় খোঁচায় একটি পদ্যের কুঁড়ি তার মাথার চাঁদিতে বেঁধে ছোটো একটি কাটার মতো, কিন্তু কুঁড়িটা ফোটে না। কুণ্ডুবাড়ির সব জায়গায় আবদুল কাদেরের নেতৃত্বে রিলিফের মাল দিতে দিতে কেরামতের মাথায় পদ্য ফোঁটার বদলে ফুটে ওঠে কুলসুমের মুখ। মুখটা গাঁথা হয়ে যায় বিহারি মেয়েটির ধড়ের ওপর। মাঝখান থেকে কুলসুমের বুকের একটা স্তন খসে পড়ে খাড়ার আঘাতে।

রিকুইজিশন করা যতীন রায়ের বাড়িতে রিফিউজি-ক্যাম্পের জন্যে বড়ো দুই টিন পাউডার দুধ নিয়ে একটি কাদেরের বাড়িতে রেখে এবং আরেকটি রিকশায় চাপিয়ে বাদুড়তলা যাবার সময় কুলসুমের কাটা স্তন কেরামতের চোখে ঝাপসা হতে থাকে। তাই রেলগেটের সামনে এসে নিজের নামটা শুনতে তার অনেকটা সময় লাগে। হঠাৎ চমকে উঠে ডানদিকে তাকিয়ে দেখে, রেল লাইনের ধারে চশমার ডালা থেকে ছোটো আয়না ধরে চোখের চশমা পছন্দ করছে কালাম মাঝি। তার সঙ্গেও রিফিউজিদের জন্যে রিলিফের পাাকেট। কালাম মাঝি তার রিকশায় উঠে বসলে তার চশমাপরা মুখ জীবনে। এই প্রথম দেখে কেরামত তাকে মিনিট তিনেকের মধ্যে দ্বিতীয়বার স্লামালেকুম বলে তাজিম করে। যতোটা সম্ভব বিনয় করে সে জিগ্যেস করে, সোমাচার ভালো?

আর ভালো! ভালো না থাকার কারণ সে বয়ান করে একে একে–। মাঝিপাড়ার কয়েকটা চোরাডাকাতকে পুলিসে ধরে নিয়ে গেছে বলে ইসমাইল অকারণে তার ওপর খাপ্পা হয়ে রয়েছে। আরে নিজের রক্ত পানি করা পয়সায় যে বিল ইজারা নিয়েছে, সে কি চোরডাকাতদের মাছ ধরার জুত করে দিতে? ইসমাইল এই রাগে তকে রিলিফের মাল পর্যন্ত দিলো না। তা তাতে তার বয়েই গেলো! বলতে গেলে এই কারণেই তার দাম। বেড়েছে ডাক্তার শামসুদ্দিন খোন্দকার আর সাদেক উকিলের মতো জাঁদরেল নেতাদের কাছে। ডাক্তার তাকে দুধের টিন দিতে না পারলেও বেশ কিছু শাড়ি আর লুঙি জোগাড় করে দিয়েছে। তবে কি-না ইসমাইল হোসেন একজন এম এল এ এবং গিরিরডাঙা নিজগিরিরডাঙা গোলাবাড়ি এলাকায় এখনো তার পজিশন ভালো। শরাফত মণ্ডলের বেটা কাদের ইসমাইলের কান ভারি করে রেখেছে। মাঝিপাড়াটাও হাত করার তালে আছে মদের। কালাম অনুমান করে, তমিজকে লুকিয়ে রেখেছে এই শালা কাদেরই। কালাম মিনতি করে, কেরামত কি ইসমাইল হোসেনকে তার হয়ে একটু বুঝিয়ে বলতে পারে না?

কিন্তু কুলসুমের একটি কাটা স্তন ও তার গায়ে ফর্সা ছাপ দেখে কেরামত বড়ো বিচলিত, শোলোকের কুঁড়িটা তার মাথায় ফোটে না। অন্যমনস্কভাবে সে জিগ্যেস করে, গোলাবাড়ির দিকে তো রিফিউজি যায় নাই, না? এবং তমিজ এখনো ধরা পড়ে নাই?

প্রশ্ন দুটির মধ্যে সামঞ্জস্য না থাকলেও কালাম মাঝি জবাব দেয় দুটোরই, এখাননা যায় নাই, তবে যাতে কতক্ষণ? এবং শালা খুনের আসামী হয়া পলায়া বেড়ায়।

কুলসুম একা একা নিরাপদে থাকে কী করে? কালাম মাঝির দারোগা বেটা কি তার ফোর্স নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে না তার ওপর? পুলিস কি তার স্তনে ছুরি বসিয়ে দিলো? তার কাটা স্তনের দুধ ও রক্ত লেগেই কি কুলসুমের কালো মুখ গোলাপি হয়ে গেলো? কালাম মাঝিকে তো আর এসব প্রশ্ন করা সম্ভব নয়। কথাগুলো কেরামতের স্তনবিহীন বুকেই পড়ে থাকে এলোমেলোভাবে। কালাম মাঝি নিজে থেকেই বলে, বেটা তার চোরডাকাত জেলখাটা কয়েদি হলে কী হয়, তমিজের বাপ তো আছিলো ফেরেশতার লাকান মানুষ। হামরা একই বংশের মানুষ। তার বৌয়েক দেখাশোনা করা লাগে হামাকই। হামার ঘরত তাক থাকবার দিছি, দেখাশোনা করা লাগবি না?

কুলসুমের এই দুর্দিনে তার দেখাশোনার ভার নিয়েছে, আহা মানুষটা খুব সওয়াবের কাম করছে গো। কেরামত গদগদ চোখে তাকায় কালামের নতুন চশমা-পরা চোখের দিকে। আবার কুলসুমের দেখাশোনার সুযোগ কালাম মাঝির ভাগ্যেই জুটে যাওয়ায় তার বুকটা একটুখানি চিনচিন করে ওঠে। তার হিংসাটুকু হেঁকে পড়লে তার ভক্তিজৰ্জর দৃষ্টির প্রতিদান দেয় কলাম মাঝি তার কাব্যচর্চায় আগ্রহ দেখিয়ে, কেরামত আলি, তোমার দেখাই পাই না। এখন আর গান বান্দো-না?

টাইম পাই না কালাম ভাই। ব্যস্ত থাকার গৌরবে কেরামতের বিষণ্ণতা, উদ্বেগ ও . চিনচিনে হিংসা কেটে যায়, কিংবা এইসব কাটাতেই সে ব্যস্ত হওয়ার উপায় খোজে, হামার টাইম কোটে? ইসমাইল সাহেব কয়, কেরামতের হাতে রিলিফেরমাল দিলে নষ্ট হবি না। আবার সালেক উকিল ওইদিন কলো, কবি, এখন তোমাগোরে গান লেখার টাইম। পাকিস্তান হলো, এখনো যদি হিন্দু কবিদের কবিতাই পড়া লাগে তো ইসলামি : স্টেট করার ফায়দাটা কী? ঢাকাত যাও, ইসলামি জোশের গান লিখ্যা মানুষের মন পরিষ্কার করো। হামার ঢাকাত যাবার ফুরসৎ কৈ? কিন্তু নতুন শোলোকের কুঁড়িটা ফোঁটাবার ফুরসৎ তো তাকে করে নিতেই হবে। আপন মনে সে বলে, অনেকদিন বাদে গান একটা বান্দিচ্ছি। রিফিউজি লিয়া গান।।

চলো হামাগোরে ওটি চলো। একটা মজলিশ না হয করি। কালাম মাঝির প্রস্তাবে খুশি হলেও নিজের একটু দাম বাড়ায় কেরামত, মাঝিপাড়াত গান শোনার মানুষ কোটে?

মাঝিপাড়াত গান করবা কিসক? ওটি মানুষ কৈ মাঝিপাড়ার মানুষের কাব্যবোধে কালাম মাঝির আস্থা নাই, গান করবা তুমি গোলাবাড়ি হাটেত। মুকুন্দ সাহার দোকান তো আমি লিচ্ছি, সাহাক বায়না দিয়া রাখিছি। ঐ দোকানের সামনে মেলা জায়গা।

নিজের বাঁধা শোলোক অনেক অনেক মানুষের সামনে গাইবার জন্যে কেরামত কাঙাল হয়ে ওঠে, নিজের দাম বাড়াবার ইচ্ছা জলাঞ্জলি দিয়ে সে বলে ওঠে, আজই যাবেন? চলেন। রিলিফের এই টিনটা যতীনবাবুর বাড়িত দিয়াই আমি আসিচ্ছি। এক ঘড়িও লাগবি না।

দুধ তো গোলাবাড়িতও দরকার। ওটা না হয় লিয়াই চলো।

দুধের বড়ো টিন হাত করে কেরামতকে সঙ্গে নেওয়ার ইচ্ছা কালাম মাঝির আরো তীব্র হয়। মাঝিপাড়ায় সে বড়ো একা পড়ে গেছে। নিজের পরিবার পর্যন্ত মুখ গোমড়া করে থাকে তার সামনে। বৌয়ের চাচাতো বোনের ভাসুর আর খালাতো বোনের ছেলে বিলের ঘটনায় হাজত খাটছে। গোটা মাঝিপাড়ায় একটু আরাম পাওয়া যায় বরং কুলসুমের ঘরে গেলে। বিলডাকাতির কোনে কথাই সে তোলে না। মাঝিবংশের মেয়ে তো নয়, হাজার হলেও চেরাগ আলি ফকিরের নাতনি। তমিজের বাপ নাকি প্রায়ই তার কাছে আসে। এসব কথায় কালাম তেমন আমল দেয় না। কিন্তু কয়েকদিন হলো তার কথা সে খুব মনোযোগ দিয়ে শোনে। তমিজের বাপের কথা বলতে বলতে কুলসুমের লম্বাটে মুখ কেমন জ্বলজ্বল করে। দূর সম্পর্কের এই চাচিকে কালাম মাঝি দেখে আসছে কতোদিন থেকে, তার বাঁশঝাড়ের ভেতরেই তো সে বড়ো হলো দাদার সাথে। তারপর মেয়েটির বিয়েও হলো তারই সম্পর্কের চাচার সঙ্গে। কিন্তু এই মুখে এরকম আলো তো কালাম আগে কখনো খেয়াল করে নি।

আরার ওই আলো দেখে তার কেমন ভয় ভয় করে, একলা ঐ ঘরে ঢুকে কখন কী করে ফেলে সে নিজেই বুঝতে পারে না। মাঝিপাড়ার মানুষের কাছে দিনদিন সে ছোটো হয়ে যাচ্ছে, কালাম মাঝির নিজের ওপর নিজের দখল যেন কমে যাচ্ছে। কেরামত আলিকে আজকাল সে আর কাছছাড়া করতে চায় না। তার বাড়িতে নতুন ওঠানো চারচালা খানকা ঘরে তার থাকার ব্যবস্থাও সে করে দিয়েছে। বাঁশঝাড়ের পেছনে চেরাগ। আলির জন্যে যে ছাপরাটা ভোলা হয়েছিলো, ঐ ভিটাটা এখনো খালিই রয়ে গেছে। কেরামতের জন্যে ওখানে একটা ঘর তুলে দেওয়া এমন কোনো ব্যাপারে নয়। কিন্তু এই কবি শালা মানুষটা বড়ো ছটফটে, কখন কেটে পড়বে, হয়তো কাদেরের এক ডাকেই কুত্তার মতো চলে যাবে কালামকে কিছু না বলেই। তবে থাক, খানকা ঘরেই থাক। যতদিন থাকে, ততোদিনই লাভ। কালাম মাঝি এখন তার সঙ্গে, গপ্পো করতে পারে, তাকে নিয়ে হাটে যায়, বাজারে যোরে। আবার লোকজনের সামনে তার ওপর একটু তম্বিও করতে পারে।

কুলসুমের জন্যে কেরামতের টানটা কালামের কিন্তু ভালৈই লাগে। কুলসুমের সঙ্গে একা একা কথা বলতে তার যতোই ভালো লাগুক, ভয়ও করে। কেরামতটা থাকলে নিরাপদ।

কালাম মাঝির বাড়িতে সকালে পান্তা বা কড়কড়া ভাত, দুই সন্ধ্যা মাছ দিয়ে গরম ভাত খেয়ে এবং সময় অসময়ে কালাম মাঝির সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে কেরামতের সময় কাটে, কিন্তু মাথার পদ্যটা তার ফোটে না। কুলসুমের দেখা পেলে এ্যাদ্দিনে গান বাঁধা হয়ে যেতো। পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে কালাম মাঝি হুট করে তুমি একটু আগাও, হামি আসি বলে কুলসুমের ঘরে ঢোকে, কেরামত ধীর পায়ে চলে কালামের খানকা ঘরে। আবার কেরামতের সঙ্গে কালাম কুলসুমের গপ্পোও করে। বলে, কেরামত কি সারাটা জীবন এমনি বাউণ্ডেলে হয়েই থাকবে? বিয়ে শাদি করবে না? কুলসুমটাও এই বয়সে ব্লাড়ি হয়ে থাকবে আর কতোদিন? কালাম মাঝি সরাসরি না বললেও ইঙ্গিতটা কেরামত ঠিকই বোঝে। কিন্তু কালাম তাকে কুলসুমের ঘরে ঢুকতে দেয় না কেন?

এক মেঘলা ভোরে বাঁশঝাড়ে চেরাগ আলির শূন্য ভিটার দিকে মুখ করে পায়খানা করতে বসে কেরামত হঠাৎ খুব উতলা হয়ে ওঠে। কালাম মাঝি এখনো বাড়ির ভেতরে, তার বেরুতে দেরি আছে। কেরামত ডোবার পানিতে ভালো করে হাত ধুয়ে চলে যায় তমিজের বাপের ঘরে।

ঘরের চৌকাঠে বসে সে কুলসুমকে নিবেদন করে, তুমি তো তোমার দাদার শোলোক শাস্তর সবই জানো। হামাক কলে হামি না হয় লিখ্যা লিবার পারি।

বইতো তোমাক দিলাম। তুমি বলে বেচ্যা দিছো কার কাছে? দাদা অ্যাসা বই উটকায়, পায় না। সেই বই ফেরত পাওয়ার কোনে সম্ভাবনাই কেরামতের নাই। কুলসুম  ববাঝে না কেন, কেরামত নিজেই কতো কতো শোলোক বাঁধতে পারে, খোয়াবনামার তুলনায় সেগুলো কম কোনোদিকে? রীতিমতো ছাপা বই, লোকে পয়সা দিয়ে কেনে, পাইকাররা বাড়ি বয়ে এসে নিয়ে যায়।

এখন তার লেখা আসছে না। ওই ছেড়াখোড়া বইটাই যতো অনিষ্টের মূল। একবার হাতে পেয়ে সেখানে কী যে সে পেলো, তার ওপর কী যে আসর করলো, এখন বইটা হাতছাড়া হতেই কলম তার একেবারে শুকিয়ে গেলো। কুলসুম যদি একটু পাশে থাকে, ফকিরের গানগুলো যদি একটু শোনায় তো কেরামত ফের আগের মতো গান বাঁধতে পারে। মরিয়া হয়ে সে বলেই ফেলে, তোমাকে দেখলে হামার গান বান্দা হয়। হাজার হলেও তুমি ফকিরের লাতিন। একটা গান বান্দিচ্ছি, এখনো শেষ করবার পারি নাই। শুনবা?

কাগজ নাই, কলম নাই, তবু তার পদ্যের বীজ মাথা ফেটে বেরোয় এই রকম আওয়াজে :

বাস্তভিটা হইতে বিতাড়িত মোহাজের।
পাকিস্তানেতে তারা হইয়াছে হাজের।।

কুলসুমের দিকে চোখ রেখেই সে পদ্য বলছিলো, কিন্তু তার চোখ দরজার বাইরে। চোখে তার তেজের বদলে একটুখানি হাসির কুচি। কেরামতের শোলোক তার কানে ঢুকেছে বলে মনে হয় না। দরজার বাইরে কুলসুম কাকে দেখে? কেরামত বাইরে চোখ মেললে কাউকেই তো দেখতে পায় না। কেরামতের দিকে তাকিয়ে কুলসুম হঠাৎ বলে, দুয়ার ছাড়ো, আসবার দাও।

কৈ, কেউ তো নাই। অথচ কুলসুম কার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলে, তোমার বেটার বৌ তো পোয়াতি হছে গো। উনিক গেছিলাম।

সত্যি সত্যি কে যেন ঘরে ঢোকে, কেরামতের গা তার গতির বাতাসে কাঁপলে সে একটু সরে বসে। কিন্তু মানুষটাকে দেখা যায় না কেন? কুলসুম তার সঙ্গে কথা বলেই চলে, ঘেগি হলে কী হয়, বৌটা মানুষ ভালো। আমাকে বোয়াল মাছের সালুন দিয়া ভাত খিলালো। ওপরে এ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি থেকে একটা কথা বার করে কুলসুম সামনে এগিয়ে ধরে, বৌ হামাক খ্যাতাখান দিলো। একটা কোণ অল্প একটু ছিড়া গেছে, তাও দুইটা শীত পাড়ি দেওয়া যাবি, লয়? এগিয়ে দেওয়া কাথার একটা কোণ শূন্যে একটু ওপরে উঠলো, কেউ হাত দিয়ে ধরে ছেড়ে দিলো। কুলসুম বলে, বৌয়ের বোন খ্যাতা সেলাই করিছে। কী সোন্দর খ্যাতা গো, লকসা দেখিছো? অদৃশ্য লোকটি দেখে, কেরামতও দেখে, সারা কাঁথা জুড়ে লাল নীল ও হলুদ সুতায় বরফি আঁকা, মাঝে মাঝে চাঁদ তারার ছবি। একেকটা চাঁদ পিছু তিনটে তারা।

কিন্তু তমিজের বাপের হাজিরা অনুমান করে, ঠিক করে বললে বলতে হয়, টের পেয়ে কেরামত শুকনা টোক গেলে। সবটা ঘরে বিলের কাদাপানির গন্ধ, পানির আঁশটে গন্ধ।

 

কেরামত আর কথা না বলে প্রায় দৌড়ে বেরিয়ে আসছে, দেখা হয়ে যায় কালাম মাঝির সঙ্গে। কালাম হঠাৎ এতো গম্ভীর হয়ে গেলো কেন? তমিজের বাপের ঘরে গিয়েছিলো শুনে স্থির চোখে সে তাকায় কেরামতের দিকে।

তবে বিকালবেলাতেই কালাম তাকে জানায়, কাল বুধবার না? হাটবার। কালই। তোমার গান হবি।

কালই? গান তো পুরা বান্দা হয় নাই। শুক্কুরবার দিন হাটবার আছে না?

বালের গান বান্দো! আজ রাতের মধ্যেই গান বান্দা রাখবা।

 

মুকুন্দ সাহার দোকানের বারান্দায় তক্তপোেষ পাতা হলো। তক্তপোষ ঘর থেকে বার করে দিলো বৈকুণ্ঠ নিজেই। আড়তে ঢুকে কালাম চোখ দিয়ে জরিপ করে বলে, ক্যা রে, মরিচের বস্তা না উদিনকা দেখলাম আটটা। আজ ছয়টা কিসক? জিরার বস্তা খালি একটাই আছে? সব বেচ্যা দিছু?

কালামের কথায় নয়, মুকুন্দ সাহাকে হিসাব দিতে হবে বলে বৈকুণ্ঠ মুখ কাঁচুমাচু করে। বাবুর আসতে দেরি হচ্ছে দেখে ও যে দাম পায় তাতেই মাল ছেড়ে দিচ্ছে। খরচাও করছে দেদার। সকালে চিড়া খায় আধসের রসগোল্লা দিয়ে, দুইবেলা ভাত খাচ্ছে বড়ো মাছ রান্না করে। তা ছাড়া সারাদিন তার মুখ চলছেই। হাটে কি আর খাবারের অভাব থাকে সেদিন গোসাইবাড়ির মেলায় গিয়েছিলো, নটিপাড়ায় পয়সা ঢেলে এসেছে খুশিমতো।

কিন্তু কালাম তাকে শাসায় অন্য কারণে, সাহা বায়না লিছে, দোকান হামাক দিবি মালশুদ্ধা। তুই বামাক মাল বেচলে লোকসান কার?

বৈকুণ্ঠ অবশ্য খুব একটা কানে নেয় না, সে মহা ব্যস্ত কেরামতের জন্যে মঞ্চ সাজাতে। দুটো হ্যারিকেন জ্বালিয়ে ঝুলিয়ে দিলো বারান্দার টিনের ছাদের সিলিঙে। নিজের দোকান থেকে কালাম একটা হাতলওয়ালা চেয়ার নিয়ে আসে বুধাকে দিয়ে। বৈকুণ্ঠ আরেকটা চেয়ার নিয়ে এলে কালাম মাঝি বলে, একটাই হবি। কবি বস্যা থ্যাকা গান করবি নাকি? চেয়ারে বসে ঘাড় ঘুরিয়ে কালাম হুকুম করে, উগলান পরিস্কার কর। বৈকুণ্ঠ বুঝতে না পারলে সে দেখিয়ে দেয় দরজায় ঝোলানো লক্ষীপূজার সোলার সরা আর দড়িতে বাঁধা আমপাতার দিকে। বৈকুণ্ঠ বলে, উগলান তো লক্ষীপূজার।

যা কই শোন। বুধা দূরজা সাফ কর। মামার হুকুমে বুধা দরজার সোলার সরা আর আমপাতা সরাতে গেলে হাঁ হাঁ করে ওঠে বৈকুণ্ঠ আরে করো কী? করো কী?

না, ধরেন, পূজার জিনিস, যি সি মানুষ ধরা হয় না।

হামরা হাত দিলে দরজা লষ্ট হয়? শালা হামারই ঘরের দরজা, হামার ভাইগ্না হাত দিবার পারবি না?

না, তা কই নাই। ধরেন পূজা বলে কথা। বেজাতের মানুষ হাত দিলে– বলতে বলতে বৈকুণ্ঠ নিজেই ওসব সরিয়ে ফেলে। তখন কালাম মাঝি ফের হাঁক ছাড়ে, ক্যা রে বুধা, আগরবাতি কুটি?

ছোটো দুটো চালের মালসায় আগরবাতি গুজে বুধা মালসা দুটো রাখে মঞ্চের সামনে। কালাম মাঝি দাঁড়িয়ে হাঁক দেয়, নারায়ে তকবির। তেমন জোরে সাড়া না পেয়ে সে ধমক দেয়, আল্লার নাম মুখোত লিতে আটকায়? জোরে কন। এরপর সে কয়েকবার নারায়ে তকবির ও পাকিস্তান বলে চিৎকার করলে সন্তোষজনক জবাব পায়। বেরাদারানে ইসলাম সম্বোধন করে কালাম মাঝি শুরু করে তার বক্তৃতা। মাসখানেক আগের একটা দৈনিক আজাদ তার চশমা-পরা চোখের সামনে ধরে সে শুরু করে ইনডিয়ার মোসলমানদের ওপর হিন্দুদের জুলুম ও নির্বিচার হত্যাকাণ্ডের বিবরণ। মনে মনে বানান করে ফের চেঁচিয়ে পড়তে তার কষ্ট হয় বলে কাগজটা হাতে রেখে নিজেই পেশ করে ভারতীয় মোসলমান নিধনের ভয়াবহ কাহিনী। বক্তৃতা দেওয়ার অভ্যাস তার নাই; টাউনে রিফিউজি ক্যাম্পে ঘুরে ও এর ওর কাছে শুনে যেটুকু সে জানে তাই বলে যায় অগোছালো ভঙ্গিতে। ভাষা তার তেজোদীপ্ত না হলেও মোসলমান মেয়েদের স্তন কাটা, পাইকারি হারে তাদের ধর্ষণ, নির্বিচার হত্যাকাণ্ড, ভিটা থেকে তাদের উচ্ছেদ প্রভৃতি বিবরণে শ্রোতারা উৎসাহিত, এমন কি উত্তেজিত হতে থাকে। তারা বারবার ফিরে তাকায় পালপাড়ার শ্রোতাদের দিকে। আর এইসব শ্রোতাদের মাথা নিচু হতে হতে প্রায় মাটি স্পর্শ করে। কালাম মাঝি এবার ইশারা করে কেরামতকে, তোমার গান শুরু করো।

কালাম মাঝির বেপরোয়া বর্ণনায় কেরামত একটু উসখুস করছিলো। এরপর তার নতুন গান কি আর জমবে? সে তাই স্মৃতি থেকে শুরু করে, যাহার হাতে নাঙল, ফলায় ফসল অন্ন নাই তার পাতে।

কালাম মাঝি ধমকে বলে, ইগলান প্যাচাল বাদ দেও। মোহাজের লিয়া গান ধরো।

বৈকুণ্ঠ গা ঝাড়া দিয়ে উঠেছে, বারান্দার নিচে থেকেই জিগ্যেস করে, তুন গান বান্দিছো?

এ কালাম মাঝির হুকুমে এক রাতেই নতুন গান লিখলেও এটা নিয়ে কেরামত খুঁতখুঁত করছিলো। এখন কী আর করা যায়? পকেট থেকে রুল টানা কাগজ বার করে সে পড়তে শুরু করে,

শোনো শোনো শোনো রে ভাই হিন্দু মোসলমান।
মোহাজেরের দুষ্কু কিছু করিব বয়ান।।
বাস্তুভিটা হইতে বিতাড়িত মোহাজের।
পাকিস্তানেতে তারা হইয়াছে হাজের।।
তাদের ঘর ছিলো বাড়ি ছিলো ছিলো পুষ্করিনী।
খোদার ফজলে তারা ছিলো নাকো ঋণী।।
আল্লা ও রসুলে তারা রেখেছে ইমান।
ইমান রাখিতে গিয়া দিলো শত জানা।।

তাকে থামিয়ে দিতে, কিংবা তার গানে অনুপ্রাণিত হয়েও হতে পারে, কালাম জিভে এচ এচ করে,বলে, মোসলমান জান দিয়া লিজের ইমান ঠিক রাখে! কতো মানুষ যে মরিচ্ছে। কোনো বাজনা ছাড়া পয়ারের একঘেয়ে ছন্দে বৈকুণ্ঠ মাথা দোলায়, কোথাও তাল কেটে গেলে মাথা নাড়া টললেও গানে মনোযোগ তার একটুও চিড় খায় না। কেরামত ফের গান ধরে,

কাফের হস্তে মায়েবোনে হারালো ইর্জত।
সব্বোশ্রান্ত হইয়া হেথায় করিলো হিজরত।।
হেথা হইতে যায় চলিয়া হিন্দু ভাইগণে।
মাতৃভূমি ত্যাগে বড়ো দাগা পায় গো মনে।।
স্বর্গদর্পে গড়িমসি এহি জম্মভূমি।
পিতাপিতামহ রহে এহি মাটি চুমি।।
তাহাদের মনোকষ্টে আল্লা হয় নারাজ।

কেরামত কোনো ভুল কথা বললো কি-না না জেনেও নিজের কথা বলার বেগ প্রবল হয়ে ওঠায় কালাম মাঝি তাকে থামিয়ে দেয়, রাখো। তারপর সে তার বক্তৃতার উপসংহার টানে, ভাইসব, পাকিস্তান শুধু মোসলমানের নয়, হিন্দুরও দেশ। হিন্দু ভাইগণ যদি এই দেশকে আপন মনে না করে, এদেশের মালসম্পত্তি সামান যদি ঐপারে পাঠায় তবে পাকিস্তানের বুকে ছুরি মারা হয়। হয় কি-না বলেন? হিন্দু হোক আর মোসলমান হোক, দেশের সয়সম্পত্তি নষ্ট করলে পাকিস্তানের পাক জমিনে তার জায়গা নাই।

কিন্তু শ্রোতারা তার কথায় তেমন কান না দিয়ে উঠে যেতে শুরু করলে এবং বিশেষ করে মাঝিপাড়ার লোকজন পানি আসবি গো, বাড়িত চলো। বলে ডাকাডাকি শুরু করলে কালামকে থামতে হয়। বৈকুণ্ঠ শুধু কেরামতের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলে, শ্যাষ করবা না?

কালাম মাঝি তাকে মুখ ঝামটা দেয়, মোসলমান তোর ঘরত হাত দিলে ঘর নষ্ট হয়, মোসলমানের শোলোক শুনলে কান দুইখান তোর পচ্যা যাবি না?

বৈকুণ্ঠ কৈফিয়ত দেয়, না, না কি যে কন! লক্ষ্মীপূজার সরা তো? বেজাতের মানুষ হাত দিলে–।

মোসলমানে বেজাত হলো? মালাউনের বাচ্চা তুই কোস কি রে? কালাম মাঝি রাগে কাঁপে, ভাত খাস তুই পাকিস্তানের আর মোসলমানক তুই গাল পাড়িস জাত তুল্যা?

পালপাড়ার বিষ্ণু পাল তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে প্রচণ্ড ধমক ছাড়ে, বৈকুণ্ঠ, হুঁশিয়ার হয়া কথা কোস। না হলে তোর দাঁতের পাটি দুইটাই একো চড়ে ফালায়া দিমু কলাম। তার হয়ে সে মাফ চায় কালাম মাঝির কাছে, এটা একটা পাগলা চোদা, অর কথা হামরা কি ধরি?

তোমরা ধরবা কিস? তোমার তো জাত তুল্যা কথা কয় না। বিটু পালকে প্রত্যাখ্যান করে দিয়ে কালাম মাঝি চোখ পাকায় বৈকুণ্ঠের দিকে, শালা মালাউনের বাচ্চা, হামার ঘরত থাকিস, আর হামারই জাত লিয়া মুখ খারাপ করিস? ওঠ, শালা, আজই তোক এই ঘরছাড়া করমু। ঐ দরজাত হামি কলমা লেখ্যা টাঙায়া দিমু। দেখি শালা তোর লক্ষ্মী হামার কি বাল ঘেঁড়ে।

কেষ্ট পালের ভাই বিষ্ণু এবার পিছু হটে। আর কারো বিরোধিতা কিংবা সমর্থন না পেয়ে কালাম মাঝি ধরে এবার তার ভাগ্নেকে, ক্যা রে বুধা, ভাত খাস না? শালা মালাউন জাত তুল্যা কথা কয় আর তুই চুপ করা খাড়া হয়া মজা দেখিস! ওই শালাক কান ধরা বার কর‍্যা দে এই ঘর থ্যাকা।

বৈকুণ্ঠ এবার ভয় পায়, বাবু তো খবর পাঠাছে, আর কয়টা দিন বাদে আসিচ্ছে।

তোর বাবুর গোয়া মারি। তোর জাতের গোয়া মারি হামি। গতকাল সাহার ফিরে আসার খবর পাবার পর থেকে কালাম তার সঙ্গে সমকামে লিপ্ত হওয়ার সংকল্প ঘোষণা করে আসছে। কিন্তু এতোগুলো মোসলমান কেউ তার হয়ে কিছু বলছে না দেখে সে। আরো ক্রদ্ধ হয়ে উঠলে সামনে এগিয়ে আসে গফুর কলু।

অতো গরম কিসের গো? মাঝির বেটার অতো গরম কিসের? কাদের ভাই কয়া গেছে, মুকুন্দ সাহার দোকানে কিছু হলে, কি তার মানষের উপরে জুলুম হলে ফল ভালো হবি না। হুঁশিয়ার হয়া কথা কবা। বুঝিছো তো? বলতে বলতে গফুর কলু কালামের একেবারে কাছাকাছি চলে এলে কালাম সরে দাঁড়ায়, শালা কলুর বেটা তফাত থাক, তফাত থাক। কলুর স্পর্শ থেকে দূরে থাকতে সে নিজেই আরো পিছে হটে। শালা মাঝির বেটিক লিকা করা মনে করিস, জাভোত উঠিছু, না? অতো সোজা লয়। শালা বুধবার দুপুর বেলা কলুর মুখ দেখিছি, তখুনি বুঝিছি, শনির লজর লাগলো।

বুধবার শনির নজর লাগায় কালাম মাঝি হন হন করে রওয়ানা হয় বাড়ির দিকে। তার পাশাপাশি দূরের কথা, ঠিক পেছনে পেছনে হাঁটতেও বুধাকে দৌড়াতে হয় সারাটা পথ। তবে মামুর কথাগুলো সে শুনতে পায় সবই, মণ্ডল তো সাহার বাড়ি দখল করিছে, এখন দোকানখানও লেওয়ার তালে আছে। হামিও দেখমু।

পরদিন সকালে কেরামতের সঙ্গে কালাম মাঝি নিজের দুঃখবেদনার কথা বলে। মাঝিদের উন্নতি হবে কী করে? এই যে শালা গফুর কলু, কিছুদিন আগেও মাঝিপাড়ার মানুষ ঘেন্না করে তার ছায়া মাড়াতো না। আর কাল সেই কলুর বাচ্চা তাকে বেইজ্জত করলো, মাঝিরা নাকি উত্তরপাড়ায় তাই নিয়ে খুব হাসাহাসি করেছে। মাঝিরাই যদি মাঝির দুষমনি করে তো এই জাতের ওঠার কোনো পথ আছে? মাঝির খাঁটি মুরুব্বি। ছিলো এক তমিজের বাপ। নিজের জাতের জন্যে মানুষটা মণ্ডলের হাতে খড়মের বাড়ি খেয়েছে। তার ছেলেটা পর্যন্ত মাঝির সঙ্গে, নিজের বাপের সঙ্গে বেইমানি করলো। কুলসুমের ঘরে তমিজের বাপের রুহ নাকি রোজই একবার না একবার আসে, কথা কয়, কথা শোনেও। কুলসুমের কাছে বসে নিজের দুঃখবেদনার কথা বলার জন্যে কালাম মাঝির প্রাণটা আইঢাই করে।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *