ছায়াসঙ্গী-পর্ব-(৭)-হুমায়ুন আহমেদ

ছায়াসঙ্গী-

‘আপনি এই দৃশ্যটি দেখলেন, তারপর কী করলেন ? ‘আপনি হলে কী করতেন?…..‘আমি হলে কী করতাম সেটা বাদ দিন। আপনি কী করেছেন সেটা বলুন। ‘দাঁড়ান, আরাে খানিকটা অ্যালকোহল গলায় ঢেলে নিই। তা না হলে বলতে পারব না। 

ভদ্রলােক ঢকঢক করে অনেকখানি কাঁচা-হুইসকি গলায় ঢেলে দিলেন। দেখতে দেখতে তাঁর চোখ রক্তবর্ণ হয়ে গেল। তিনি স্থির গলায় বললেন আমি সেদিন যা করেছিলাম একজন বুদ্ধিমান যুক্তিবাদী মানুষ তা-ই করবে– আমি ছুটে গিয়েছিলাম সেখানে। প্রচণ্ড ভয়াবহ কোনাে ঘটনার মুখােমুখি এসে দাঁড়ালে মানুষের ভয় থাকে না। একজাতীয় এনজাইম শরীরে চলে আসে। তখন প্রচুর গুকোজ ভাঙতে শুরু করে। মানুষ শারীরিক শক্তি পায়। ভয় কেটে যায়। 

‘আমার কোনাে ভয় ছিল না। আমি দ্রুত গেলাম ঐ জায়গায়। কাদায় পানিতে মাখামাখি হয়ে গেলাম। ………‘তারপর কী দেখলেন ?’ 

কী আর দেখব ? কিছুই দেখলাম না। আপনি কি ভেবেছেন গিয়ে দেখব ইয়াকুব তার স্ত্রীর ডেডবডি নিয়ে বসে আছে ? ………….না, তা ভাবিনি।’ 

ছায়াসঙ্গী-পর্ব-(৭)-হুমায়ুন আহমেদ

‘নেচার বলুন বা ঈশ্বর বলুন বা প্রকৃতি বলুন-এরা কোননারকম অস্বাভাবিকতা সহ্য করে না, এই জিনিসটি খেয়াল রাখবেন । কাজেই আমি কিছুই দেখলাম না। বৃষ্টিতে ভিজলাম, কাদায় মাখামাখি হলাম। আমার জিদ চেপে গেল। পাশের বাগানের মালীকে ডেকে এনে সেই রাতেই জায়গাটা খুঁড়লাম। কিছুই পাওয়া গেল না। 

পরদিন থানায় খবর দিলাম । পুলিশের সাহায্যে আবারও খোঁড়াখুঁড়ি করা হলাে । কিছুই পাওয়া গেল না। সবার ধারণা হলাে আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে । আমার বাবা খবর পেয়ে আমাকে এসে নিয়ে গেলেন। দীর্ঘদিন ডাক্তারের চিকিৎসায় থেকে সুস্থ হলাম। শুনে অবাক হবেন, এই ঘটনার পর মাসখানেক আমি ঘুমুতে পারতাম না।’ 

‘গল্পটা কি এখানেই শেষ, না আরাে কিছু বলবেন ? …….না আর কিছু বলব না। ভাই আগেই তাে বলেছি এটা কোনাে ভৌতিক গল্প না । ভৌতিক গল্প হলে দেখা যেত ইয়াকুব বউটাকে মেরে ঐখানে কবর দিয়ে রেখেছিল। ভৌতিক গল্প না বলেই ঐটা সত্যি হয়নি। তবে ঐ বাড়ি আমি কিনে নিয়েছি। বর্ষার সময় প্রায়ই ঐখানে একা একা রাত্রিযাপন করি।

আমার দৃঢ় বিশ্বাস ঐ রাতে ঘটনার অংশবিশেষ আমি দেখেছিলাম। নিজের ওপর কনট্রোল হারিয়ে ফেলেছিলাম বলে বাকিটা দেখতে পারিনি। কোনাে একদিন বাকিটা হয়তাে দেখব। ইচ্ছা করলে আপনিও আমার সঙ্গে যেতে পারেন। আপনি কি যাবেন ? | ‘না আমার ভূত দেখার কোনাে ইচ্ছা নেই আপনার ঐ মালী, ইয়াকুব কী যেন নাম বললেন ও কি এখনও ঐ বাড়িতে আছে ?

ছায়াসঙ্গী-পর্ব-(৭)-হুমায়ুন আহমেদ 

‘হা আছে। ‘সে আপনার ঘটনা শুনে কী বলে? ………‘এটাও একটা মজার ব্যাপার। সে কিছুই বলে না। হঁাও বলে না, নাও বলে না। চুপ করে থাকে। ভালাে কথা এতক্ষণ যে আমাদের ড্রিংকস দিয়ে গেল, কাজু বাদাম দিয়ে গেল তার নামই ইয়াকুব। তাকে আমি সবসময় কাছাকাছি রাখি। আপনি কি তার সঙ্গে কথা বলবেন ? ইয়াকুব, এই ইয়াকুব…।। 

প্রায় আট বছর পর নাসরিনের বড় ভাই আলাউদ্দিন দেশে ফিরল। সঙ্গে বিদেশি বউ। বউয়ের নাম ক্লারা। বউয়ের চুল সােনালি, চোখ ঘন নীল, ………..মুখটাও মায়া-মায়া । তবু মেয়েটাকে কারােই পছন্দ হলাে না। 

যে-পরিমাণ আগ্রহ নিয়ে নাসরিন বড় ভাইয়ের জন্যে অপেক্ষা করছিল, ভাইকে দেখে সে ঠিক ততখানি নিরাশ হলাে। আট বছর আগে নাসরিনের বয়স ছিল নয়, এখন সতেরাে। ন’বছর বয়েসী চোখ এবং সতেরাে বছর বয়েসী চোখ একরকম নয়। নবছর বয়েসী চোখ সবকিছুই কৌতুহল এবং মমতা দিয়ে দেখে। সতেরাে বছরের চোখ বিচার করতে চেষ্টা করে। তার বিচারে ভাই এবং ভাইয়ের বউ দুজনকেই খারাপ লাগছে । 

নাসরিন দেখল তার ভাই আগের মতাে চুপচাপ শান্ত ধরনের ছেলে নয় খুব হইচই করা শিখেছে। স্ত্রীকে নিয়ে সবার সামনে বেশ আহ্লাদ করছে। ঠোট গােল করে ‘হানি’ ডাকছে। অথচ ‘হানি’ শব্দটা বলার সময় ঠোট গােল হয় না । 

ছায়াসঙ্গী-পর্ব-(৭)-হুমায়ুন আহমেদ

আলাউদ্দিন এতদিন পর দেশে আসছে, আত্মীয়-স্বজনদের জন্যে উপহার-টুপহার আনা উচিত ছিল, তেমন কিছুই আনেনি। ভুসভুসা অ্যাশ কালারের একটা সােয়েটার এনেছে মার জন্যে। সেই সােয়েটার নিয়ে কতরকম আদিখ্যেতা– পিওর উল মা। পিওর উল আজকাল আমেরিকাতেও এক্সপেনসিভ। মা তােমার কি কালার পছন্দ হয়েছে ? 

নাসরিনের একবার বলার ইচ্ছা হলাে— অ্যাশ কালারের পছন্দের কী আছে ভাইয়া ? ….সে অবিশ্যি কিছু বলল না। তার মনটাই খারাপ হয়ে গেল। এতদিন পর আসছে। ভাইয়ার কি উচিত ছিল না মা’র জন্যে একটা ভালাে কিছু আনা ? ……….বাবার জন্যে এনেছে ক্যালকুলেটর । যে-বাবা রিটায়ার করেছে, চোখে দেখতে পায় না, সে ক্যালকুলেটর দিয়ে কী করবে ? 

নাসরিনের বড় বােন শারমিন তার দুই যমজ মেয়েকে নিয়ে সুটকেস খােলার সময় বসে ছিল । এই দু-মেয়েকে আলাউদ্দিন দেখেনি। চিঠি লিখে জানিয়েছে এই দু-মেয়ের জন্যে একই রকম দুটো জিনিস নিয়ে আসবে যা দেখে দুজনই মুগ্ধ হবে । দুজনের জন্যে দুটো গায়েমাখা সাবান বেরুল। এই সাবান ঢাকার নিউ মার্কেট রতি, আমেরিকা থেকে বয়ে আনতে হয় না । 

ছায়াসঙ্গী-পর্ব-(৭)-হুমায়ুন আহমেদ

আলাউদ্দিন বলল, বেশি কিছু আনতে পারিনি বুঝলি। লাস্ট মােমেন্টে ক্লারা ডিসাইড করল আমার সঙ্গে আসবে । অনেকগুলি টাকা বেরিয়ে গেল । কিছু টাকা সঙ্গেও রাখতে হয়েছে। ঢাকায় হােটেলের বিল কেমন কে জানে! ………………………………………..নাসরিন বলল, হােটেলের বিল মানে? তুমি কি হােটেলে উঠবে ? 

বাধ্য হয়ে উঠতে হবে। এই গাদাগাদি ভিড়ে ক্লারার দম বন্ধ হয়ে আসছে । চট করে তাে সব অভ্যাস হয় না। আস্তে আস্তে হয়। তােরা আবার এটাকে কোন ইস্যু বানিয়ে বসবি না। তােদের কাজই তাে হচ্ছে সামান্য ব্যাপারটাকে কোনােমতে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে ইস্যুতে নিয়ে যাওয়া। 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *