নীলগঞ্জ হাইস্কুলের ড্রিল স্যারের নাম ইয়াকুব আলি। বয়স পঞ্চাশের উপর। বেঁটে-খাটো মানুষ। সাধারণত ড্রিল স্যারদের স্বাস্থ্য খুব ভালো হয়ে থাকে। ইয়াকুব আলি সাহেব ব্যতিক্রম। ভয়ংকর রোগা। বছরের বেশিরভাগ সময় পেটের অসুখে ভুগেন। যে ঋতুতে সে অসুখটা হওয়ার কথা তাঁর তা হয়। বসন্তকালে চিকেন পক্স কিংবা হাম হয়, বর্ষাকালে ভয়াবহ ধরনের ডায়রিয়া হয়। সারা শীতকাল খকখক করে কাশেন, এই সময় তার হাঁপানির টান ওঠে।
ভদ্রলোক নিতান্তই ভালমানুষ।
জগতের সমস্ত ভালোমানুষরা সরল ধরনের হয়ে থাকেন। ইয়াকুব সাহেব একটু বেশিমাত্রায় সরল। তার মাথায় স্বাস্থ্যরক্ষা অর্থাৎ ব্যায়াম ছাড়া কিছুই ঢুকে না। তিনি দুটি বই লিখেছেন–হাসতে হাসতে ব্যায়াম শিক্ষা এবং ছোটদের সহজ ব্যায়াম। টাকার অভাবে বই দুটি ছাপাতে পারছেন না।
তার বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল এঁদের কোনো ছবি নেই। তিনটি বাঁধানো ছবি আছে–একটি গামা পালোয়ানের, একটি শ্যামাকান্তের, অন্যটি ভীম ভবানীর। এ ছাড়াও তার শোবার ঘরে একটা সূচিকর্ম আছে। চারদিকে লতা, ফুল, পাতা, মাঝখানে লেখা, স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। সূচিকর্ম তার স্ত্রীর করা। বিয়ের দ্বিতীয় বছরে ভদ্রমহিলা মারা যান। ইয়াকুব সাহেব দ্বিতীয়বার আর বিয়ে করেন নি।
ড্রিল ক্লাসে তিনি ছাত্রদের ব্যায়াম করান কবিতায়। এইসব কবিতা তাঁর নিজের লেখা। গানের মতো সুরে তিন মাত্রায় পড়তে হয়, সেই সঙ্গে ব্যায়াম করতে হয়। একেক ক্লাসের জন্য একেক ধরনের কবিতা। প্রাইমারি সেকশনের জন্য লেখা তার ব্যায়াম কবিতাটা এই রকম,
বায়ু বহে ভীম বেগে শব্দ শন শন।
এইবার দাও দেখি পাঁচ বুক ডন।।
[এইখানে ছাত্ররা পাঁচটা বুক ডন দেবে। বুক ডন শেষ করে উঠে দাঁড়িয়ে বলবে–]
দেখো দেখো উড়ে যায় সাদা সাদা বক
এইবার দাও দেখি দশ বৈঠক।।
[দশটা বৈঠক দিতে হবে। অতি দ্রুত।]
পাল তুলে চেয়ে দেখ চলে ছোট নাও।
কোমরে হাত রেখে সোজা দৌড়াও।।
[দৌড়ে স্কুলের মাঠে দুটা চক্কর দিতে হবে।]
ইয়াকুব আলি সাহেব নিতান্তই দরিদ্র ব্যক্তি। ড্রিল টিচার হিসেবে স্কুল থেকে সামান্যই বেতন পান। একা মানুষ বলে কষ্টেসৃষ্টে কোনোরকমে চলে যায়। শারীরিক কষ্ট। তার গায়ে লাগে না। তবে কেউ যখন ব্যায়াম বিষয়ে আজেবাজে কথা বলে তখন তার মনটা খুব খারাপ হয়।
আজ তাঁর মনটা খারাপ। শুধু খারাপ বললে কম বলা হবে, খুবই খারাপ। কারণ নীলগঞ্জ স্কুলের হেড স্যার ব্যায়াম নিয়ে তাকে কিছু কটু কথা বলেছেন। অথচ কটু কথা বলার মতো কিছুই তিনি করেন নি। ব্যাপারটা এরকম–তিনি টিচার্স কমন রুমে বসে লিখছিলেন। হেড স্যার ঘরে ঢুকে বললেন, ইয়াকুব সাহেব কি করছেন?
তিনি উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, লিখছি স্যার।
কি লিখছেন?
স্যার, একটা গ্রন্থ রচনা করছি–ব্যায়ামের অ আ ক খ।।
হেডস্যার সঙ্গে সঙ্গে মুখ এমন করলেন যেন ব্যায়ামের অ আ ক খ লেখা খুব অন্যায়। তিনি খড়খড়ে গলায় বললেন, ক্লাস থ্রিতে একটু যান তো। ওদের অংক স্যার আসেন নি। ছাত্ররা খুব হৈচৈ করছে। গোটা কয়েক ভাগ অংক দিয়ে বসিয়ে দিন। পারবেন তো?
অবশ্যই পারব, স্যার।
ইয়াকুব সাহেব ক্লাসে গেলেন। রোল কল করে বোর্ডের কাছে চলে গেলেন। বোর্ডে বড় বড় করে লিখলেন–অংক। তারপর গম্ভীর গলায় বললেন, অংক জিনিসটা কি বলো তো?
কেউ বলতে পারল না। তিনি বিরক্ত গলায় বললেন, সামান্য জিনিস বলতে পারছিস না? অংক হচ্ছে মাথার ব্যায়াম। তাহলে ব্যায়াম কত রকমের হলোর দুরকম। শরীরের ব্যায়াম এবং মাথার ব্যায়াম। শরীরের ব্যায়ম ক ধরনের হয় তোরা জানিস? তোদের ক্লাসে ফার্স্ট বয় কে উঠে দাঁড়া দেখি?
ফার্স্ট বয় উঠে দাঁড়াল। ইয়াকুব সাহেব হতাশ গলায় বললেন, ও-কি, এমন বাঁকা হয়ে দাঁড়িয়েছিস কেন? সোজা হয়ে দাঁড়া। বুক টান করে দাঁড়া। বুক টান করে দাঁড়ানোও এক ধরনের এক্সারসাইজ।
ভাগ অংক কিছুই করা হলো না। পুরো এক ঘণ্টা চলে গেল। ইয়াকুব স্যার জলের মতো বুঝিয়ে দিলেন বুকটান করে দাঁড়ানোর কি উপকারিতা। এতে ফুসফুসের কি হয়-এই সব।
ক্লাসের শেষে তিনি কমন রুমে এসে বসেছেন, হেডস্যার ডেকে পাঠালেন। থমথমে গলায় বললেন, বারান্দায় দাঁড়িয়ে আপনার পড়ানো শুনছিলাম। এক সময় শুনি আপনি গান গাচ্ছেন। এর মানে কি?
ইয়াকুব সাহেব বিনয়ের সঙ্গে বললেন, গান না স্যার। যোগ ব্যায়াম নিয়ে একটা কবিতা লিখেছিলাম। ছাত্রদের পড়ে শুনালাম। এই কবিতাটা গানের সুরে পড়তে হয়। তাই নিয়ম।
অংকের ক্লাসে আপনি যোগ ব্যায়ামের কবিতা পড়াচ্ছেন, এর মানে কি?
ইয়াকুব সাহেব মাথা চুলকাতে লাগলেন। হেড স্যার কঠিন স্বরে বললেন, আমার তো ধারণা আপনার মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে।
খারাপ হয় নি, স্যার।
আপনি বললে তো হবে না, আমরা দশজন যা দেখছি তাতে আমাদের ধারণা হয়েছে, আপনার মাথা পুরো এলোমলো অবস্থায় আছে। সবাই আপনাকে নিয়ে হাসাহাসি করে এটা জানেন?
জি না।
তা তো জানবেনই না। আপনাকে নিয়ে যে হাসি-তামাশা হয় তা বোঝার মতো বুদ্ধিও তো আপনার নেই। শুনছি ইদানীং না-কি ঘাস খাচ্ছেন। এটা কি সত্যি?
ইয়াকুব সাহেব জবাব দিলেন না। চুপ করে রইলেন। তাঁর নীরবতার কারণ হচ্ছে ঘাস খাওয়ার ব্যাপারটা সত্যি। তার ধারণা হয়েছে ঘাসে প্রচুর ভিটামিন। সেই ভিটামিন কাজে লাগানো যায় কি-না তা পরীক্ষা করে দেখছেন। আধাসের কচি ঘাসে এক তোলা সোডা দিয়ে ঘন্টা খানিক জ্বাল দিয়েছেন। থকথকে সবুজ জেলির মতো একটা বস্তু তৈরি হয়েছে। রোজ বিকেলে চিনি দিয়ে তিনি সেই বস্তু দুচামচ করে খান।
কি, কথা বলছেন না কেন? ঘাস খাচ্ছেন না-কি?
জি স্যার, খাচ্ছি?
খেতে কেমন?
খেতে ভালো না, তবে বলকারক।
হেডস্যার থমথমে গলায় বললেন, লোকে যখন জানবে এই স্কুলের একজন প্রবীণ শিক্ষক রোজ ঘাস খাচ্ছেন তখন স্কুল সম্পর্কে তাদের কি ধারণা হবে বলুন দেখি?
আপনি যদি নিষেধ করেন তাহলে আর খাব না।
na, আমি নিষেধ করব না। আপনার ইচ্ছা হলে ঘাস খাবেন, কাঁঠাল পাতা খাবেন, কচুরিপানা খাবেন। আপনি খাবেন রুচিমত–আমি সেখানে বলার কে? তবে ঢাকঢোল পিটিয়ে খাবেন না। গোপনে খাবেন।
জি আচ্ছা।
শুধু একটা কথা আপনাকে বলি–ব্যায়াম নিয়ে হৈচৈ করবেন না। স্কুল পড়াশোনার জায়গা। কুস্তির আখড়া না। ব্যায়াম প্রসঙ্গে একটি কথাও যেন আর না শুনি।
বই কি লিখতে পারব স্যার?
কি বই?
ছোটদের ব্যায়ামের অ আ ক খ।
আপনি আমার সামনে থেকে যান।
তিনি বিষণ্ণ মুখে বের হয়ে এলেন। তাঁর মনটা ভেঙে গেল। রোজ যথানিয়মে স্কুলে যান। টিচার্স কমন রুমে চুপচাপ বসে থাকেন। বিকেলে বাসায় ফিরে আসেন। তাঁকে কোনো ক্লাস দেয়া হয় না। এমনকি পিটি ক্লাসও না। ব্যায়ামের বইটা লেখার চেষ্টা করেন। লেখা তেমন আগায় না। মন ভার না থাকলে লেখা আসে না।
দেখতে দেখতে ম্যাট্রিক পরীক্ষা এসে গেল। কোচিং ক্লাস শুরু হয়েছে। রোজ তিন ঘণ্টার কোচিং-ইংরেজি, অংক, ইলেকটিভ অংক, বিজ্ঞান। স্কুলের গত বছরের রেজাল্ট খারাপ হয়েছে, এবার যেন খারাপ না হয়।
এই সময় ইয়াকুব সাহেব এক কাণ্ড করলেন। এক সকালে হেড স্যারের ঘরে উঁকি। দিয়ে বললেন, স্যার আসব?
জরুরি কিছু না থাকলে আসবেন না। কাজ করছি।
খুব জরুরি।
আসুন। বলুন কি ব্যাপার?
ইয়াকুব সাহেব হড়বড় করে বললেন–ম্যাট্রিকের ছাত্রদের তো কোচিং হচ্ছে। আমি ভাবছিলাম এই সঙ্গে এক ঘণ্টা ব্যায়ামের কোচিং দিয়ে দিলে খুব ভালো হয়।
হেডস্যার হতভম্ব হয়ে বললেন, ব্যায়ামের কোচিং মানে? কি বলছেন আপনি?
ছাত্রদের এক ঘন্টা করে ব্যায়াম করা। ফ্রি হ্যাঁন্ড এক্সারসাইজ, বৈঠক, বুকডন আর যোগ ব্যায়াম। যোগ ব্যায়ামের মধ্যে থাকবে–প্রাণায়াম এবং কুম্ভক। সব লিখে এনেছি।
ইয়াকুব আলি সাহেব খাতাটা এগিয়ে দিলেন। খাতায় ছক টেনে সবকিছু লেখা। কোন বারে কি ব্যায়াম, কতক্ষণের ব্যায়াম সব সাজানো আছে।
একেবারে সিলেবাস বানিয়ে নিয়ে এসেছেন?
জি স্যার।
কেন এটা করেছেন জানতে পারি?
পরীক্ষার আগে আগে স্বাস্থ্যটা ঠিক রাখা খুবই জরুরি। স্বাস্থ্য ঠিক না থাকলে একটু কঠিন প্রশ্ন দেখলেই মাথা ঘুরে পড়ে যাবে এবং পরীক্ষার আগের রাতে একশ তিন জ্বর এসে যাবে। এতদিনের পরিশ্রম সব গেল।
হেড স্যার হিমশীতল গলায় বললেন, আপনি কি আমার সঙ্গে ফাজলামি করছেন না–কি?
জি না স্যার, ফাজলামি করব কেন?
আমার তো আপনার কথাবার্তা শুনে সে রকমই ধারণা হচ্ছে।
আপনি যদি উত্তেজিত না হয়ে আমার খাতার ছকগুলি একটু পরীক্ষা করে দেখেন, খুব যত্ন নিয়ে করেছি। প্রচুর মেধা ব্যয় করেছি।
শুনুন ইয়াকুব আলি সাহেব, আপনি আর স্কুলে আসবেন না।
কি বললেন স্যার?
আপনি আর স্কুলে আসবেন না। আমার ধারণা আপনার ব্রেইন ডিফেক্ট হয়ে গেছে। আপনার স্কুলে আসা মানে স্কুলের জন্য সমস্যা। আমি স্কুল কমিটিতে বিষয়টি তুলব। তারা যা সিদ্ধান্ত নেয় নেবে।
স্কুলে না এসে আমি করবটা কি স্যার?
বাড়িতে বসে ব্যায়াম-কবিতা লিখবেন এবং ঘাসের চাটনি খাবেন। এখন আমার সামনে থেকে যান। এ কি, খাতা না নিয়ে চলে যাচ্ছেন কেন? খাতা নিয়ে যান।
তিনি বাড়িতে চলে এলেন। মন অসম্ভব খারাপ। বয়স কম হলে চিৎকার করে কাঁদতেন। এই বয়সে চিৎকার করে কাঁদা মানায় না বলে কাঁদতেও পারছেন না। সত্যি সত্যি চাকরি চলে গেলে গভীর সমুদ্রে পড়তে হবে। খাবেন কি?
ঘাসের চাটনি জিনিসটা বলকারক হলে অতি অখাদ্য। কষটা তিতকুটে ভাব আছে। মুখে নিলেই বমি ভাব হয়, নাড়িভুড়ি উল্টে আসে। এই বস্তু খেয়ে জীবনধারণ করা নিতান্তই অসম্ভব। প্রাইভেট টিউশানিও যে করবেন সে উপায় নেই। কে আর ব্যায়ামের জন্যে প্রাইভেট টিউটর রাখবে?
তিনি দুপুরে কিছু খেলেন না। রাতেও কিছু খাবেন না বলে ঠিক করে রেখেছিলেন। শেষমেশ ক্ষিদের যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে খিচুড়ি রাঁধতে বসলেন। ভোলা উনুনে রান্না হচ্ছে। তিনি দরজার দিকে পেছনে ফিরে বসেছেন, হঠাৎ মনে হলো কে যেন দরজার পাশে এসে দাঁড়াল। চিকন গলায় বলল, জনাব আপনার সঙ্গে কি একটা কথা বলব?
ইয়াকুব আলি বললেন, কে?
আমাকে তো জনাব চিনবেন না। যদিও আমি আপনার প্রতিবেশী।
খিচুড়ি ধরে গিয়েছে। চামচ দিয়ে প্রবল বেগে নাড়তে হচ্ছে বলে ইয়াকুব সাহেব দরজার দিকে তাকাতে পারছেন না। খিচুড়ি নাড়তে নাড়তে বললেন, কোন বাড়িতে থাকেন, বলুন। বললেই চিনব। আমি তো জনাব কোনো বাড়িতে থাকি না, আম গাছে থাকি। আপনার বাসার পেছনে যে আমগাছ আছে ঐ আমগাছে থাকি।
আম গাছে থাকেন মানে? আপনি কে?
আমি স্যার একজন ভূত।
ইয়াকুব সাহেবের মনে হলো তিনি কানে ভুল শুনেছেন। ভূত আবার কি? ভূত প্রেত থাকে বাচ্চাদের রূপকথার বই-এ। নিশ্চয়ই কোনো দুষ্ট ছেলে ফাজলামি করছে। তিনি খিচুড়ির হাঁড়ি চুলা থেকে নামিয়ে ঘরের বাইরে এসে দাঁড়ালেন। চারদিকে ফকফক চাঁদের আলো। কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। এটা কি স্বপ্ন স্বপ্ন হওয়া তো সম্ভব না। স্বপ্নে গন্ধ পাওয়া যায় না। তিনি খিচুড়ির গন্ধ পাচ্ছেন। খিচুড়ি ধরে গেছে। সেই ধরা খিচুড়ির পোড়া পোড়া গন্ধ।
ইয়াকুব সাহেব ভূতে বিশ্বাস করেন না, তবু তার গা ছমছম করতে লাগল। এসব কি হচ্ছে? তিনি কাঁপা গলায় বললেন, কে? কে কথা বলছিল?
জি জনাব, আমি। আপনার পাশেই আছি। অদৃশ্য হয়ে আছি তো, এই জন্যে দেখতে পাচ্ছেন না। বড় আশা করে আপনার কাছে এসেছি, জনাব। অধীনকে নিরাশ করবেন না।
বাতাসের সঙ্গে কথা বলার কোনো মানে হয় না। তার যা করা উচিত তা হচ্ছে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে খেতে বসা। তবু তিনি নিজের অজান্তেই বলে ফেললেন, আমার কাছে কি ব্যাপার?
আমার সন্তানটাকে আপনার দরবারে নিয়ে এসেছি জনাব। বড় আশা করে এনেছি।
কি জন্যে এনেছেন?
ওর স্বাস্থ্যটা খুবই খারাপ। যদি দয়া করে তার শরীরটা ঠিক করে দেন। ব্যায়াম ট্যায়াম করান। এই বিষয়ে আপনার চেয়ে ভালো তো কেউ জানে না। আপনি হচ্ছেন বিশেষজ্ঞ অতি ওস্তাদলোক।
ইয়াকুব সাহেব মনে মনে খুশি হলেন। যা ঘটছে তা স্বপ্ন না চোখের ভুল তিনি জানেন না। তবু তো তাকে ব্যায়াম বিষয়ে কিছু ভাল কথা বলছে। এইটাইবা কে বলে?
স্যার, একটু দয়া করুন, মা-হারা সন্তান।
তিনি চমকে উঠলেন। ভূতদেরও মৃত্যু হয়। মানুষ মরে ভূত হয় শুনেছেন, ভূত মরে কি হয়?
ইয়াকুব সাহেব গলা খাকাড়ি দিয়ে বললেন, এই ছেলের মাতা কি গত হয়েছেন?
জি না স্যার, পালিয়ে গেছে। দুর্বল পাতলা ছেলে দেশে মনের দুঃখে দেশান্তরী হয়েছে। ভূত-সমাজে এরকম ছেলে জন্মে দিলে মার অপমান। সবাই ছিঃ ছিঃ করে। এখন যদি স্যার আপনি আপনার চরণ কমলে অধীনের সন্তানকে ঠাঁই দেন–মনটা শান্ত হয়। আমি ছেলের মার সন্ধানে যেতে পারি। ছেলেকে নিয়ে আপনার কোনো চিন্তা করতে হবে না স্যার। ছেলে নম্র-ভদ্র। আপনার খাটের নিচে শুয়ে থাকবে। ছোটখাটো কাজকর্ম করে দেবে।
কি কাজকর্ম করে দেবে?
এই ধরুন এক গ্লাস পানি আনা, থালা-বাসন ধোয়া। ভারী কাজ পারবে না স্যার। শরীর দুর্বল।
শরীর দুর্বল হলো কেন?
খাওয়া-দাওয়া ঠিকমত করে না। না খেলে শরীরে বল হয়? স্যার আপনি বিচক্ষণ ব্যক্তি, আপনি বলুন। এই বিষয়ে আপনার চেয়ে বেশি কে জানে? এই যে রোজ বিকেলে দুচামচ করে ঘাসের চাটনি খাচ্ছেন, কি জন্যে খাচ্ছেন? শরীর ঠিক রাখার জন্যই তো খাচ্ছেন। জিনিসটা যে খেতে কি খারাপ সে তো খাবার সময় আপনার মুখ দেখেই বুঝতে পারি। ছেলেকে কত বার বলেছি এই লোকটাকে দেখে শেখ–স্বাস্থ্যের জন্য কত কষ্ট করতে হয়।
ইয়াকুব সাহেব ইতস্তত করে বললেন, ভূতদের খাদ্য কি?
আমাদের খাদ্য হলো স্যার-আলো। চাঁদের আলো। সূর্যের আলোও খাওয়া যায় তবে সহজে হজম হয় না। তারার আলো, মোমবাতির আলো–এইগুলো খুব ভালো। খেতে স্বাদ আছে। সহজে হজম হয়। বিশেষ করে মোমবাতির আলো তো খুবই উপকারী। তা স্যার মোমবাতির আলো তো আজকাল পাওয়াই যায় না। সব জায়গায় ইলেকট্রিক বাতি।
ইলেকট্রিক বাতির আলো খাওয়া যায় না?
আমরা খাই না। কেউ কেউ খায়। একেবারেই টেস্ট নেই। খেলে এল্যার্জির মতো হয়। হাত-পা ফুলে যায়। তবে স্যার জিনিসটার মধ্যে ভাইটামিন আছে।
ইয়াকুব সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, খাওয়া নিয়ে এত বাছবিচার করলে তো চলবে না। সব জিনিস খেতে হবে। এটা খাব ওটা খাব না করলে তো চলবে না।
এটা স্যার আপনি বুঝবেন। সন্তান আপনার হাতে তুলে দিয়েছে। যা করলে ভালো হয় করবেন। প্রয়োজনে শাসন করবেন। ওর স্বাস্থ্য ঠিক না হলে আমার আত্মহত্যা ছাড়া পথ থাকবে না। পানিতে ডুবে মরতে হবে। একজন ভূতের কাছে পানিতে ডুবে মৃত্যুর চেয়ে অপমানের মৃত্যু আর কিছুতেই হয় না।
ইয়াকুব সাহেব ভূতের কথায় খুব আনন্দ পেলেন। সন্তানের স্বাস্থ্য নিয়ে এই উদ্বেগ যদি মানুষদের মধ্যে থাকত তাহলে কত ভালো হতো। বাচ্চাদের পড়াশোনা নিয়ে বাবা মার যত চিন্তা তার একশ ভাগের এক ভাগ চিন্তাও স্বাস্থ্য নিয়ে নেই। ইংরেজি, অংকের জন্যে প্রাইভেট মাস্টার রাখে অথচ স্বাস্থ্যের জন্যে প্রাইভেট মাস্টার নেই। কি অন্যায়!
জনাব, যদি অনুমতি দেন তাহলে যাই।
যাবেন?
আমাকে তুমি করে বলবেন স্যার। আপনি বলে অধমকে লজ্জা দেবেন না।
ভূতের বিনয়ও তাঁর ভালো লাগল। বিনয় নামক ব্যাপারটা তো দেশ থেকে উঠেই যাচ্ছে। এটাও দুঃখের কথা। তবে পুরো ব্যাপারটা স্বপ্ন কিনা তাও তিনি ঠিক বুঝতে পারছেন না। স্বপ্ন হতে পারে, আবার উত্তেজিত মস্তিষ্কের কল্পনাও হতে পারে। ইয়াকুব সাহেব গলা খাকাড়ি দিয়ে বললেন, আচ্ছা, ছেলেকে রেখে যাও, দেখি কি করতে পারি।
স্যার, আপনার অসীম দয়া। মনে বড় শান্তি পেলাম। ছেলেটাকে আরও আগেই আপনার কাছে আনা উচিত ছিল। আগে আনলে স্বাস্থ্যটা ইতোমধ্যে অনেকখানি ভালো হতো। মানুষজনকে ভয় দেখাতে শুরু করতে পারত।
ইয়াকুব সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, ভয় দেখানো মানে?
ভূতের প্রধান কাজই তো ভয় দেখানো। আমরা করি কি স্যার সুযোগ পেলেই মানুষকে ভয় দেখাই। তা আমার ছেলে ভয় দেখাবে কি-সে নিজেই ভয়ে অস্থির। কি লজ্জার কথা ভেবে দেখুন। ভূতের ছেলে অথচ ভয় দেখাতে পারছে না। ঐদিন কি হলো শুনুন। রাত দশটার মতো বাজে। ঘুটঘুঁটে অন্ধকার টুপটাপ করে বৃষ্টি পড়ছে। আপনাদের স্কুলের হেডস্যার ছাতা মাথায় দিয়ে বাজারে যাচ্ছেন। আমি ছেলেকে বললাম, বাপধন, একটা কাজ কর তো, পেছন থেকে গিয়ে হেডস্যারের ছাতাটা টেনে ধর। দেখ, উনি কেমন ভয় পান। তা ছেলে এই কাজ করবে না। তার সাহস নেই। বুক নাকি ধড়ফড় করে। কি লজ্জার কথা! আমার ছেলের এই হল সাহসের নমুনা।
তোমার বুঝি খুব সাহস?
নিজের কথা নিজের মুখে বলা ঠিক না, আত্মপ্রশংসা হয়। তবে স্যার আপনাদের দশজনের দোয়ায় হাজার হাজার মানুষকে ভয় দেখিয়েছি। নীলগঞ্জ থানার ওসি সাহেবকে কি আপনার মনে আছে? ইয়া জোয়ান। ভূত-প্রেত কিছুই বিশ্বাস করেন না। অসীম সাহস। এমন ভয় দেখিয়েছি তাঁকে যে একেবারে হার্ট অ্যাটাকের মতো হয়ে গিয়েছিল। ঘটনাটা আপনাকে সংক্ষেপে বলি–ওসি সাহেব রাত একটার সময় দলবল নিয়ে আসামি ধরতে যাচ্ছেন, সাহসী লোক তো–আগে আগে যাচ্ছেন। আমি করলাম কি, ঠিক তার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললাম, কেমন আছেন ওসি সাহেব?
ওসি সাহেব চমকে উঠে বললেন, কে, কে? কে কথা বলল?
আমি তখন তার অন্য কানের কাছে মুখ নিয়ে ছোট বাচ্চাদের মতো আদুরে গলায় বললাম, এই খোকাবাবু গু খাবে?
ওসি সাহেব সঙ্গে সঙ্গে ফিট। সেটা একটা দেখার মতো দৃশ্য। হা হা হা। মনে হলেই আনন্দ হয়।
ইয়াকুব সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, কাজটা কি ঠিক হলো? এটা তো অদ্রতা। শুধু অদ্ৰতা না অসভ্যতাও। আমার কাছে থাকলে তো এসব চলবে না। আচার ব্যবহারও শিখতে হবে।
আপনি যা বলবেন তাই। আপনি দয়াপরবশ হয়ে আপনার চরণ কমলে আমার ছেলেটাকে আশ্রয় দিয়েছেন-এই যথেষ্ট। আপনার হাতে ছেড়ে দিয়েছি। এখন তাহলে স্যার যাই। যাবার আগে একটা কথা নিবেদন করতে চাই স্যার।
নিবেদন করো।
আমার সন্তানকে চরণে আশ্রয় দিয়েছেন এই জন্যে সামান্য উপহার দিতে চাই।
কি উপহার?
এক কলসি সোনার মোহর। বাদশাহ জাহাঙ্গীর আমলের। কলসিটা কোথায় তা আছে আপনাকে দেখিয়ে দেব, আপনি তুলে নেবেন।
এইসব লাগবে না। সামান্য কাজের জন্য আমি অর্থ গ্রহণ করি না।
আপনি এই কথা বলবেন আমি জানতাম। যাই স্যার।
আমগাছের ডালে একটা প্রবল ঝাঁকুনি হলো। তারপর চারদিকে নিঃশব্দ। ইয়াকুব সাহেব বললেন, কেউ আছে?
কোনো সাড়া পাওয়া গেল না।
এই যে ভূতের ছেলে, তুমি কি আছ? তোমার নাম তো জানা হলো না?
কোনো উত্তর নেই। তিনি নিশ্চিত হলেন যে এতক্ষণ যা ঘটেছে সবই কল্পনা। কল্পনা ছাড়া কিছুই না। মাথা গরম হয়েছিল তাই এইসব দেখেছেন।
তিনি ঘরে ঢুকে খেতে বসলেন। তখনই ঘটনাটা ঘটল। তিনি দেখলেন পানি ভর্তি একটা গ্লাস ভাসতে ভাসতে তার দিকে আসছে। তার থালার পাশে এসে গ্লাসটা আপনাআপনি থেমে গেল। সুন্দর করে বসে গেল থালার পাশে। ইয়াকুব সাহেবের গা খানিকটা কেঁপে উঠল। বুক ধকধক করতে লাগল। এই জাতীয় দৃশ্য আগে দেখেন নি। কখনো দেখবেন তাও ভাবেন নি। ভূতের বাচ্চাটা তাহলে যায় নি। আছে। ঘরেই আছে। তিনি চাপা গলায় বললেন, তুমি আছ?
হুঁ
হুঁ না, বলো জি। এটা হলো দ্রতা। দ্রতা শিখতে হবে। খাওয়া-দাওয়া হয়েছে?
না।
এ তো কোনো কাজের কথা না। এখনো জ্যোৎস্না আছে, যাও খেয়ে আসো।
ক্ষিদে নেই।
ক্ষিদে নেই বললে শুনব না। স্বাস্থ্য রক্ষার প্রধান নিয়ম হলো সময়মত খাওয়া দাওয়া করা। যাও বললাম, একটা মোড়া নিয়ে উঠানে গিয়ে বসো। আরাম করে চাঁদের আলো খাও। তোমাদের খাওয়ার নিয়ম-কানুন তো আমি ঠিক জানি না। চাঁদের আলো কেমন করে খাও? চিবিয়ে খাও না গিলে ফেলো?
সবাই চিবিয়ে খায়। আমি কুঁৎ করে গিলে ফেলি। ভালো লাগে না তো, এই জন্যে।
অসম্ভব, এখন থেকে গেলা চলবে না। একগাল করে চাঁদের আলো মুখে নেবে, বত্রিশ বার করে চিবুবে। এতে হজম ভালো হয়। বুঝলে?
হুঁ।
আবার হুঁ? বলো জি।
জি।
নাম কি তোমার?
ৎৎঘুঁৎ!
এই নাম তো উচ্চারণ করা সম্ভব না। তোমার নাম আমি দিলাম গোবর।
গোবর?
শুনেই আঁৎকে উঠলে। বিখ্যাত কুস্তিগীর গোবার পালোয়নের নামে তোমার নাম দিলাম। গোবার বাবু ১৯২০ সনে কুস্তিতে বিশ্বচ্যাম্পিয়ান হয়েছিলেন। বাঙালি ছেলে। ইংল্যান্ড, আমেরিকার সব বাঘা বাঘা কুস্তিগীরকে কুপোকাৎ করেছিলেন। তোমাকেও তাই হতে হবে। তুমি হবে ভূত-সমাজের গোবর বাবু। বুঝলে?
গোবর বাবু হতে চাই না।
চাইলেও হতে হবে। তোমাকে আমি গোবর বানিয়ে ছাড়ব। বুঝলে?
জি।
ব্যায়াম শুরু হবে কাল সকাল থেকে। চার্ট করে দেব। রুটিন দেখে দেখে ব্যায়াম হবে। খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারটা নিয়েও আমি চিন্তা করব। কোন খাবারটা তোমার সবচে প্রিয়?
জোনাকি পোকার আলো।
আচ্ছা, জোনাকি পোকা কয়েকটা ধরে আনার চেষ্টা করব। আর শোনো, খাটের নিচে শোয়ার দরকার নেই। আমার সঙ্গেই ঘুমুবে। খাট বড় আছে, অসুবিধা হবে না। তোমরা কি দাঁত মাজ?
অন্যরা মাজে। আমি মাজি না, ভালো লাগে না।
তোমাকে দাঁত মাজতে হবে। রাতে ঘুমুতে যাবার আগে একবার, ঘুম থেকে উঠার পর একবার।
জি আচ্ছা।
ইয়াকুব সাহেব রাতে ঘুমুতে গেলেন। ঘুম খুব ভালো হলো না। তার পাশে একটা ভূতের বাচ্চা শুয়ে আছে। তাকে দেখা যাচ্ছে না তবে সে যে আছে তা বোঝা যাচ্ছে। ভূতদের ব্যায়াম কিভাবে করতে হয় তিনি জানেন না। আস্তে আস্তে জানবেন। একটা বই লেখার চিন্তাও মাথায় ঘুরতে লাগল। বইটার নাম হবে–ভূতদের সহজ ব্যায়াম শিক্ষা।
স্কুল কমিটির বৈঠকে হেড স্যার খুব জোরালো বক্তব্য রাখলেন। বক্তব্যের বিষয়বস্তু হচ্ছে, একজন পাগল শিক্ষককে স্কুলে রাখার কোনো মানে হয় না। সে স্কুলের প্রতি হুমকি স্বরূপ। তাকে অবসর গ্রহণ করতে বাধ্য করা উচিত। ইত্যাদি।
স্কুলের সেক্রেটারি আজমল সাহেব বললেন, ইয়াকুব স্যারকে তো আমি চিনি। আমার শিক্ষক ছিলেন। অতি ভালো মানুষ। তাকে পাগল বলছেন কেন? কি পাগলামি উনি করেছেন?
উনি ঘাস খাচ্ছেন।
ঘাস খেতে যদি উনার ভালো লাগে, খাবেন। শাকসবজি আমরা খাই না? কাঁচা লেটুস পাতা খাই, কি-খাই না? উনি হয়তো খোঁজ পেয়েছেন যে ঘাসে কোন নতুন ভাইটামিন আছে যা অন্য কিছুতে নেই। এতে পাগলামির কি দেখলেন? তেমন কোনো ভিটামিনের সন্ধান পাওয়া গেলে আমার তো মনে হয় আমাদের সবারই ঘাস খাওয়া উচিত।
হেডস্যার বললেন, ঘাস খাওয়া ছাড়াও সারাক্ষণ ব্যায়াম ব্যায়াম করেন।
তা তো করবেনই। তিনি হচ্ছেন ব্যায়ামের শিক্ষক। উনি ব্যায়াম ব্যায়াম করবেন? যিনি অংকের শিক্ষক তিনি করবেন অংক অংক। যিনি গানের শিক্ষক তিনি গান নিয়ে মাতামাতি করবেন। এ ছাড়া উনি আর কি করেছেন যার থেকে আপনার ধারণা হয়েছে উনি পাগল?
এস. এস. সি. পরীক্ষার কোচিং হচ্ছিল, উনি বললেন ব্যায়ামেরও কোচিং দরকার।
আমার তো মনে হয় অতি উত্তম কথা বলেছেন। পড়াশোনার প্রচণ্ড চাপের মধ্যে শরীরটা ঠিক রাখতে হবে। রুগ্ণ শরীর পড়াশোনার চাপ সহ্য করতে পারবে না। আপনি উনাকে বলুন ব্যায়ামের কোচিং শুরু করতে।
হেড স্যার বিমর্ষ গলায় বললেন, জি আচ্ছা, বলব।
আর শুনুন, চট করে একজনকে পাগল বলবেন না। এটা ঠিক না।
হেডস্যার শুকনো মুখে বের হয়ে এলেন। তার মেজাজ খুব খারাপ। বাসায় ফিরছেন। বাসা অনেকখানি দূর। মাইল খানিকেরও বেশি। পোস্টাফিসের কাছে এসে থমকে দাঁড়ালেন। অন্ধকারে একটা লোক ঝোঁপের পাশে বসে আছে। হেডস্যার বললেন, কে ওখানে? কে?
স্যার আমি। আমি ইয়াকুব।
ওখানে কি করছেন?
জোনাকি পোকা ধরছি স্যার।
জোনাকি পোকা ধরছেন কেন?
ইয়াকুব সাহেব চুপ করে রইলেন। জবাব দিলেন না। খুকখুক করে দুবার কাশলেন।
কি ব্যাপার, জোনাকি পোকা কেন ধরছেন? খাবেন না-কি?
জি স্যার। তবে পোকা খাওয়া হবে না। পোকার আলো খাওয়া হবে।
কে খাবে, আপনি?
জি না, আমার এক ছাত্র।
ও আচ্ছা। আপনার ছাত্র? তা আলোটা কিভাবে খাবে?
গিলে ফেলা যায়, আবার চিবিয়েও খাওয়া যায়। আমি চিবিয়ে খেতে বলেছি। এতে হজমের সুবিধা। মুখে জারক রসের সঙ্গে আলোটা ভালো করে মিশতে পারে।
নাম কি আপনার ছাত্রের?
ওর নাম গোবর।
হেড স্যার বিস্মিত হয়ে বললেন, গোবর! বাপ-মা নাম রেখেছে গোবর?
জি না, বাপ-মা অন্য নাম রেখেছে। আমি নাম দিয়েছি গোবর।
ভালো করেছেন। খুব ভালো করেছেন। সুন্দর নাম। বিষ্টা হলে আরও ভালো হতো। তা গোবর নামও খারাপ না।
হেডস্যার আর দাঁড়ালেন না। একজন উন্মাদের সঙ্গে বেশি সময় থাকা ঠিক না। মাথার ঠিক নেই কখন কি করে বসবে। স্কুলের সেক্রেটারিকে এই ঘটনার কথা বলতে হবে। তারপরেও যদি উনি মনে করেন ইয়াকুব সাহেব মানসিকভাবে সুস্থ তাহলে ভিন্ন কথা। হেডস্যার আবার সেক্রেটারি সাহেবের বাসায় ফিরে গেলেন। দেরি করে লাভ নেই। আজই বলা যাক।
সেক্রেটারি সাহেব সব শুনে হাসতে হাসতে বললেন, ইয়াকুব সাহেব আপনার সঙ্গে ঠাট্টা করেছেন।
ঠাট্টা?
অবশ্যই ঠাট্টা। আপনি উনাকে পাগল ভাবেন, এই জন্যেই পাগলের মতো কথাবার্তা বলে উনি আপনাকে ভড়কে দিয়েছেন। জোনাকি পোকার আলো খাচ্ছে তার ছাত্র–এই সব তো ঠাট্টার কথা, এটও বুঝেন না? আমার কি মনে হয় জানেন? আমার মনে হয়, আপনি এক ধরনের স্নায়বিক উত্তেজনায় ভুগছেন। এই কথা বলায় কিছু মনে করবেন না।
জি না, কিছু মনে করছি না।
আপনি ইয়াকুব সাহেবকে খবর দিয়ে স্কুলে আনুন। উনাকে আগের মতো ক্লাস নিতে দিন। দেখবেন উনি আর ঠাট্টা-তামাশা করছেন না।
জি আচ্ছা।
হেডস্যার ইয়াকুব সাহেবকে খবর দিয়ে স্কুলে আনলেন। যথারীতি ক্লাস নিতে বললেন। একবার ভাবলেন জোনাকি পোকার আলো খাওয়ার ব্যাপারটা জিজ্ঞেস করবেন। শেষটায় বাদ দিলেন। দরকার কি ঝামেলায়। বরং দুএকটা সামাজিক দ্রতার কথা বলাই ভালো। হেডস্যার বললেন, ইয়াকুব সাহেব, আছেন কেমন?
জি ভালো আছি। তবে খুব ব্যস্ত।
ব্যস্ত কেন?
ছাত্র একটা আছে, ব্যায়াম শেখাচ্ছি।
কোন ছাত্র? গোবর যার নাম?
জি। একটা বইও লিখছি।
ব্যায়ামের বই?
বইয়ের কি নাম?
ভূতদের সহজ ব্যায়াম শিক্ষা।
কি বললেন–ভূতদের সহজ ব্যায়াম শিক্ষা?
জি। আমাদের জীবনে যেমন ব্যায়ামের প্রয়োজন আছে, ভূতদেরও আছে।
তা তো বটেই। আপনার ধারণা-এই বই পড়ে ভূতরা সব ব্যায়াম শিখবে?
তা শিখবে। ওদের শেখার আগ্রহ খুব বেশি।
হেডস্যার অস্বস্তিবোধ করতে লাগলেন। একজন বৃদ্ধ উন্মাদের সঙ্গে বেশিক্ষণ কথা বলা উচিত না। কি থেকে কি হয়ে যায় কে জানে। হঠাৎ খ্যাক করে কামড়ে ধরতে পারে। এদের কাছ থেকে যতটা দূরে থাকা যায় ততই ভালো।
.
গোবরের ব্যায়াম শিক্ষা পুরোদমে চলছে। ফ্রি হ্যাঁন্ড এক্সারসাইজ, যোগ ব্যায়ম কোনোটাই বাদ যাচ্ছে না। ইয়াকুব সাহেব ঘরে রিং টানিয়ে দিয়েছেন। রিং-এর খেলাও হয়। জানা গেছে গোবর লম্বায় একটু খাটো। রিং টানাটানিতে যদি খানিকটা লম্বা হয়।
খাওয়া-দাওয়ার দিকে তিনি খুব লক্ষ রাখছেন। নানান ধরনের আলোর ব্যবস্থা করেছেন–মোমবাতির আলো, ঘিয়ের প্রদীপের আলো, তিসির তেলের আলো, জোনাকির আলো। টর্চ লাইটের আলো আছে। তবে এই আলো গোবরের সহ্য হয় না। খাওয়া মাত্র বমি হয়ে যায়।
গোবরের স্বাস্থ্য কতটা ভালো হয়েছে বোঝা যাচ্ছে না। ওজন বাড়ল কি-না ধরতে পারছেন না, কারণ ভূতদের ওজন নেই। হাত-পা মোটা মোটা হলো কি-না তাও বোঝা যাচ্ছে না। কারণ ভূতদের দেখা যায় না।
একদিন সন্ধ্যার কথা। ইয়াকুব সাহেব ভূতদের সহজ ব্যায়াম শিক্ষা বইটার সেকেন্ড ট্যাপ্টার লিখছেন–গোবর এসে তার পা ছুঁয়ে সালাম করে দাঁড়াল। তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, কি ব্যাপার?
গোবার ফিসফিস করে বলল, আমার স্বাস্থ্য ভালো হয়েছে স্যার।
ইয়াকুব সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, স্বাস্থ্য ভালো হয়েছে কি করে বুঝলে?
গোবর ক্ষীণ স্বরে বলল, এখন মানুষকে ভয় দেখাতে পারি।
সে কি! কাকে ভয় দেখালে?
হেডস্যারকে।
ইয়াকুব সাহেব মহাবিরক্ত হয়ে বললেন, তাকে কিভাবে ভয় দেখিয়েছ?
গোবর মিনমিন করে বলল, তাকে একটা সুপারি গাছের মাথায় বসিয়ে রেখেছি। গাছে বসে তিনি চিৎকার করছেন।
ইয়াকুব সাহেব স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। থমথমে গলায় বললেন, কখন করলে এই কাজ?
কিছুক্ষণ আগে।
আর কখনো এই কাজ করবে না। কখনো না। হেড মাস্টার সাহেব বিশিষ্ট ভ ভদ্রলোক। স্কুলঅন্তপ্রাণ। তাকে ভয় দেখানো অমার্জনীয় অপরাধ হয়েছে। আমি খুব রাগ করেছি। সেই সঙ্গে ব্যথিত হয়েছি।
গোবর কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, মানুষদের ভয় দেখাতেই হয়। এটা ভূতদের নিয়ম।
ভয় যদি দেখাতেই হয় দুষ্টু লোকদের ভয় দেখাবে। ধরো, ডাকাত এসেছে গ্রামে, ডাকাতদের ভয় দেখাও। চোর এসেছে, চোরদের ভয় দেখাও। দেশে দুষ্ট মানুষের তো অভাব নেই।
আর করব না স্যার।
শুধু স্বাস্থ্য ভালো করলে তো চলবে না। স্বাস্থ্যের সঙ্গে ন্যায়-নীতি শিখতে হবে। আদব-কায়দা শিখতে হবে। আমি তো ঠিক করেছি হেডস্যারকে বলে তোমাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেব। আজ যা কাণ্ড করেছ তাতে হেডস্যার রাজি হবেন কিনা কে জানে। দুষ্টু ছাত্ৰ হেডস্যারের চোখের বিষ। তোমাকে ক্ষমা চাইতে হবে, বুঝলে?
জি স্যার, বুঝেছি।
কোন্ গাছে হেডস্যারকে বসিয়ে রেখেছে? চলো যাই উনাকে নামিয়ে নিয়ে আসি। একা একা নামতে পারবে না। সুপারি গাছ থেকে নামা কঠিন ব্যাপার।
স্কুল সেক্রেটারির বাসার ঠিক সামনের সুপারি গাছের মাথায় হেডস্যার বসে আছেন। কিছুক্ষণ পরপর চিৎকার করছেন–বাঁচাও, বাঁচাও।
সেক্রেটারি সাহেব দৌড়ে বাড়ি থেকে বের হলেন। অবাক হয়ে বললেন, গাছে কে?
আমি নীলগঞ্জ হাইস্কুলের হেডমাস্টার।
গাছে বসে কি করছেন?
কিছু করছি না, শুধু বসে আছি।
গাছে উঠলেন কিভাবে?
জানি না।
জানি না মানে?
গাছে উঠেছেন, তারপর বলছেন জানেন না কিভাবে উঠেছেন?
রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ দেখি গাছে বসে আছি।
নেমে আসুন। আপনার সঙ্গে আমার কথা আছে।
নামতে পারছি না। কি করে নামতে হয় জানি না।
আপনার যে মস্তিষ্কবিকৃতি ঘটেছে বুঝতে পারছেন?
পারছি।
আপনি শিক্ষক হিসেবে খুবই ভালো। কিন্তু বুঝতেই তো পারছেন বিকৃতমস্তিষ্ক শিক্ষক রাখা সম্ভব না।
বুঝতে পারছি। আমি রেজিগনেশন লেটার দিয়ে কাল সকালে দেশে চলে যাব। দয়া করে আমাকে গাছ থেকে নামানোর ব্যবস্থা করুন।
কথাবার্তার এই পর্যায়ে ইয়াকুব সাহেব এসে পড়লেন।
ততক্ষণে আরও বহু লোক জড়ো হয়েছে। স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা চলে এসেছে।
বেজায় হৈচৈ।
ইয়াকুব সাহেব বললেন, আমার ছাত্র গোবরের কারণে এই লজ্জাজনক ঘটনা ঘটেছে। সে তার জন্যে সকলের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। এক্ষুনি সে হেডস্যারকে গাছ থেকে নামাবে।
সবাই হতভম্ব হয়ে দেখল হেডস্যার পাখির পালকের মতো খুব ধীরে ভাসতে ভাসতে নিচে নেমে আসছেন। সেক্রেটারি সাহেব এই দৃশ্য সহ্য করতে পারলেন না। মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন।
এমন অস্বাভাবিক ঘটনা কিভাবে ঘটছে কেউ কিছু বুঝতে পারল না। ব্যাপারটা বুঝতে ইয়াকুব সাহেবের সপ্তাহখানেক সময় লাগল। একটা ভূতের বাচ্চা তার সঙ্গে বাস করছে এবং ব্যায়াম শিখছে এটা চট করে বিশ্বাস করার কথাও না আবার কাণ্ডকারখানা চোখের সামনে ঘটতে দেখা যাচ্ছে। শুরুতে গোবরকে সবাই ভয়ে ভয়ে দেখত-শেষে অভ্যস্ত হয়ে গেল। এক রবিবার সকালে ইয়াকুব সাহেব তাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন।
পড়াশোনায় গোবর তেমন ভাল ছিল না, তবে ম্যাট্রিক এক চান্সেই পাস করল। যদিও পরীক্ষার সময় বেশ সমস্যা হয়েছিল। ইনভিজিলেটর এসে দেখেন একজন পরীক্ষার্থীর খাতায় আপনা-আপনি কলম দিয়ে লেখা হচ্ছে কিন্তু কাউকে দেখা যাচ্ছে না। তিনি কিছুক্ষণ দৃশ্যটি দেখলেন, তার পরেই মাথা ঘুরে নিচে পড়ে গেলেন। মাথায় পানি ঢেলে তাকে সুস্থ করা হলো। ধারণা করা হয়েছিল বিষয়টা নিয়ে তিনি খুব হৈচৈ করবেন। তা করলেন না। কোনো প্রশ্নও করলেন না।
গোবরের খুব শখ ছিল কলেজে পড়বে। হেডমাস্টার সাহেব চেষ্টাও করেছিলেন। নিজে সঙ্গে গিয়ে অনেক কলেজে যোরাঘুরি করেছেন। সব কলেজের প্রিন্সিপালরা যেই শুনেছেন তিনি একটা ভূতকে কলেজে ভর্তি করাতে চান ওমি হেডমাস্টার সাহেবকে বের করে দিয়েছেন। তাঁর কোনো কথাই শুনতে চান নি। গোবর মনে খুব কষ্ট পেল। মনের কষ্ট আরও বাড়ল যখন ইয়াকুব সাহেব মারা গেলেন। তিনদিনের জ্বরে হঠাৎ মৃত্যু। চিকিৎসা করার সুযোগও ছিল না। ইয়াকুব সাহেবের মৃত্যুর পর গোবর বেচারা নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ল। দিনরাত আমগাছে পা ঝুলিয়ে বসে থাকত। তার বাবা-মার সঙ্গেও গোবরের বনে নি। তারা ফিরে এসেছিলেন–গোবরের ম্যাট্রিক পাস করা নিয়ে অসম্ভব বিরক্ত হলেন। তুই ভূত সমাজের কলংক-এই বলে তারা অনেক দূরে কোথাও চলে গেলেন।
নীলগঞ্জের মানুষজন গোবরের কারণে খুব সুখে দিন কাটাত। চোর-ডাকাতের কোনো উপদ্রব ছিল না। নীলগঞ্জ থানার বড় দারোগা সাহেবের কাজের অভাবে কোমরে বাত হয়ে গেল। একবার চেয়ারে বসলে উঠতে পারেন না। উঠলে বসতে পারেন না এমন অবস্থা। চোর-ডাকাত ভুলেও নীলগঞ্জে আসে না। হঠাৎ একজন মনের ভুলে চলে সে। গোবর তখন তাকে ধরে খুব উঁচু কোনো সুপারি গাছে বসিয়ে ওসি সাহেবকে খবর দেয়। ওসি সাহেব বিরস মুখে বলেন, কে, গোবর?
জি।
আবার ধরেছিস?
জি।
সুপারি গাছের মাথায় রেখে দিয়েছিস?
জি।
এই কাণ্ডটা তুই কেন করিস বল তো? বর্ষার দিন, স্লিপ কেটে যদি সুপারি গাছ থেকে পড়ে কোমর ভাঙে তাহলে তো তুই বিপদে পড়বি। তিনশ দুই ধারায় কেইস হয়ে যাবে। তোকে কোমরে দড়ি বেঁধে কোর্টে চালান করতে হবে। আইনের চোখে ভূত-প্রেত সব সমান বুঝলি?
আর করব না স্যার।
ওসি সাহেব মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলেন, তুই বড় যন্ত্রণা করিস। তোকে স্নেহ করি বলে কিছু বলি না। এখন না বলে পারছি না। সাবধান হয়ে যা।
.
গোবর এখনো বেঁচে আছে। তবে বুড়ো হয়ে গেছে। আগের মতো শক্তি-সামর্থ্য নেই। আমগাছে বসে দিনরাত ঝিমায়। মাঝেমাঝে আফসোসের সঙ্গে বলে–এই যুগের পড়াশোনার মান খুব নিচে নেমে গেছে। সামান্য সমাস তাও পারে না। রসগোল্লার ব্যাসবাক্য কি–রসের গোল্লা না রসে ডুবানো গোল্লা তাও জানে না। বড়ই পরিতাপের বিষয়। বড়ই আফসোস। সামান্য একটা দরখাস্ত সেটাও ইংরেজিতে লিখতে পারে না। আফসোস। বড়ই আফসোস।
আমের সময় ছোট ছোট বাচ্চারা গাছের নিচে ভিড় করে। তারা খুব ঘ্যানঘ্যান করে–গোবর চাচা, গোবর চাচা, আম পেড়ে দাও না।
গোবর প্রচণ্ড ধমক দেয়–ভাগ, ঘুমের সময় বিরক্ত করিস না। মারব থাপ্পড়।
বাচ্চারা তারপরেও বিরক্ত করে, তারা জানে গোবর চাচা কখনো তাদের থাপ্পড় মারবে না। এক সময় আম পেড়ে দেবে। কারণ গোবর চাচা তো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভূত।